সুবীর প্রশ্ন করে, কে? কে ওখানে?
আমি বাহাদুর হুজুর।
সেই নেপালীটা বুঝি সুবিনয়? সুবীর শুধায়।
হ্যাঁ।
যে যার ঘরে গিয়ে অতঃপর খিল তুলে দিল।
জামা-কাপড় বদলে সুবীর শ্লিপিং-সুটটা পরে নিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল।
ভাল লাগছে না সুবীরের, কাল এখান থেকে চলে যেতে পারলে ভাল হত কিন্তু উপায় নেই।
গত মাস থেকে চাকরি নেই। টেম্পোরারি চাকরি অবিশ্যি যাবে জানতই, তাছাড়া ডেপুটি ম্যানেজার মিঃ সিংয়ের সঙ্গে আদৌ বনিবনা হচ্ছিল না।
হয়ত এত তাড়াতাড়ি চাকরিটা যেতও না, আর মাস দুই থাকত—কিন্তু সিং-এর সঙ্গে হঠাৎ সেদিন চটাচটি হতেই পরের দিনই চাকরিটা গেল।
পরের দিন অফিসে গিয়েই নোটিস পেল। ডেপুটি ম্যানেজারের নোটিস। মাইনে বুঝে নিয়ে তাকে চলে যেতে বলা হয়েছে। সুবীরও চলে এসেছিল সোজা টাকাকড়ি বুঝে নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে। চাকরি আজও একটা জোটেনি। তাহলেও এখানে সে থাকবে না। থাকতে সে পারবেও না। তবে একটা চাকরি চাই সর্বাগ্রে। এখানে অন্ততঃ থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিল সে। তাছাড়া মিত্ৰাণীর হোস্টেলটাও কাছে।
শ্যামবাজার থেকে মাস দুই হল মিত্ৰাণী কাছেই এখানকার একটা মেয়েদের হোস্টেলে উঠে। এসেছে।
হেঁটে যেতেই পারা যায় মিত্ৰাণীর হোস্টেলে। মিত্ৰাণীর কথা মনে পড়তেই অন্ধকারে সুবীরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে, বয়স কত হল মিত্ৰাণীর! মনে মনে একটা হিসাব করে সুবীর।
খুব কম করেও ত্রিশের কাছাকাছি তো হবেই। চাকরিই তো করছে দশ বছর। এখনও মিত্ৰাণী ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। বেচারী! আজকের দিনে ঘর বাঁধার ব্যাপারটা যেন এতই সহজ!
মিত্ৰাণী এখনও জানে না বছর দুই আগেই তার পার্মানেন্ট চাকরিটা গিয়েছে। তারপর দু জায়গায় টেম্পোরারি কাজ করল। শেষ চাকরিটাও মাসখানেক হল গিয়েছে।
ব্যাপারটা জানলে অত উৎসাহের সঙ্গে বলত না, আমি আড়াইশো মত পাই, তুমিও তিনশো সাড়ে তিনশো পাও। দুজনের বেশ ভাল ভাবেই চলে যাবে। একটা দুঘরওয়ালা ফ্ল্যাট।
নাঃ, একটা চাকরি যোগাড় করতে হবেই।
.
পরের দিন দেখা হল সুবীরের গগনবিহারীর সঙ্গে। সামান্যই কথাবার্তা হল। তার মধ্যে বিশেষ যে কথাটা সেটা হচ্ছে তার চাকরি ও উপার্জন সম্পর্কে।
তাহলে বি.এ.টাও পাস করতে পারনি?
গগনবিহারী বললেন। পরীক্ষা দিইনি।
দিলে অন্ততঃ নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ করা হত না। তা কোথায় চাকরি করছ?
ঐ একটা মার্চেন্ট অফিসে। কোনমতে ঢোঁক গিলে কথাটা উচ্চারণ করল সুবীর কতকটা যেন ভয়ে-ভয়েই।
মাইনে কত?
শ-দুই মত।
ঠিক আছে, যোগজীবন আসুক, তাকে বলবখন তোমার কথা।
আমি তাহলে উঠি?
