কাম হিয়ার জ্যাকি!
কুকুরটা এগিয়ে এসে গগনবিহারীর কোলের উপরে দুপা তুলে দিয়ে নানাভাবে তার প্রভুকে আদর জানাতে লাগল।
একটু পরে এসে ঢুকল রামদেও, গগনবিহারীর বহুদিনের পুরাতন এবং খাসভৃত্য।
রামদেও জ্যাকিকে নিয়ে ট্রেনেই এসেছে।
রামদেও লক্ষ্ণৌর লোক।
দুপুরে জ্যাকি কিছু খেয়েছিল রে? জিজ্ঞাসা করলেন গগনবিহারী।
জী হাঁ।
জ্যাকি ইতিমধ্যেই গগনবিহারীর কাছে বসে পড়ে পা চাটছিল নিজের।
রামদেও?
জী সাব!
তুই এই ঘরের পাশের ঘরটায় থাকবি।
বহুৎ খুব সাব!
নীচে রান্নাঘরে গিয়ে দে ঠাকুর কি কি এনেছে, চিকেন না থাকলে চিকেন নিয়ে আয়, আর জ্যাকির জন্য মাংস।
সুবিনয় বলে, আমি টাকা দিচ্ছি–
তাহলে তাই যাও। টাকা দিয়ে দাও গে। আর চাকরটাকে বল ওর সঙ্গে গিয়ে বাজারটা চিনিয়ে দিতে।
চল রামদেও।
চলিয়ে সাব।
সুবিনয় এগুচ্ছিল, গগনবিহারী আবার ওকে ডাকলেন, শোন সুবিনয়বাবু!
কিছু বলছিলেন?
হ্যাঁ। সুবীরবাবুর ফিরতে কি এর চাইতেও বেশী রাত হয়?
ঘড়িতে তখন রাত পৌনে আটটা।
আজ্ঞে হ্যাঁ, মধ্যে মধ্যে রাত দশটাও হয়ে যায় ফিরতে।
আর তোমার?
আমারও হয়।
দেখ একটা কথা মনে রেখো আর সুবীরবাবুকেও বলে দিও, রাত ঠিক সাড়ে দশটায় কিন্তু আমি জানাল সিংকে কাল থেকে গেট বন্ধ করে দেবার জন্য বলব।
বেশ, বলব।
আচ্ছা যাও।
সেরাত্রে সুবীর এল প্রায় পৌনে এগারোটায়। গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়াল সুবীর, দোতলার উপর থেকে জ্যাকি গর্জন শুরু করে দিয়েছে। মুখ তুলে তাকাল সুবীর দোতলার বারান্দার দিকে।
বারান্দার আলোয় চোখে পড়ল ড্রেসিংগাউন গায়ে কে একজন দীর্ঘকায় ব্যক্তি বারান্দার রেলিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে দাঁড়িয়ে বাঘের মত একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে।
উপর থেকেই ভারী গলায় সাড়া এল, হু কামস দেয়ার?
সুবীর সাড়া দেয়, আমি সুবীর।
সুবিনয় জেগেই ছিল সুবীরের প্রতীক্ষ্ণয়, সে ততক্ষণে বের হয়ে গেটের কাছে এগিয়ে গিয়েছে।
কে, সুবীরদা?
হ্যাঁ।
এস ভেতরে।
কাকা এসে গেছেন বলে মনে হচ্ছে!
হ্যাঁ।
জ্যাকির ডাকাডাকি তখন থেমে গিয়েছে।
০২. নীচের তলায় দুটো ঘরে
নীচের তলায় দুটো ঘরে সুবিনয় ও সুবীর নিজেদের ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। সুবীর এসে সুবিনয়ের ঘরে ঢুকল।
কখন এল রে?
সন্ধ্যাবেলা। সুবিনয় বলল।
ঐ বাঘের মত কুকুরটাও সঙ্গে এনেছে নাকি?
হ্যাঁ। আরও আছে—
আর কে এল আবার?
ড্রাইভার কাম বডিগার্ড নেপালী বাহাদুর, আর এক্স-মিলিটারী পার্সোন্যাল রামদেও।
হুঁ।
সুবীর পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বের করে, তা থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। নিঃশব্দে গোটা-দুই টান দিল।
এখনও জেগে আছেন?
বোধহয় তোমার ফেরবার প্রতীক্ষ্ণতেই জেগে ছিলেন।
তাই নাকি?
