হয়তো ব্যাপারটা জানতে পেরে ভয়ে নাভাস হয়ে পালিয়েছে।
সুবীর মৃদু হাসল, ভুলে যেও না সুবিনয়, বেটা এককালে মিলিটারিতে চাকরি করত।
কিন্তু ও তো মামার কাছে অনেকদিন থেকেই আছে।
হুঁ, মেয়েমানুষের ব্যাপারে বিশ্বাস! দুনিয়াটা অত সহজ রাস্তায় চলে না হে সুবিনয়। অত্যন্ত জটিল। আমি তোমাকে বলে রাখছি, ঐ রুক্মিণী ছুঁড়ীকে নিয়েই ব্যাপারটা ঘটেছে। তা গতরাত্রে মিস শমিতা সান্যাল আসেনি?
শুনলাম তো এসেছিলেন কাল রাত্রে—
কে বললে?
রামদেওই বলছিল।
ঐ মিস শমিতা সান্যালটি আর একটি চিজ!
.
আধঘণ্টার মধ্যে থানা অফিসার অরূপ মুখার্জী এসে গেলেন। অরূপ মুখার্জী একেবারে ইয়ং নয়–বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি, লম্বাচওড়া চেহারা। সঙ্গে জনাচারেক সিপাইও আছে।
পুলিসের জিপের আওয়াজ পেয়েই সুবীর সুবিনয়কে নিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল।
অরূপ মুখার্জী জিজ্ঞাসা করলেন, থানায় ফোন করেছিলেন কে?
সুবীর বললে, আমি স্যার।
আপনি?
আমি এই বাড়িতেই থাকি, আমার কাকা এক্স-মিলিটারি অফিসার কর্ণেল গগনবিহারী চৌধুরী খুন হয়েছেন।
কি করে খুন হল?
খুব সম্ভব স্ট্যান্ড্র টু ডেথ!
ডেড বডি কোথায়?
দোতলায়।
চলুন।
ঐ সময় হঠাৎ দূরে কোথা থেকে ক্ষীণ একটা কুকুরের ডাক যেন কানে এল সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে থানা-অফিসার অরূপ মুখার্জীর।
ডাকটা সুবীর ও সুবিনয়ের কানেও এসেছিল।
অরূপ মুখার্জী বললেন, একটা কুকুরের ডাক শুনছি যেন! এ বাড়িতে কোন কুকুর আছে নাকি?
সুবিনয় বলে, হ্যাঁ স্যার, একটা আলসেসিয়ান কুকুর আছে।
কুকুরটা কার সুবিনয়বাবু?
মামার পোষা কুকুর।
মানে যিনি খুন হয়েছেন?
হ্যাঁ।
আশ্চর্য! এ বাড়িতে একটা কুকুর ছিল তাহলে? তা কোথায় কুকুরটা?
সুবিনয় বললে, তাই তো, কুকুরটা কোথায়?
সুবিনয় ও সুবীর তখন দুজনেই জ্যাকির নাম ধরে ডাকতে শুরু করে, জ্যাকি জ্যাকি!
কিন্তু জ্যাকি আসে না। জ্যাকির দেখা পাওয়া যায় না।
সুবীর বলে, আশ্চর্য, সত্যিই এতক্ষণ আমাদের একবারও জ্যাকির কথা মনে পড়েনি। জ্যাকি কোথায় গেল?
একটা বাঘের মত কুকুর।
জ্যাকির ডাক আবারও শোনা গেল।
ওরা সকলে সিঁড়ি থেকে নেমে এল। একতলাটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির পিছনে মালীর জন্য যে ঘর তৈরি করা হয়েছিল, অথচ কোন মালী না থাকায় এতদিন যে ঘরটা খালি পড়েছিল সেখানে সকলে এসে দাঁড়াল।
বাড়ির পিছনে যে জায়গাটা খালি পড়েছিল সেখানেই ছিল ঘরটা। ঘরটার মধ্যে বাড়ি তৈরির সব জিনিসপত্র, কোদাল, শাবল, চুপড়ি, বালতি, লোহার রড, বাঁশ, দড়ি তূপীকৃত করা ছিল এবং বাইরে থেকে তালা লাগানো ছিল। দেখা গেল সেই ঘরের তালা নেই, একটা দড়ির সাহায্যে কড়া দুটো দরজায় শক্ত করে বাঁধা আর সেই ঘরের ভিতর থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে, দরজার গায়ে নখের আঁচড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ডাকটা এবারে বেশ স্পষ্ট।
অরূপ মুখাজী থমকে দাঁড়ালেন দরজার সামনে এসে।
কুকুরটা আপনাদের চেনে তো! সুবীর ও সুবিনয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, স্যার। সুবীর বললে।
তাহলে আপনারাই কেউ দরজাটা খুলুন তো!