হ্যাঁ, এস।
সুবীর উঠে দুপা এগিয়েছে, পিছন থেকে গগনবিহারী ডাকলেন, হ্যাঁ শোন, আর একটা কথা—
থেমে ঘুরে তাকাল সুবীর গগনবিহারীর মুখের দিকে।
রাত ঠিক সাড়ে দশটায় আজ থেকে কিন্তু গেট বন্ধ হয়ে যাবে, বুঝেছ?
হ্যাঁ।
যাও।
সুবীর ঘর ছেড়ে চলে গেল।
নীচে এসে নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখে সুবিনয় বসে আছে।
সুবিনয় জিজ্ঞাসা করল, কি বললেন মামা, সুবীরদা?
সুবীর খাটের উপর থপ করে বসে পড়ে বললে, ইম্পসিবল।
কি হল?
এখানে বাস করা আমার চলবে না সুবিনয়। এত কড়াকড়ি, এত নিয়মকানুন—এ তো কয়েদখানা!
একটা কথা বলব সুবীরদা?
কি?
বলছিলাম ভাল একটা যা হোক চাকরিবাকরি না পাওয়া পর্যন্ত—
তার আগেই মৃত্যুরেব ন সংশয়!
পাগলামি করো না সুবীরদা। যা বলি শোন, হুট করে একটা কিছু করে বসোনা। তাছাড়া রাজীব ওদেশ থেকে আর ফিরবে না, মামার যা কিছু তো তুমিই পাবে।
আমি?
হ্যাঁ, তুমি ছাড়া আর কে আছে বল?
তাহলে বলব সুবিনয় তুমি ভুল করেছ।
ভুল করেছি!
হ্যাঁ। আমি ঐ চীজটিকে এক আঁচড়ে চিনে নিয়েছি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে।
তার মানে?
মানে অতীব সরল, অতীব প্রাঞ্জল।
হেঁয়ালি রাখ তো।
শোন, ঘরে ঢুকে কি দেখলাম জান?
কি?
যত রাজ্যের বিলিতী আমেরিকান আর ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিন।
হ্যাঁ, সঙ্গে দু-বাক্স ভর্তি ম্যাগাজিন ও বইপত্র এসেছে কাল দেখছিলাম।
ঐ ম্যাগাজিনগুলো কিসের জানো?
কিসের?
যত নগ্ন মেয়েদের মানে ন্যাংটো মেয়েদের ছবিতে ভরা। আর সেই ছবিগুলো বসে উল্টে উল্টে দেখছেন তোমার মামাবাবু।
সত্যি!
এক বর্ণ মিথ্যে নয়। ঐ ম্যাগাজিনগুলো দেখে বুঝে নিয়েছি, ওঁর মনের অলিতেগলিতে
এই বয়সেও কোন রসের প্রবাহ চলেছে।
কিন্তু–
ছি ছি, বুড়ো হয়েছেন, সাতকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছেন, এখনও ঐসব পর্ণোগ্রাফি নিয়ে মজে আছেন! এই মানুষ দেবে আমায় সম্পত্তি? একটি কপর্দকও নয়!
সুবিনয় আর কোন কথা বলে না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, যাই উঠি, অফিসের বেলা হল।
টাকাটা দিয়ে যেও কিন্তু–
হ্যাঁ, মনে আছে।
সুবিনয় উঠে পড়ল।
.
দিনচারেক বাদে এলেন যোগজীবন সান্যাল, কলেজ-জীবনের সহপাঠী গগনবিহানীর এবং দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা। যোগজীবনও দীর্ঘদিন সেন্ট্রালের বড় চাকরি করে রিটায়ার করেছেন। যোগজীবন একা আসেননি, সঙ্গে তাঁর ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের বোন শমিতা।
শমিতার গায়ের রংটা কালো হলেও সারা দেহ জুড়ে যেন একটা অপূর্ব যৌবনশ্রী। যৌবন যেন সারা দেহে টলমল করছে।
যেন উপচে পড়ছে কানায় কানায়। বেশভূষাও অনুরূপ। শমিতা এম.এ পাশ—কোন এক বেসরকারী কলেজের অধ্যাপিকা। ভালবেসে একজনকে বিবাহ করেছিল, কিন্তু সে বিবাহ দুবছরের বেশি টেকেনি, ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল সেও আজ বছর পাঁচেকের কথা।