শমিতা চেয়ে থাকে অমলেন্দুর দিকে।
সদ্য বোধ হয় অমলেন্দুর ঘুম ভেঙেছে। গায়ে একটা ড্রেসিং–গাউন–মাথার চুল বিস্ত।
শমিতা নিজের অজ্ঞাতেই উঠে দাঁড়াচ্ছিল আবার কিন্তু অমলেন্দু বাধা দিল। বস, বসবলতে বলতে আরও দু’পা সামনের দিকে এগিয়ে এল অমলেন্দু।
ব্যাপারটা যেন তখনও তার সদ্য-ঘুম-ভাঙা মস্তিষ্কে ঠিক প্রবেশ করছে না। শুধু আকস্মিক নয়, অভাবিতও ব্যাপারটা তার কাছে। শমিতা তার গৃহে!
কি ব্যাপার বল তো? ইউ লুক সো শ্যাবি! মনে হচ্ছে যেন কোন দীর্ঘপথ ট্রেন-জার্নি করে আসছ–কোথা থেকে আসছ?
অমলেন্দু—
চল চল–তা এখানে বসে আছ কেন? বুধনটা বলল কে একজন মাইজী এসেছে কানপুর থেকে। আমি তো ভাবতেই পারিনি তুমি! চল চল, ভিতরে চল। অমলেন্দুর কণ্ঠস্বরে যেন একটা সাদর আগ্রহ অভ্যর্থনার আত্মীয়তার সুর ধ্বনিত হয়ে ওঠে।
এস।
শমিতা উঠে দাঁড়াল।
শমিতাকে নিয়ে অমলেন্দু শয়নঘরে গিয়ে ঢুকল তার। একপাশে এলেমেলো শয্যা, একপাশে দেওয়াল ঘেঁষে একটা ডিভান–অন্যপাশে একটা টেবিলের ওপরে একরাশ বই কাগজপত্র ছড়ানো।
মাথার কাছে টেলিফোন, সিগারেট প্যাকেট, অ্যাশট্রে, লাইটার, ছোট একটা টেবিল–ক্লক।
বস। ডিভানটা দেখিয়ে দিল অমলেন্দু।
শমিতা সত্যিই আর দাঁড়াতে পারছিল না। পা দুটো যেন কাঁপছিল। শমিতা ডিভানটার উপরে বসে পড়ল।
এত সকালে নিশ্চয়ই তোমার চা খাওয়া হয়নি শমিতা? এই বুধন–বুধন!
প্রভুর ডাকে বুধন এসে ঢোকে, জী।
চা হয়েছে?
জী হাঁ–চা রেডি।
এই ঘরে নিয়ে আয়।
বুধন চলে যাবার পর অমলেন্দু আবার শমিতার দিকে তাকিয়ে বলল, হাত–মুখ ধোয়া হয়নি এখনও বলেই মনে হচ্ছে। ঐ যে বাথরুম, যাও।
শমিতা একটা কথাও বলে না। যন্ত্রচালিতের মত উঠে বাথরুমে ঢোকে।
অমলেন্দু প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে অগ্নিসংযোগ করল। শমিতা! শমিতা হঠাৎ এল কেন আবার? মনে হচ্ছে শমিতা খুব চিন্তিত, ক্লান্ত। শমিতার কোন খবরাখবর না নিলেও, এই দুই বৎসর তার সম্পর্কে সকল সংবাদই অমলেন্দুর কানে এসেছে। বিশেষ করে মরালী সঙেঘর ব্যাপারটা।
শমিতা ইদানীং রীতিমত উচ্ছঙ্খল জীবনযাপন করছে। তার সম্পর্কে নানা ধরনের রসালো কেচ্ছা সবই তার কানে এসেছে।
কিন্তু অমলেন্দু কান দেয়নি সে-সব কোন সংবাদে। এককালে শমিতা তার স্ত্রী ছিল। তারপর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে তো আর কোন সম্পর্ক নেই। তবু–তবু কেন যেন মধ্যে মধ্যে অমলেন্দুর মনের ভিতরটা কি এক বেদনায় ক্লিষ্ট হয়ে উঠেছে। আসলে অমলেন্দু তাকে ভুলতে পারেনি।
ঐ ভুলতে না পারাটাও কি তার কাছে কম লজ্জা মনে হয়েছে?
