সুবীর বলে ওঠে ঐ সময় এতক্ষণ পরে, সুবিনয় তুমি! তুমিই তাহলে কাকাকে খুন করেছ?
এ মিথ্যে মিথ্যে সুবীরদা। চেঁচিয়ে ওঠে সুবিনয়, ইট ইজ প্রিপ্রোস্টারাস!
কিরীটী এবারে রামদেওর দিকে তাকাল, রামদেও!
রামদেও কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।
ডাঃ অধিকারী?
বলুন।
সঙ্গে আপনার সিরিঞ্জ ওপেথিডিন অ্যামপুল একটা এনেছেন তো– যা আনতে বলেছিলাম?
হ্যাঁ।
রামদেকে একটা পেথিডিন ইনজেকশন দিন।
সবাই নির্বাক।
ডাঃ অধিকারী কিরীটীর নির্দেশে রামদেকে একটা পেথিডিন ইনজেকশন দিয়ে দিলেন।
মিনিট কয়েক পরেই রামদেওর চেহারার পরিবর্তন হয়।
চোখের মণি দুটো চকচক করতে থাকে।
রামদেও? কিরীটী আবার ডাকে।
জী!
বল সে রাত্রে তুমি কেন পালিয়েছিলে? আমি বলছি তুমি তোমার সাহেবকে খুন করনি–তুমি নির্দোষ।
আমি খুন করিনি।
বললাম তো, আমি তা জানি।
আমিও সে রাত্রে বার বার বাবুজীকে (সুবিনয়কে দেখিয়ে বলেছিলাম, আমি কিছু জানি , আমি খুন করিনি কিন্তু উনি বললেন, উনি দেখেছেন আমাকে খুন করতে সাহেবকে। পুলিসকে উনি বলে দেবেন। সেই ভয়েই আমি পালাই।
১৮. রুক্মিণীর যৌবন
কিরীটী বলছিল।
রুক্মিণীর যৌবন তিনজনকে আকর্ষণ করেছিল। প্রৌঢ় গগনবিহারী আর যুবক সুবিনয় ও সুবীর। তবে সুবীর ভীতু প্রকৃতির। কিন্তু রুক্মিণী গভীর জলের মাছ। সে কারও কথা কারও কাছে না বলে দুজনকেই নিয়ে খেলিয়েছে। রামদেও মিলিটারি ফেরতা রগচটা লোক ব্যাপারটা কোনক্রমে জানতে পারলে ছোরা বসিয়ে দেবে বুকে। তাই সুবিনয় কৌশলে রামদেকে পেথিডিনে অ্যাডিক্ট করে ক্রমশঃ তাকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসে। সুবীর ভীতু প্রকৃতির আগেই বলেছি–সে বেশীদূর অগ্রসর হবার সাহস পায়নি–কাজেই সুবিনয়ের আরও সুবিধা হয়ে যায়।
তারপর? অরূপ জিজ্ঞাসা করে।
কিন্তু গোপন প্রেমের যা শেষ পরিণতি–শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল। গগনবিহারী ব্যাপারটা জানতে পেরে গিয়েছিলেন। এবং সে জানাটা আদৌ তাঁর পক্ষে আনন্দের হয়নি। আর কেউ না–তাঁরই আশ্রিত এবং তাঁরই ভাগ্নে তাঁর লালসার ভোগে ভাগ বসাচ্ছে জানতে পেরে নিশ্চয়ই ক্ষেপে উঠেছিলেন তিনি। ফলে তিনি সুবিনয়কে ডেকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন।
কবে? অরূপ প্রশ্ন করে।
কিরীটী বললে, যে রাত্রে দুর্ঘটনাটা ঘটে সেইদিন সকালে।
জানলেন কি করে?
ঠাকুর প্রিয়লালের কাছে। ঐদিন সকালে অফিস যাবার আগে খেতে বসে সুবিনয় বলেছিল প্রিয়লালকে, পরের দিনই সকালে সে ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
তারপর?
