মনে আছে বৈকি।
সেই ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরো ও শমিতা দেবীর ডান হাতের কজীতে প্লাস্টার দিয়ে ঢাকা গোপন ক্ষতচিহ্নটাই আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল সেরাত্রে শমিতা দেবী গগনবিহারীর ঘরে গিয়েছিল।
কাচের চুড়িটা যে ওর হাতেই ছিল তার প্রমাণ কি?
যোগজীবনবাবুই বলেছিল, দুর্ঘটনার দিন দুই আগে শমিতার এক বান্ধবী কাশী থেকে কিছু কাচের চুড়ি এনে ওকে দেয়। সেগুলো তার হাতেই ছিল। অবিশ্যি প্রশ্ন করে সংবাদটা আমাকে সংগ্রহ করতে হয়েছে যোগজীবনবাবুর কাছ থেকে।
কিন্তু তাই যদি হয় তো শমিতা দেবী যা বলে গেলেন তা কেমন করে সত্য হয়? উনি তো ঘরে ঢুকে তাঁকে মৃত দেখেছিলেন!
না–দেখেনি।
তবে?
গগনবিহারী তখনও বেঁচেই ছিলেন। এবং আমার অনুমান যদি মিথ্যে না হয় তো—
কি?
তার উপস্থিতিতেই গগনবিহারী নিহত হন।
তবে নিশ্চয়ই শমিতাদেবী হত্যাকারীকে দেখেছিলেন সে–রাত্রে?
সম্ভবত দেখেনি।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে মিঃ রায়।
সব অন্ধকার দূর হয়ে যাবে আজ রাত দশটায়। যে ঘরে হত্যা হয়েছিল সেই ঘরেই হত্যাকারীকে আমার ধারণা আজ রাত্রে আমরা খুঁজে পাব। যা হোক, তুমি কিন্তু প্রস্তুত হয়ে যেও অরূপ।
যাব। কিন্তু—
আর কিন্তু নয় রাত দশটায় আজ। চলি এখন।
কিরীটী উঠে পড়ল।
১৭. সেই গগনবিহারীর গৃহে
রাত দশটায়।
সেই গগনবিহারীর গৃহে। তাঁর শয়নকক্ষে–যে কক্ষে কয়েক রাত্রি আগে আততায়ীর ছুরিকাঘাতে তিনি নিহত হয়েছিলেন।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত যোগজীবনবাবু, অমলেন্দুবাবু, শমিতাদেবী, সুবীর, সুবিনয়, বাহাদুর, কিরীটী, অরূপ ও ডাঃ অধিকারী–কিরীটীর পরিচিত একজন ডাক্তার।
কিরীটী সম্বোধন করে বলে, আপনারা সকলেই হয়ত একটু অবাক হয়েছেন কেন এভাবে সকলকে আপনাদের আমরা এ সময় এই ঘরে আসতে বলেছিলাম কথাটা ভেবে। আসতে বলেছিলাম এই কারণেই যে–কিরীটী একটু থেমে আবার বলে, আমরা মানে অরূপবাবু, গগনবিহারীর হত্যাকারী কে জানতে পেরেছেন। হি ওয়ান্টস টু আনমাস্ক হিম্ বিফোর অল অফ ইউ!
সকলেই পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
একটা ভয়–একটা সন্দেহ যেন সকলেরই দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কিন্তু সব কথা বলবার আগে শমিতা দেবী, আপনাকে আমি অনুরোধ করছি, সেরাত্রে গগনবাবুর টেলিফোন পেয়ে এ–ঘরে পা দেবার পর কী আপনি দেখেছিলেন–কী হয়েছিল বলুন?
আমি তো সকালেই বলেছি।
আপনি বলেছেন গগনবাবুকে আপনি মৃত দেখেন। কিন্ত তা তো নয়। হি ওয়াজ স্টীল লিভিং–তখনও তিনি বেঁচেই ছিলেন এবং সে–সময় তিনি ফুললি ড্রাঙ্কড়। বদ্ধ মাতাল। কি, তাই নয়?
