কিন্তু একটু থেমে আবার শুরু করল, সুবিনয় সম্ভবত রুক্মিণীর মুখেই গগনবিহারী ও শমিতার সব ব্যাপারটা ও ঝগড়ার ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল আর সেইটাই সে শেষ মুহূর্তে কাজে লাগায়।
কি ভাবে? অরূপ শুধায়।
সুবিনয় ফোন করেছিল শমিতাকে ক্লাবে। গগনবিহারী নয়। আমার ধারণা–কারণ সে শমিতার উপরে দোষটা চাপাবার জন্য তাকে অকুস্থলে টেনে নিয়ে আসে। শমিতা আসতেই তারপর যা যা ঘটেছিল সেও শমিতার মুখেই তোমরা শুনেছ। যখন দুজনে ঝটাপটি চলেছে তখন পশ্চাৎ দিক থেকে সুবিনয় গগনবিহারীকে ছোরা মেরেই ঘর ছেড়ে যাবার আগে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দেয়। কাজেই শমিতা সুবিনয়কে দেখতে পায়নি। সব ব্যাপারটা রুক্মিণী জানতে পেরেছিল অবিশ্যি, কিন্তু সেও ভয়ে মুখ খোলেনি। গগনবিহারীর কোট ও জুতোটা আগে থাকতেই সরিয়ে রেখেছিল সুবিনয়। একটা গায়ে ও একটা পায়ে দিয়ে হত্যা করেছিল যাতে পুলিসের কুকুর ও জ্যাকিকেও ধোঁকা দিতে পারে। সর্বশেষে পেথিডিনে অ্যাডিক্টেড, সম্পূর্ণ তার হাতের কজীতে, রামদেকে ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দেয়। সম্পূর্ণ আটঘাট বেঁধেই প্ল্যান করে সব কিছু করেছিল সুবিনয়, কিন্তু এত করেও সে নিজেকে বাঁচাতে পারল না, সে নিজের ভুলের ফাঁদেই নিজে আটকে পড়ল।
হ্যাঁ। এমনিই হয়। সবার চোখের আড়ালে একজন যিনি সর্বক্ষণ চোখ মেলে বসে আছেন তাঁকে ফাঁকি দেওয়া শেষ পর্যন্ত যায় না। সুবিনয়ও পারল না। ভুলের কথা বলছিলাম না! প্রথম ভুল সে করেছিল জ্যাকিকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করে। যদিও তা পুরোপুরি। সম্ভবপর হয়নি। দ্বিতীয় ভুল রামদেওকে ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দিয়ে। পাছে নিজে ধরা পড়ে যায় এবং সে যে আগে রামদেকে পেথিডিনে অ্যাডিক্টেড করেছে সেটা কোনক্রমে প্রকাশ। হয়ে পড়ে।
রামদেওকে খুন করে ফেললেই তো একেবারে ল্যাঠা চুকে যেত! অরূপ বলে।
তা যেত—কিরীটী বলে, কিন্তু তখন আর সেটা হয়ত সম্ভবপর ছিল না। অবিশ্যি সে যদি আগে রামদেকে শেষ করত, তবে চট করে হয়ত রামদেওর প্রবলেম তার সামনে এসে দাঁড়াত না। কিন্তু সেরকম পরিকল্পনা হয়ত ওর মাথায় আসেনি। রামদেও পুরোপুরি তার হাতের মুঠোর মধ্যে ছিল বলে রামদেওর ব্যাপারটা পরে কোন একসময় মেটাবে মনে করে রামদেকে তখনও হয়ত শেষ করেনি। এবং তৃতীয় ও মারাত্মক ভুল যেটা করেছিল সুবিনয় সেটা হচ্ছে গগনবিহারীর জামা ও জুতো চুরি করে হত্যার সময় সেটা ব্যবহার করে। ঐ দুটো বস্তুই আমাকে। স্থিরনিশ্চিত করেছিল হত্যাকারী ঐ বাড়িরই কেউ, যার পক্ষে ঐ দুটি বস্তু হাতানো সম্ভবপর ছিল। সর্বশেষে ঐ দুটি বস্তুর ব্যবহার থেকেও আমার যে কথাটি মনে হয়েছিল সেটা হচ্ছে হত্যাকারী রামদেও নয়—হয় সুবিনয়, না হয় সুবীর—দুজনের একজন।
তাহলে যত নষ্টের মূল রুক্মিণীই দেখতে পাচ্ছি! অরূপ বলে।
হ্যাঁ। রুক্মিণী নয়, বল বনমরালী। গগনবিহারীর সাধের বনমরালীই শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর কারণ হল।
কিরীটী থামল।
.
পরের দিন প্রত্যুষে লেকে দেখা হল যোগজীবনবাবুর সঙ্গে কিরীটীর। এই কদিন ভদ্রলোক লজ্জায় বেড়াতেও আসেননি লেকে সকালে বোধ হয়।
রায় সাহেব।
যোগজীবনের ডাকে কিরীটী ফিরে তাকায়।
শমিতা দেবীর খবর কি সান্যাল মশাই?
সে অমলেন্দুর ওখানেই আছে।
মিটে গিয়েছে তাহলে?
তাই তো মনে হচ্ছে।
যাক। পাশ থেকে যোগেশবাবু বলে উঠলেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত মধুরেণ সমাপয়েৎ!
ফণীবাবু বললেন, আজকালকার পোলাপান কি যে ভাবে আর কি যে করে—
কিরীটী শেষ করে কথাটা, বোঝাই যায় না!
সকলে হেসে ওঠে।