কিন্তু সুবিনয় মুখে যাই বলুক রুক্মিণীর উগ্র রূপ ও যৌবন যার স্বাদ সে পেয়েছিল সেটা ভুলে যাওয়া বা সে লোভ দমন করা সুবিনয়ের পক্ষে তখন আর সম্ভবপর ছিল না। তাছাড়া জগতে বিশেষ একশ্রেণীর নারী আছে যারা পুরুষকে একেবারে কুক্ষিগত করে ফেলে তাদের যৌন আবেগ দিয়ে, একবার কোন পুরুষ তার বাহুবন্ধনে ধরা দিলে। সুবিনয়েরও হয়েছিল তাই–ঐ রুক্মিণীও হচ্ছে সেই শ্রেণীর স্ত্রীলোক। তাই শেষ পর্যন্ত রুক্মিণীকে হারাবার ভয়ে সুবিনয় ডেসপারেট হয়ে ওঠে।
ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল।
অরূপ বলে, আশ্চর্য! মানুষটাকে দেখে একবারও মনে হয় না ঐ প্রকৃতির–
ওরা হচ্ছে বর্ণচোরা আম। তাই তো প্রথমটায় আমার ধোঁকা লেগেছিল। কিন্তু তিনটে ব্যাপার আমার মনকে সন্দিগ্ধ করে তোলে। এক নম্বর, জ্যাকিকে ওষুধ দিয়ে নিস্তেজ করে ফেলা। আর দু নম্বর, সে–রাত্রে সুবিনয়ের গৃহে উপস্থিতি। এবং শেষ তিন নম্বর, যেভাবে গগনবিহারীকে আমূল ছোরা বিঁধিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সেটা কোন শক্তিশালী লোক ছাড়া সম্ভব ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে আমি মনে মনে সমস্ত ব্যাপারটার অ্যানালিসিস শুরু করি। প্রথমত কার কার পক্ষে গগনবিহারীকে হত্যা করা সম্ভব ছিল ভাবতে গিয়ে এবং সমস্ত ব্যাপারটা ও গগনবিহারীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছিল চারজনের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল–রুক্মিণী, শমিতা, রামদেও ও সুবিনয়। রুক্মিণীকে বাদ দিয়েছিলাম হিসাব থেকে এই কারণে যে তার কাছে গগনবিহারী ছিল স্বর্ণডিম্বপ্রসবকারী হংস। কাজেই সে গগনবিহারীকে হত্যা করতে পারে না। শুধু তাই নয়, ঐভাবে আমূল ছোরা বিঁধিয়ে তার মত একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে হত্যা করাও সম্ভব ছিল না। তারপর শমিতা। গগনবিহারীর হাতের মুঠোয় ভাঙা চুড়ি ও শমিতার হাতের ক্ষত যদিও উভয়ের মধ্যে একটা স্ট্রাগলের সম্ভাবনা আমার মনে উঁকি দিয়েছিল কিন্তু সেও নারী। একই কারণে রুক্মিণীর মত তাকেও আমি হিসাব থেকে বাদ দিয়েছিলাম।
তারপর?
তারপর রামদেও। গগনবিহারীকে এত বোকা ভাবতে পারি না যে তিনি রামদেওর চোখের উপরেই তার বৌকে সম্ভোগ করবেন। তাছাড়া সে গগনবিহারীকে হত্যা করলে তার বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রীকেও বাদ দিত না। তাকেও ঐ একই সঙ্গে শেষ করে দিত। তাহলে বাকি থাকে সুবিনয়। সন্দেহটা সুবিনয়ের উপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার চেহারা, তার উপস্থিতি সে রাত্রে ও সে একজন মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ–সব মিলিয়ে আমার মনকে সজাগ করে তোলে। তারপর জ্যাকিকে ওষুধ দিয়ে নিস্তেজ করা–রামদেও ধরা পড়বার পর সেও অ্যাডিক্টেড জানতে পেরে আমার কোন সন্দেহের আর অবকাশ রইল না। অবিশ্যি তার আগেই শমিতা দেবীর কিছুটা সত্য বিবৃতিও সেদিন থানায় আমার সন্দেহকে ওর ওপরে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল। যাক, এবারে আসল ঘটনায় আসি।