সিঁড়ির নীচে বাহাদুর বসে থাকে। সুবিনয় ও সুবীরের সঙ্গে জ্যাকির বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে।
আরও তিন মাস পরে হঠাৎ আর একজনের আবির্ভাব ঘটল ঐ বাড়িতে। রামদেওর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী রুক্মিণী।
রুক্মিণীর বয়স সতের কি আঠার। সবে যৌবনে পা দিয়েছে। যৌবন যেন টলমল করছে রুক্মিণীর সারা দেহে। দেহাতী গাঁয়ের মেয়ে হলে কি হবে রুক্মিণী রীতিমত চটুল। লাজলজ্জার তেমন বালাই নেই। সারা বাড়ি সে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়।
সন্ধ্যায় সাজগোজ করে, খোঁপায় ফুল গোঁজে। গুনগুন করে গান গায়। রুক্মিণীর স্থান হল উপরেই রামদেওর ঘরে।
রুক্মিণী ঐ গৃহে আসবার দিন কুড়ি-বাইশ বাদেই আকস্মিক ঘটনাটা ঘটল।
একদিন প্রত্যুষে—
হঠাৎ বাহাদুরের চেঁচামেচিতে সুবিনয়ের ঘুমটা ভেঙে গেল।
সুবীর গতরাত্রে গৃহেই ফেরেনি। সুবিনয়কে সে বলেই গিয়েছিল, রাত্রে হয়তো ফিরবে না–কোথায় এক বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে যাবে।
সুবিনয় বাহাদুরের চেঁচামেচিতে চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি রে, ব্যাপার কি?
সাব—
বাহাদুর আর বলতে পারে না। গলা আটকে যায়।
কি হয়েছে সাহেবের?
সাব খতম হো গিয়া—
খতম হো গিয়া! সে কি রে!
হাঁ। চলিয়ে—উপরমে চলিয়ে—
ত্বরিত স্খলিত পদে সুবিনয় উপরে উঠে গেল।
গগনবিহারী আসবার পর থেকে আর সে উপরে ওঠেনি। প্রয়োজনও হয়নি তার।
গগনবিহারীর শয়নকক্ষে ঢুকে থমকে দাঁড়াল সুবিনয়।
ঘরের মেঝেতে গগনবিহারীর মৃতদেহটা পড়ে আছে। পিঠে একটা ছোরা বসানো আমূল—চাপ চাপ রক্ত চারদিকে জমাট বেঁধে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে ও চোখ বোজে।
০৩. প্রায় মিনিট দশ-পনেরো লাগে
প্রায় মিনিট দশ-পনেরো লাগে সুবিনয়ের নিজেকে সামলে নিতে।
ধীরে ধীরে একসময় নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সুবিনয়। আবার মেঝের দিকে তাকায়, পরনে গগনবিহারীর পায়জামা ও ড্রেসিংগাউন।
খালি পা। পায়ের চপ্পল জোড়ার একটা খাটের সামনে পড়ে আছে, অন্যটা মৃতদেহের পায়ের অল্প দূরে।
উপুড় হয়ে পড়ে আছেন গগনবিহারী। একটা হাত ছড়ানো, অন্য হাতটা দেহের নীচে। ঘরের মধ্যে সেন্ট্রাল টেবিলটা উল্টে পড়ে আছে। একটা অর্ধসমাপ্ত হোয়াইট হর্সের বোতল, একটা ভাঙা কাচের গ্লাস, গোটা-দুই সোডার বোতলও মেঝের মধ্যে পড়ে আছে।
সুবিনয় ভেবে ঠিক করতে পারে না অতঃপর তার কি কর্তব্য। সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
বাহাদুর পাশেই দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। সে-ই বলে, অব কেয়া হোগা দাদাবাবু!
রামদেও কোথায়? এতক্ষণে যেন নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নিয়ে প্রশ্নটা করে সুবিনয়।
রামদেও!
হ্যাঁ, রামদেও কোথায়?
সে তো রাত্রে পাশের ঘরেই থাকে?
রামদেও নেহি হ্যায়।
নেহি হ্যায়? কোথায় গেল সে জান?
