শমিতা তাড়াতাড়ি বলে, মিডলটন স্ট্রীট চল।
ড্রাইভার আর কোন কথা বলে না–যেমন গাড়ি চালাচ্ছিল তেমনিই চালাতে থাকে।
সবে প্রত্যুষের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তার আলোগুলো এখনও নেভেনি। রাস্তা একপ্রকার খালি বললেই হয়।
মধ্যে মধ্যে পাশ দিয়ে এক-আধটা খালি বাস, মিল্ক ভ্যান বা প্রাইভেট গাড়ি চলে যাচ্ছে। দু’একজন পথিক চোখে পড়ে। শমিতার যেন কেমন শীত–শীত করে।
গাড়ি ক্রমে রামকৃষ্ণ কালচারাল মিশনগোলপার্ক পার হয়ে ট্রাম রাস্তার দিকে চলেছে।
হঠাৎ কি যেন আবার মনে হয় শমিতার। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের দিকে তাকাল। কেউ কোন গাড়ি তাকে অনুসরণ করছে না তো? পিছনে পিছনে একটা গাড়ি আসছে না?
কার গাড়ি? তার ট্যাক্সিটাকেই ফলো করছে নাকি?
নাঃ, শমিতা কি পাগল হয়ে যাবে নাকি! এসব কি সে ভাবছে! এসব কিসের প্রতিক্রিয়া? ভয়? কিরীটী রায়ের সেই দুটো চোখের দৃষ্টি! তীক্ষ্ণ শলাকার মত অন্তর্ভেদী!
পাশ দিয়ে একটা খালি ট্রাম চলে গেল পার্ক সাকার্সের দিকে। বলবে কি শমিতা ট্যাক্সি–ড্রাইভারকে মিডলটন স্ট্রীট নয়, অন্য কোথাও সে চলুক! কিন্তু কোথায়?
কেন, সোজা হাওড়া স্টেশনে। তারপর সেখান থেকে ট্রেনে চেপে দূরে–অনেক দূরে–আসানসোল, ধানবাদ, গোমো, গয়া, মোগলসরাই, বেনারস ছাড়িয়ে আরও দূরে!
কিন্তু তারপর?
সমস্ত শহরটা এরকম আশ্চর্যরকম ফাঁকা ফাঁকা কেন? শহরের এত লোকজন কোথায় গেল? আচ্ছা ট্যাক্সি-ড্রাইভারটা কিছু ভাবছে না তো! ট্যাক্সি ড্রাইভারটা যদি বলে দেয়!
শমিতা আবার একটু নড়েচড়ে বসল। কপাল বুকের কাছে পিঠে ঘাম জমছে। হাত দুটো কেমন যেন অবশ। হাত তুলে একবার নিজের মুখে হাতটা বুলিয়ে নিল শমিতা। কোন সাড় নেই মুখে।
হাওয়ায় কয়েকগাছি চূর্ণকুন্তল চোখে-মুখে এসে পড়ছে। হাত দিয়ে ওড়া চুলগুলো ঠিক। করে দেবার চেষ্টা করল শমিতা, কিন্তু পারল না–হাতের আঙুলগুলোও যেন কেমন অবশ হয়ে গিয়েছে।
কেমন যেন অনড় হয়ে বসে থাকে শমিতা। একসময় ট্যাক্সিটা ক্যামাক স্ট্রীট দিয়ে মিডলটন। স্ট্রীটে এসে ঢুকল।
কেতনা নাম্বার মাঈজী?
ইধারই রোখ।
ড্রাইভার ট্যাক্সি থামাল। শমিতা ট্যাক্সি থেকে নামল সুটকেসটা নিয়ে। হাতের ব্যাগ খুলে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিল। ট্যাক্সিটা মিটার তুলে সোজা বের হয়ে গেল চৌরঙ্গীর দিকে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল শমিতা। তারপর এদিক–ওদিক তাকাতে তাকাতে এগিয়ে চলল।
নতুন একটা সাততলা বিরাট ম্যানসন। গেটটা খোলাই। মনে পড়ল শমিতার, কে যেন বলেছিল নতুন একটা ম্যানসনের কোন একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে অমলেন্দু।
কোটইয়ার্ড দিয়ে এগুতেই একজন দারোয়ানকে নজরে পড়ল। দারোয়ানকেই ও শুধায়, ইধার মিঃ এ. মল্লিক কোন ফ্ল্যাটমে রহতা হ্যাঁয় দারোয়ানজী?