সুবীরই এগিয়ে গিয়ে দরজাটার দড়ি খুলে দিল। ঘরটা অন্ধকার, একটা বিশ্রী ভ্যাপসা গন্ধ দরজাটা খুলতেই ওদের নাকে এসে যেন ঝাপটা দেয়।
জ্যাকি ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বের হয়ে এল দরজাটা খুলে দিতেই। কিন্তু তার তেজ ও গতির ক্ষিপ্রতা যেন নেই আর।
কেমন যেন একটা মিয়ানো ভাব।
কুকুরটা কিন্তু ওদের দিকে তাকালও না, একবার অরূপ মুখার্জীর সামনে এসে ওর গন্ধ শুঁকে সোজা ভিতরের দিকে চলে গেল।
সকলে ওরা অনুসরণ করে জ্যাকিকে।
জ্যাকি আগে চলেছে, ওরা তিনজন পিছনে পিছনে।
জ্যাকি ভিতরে ঢুকে সোজা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যেতে থাকে। পিছনে পিছনে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে ওরা তিনজন।
জ্যাকি এসে একেবারে খোলা দরজাপথে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গগনবিহারীর শয়নঘরে প্রবেশ করল, ওরাও ঘরে গিয়ে ঢুকল।
জ্যাকি ঘরে ঢুকে সোজা গিয়ে ভূপতিত গগনবিহারীর মৃতদেহটার সামনে দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক শুঁকলো দেহটা, তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মৃতদেহের কাছেই একেবারে।
তারপরই হঠাৎ মুখ তুলে জ্যাকি কয়েকবার ডাকল। ডাকল ক্ষীণ, ক্লান্ত কিন্তু দীঘায়ত। মনে মনে যেন প্রভুর মৃত্যুতে কাঁদছে।
আশ্চর্য, জ্যাকির চোখে সত্যিই জল! সত্যিই জ্যাকি কাঁদছে।
তিনজনেই সেই করুণ দৃশ্য দেখে একেবারে নির্বাক। বোবা যেন!
০৪. যোগজীবন যখন ফোনটা পেলেন
যোগজীবন যখন ফোনটা পেলেন সে সময় তিনি একা ছিলেন না। ঘরের মধ্যে দুজন ছিলেন। তিনি আর কিরীটী।
যোগজীবনের খুব ভোরে ওঠা অভ্যাস বরাবরই, লেকের কাছাকাছি বাড়ি তৈরি করার পর থেকে প্রত্যহ খুব ভোরে রাত থাকতে উঠে বেড়াতে চলে যেতেন লেকে।
সারাটা লেক হেঁটে চক্কর দিতেন এবং সূর্যোদয়ের আগেই ফিরে আসতেন আবার। কি গ্রীষ্ম, কি শীত কখনও বড় একটা তাঁর ঐ রুটিনের ব্যতিক্রম হত না।
কিরীটীও তার নতুন বাড়ি গড়িয়াহাটায় চলে আসবার পর খুব ভোরে উঠে লেকে বেড়াতে যেতে শুরু করেছিল।
সেইখানেই অনেকের সঙ্গে আলাপ।
যোগেশবাবু, ধীরেনবাবু, মাস্টারমশাই প্রমোদবাবু, ফণীবাবু, দীনেশবাবু ও যোগজীবন— সবারই রিটায়ার্ড লাইফ।
অবসর জীবন যাপন করছেন। যোগজীবনের সঙ্গেই কিরীটীর একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা জমে ওঠে। মধ্যে মধ্যে যোগজীবন আসতেন কিরীটীর গৃহে, কিরীটীও যেত যোগজীবনের গৃহে। কিরীটীর মাথায় আবার নানা ধরনের ফুলের গাছের শখ চেপেছিল, যোগজীবনেরও ফুলগাছের শখ। যোগজীবন প্রায়ই গাড়ি নিয়ে এদিক-ওদিক কলকাতার বাইরে সব নারীতে যেতেন ফুলগাছের সন্ধানে।