শমিতা বোবা। পাথর।
বলুন? আমার কথা কি মিথ্যে?
না, তিনি বেঁচেই ছিলেন।
এবং আপনার উপস্থিতিতেই হি ওয়াজ স্ট্যান্ড।
হ্যাঁ। কিন্তু আমি–আমি হঠাৎ ঘর অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় বুঝতে পারিনি কে তাকে ছোরা মেরেছিল।
সব বলুন।
ঘরে ঢুকতেই গগনবাবু বলেন তাঁকে বিয়ে করার জন্য বিয়ে করলে সব সম্পত্তি তিনি আমার নামে লিখে দেবেন।
শমিতার বিবৃতি।
শমিতা ঝড়ের মতই এসে ঘরে ঢুকেছিল, ফোন করেছিলেন কেন?
শমি, এস। গগনবিহারী দু হাত বাড়িয়ে দেন শমিতার দিকে।
ডোন্ট টাচ মি।
ডোন্ট বি কুয়েল মাই ডার্লিং। আই লাভ ইউ। আই ওয়ান্ট ইউ বলে টলতে টলতে গিয়ে গগনবিহারী দু হাতে ঝাঁপটে ধরেন শমিতাকে বুকের উপরে।
দুজনে একটা ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। তারপরই হঠাৎ গগনবিহারী একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠেন। ঠিক ঐ সময় ঘরের আলোটা দপ করে নিভে যায়।
গগনবিহারীর আলিঙ্গন শিথিল হয়ে যায়। তিনি মাটিতে পড়ে যান। কয়েটা মুহূর্ত অতঃপর স্তব্ধ হয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে শমিতা। তারপর একসময় আলোটা জ্বলতেই তার নজরে পড়ে রক্তের স্রোতের মধ্যে গগনবিহারী পড়ে। ঘরময় কাচের চুড়ি। শমিতার ডান হাতের কজীতেও কেটে গিয়েছে, শমিতা ভয়ে তাড়াতাড়ি ভাঙা চুড়িগুলো মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ঘর ছেড়ে যখন পালাতে যাবে সিঁড়িতে রামদেওর সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়।
শমিতা থামল।
তারপর? কিরীটী শুধায়।
আমি প্রথমে বাড়ি যাই। সেখান থেকে আবার ক্লাবে ফিরে যাই। এর বেশী কিছু আর আমি জানি না। বিশ্বাস করুন–
অরূপ!
বলুন।
রামদেওকে নিয়ে এস এ ঘরে।
অরূপ বের হয়ে গেল।
রামদেও! অধোস্ফুট কণ্ঠে সুবীর বলে।
হ্যাঁ। সুবীরবাবু, দুভাগ্য খুনীর, রামদেও ধরা পড়েছে পরশু রাত্রে মোকামা জংশনে। বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটী সুবিনয়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলে, উঁহু সুবিনয়বাবু, দরজার দিকে এগুবার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। দি ক্যাট ইজ অলরেডি আউট অফ দি ব্যাগ! তাছাড়া এ বাড়ির চারদিকে পুলিস।
অরূপ এসে ঘরে ঢুকল রামদেওকে সঙ্গে নিয়ে। মাত্র কটা দিনেই লোকটার চেহারা যেন শুকিয়ে গিয়েছে। একমুখ দাড়ি, রুক্ষ চুল, মলিন বেশ, চোখের কোলে কালি। বিষণ্ণ, ক্লান্ত। অরূপ, তুমি সঙ্গে করে যে লৌহবলয় এনেছ–সে দুটি আমাদের সুবিনয়বাবুর হাতে আপাতত পরিয়ে ওকে নিশ্চিন্ত কর।
কিরীটীর কথায় অরূপ যেন কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
সুবিনয় বলে ওঠে, এসবের মানে কি কিরীটীবাবু? আপনার কি ধারণা আমিই মামাকে হত্যা করেছি?
ধারণা নয় সুবিনয়বাবু–ইটস্ এ ক্রুয়েল ফ্যাক্ট! কই অরূপ—
অরূপ এগিয়ে সুবিনয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।