শমিতা এসেছিল নিজেই ইচ্ছা করে গগনবিহারীর সঙ্গে দেখা করতে, কারণ যোগজীবনের বাড়িতে গগনবিহারীর ছাত্রজীবনে যখন যাতায়াত ছিল তখন থেকেই বালিকা শমিতাকে চিনতেন গগনবিহারী।
যোগজীবনের ছোট বোন ওঁকেও দাদা বলে ডাকত। গগনবিহারী ভালও বাসতেন।
শমিতা যোগজীবনের সঙ্গে গগনবিহারীর ঘরে ঢুকে একেবারে হৈ-হৈ করে উঠল, তোমার উপরে ভীষণ রাগ করেছি গগনদা!
কেন বল তো? গগনবিহারী হাসতে থাকেন।
চারদিন এসেছ অথচ একটিবার আমাদের ওখানে গেলে না দেখা করতে।
আর দুদিন অপেক্ষা করলে না কেন? দেখতে যেতাম কিনা?
সত্যি বলছ যেতে?
পরীক্ষা করা উচিত ছিল আগে।
যোগজীবন বলেন, শমির সঙ্গে তুমি কথায় পারবে না গগন।
গগনবিহারী নিঃশব্দে মৃদু মৃদু হাসেন আর দুচোখের দৃষ্টি দিয়ে স্বল্প বেশবাসের ফাঁকে ফাঁকে শমিতার যে উগ্র যৌবন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেই যৌবনকে যেন উপভোগ করতে থাকেন।
শমিতা ঐ সময় বলে, শোন গগনদা, দাদার সঙ্গে তোমার এখানে আসার আমার আরও একটা উদ্দেশ্য আছে কিন্তু–
তাই নাকি!
হ্যাঁ।
তা উদ্দেশ্যটা কি?
আমাদের একটা ক্লাব আছে—
ক্লাব! তা ক্লাবের নাম কি?
ক্লাবের নাম মরালী সঙ্ঘ।
বেশ নামটা তো!
যোগজীবন বলেন, ঐসব করছে আর কি! তা বাপু বলেই ফেল না গগনকে কি করতে হবে!
পেট্রোন হতে হবে।
পেট্রোন?
হ্যাঁ।
গগনবিহারী হাসতে হাসতে বলেন, তা দক্ষিণা কত?
পেট্রোনের কোন ধার্য দক্ষিণা নেই—তাঁরা যা-ই দেবেন তাই গ্রহণীয় হবে।
সুবীর একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল নিঃশব্দে।
যোগজীবন আসছেন বলে গগনবিহারী তাকে ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, সুবীর দেখছিল তার কাকার দুচোখের লুব্ধ দৃষ্টি কেমন করে লেহন করছে শমিতার যৌবনকে।
ঠিক আছে, বস—আসছি।
গগনবিহারী উঠে গেলেন এবং একটু পরে চেক-বইটা হাতে ঘরে এসে খস খস করে একটা দেড় হাজার টাকার চেক লিখে শমিতার দিকে চেকটা ছিঁড়ে এগিয়ে ধরলেন, নাও।
চেকটায় একবার চোখ বুলিয়ে শমিতা বললে, মেনি মেনি থ্যাংকস্। আজ সন্ধ্যায় তাহলে আসছ?
কিন্তু আমি তো তোমাদের ক্লাব চিনি না।
আমি নিজে এসে নিয়ে যাব, শমিতা বললে।
বেশ, কখন আসবে?
সাড়ে সাতটায়। আমি তাহলে এখন উঠি গগনদা!
এখুনি উঠবে কি, চা-টা খাও। সুবীর?
কাকা!
রামদেকে চা দিতে বল।
সুবীর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার সমস্ত মনটা জুড়ে তখন একটা ভরন্ত উজ্জ্বল যৌবন যেন নানা রংয়ের তুলি টেনে চলেছে!
.
চা-পর্ব শেষ হবার পর শমিতা চলে গেল।
গগনবিহারী তখন সুবীরের পরিচয় দিলেন, যোগজীবন, এই ভাইপোটির একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিতে পার? তোমার তো অনেকের সঙ্গে পরিচয় আছে!