তাই তো মনে হচ্ছে।
কেন?
বলে দিয়েছেন কাল থেকে নাকি রাত ঠিক সাড়ে দশটায় গেট বন্ধ হয়ে যাবে।
গেট বন্ধ হয়ে যাবে!
হ্যাঁ।
তাহলে তো এখানে আমার পোষাবে না সুবিনয়।
কটা দিন একটু তাড়াতাড়ি ফেরবার চেষ্টা কর না।
থাম্ তো তুই। রাত এগারোটা সাড়ে-এগারোটার আগে কোন ভদ্রলোক আজকালের দিনে বাড়ি ফিরতে পারে নাকি? ওসব আমার দ্বারা হবে না।
সুবিনয় মৃদু হাসল। তারপর জিজ্ঞাসা করে, কিছু সুবিধে হল?
সুবীরের চাকরিটা টেম্পোরারী ছিল, মাসখানেক হল চাকরি গিয়েছে, সে আবার একটা চাকরির চেষ্টা করছে।
না।
নটরাজনের সঙ্গে দেখা করেছিলে?
করেছিলাম।
কি বললে সে?
বললে এখনও কিছু স্থির হয়নি। ঐ পোস্টটার জন্য তোদের অফিসে দিন পনেরো বাদে একবার খোঁজ নিতে বলেছেন।
ঠিক আছে। আমাদের সার্কুলেশন ম্যানেজার মিঃ গিল বম্বে থেকে ফিরুক, তাকে আবার আমি বলব।
কবে ফিরবে রে?
দিন সাত-আট বাদে বোধ হয়।
এদিকে পকেট তো আমার গড়ের মাঠ! নেহাৎ থাকা-খাওয়ার ভাবনা নেই এখন—
পরশু পঁচিশ টাকা নিলে যে!
পঁচিশ টাকা একটা টাকা নাকি?
তা এত রাত হল কেন ফিরতে?
মিত্ৰাণীকে নিয়ে সিনেমায় গিয়েছিলাম।
সুবীর চরিত্রে একটু ঢিলেঢালা, দিলদরিয়া ভাব, যা উপার্জন করে দুহাতে খরচ করে। কাল কি হবে তার জন্য কোন চিন্তাই নেই যেন।
পোশাক-পরিচ্ছদেও একটু বাবু গোছের।
সুবিনয় কিন্তু সুবীরের ঠিক বিপরীত। সঞ্চয়ী, গোছানো চিরদিনই।
সুবিনয়!
কি?
কাল আমাকে আরও কিছু দিতে পারিস?
কত?
এই গোটা কুড়ি টাকা!
দেব।
মাসের শেষ, তোর অসুবিধা হবে না তো আবার?
না। চল ওঠ, এবার খাবে চল। না খেয়ে এসেছ!
বিশেষ কিছু খাইনি—একটা কাটলেট আর এক কাপ চা। চল, খিদে পেয়েছে দারুণ।
ডাইনিং হলে দুজনে খেতে বসে।
চিকেন স্টু ও পুডিং দেখে খেতে বসে সুবীর বলে, আরে বাবা, এ যে রাজকীয় ব্যাপার! প্রিয়লাল, এসব কখন রাঁধলি রে!
আজ্ঞে কত্তাবাবুর বেয়ারা বেঁধেছে–রামদেও।
আই সি!
সুপ থেকে একটুকরো চিকেন তুলে নিয়ে চিবুতে চিবুতে সুবীর বলে, বেঁধেছে তো খাসা!
সুবীর চিরদিনই একটু ভোজনবিলাসী।
ঐ সময় জ্যাকি এসে ঘরে ঢুকে সুবীরের গায়ের গন্ধ শুঁকতে থাকে। ভয়ে সুবীর সিঁটিয়ে ওঠে। হাত থেমে যায় তার।
বলে, ওরে বাবা, এটা আবার এখানে কেন?
সুবিনয় বললে, কিছু বলবে না। গন্ধ শুঁকে চিনে নিচ্ছে।
বিশ্বাসও নেই কিছু—সুবীর বলে।
জ্যাকি গন্ধ শুঁকে চলে গেল ঘর থেকে।
খাওয়া-দাওয়ার পর দুজনে ঘর থেকে বেরুল। বারান্দায় আসতেই অন্ধকারে নজরে পড়ে বারান্দার শেষপ্রান্তে কে যেন আবছায়া দাঁড়িয়ে আছে।