না।
ছিঃ ছিঃ, ডিভোর্স করে স্বামীটাকে ছেড়ে এসে একটা স্বৈরিণীর জীবনযাপন করছে! ঐজন্যই বোধ হয় ডিভোর্স করেছে!
সর্বাণী কোন কথা বলেনি।
রমলার কথাগুলোই মনে পড়েছিল সর্বাণীর ঐ মুহূর্তে।
হঠাৎ শিশিরাংশুর কণ্ঠস্বরে সর্বাণীর চমক ভাঙে, কই, তোমার বান্ধবী কোথায় সবি? এক কাজ কর। আমার ঘরটায় ওঁর থাকবার ব্যবস্থা করে দাও বরং। খেয়েদেয়ে এসেছেন কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলে?
না।
দেখ যদি না খেয়েদেয়ে এসে থাকেন–কিন্তু কোথায় তিনি?
বাইরের ঘরে।
যাও। দেখ খেয়ে এসেছেন কিনা।
ধীরে ধীরে কিছুটা চাপা গলায় সর্বাণী বললে, বোধ হয় খেয়েদেয়েই এসেছে।
তাহলেও একবার জিজ্ঞাসাটা করা দরকার। যাও।
ভাবছিলাম এক কাজ করলে হয় না? অন্য কথা পাড়ল সর্বাণী স্বামীর কথার জবাব না দিয়ে।
কি?
যে ফোলডিং ক্যাম্প-খাটটা আছে সেটাই বাইরের ঘরে পেতে ওকে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিলে হয় না?
না, না–সেটা ভাল দেখাবে না।
কেন? ভাল দেখাবে না কেন?
হাজার হোক তোমার সহপাঠিনী—বান্ধবী।
তাতে কি হয়েছে? কবে কলেজে কটা দিন একসঙ্গে পড়েছিলাম! এমন কি সম্পর্ক–যে কথাটা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়েই বোধ হয় শেষ করতে পারল না সর্বাণী।
কিন্তু তার গলায় যে চাপা উষ্মটা প্রকাশ পেল সেটা সেই মুহূর্তে শিশিরাংশুর মত লোককেও যেন বিস্মিত করে দিয়েছিল।
সে বলে, আঃ সর্বাণী, কি বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি।
আঃ, চুপ কর। থামিয়ে দেয় শিশিরাংশু স্ত্রীকে। যাও, দেখ উনি কি করছেন।
স্বামীর কথায় সর্বাণীও যেন এতক্ষণে খানিকটা সংবিৎ ফিরে পায়। নিজের রূঢ় আচরণে খানিকটা থমকে যায়।
সর্বাণী ভেজানো দরজাটা ঠেলে পাশের ঘরে পা দেয়।
১১. ঘরে পা দিয়ে থমকে দাঁড়ায় সর্বাণী
ঘরে পা দিয়ে কিন্তু থমকে দাঁড়ায় সর্বাণী।
ঘরটা অন্ধকার। আলো নেভানো।
একটু ইতস্তত করে সর্বাণী, অন্ধকার ঘরের মধ্যে দাঁড়ায় মুহূর্তের জন্য। তারপরই মৃদুকণ্ঠে ডাকে, শমিতা!
কিন্তু কোন সাড়া আসে না অন্ধকারে।
হাত বাড়িয়ে সর্বাণী সুইচটা টিপে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল। ঘরের আলোটা জ্বলে উঠতেই ওর নজরে পড়ল বড় সোফাটার উপরে পা তুলে চোখ বুজে শুয়ে আছে শমিতা। মনে হল ঘুমোচ্ছে।
একটু ইতস্তত করল সর্বাণী। তারপর মৃদুকণ্ঠে ডাকল, শমিতা, এই শমিতা?
কিন্তু সর্বাণীর ডাকে শমিতা চোখও খুলল না, সাড়াও দিল না।
এই শমিতা? ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? বেশ মেয়ে তো! এই শমিতা, ওহ!
তথাপি শমিতার কোন সাড়া পাওয়া যায় না।
সর্বাণী তথাপি কিছুক্ষণ শায়িতা শমিতার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর এক সময় ঘরের আলোটা আবার নিভিয়ে ঘরের বাইরে এসে দরজাটা ভিতর থেকে টেনে দিল।
কি হল? শিশিরাংশু জিজ্ঞাসা করে।
ঘুমিয়ে পড়েছে। সর্বাণী বললে।
ঘুমিয়ে পড়েছে! কোথায়?