মুঝে মালুম নেহি হ্যায় দাদাবাবু। সুবেসেই উসকা পাত্তা নেহি।
ওর বৌ রুক্মিণী?
উ তো হ্যায়।
কোথায়?
উসিকা কামরামেই হ্যায়, নিদ যাতা হ্যায়।
অভিতক নিদ যাতা হ্যায়! ওকে ডেকে আন।
বাহাদুর চলে গেল এবং একটু পরে রুক্মিণীকে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। রুক্মিণী ঘরে পা দিয়েই ভূপতিত গগনবিহারীর রক্তাক্ত নিষ্প্রাণ দেহটার দিকে তাকিয়ে অধস্ফুট একটা চিৎকার করে ওঠে, এ মাইয়া—হায় রাম!
এই রুক্মিণী, কাল রাত্রে তুই পাশের ঘরেই ছিলি তো?
হ্যাঁ, ছিলাম।
কোন শব্দ বা চিৎকার শুনিসনি?
হায় রাম! নেহি দাদাবাবু, কুছ নেহি শুনা।
মিথ্যে কথা। সুবিনয় গর্জন করে ওঠে, সত্যি কথা বল?
হায় রাম! সাচ্ বলছি দাদাবাবু, তোর গোড় লাগি, আমি কিছু জানি না, কিছু শুনিনি।
রামদেও কোথায়, তোর স্বামী?
কেন, সে তত বাড়িতেই আছে।
না, তাকে দেখছি না। কোথায় গিয়েছে সে?
কোথায় আবার যাবে! হয়তো বাজারে গিয়েছে।
এত সকালে বাজারে?
তবে কোথায় যাবে?
ঐ সময় সুবীর এসে ঘরে ঢুকল হন্তদন্ত হয়ে। সে বাড়ি ফিরেই নিচে চাকর ও প্রিয়লালের মুখে দুঃসংবাদটা পেয়েছিল।
ঘরে পা দিয়ে সুবীর বলল, এ কি, কখন হল!
সুবিনয় বললে, মাথার মধ্যে আমার যেন কেমন করছে সুবীরদা। চল চল, এ ঘর থেকে বের হয়ে চল—এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ভাল নয়।
পুলিসে একটা খবর দিয়েছ? সুবীর প্রশ্ন করে।
পুলিস!
হ্যাঁ, খুন—সর্বাগ্রে আমাদের পুলিসকেই খবর দেওয়া উচিত। এস। এই রুক্মিণী, বাইরে যা!
রুক্মিণী বাইরে চলে গেল।
সুবীরই পাশের ঘরে গিয়ে নিকটবর্তী থানায় একটা ফোন করে দিল এবং থানায় ফোন করার পর যোগজীবনবাবুকেও একটা ফোন করে দিল।
ফোন করে দুজনে নিচে এসে বসল সুবিনয়ের ঘরে।
সুবিনয় বললে, এখন কি হবে সুবীরদা?
পুলিস এসে যা ব্যবস্থা করে তাই হবে।
কিন্তু ঐ ভাবে ব্লুটালি কে মামাকে খুন করল!
যে ভাবে বুড়ো বয়সে মামা মেয়েমানুষ নিয়ে বেলেল্লাপনা শুরু করেছিলেন, এমন যে একটা কিছু হবে আমি বুঝতেই পেরেছিলাম। তা রামদেও রুক্মিণী কি বলে—ওরা তো রাত্রে পাশের ঘরেই থাকে!
রুক্মিণী বললে সে কিছু জানে না।
বললেই অমনি হল? পাশের ঘরে একটা মানুষ খুন হয়ে গেল, আর ওরা কিছুই জানে? রামদেও কি বলে?
রামদেও নেই।
নেই মানে?
পাওয়া যাচ্ছে না তাকে সকাল থেকে।
তবে হয়তো ঐ বেটারই কীর্তি!
কি বলছ তুমি সুবীরদা?
কাকাবাবুর যা চরিত্র ছিল—হয়তো ঐ ছুকরি রামদেওর বৌটার দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন, দিয়েছে বেটা খতম করে!
না, না—
নচেৎ বেটা গায়েবই বা হবে কেন?