মিঃ মল্লিক!
হ্যাঁ।
চারতলা–আঠার নাম্বার ফ্ল্যাট।
সিঁড়ি কিধার হ্যাঁয়?
সিধা যাইয়ে বাঁয়ে তরফ–লিফট সিঁড়ি দুই হ্যাঁয়।
শমিতা আর দারোয়ানের দিকে তাকাল না। সুটকেসটা হাতে এগিয়ে গেল।
অটোমেটিক লিট। একজন সুট–পরিহিত ভদ্রলোক লিস্ট দিয়ে নেমে এল। শমিতা লিফটে ঢুকে থার্ড ফ্লোরের বোতামটা টিপে দিল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল, আপনা হতেই লিফট উঠতে লাগল।
চারতলায় এসে লিস্ট থামল। দরজা আপনা হতেই খুলে যেতে শমিতা করিডরে পা দিল।
১২. আঠার নম্বর ফ্ল্যাট
আঠার নম্বর ফ্ল্যাট।
ফ্ল্যাটের দরজায় অমলেন্দুরই নেমপ্লেট রয়েছে। ডক্টর অমলেন্দু মল্লিক ডি লিট।
তাহলে এই ফ্ল্যাটই।
কোনমতে অবশ হাতটা তুলে কলিং বেলের বোতামটা টিপল শমিতা। বার–দুই বোম টিপতে দরজা খুলে গেল। সামনেই নজরে পড়ে সাজানো–গোছানো একটা ড্রইংরুম।
দরজার মুখোমুখি একেবারে দেওয়ালে অমলেন্দুর একটা এনলার্জড ফটো। ভুল হয়নি তাহলে তার–অমলেন্দুরই ফ্ল্যাট।
মধ্যবয়সী একটি বিহারী ভৃত্য দরজা খুলে দিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করে, কিসকো মাংতা?
মল্লিক সাব হ্যাঁয়?
জী। আভিতো নিদ যাতা হ্যাঁয়।
ওঃ, তা—
আপ কিধার সে আতে হে?
এই মানে–কানপুর!
কানপুর।
হ্যাঁ।
আইয়ে, বৈঠিয়ে।
শমিতা এগিয়ে গিয়ে একটা সোফার উপর বসল। সুটকেসটা একপাশে নামিয়ে রেখে দিল। ভৃত্য দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে অন্দরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এতক্ষণে–এতক্ষণে যেন একটা দুর্নিবার লজ্জা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে। সমগ্র পরিস্থিতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতিটা যেন তার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।
ছিঃ ছিঃ, ঝোঁকের মাথায় এ একটা কি কাজ সে করে বসল! শেষ পর্যন্ত মরতে এখানে সে আসতে গেল কেন? একটু পরেই অমলেন্দু হয়ত এই ঘরে এসে ঢুকবে!
তারপর?
তারপর কি একটা নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের হাসি তার চোখে-মুখে ফুটে উঠবে না?
বলবে না কি, ও, তাহলে তুমি! তা মিস শমিতা সান্যাল এখানে আবার কি প্রয়োজনে? দাদা বুঝি শেষ পর্যন্ত গলাধাক্কা দিল? জানতাম দেবে। কিন্তু দেখতে তো পাচ্ছি রূপ–যৌবন এখনও ফুরিয়ে যায়নি। আর বুঝি কাউকে গাঁথতে পারলে না মিস সান্যাল।
শমিতা এদিক-ওদিক তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল।
নীচু হয়ে হাত বাড়িয়ে সোফার পাশ থেকে সুটকেসটা তুলতে যাবে হঠাৎ একটা চপ্পলের আওয়াজ কানে এল শমিতার। একেবারে দরজার গোড়াতেই। থপ করে আবার বসে পড়ল শমিতা।
পরক্ষণেই ঘরের ভারী পদাটা তুলে অমলেন্দু এসে ভিতরে প্রবেশ করল। শমিতার প্রতি দৃষ্টি পড়তেই অমলেন্দু থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বিস্ময়ে অর্ধস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারিত হল একটিমাত্র শব্দ, তুমি!