সোফাটার উপরই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ছিঃ ছিঃ, দেখ তো কি ভেবেছেন!
কি আবার ভাববে? আর ভাবে ভাবুক। চল, তোমাকে খেতে দিই। বলতে বলতে সবণিী কিচেনে গিয়ে ঢুকল।
শিশিরাংশুকে খাবার পরিবেশন করে দিল, অথচ সর্বাণী বসল না টেবিলে।
শিশিরাংশু জিজ্ঞাসা করে, তুমি খাবে না?
ক্ষিধে নেই–তুমি খাও।
খেতে খেতে শিশিরাংশু একসময় বলে, কাজটা ভাল হল না সবি!
কেন?
তা নয় তো কি! একটা রাতের জন্য ভদ্রমহিলা আমাদের বাড়িতে এলেন–তাছাড়া ঐভাবে কেউ ঘুমোতে পারে নাকি! এদিকে যা মশা–
তা আমি তো আর সোফায় শুয়ে রাত কাটাতে বলিনি।
স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল শিশিরাংশু, সর্বাণী!
কি?
মনে হচ্ছে তুমি যেন হঠাৎ উনি এভাবে তোমার বাড়িতে আসায় ঠিক সন্তুষ্ট হওনি।
নিশ্চয়ই হইনি। কিন্তু কেন?
ওর সব কথা তুমি জান না, ইদানীং ও যেভাবে উচ্ছঙ্খল জীবনযাপন করছিল—
কথাটা তোমার আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না সর্বাণী।
পরে বলব, এখন খেয়ে নাও।
কিন্তু—
আচ্ছা, তুমি কি কিছুই টের পাওনি?
কি টের পাব?
কেন, কোন গন্ধ পাওনি ওর মুখে?
কিসের গন্ধ?
ওর মুখ থেকে ভড়ভড় করে মদের গন্ধ বেরুচ্ছিল যখন ও কথা বলছিল! গন্ধ পাওনি তুমি?
সে কি! কই, আমি তো—
আশ্চর্য! তোমার নাকে গন্ধ গেল না? সি ইজ ড্রাঙ্ক! আমার সারাটা গা এখনও বমি–বমি করছে। স্নান না করে আমি শুতে পারব না।
শিশিরাংশু আর কোন কথা বলে না।
একসময় তারপর পাশের ঘরের আলো নিভে গেল। সর্বাণী ও তার স্বামীর কথা আর শোনা যায় না। আরও কিছু পরে শমিতা উঠে বসল সোফাটার ওপরে অন্ধকারে ধীরে ধীরে।
এতক্ষণ ধরে অন্ধকারে মশার কামড়ে চোখ-মুখ জ্বালা করছিল শমিতার। বাকি রাতটুকু ঘুম হবে না। মশার কামড়ের জ্বালা না থাকলেও অবিশ্যি ঘুম আসত না শমিতার চোখে।
দাদা যে তাকে অমন স্পষ্টাস্পষ্টি মুখের উপরেই বলে দিতে পারে তার বাড়িতে আর শমিতার স্থান হবে না ভাবতে পারেনি ও। কাল সকালেই যেখানে হোক একটা ব্যবস্থা থাকার করে নিতেই হবে তাকে। কিন্তু কোথায়? সেটাই ভেবে কোন কূল-কিনারা পায় না শমিতা।
সর্বাগ্রে তাকে একবার সমরেশের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
কিন্তু সমরেশের কথা মনে পড়তেই মনটা যেন কেমন একটা বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে শমিতার। তার প্রতি সমরেশের মনোভাবটা জানতে শমিতার বাকি নেই।
আজ যদি সমরেশের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, সমরেশ তার দুর্বলতার সুযোগটা পুরোপুরিই নেবে। সমরেশের বাহুবন্ধনে তাকে ধরা দিতেই হবে। অথচ মনের দিক থেকে এতটুকু সাড়া না মিললেও, সমরেশ ছাড়া এই মুহূর্তে আর কারো কথাই তার মনে পড়ছে না যে আজ তাকে বাঁচাতে পারে।