কতদূর লেখাপড়া করেছে? যোগজীবন প্রশ্ন করেন।
আরে তাহলে আর ভাবনা ছিল কি! আই.এ. পাস করে শর্টহ্যান্ড টাইপ-রাইটিং শিখেছে। অবিশ্যি একটা অফিসে কাজ করছে, মাইনে তেমন সুবিধার নয়।
যোগজীবন বললেন, বলবখন দু-একজনকে।
সুবীর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
তারপরও ঘণ্টাখানেক দুই বন্ধুতে আলাপ-সালাপ হল।
দুজনেরই স্ত্রী-বিয়োগ ঘটেছে।
গগনবিহারীর তবু এক ছেলে আছে, যোগজীবনের তাও নেই।
যোগজীবন একসময় জিজ্ঞাসা করেন, ছেলের খবর কি তোমার, ফিরছে কবে?
সে আর ফিরবে না।
সে কি হে!
হ্যাঁ, সেখানেই বিয়ে-থা করে সংসার পেতেছে। যাক গে যা খুশি তার করুক।
আমার তো তবু শমিকে নিয়ে একরকম জীবন কেটে যাচ্ছে। তোমার তো তাহলে দেখছি একা একা খুবই কষ্ট হবে হে।
সেই জন্যেই তো ভাগ্নে আর ভাইপোটাকে এখানে এনে রেখেছি। গগনবিহারী বললেন।
.
ঐদিন সন্ধ্যায় শমিতা এল গগনবিহারীকে নিতে নিজেরই গাড়িতে।
সুবীর নীচের বারান্দায় একটা আরামকেদারায় বসে একটা পিকটোরিয়াল ম্যাগাজিনের পাতা উল্টোচ্ছিল।
।মনে মনে সে স্থির করে রেখেছিল কাকা গগনবিহারী বের হয়ে যাবার পরেই সে বেরুবে।
শমিতা এল সাড়ে সাতটা নাগাদ প্রায়। দূর থেকে দেখতে পেল সুবীর শমিতাকে। সকালের বেশভূষায় তবু তার কিছু আব্রু ছিল, কিন্তু সন্ধ্যার বেশভূষায় সুবীরের মনে হল তাও বুঝি নেই।
পরচুলা দিয়ে উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। পরনে ফিনফিনে দামী আমেরিকান নাইলনের শাড়ি, গলা ও বগলকাটা অনুরূপ এক জামা গায়ে—যার তলা থেকে ব্রেসিয়ার ও দেহের প্রতিটি ভাঁজ ও উদ্ধত উচ্ছল যৌবন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
শমিতা তার সামনে দিয়ে উপরে চলে গেল এবং মিনিট কয়েক বাদে গগনবিহারীকে নিয়ে নেমে এল। গগনবিহারীও সাজের কসুর করেননি। দামী ব্লু রংয়ের টেরিউল স্যুট, গলায় দামী টাই। দুজনে গাড়িতে উঠল, গাড়ি চলে গেল।
.
তারপর তিনটে মাস।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় গগনবিহারীবের হয়ে যান মরালী সঙ্ঘে এবং ফেরেন রাত সাড়ে এগারোটায়। রাত সাড়ে দশটায় গেট বন্ধ হয়ে যায়, তবে রাত সাড়ে এগারোটায় একবার খোলে। কাজেই সুবীরের কোন অসুবিধাই হয় না।
তাছাড়া যোগজীবনের চেষ্টায় সুবীরের একটা ভাল চাকরিও জুটে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। গগনবিহারী যেন এক নতুন মানুষ হয়ে ওঠেন।
সুবীর ও সুবিনয় আরামেই কাটায়। গগনবিহারীর সঙ্গে তাদের বড় একটা দেখাই হয় না। ওরা যে দুজন ঐ গৃহে আছে তাও যেন গগনবিহারীর মনে পড়ে না।
মধ্যে মধ্যে গগনবিহারী যেদিন ক্লাবে যান না শমিতাই আসে। রাত সাড়ে এগারোটা বারোটা পর্যন্ত থাকে সে এবং ঐ সময়টা একমাত্র রামদেও ব্যতীত কারও উপরে যাবার হুকুম নেই।