বুধন ট্রেতে চা নিয়ে এল।
একটু পরেই শমিতা বাথরুম থেকে বের হয়ে এল। চোখে মুখে ও কপালের চুলে চূর্ণ জলকণা লেগে আছে। শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়ানো, শমিতা আবার ডিভানটার উপরে এসে বসল।
অমলেন্দুই চা তৈরি করে এক কাপ এগিয়ে দিল শমিতার দিকে, নাও।
হাত বাড়িয়ে শমিতা চায়ের কাপটা নেয়। হাতটা যেন কাঁপছে।
অমলেন্দু নিজের কাপটা হাতে তুলে নেয়। নিঃশব্দে দুজনে কিছুক্ষণ চা পান করে। কারও মুখেই কোন কথা নেই, দুজনেই মনে মনে ভাবে, ও আগে কথা বলুক। শমিতা ভাবে, ওরই তো জিজ্ঞাসা করার কথা। কেন আবার হঠাৎ এলাম!
অমলেন্দু ভাবে, নিশ্চয়ই শমিতা বলবে কিছু। তার বলবার কিছু নিশ্চয়ই আছে, আর সেই জন্যই হয়ত এসেছে। কিন্তু দুজনেই বুঝতে পারে মনে মনে, মধ্যিখানে দুই বৎসরের ব্যবধানে দুজনে দুজনের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে।
অত্যন্ত সহজ ছিল যা একদিন আজ তা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দুজনের মধ্যে একটা অদৃশ্য প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়েছে কখন যেন।
এক সময় চা শেষ হল বাক্যহীন স্তব্ধতার মধ্য দিয়ে।
অমলেন্দু একটা সিগারেট ধরাল। বুধন ঐ সময় ঐদিনকার সংবাদপত্রটা রেখে গেল ওদের সামনে। অমলেন্দু হাত বাড়িয়ে সংবাদপত্রটা তুলে নিল। প্রথম পৃষ্ঠার বড় বড় হেডলাইনগুলোয় চোখ বুলিয়ে তৃতীয় পৃষ্ঠাটা খুলতেই অমলেন্দুর চোখে পড়ল গগনবিহারীর নিহত হবার সংবাদটা।
অমলেন্দু যেন চমকে ওঠে। কারণ গগনবিহারীর সঙ্গে শমিতার ইদানীংকার ঘনিষ্ঠতার সংবাদটা সে পেয়েছিল।
সংক্ষিপ্ত সংবাদ। গগনবিহারীকে তাঁর শয়নগৃহে মৃত রক্তাপ্লুত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে পৃষ্ঠে ছুরিকাবিদ্ধ। কাউকেই এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। গগনবিহারীর বহুদিনের ভৃত্য রামদেওর কোন সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না।
অমলেন্দু একবার আড়চোখে তাকাল পাশেই উপবিষ্ট শমিতার দিকে, তারপর আবার সংবাদপত্রে মনোনিবেশ করল।
কিন্তু পড়তে পারল না। কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলের উপরে রেখে উঠে দাঁড়াল। আমি একটু বেরুব শমিতা!
বেরুবে? কোথায়?
একটা বই আজ বেরুবার কথা। শেষ ফমাটা কাল রাত্রে ডেলিভারী দেবার কথা ছিল। একবার প্রেসে যেতে হবে, সেখান থেকে একবার প্রফেসার চৌধুরীর ওখানে যাব। বুধন রইল–তোমার কোন অসুবিধা হবে না।
শমিতা অমলেন্দুর প্রশ্নের জবাব দেয় না।
আধ ঘণ্টার মধ্যে অমলেন্দু স্নান করে সাজগোজ করে যখন বের হয়ে গেল, শমিতা তখনও তেমনি ডিভানটার উপরে বসে আছে।
আশ্চর্য!
অমলেন্দু তো তাকে কোন কথাই জিজ্ঞাসা করল না! কেন সে হঠাৎ এখানে এসেছে, তার কিছু বলার আছে কিনা!
কি করবে সে? চলে যাবে?
কিন্তু কোথায় যাবে? কলেজে একবার যেতে হবে বটে, তাছাড়া থাকবার একটা ব্যবস্থাও করতে হবে। অমলেন্দুর এখানে সে থাকতে পারে না। অমলেন্দুই বা তাকে থাকতে দেবে কেন? কি সম্পর্ক আজ আর তার সঙ্গে?