হ্যাঁ। যাক চিনতে পেরেছেন তাহলে আপনি আমায়! আমার বান্ধবী তো চিনতেই পারেনি। বলতে বলতে শমিতা হাতের সুটকেসটা একপাশে নামিয়ে রেখে একটা বেতের সোফার উপর বসে পড়ে বলে, শোন্ সর্বাণী, আজ রাতটা তোর এখানে আমি থাকতে চাই।
শিশিরাংশু বলে ওঠে, নিশ্চয়ই থাকবেন। আজকের রাতই বা কেন–যত দিন খুশি থাকুন না।
শিশিরাংশু উচ্ছ্বসিত অভ্যর্থনা জানালেও সর্বাণী যেন কেমন স্তব্ধ হয়ে শমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে কোন কথাই বলে না। তার চোখে-মুখে অভ্যর্থনার কোন
আনন্দই নেই যেন। শমিতার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ব্যাপারটা এড়ায় না।
তাই সে একটু হেসে সর্বাণীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, আজকের রাতটা ভাই, কাল সকালেই চলে যাব।
শিশিরাংশুই আবার বলে, আপনি এত কিন্তু-কিন্তু করছেন কেন শমিতা দেবী?
কিন্তু বেশী কিছু আর বলতে পারে না শিশিরাংশু, হঠাৎ তার স্ত্রীর মুখের দিকে নজর পড়ায়। একটু যেন বিব্রতই বোধ করে–বলে,সবি, ওকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। আমার সামান্য দেরি আছে।
শিশিরাংশু ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
শমিতা বললে, আমি বোধ হয় হঠাৎ এভাবে এই রাত্রে তোর এখানে এসে পড়ে তোকে একটু বিব্রত করলাম সর্বাণী, তাই না?
কোথা থেকে আসছিস? এতক্ষণে সর্বাণী আবার কথা বলে।
দাদার বাড়ি থেকে চলে এলাম।
চলে এলি মানে?
সে-সব অনেক কথা। দু’কথায় শেষ হবে না। দাদার ওখান থেকে বের হয়ে কোথায় যাই এত রাত্রে ভাবতে গিয়ে তোর কথাই মনে পড়ল তাই সোজা তোর এখানেই চলে এলাম।
অবিশ্যি কাল সকালেই চলে যাব।
চল ঐ ঘরে। বলে শমিতাকে নিয়ে পাশের ঘরে এসে সর্বাণী ঢুকল।
একটা আরাম–কেদারায় শমিতা বসল।
দাদার সঙ্গে ঝগড়া করেছিস? সর্বাণী আবার জিজ্ঞেস করে।
না রে।
তবে?
প্লীজ সর্বাণী, এখন কোন কথা নয়। পরে তোকে সব বলব।
সর্বাণী আর কোন প্রশ্ন করে না। কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
একজন সোফায় বসে, অন্যজন অল্প দূরে দাঁড়িয়ে। কারো মুখেই আর যেন কথা নেই। ওদের দেখে মনে হয় কেউ যেন আর বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।
যদিও দুজনেই মনে মনে চাইছিল একজন কেউ বলুক যা দুজনেই শুনতে চায়। অথচ দুজনের মধ্যে কি গভীর বন্ধুত্বই না ছিল একসময়!
মাত্র মাঝখানে দুটো বছরের অদর্শন। সময়টা কি এতই দীর্ঘ যে তাদের উভয়কে ঘিরে যে উত্তাপটা দুজনের মনের মধ্যে একসময় ছিল সেটা একেবারেই মিইয়ে গিয়েছে!
সর্বাণী।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করে ডাকল শমিতাই অবশেষে, কারণ সে সত্যিই যেন বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল।
কিছু বলছিলি? সর্বাণী বান্ধবীর দিকে মুখ তুলে তাকাল।
মনে হচ্ছে তোকে খুব অসুবিধায় ফেললাম, তাই না রে! কথাটা বলে সর্বাণীর মুখের দিকে চেয়ে শমিতা হাসবার চেষ্টা করে।
না, অসুবিধা কি? কথাটা যেন নেহাৎ সৌজন্যের খাতিরেই বলার মত করে বললে সর্বাণী।
তা ফেলেছি বৈকি। সত্যি, আমি ভেবেছিলাম–যাক গে, শুধু আজকে রাতটা তোদের বাইরের ঘরে সোফাটার উপরে বসেই আমি কাটিয়ে দিতে পারব। আমি ঐ ঘরেই যাচ্ছি, বুঝলি?
শমিতা উঠে দাঁড়াল সুটকেসটা হাতে নিয়ে এবং ধীরে ধীরে সত্যি–সত্যিই একটু আগে যে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল সেই ঘরের দিকেই পা বাড়াল।
তোকে ব্যস্ত হতে হবে না শমিতা। এক রাত্রের জন্য ব্যবস্থা হয়েই যাবে একটা। তুই বস।
শমিতা সর্বাণীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, না রে, কিছু অসুবিধা হবে না আমার সত্যিই। তুই ব্যস্ত হোস না।
শমিতা পাশের ঘরটার মধ্যে চলে গেল। ঘরটার মধ্যে তখনও আলো জ্বলছিল। শমিতা একটু আগে যে সোফাটার উপর বসেছিল সেই সোফাটার উপরেই এসে বসল দরজাটা টেনে দিয়ে।
সর্বাণী তখনও পাশের ঘরে দাঁড়িয়ে আছে।
রটা ঘোট। একধারে একটি ডাইনিং টেবিল–তার পাশে ছোট একটা ফ্রিজ।
খানচারেক চেয়ার আর ক্যাম্বিসের একটা আরামকেদারা। ঐ ঘরেরই সংলগ্ন একদিকে বাথরুম, অন্যদিকে কিচেন।
সামনে পাশাপাশি দুটো শোবার ঘর। একটাতে সর্বাণী তার মেয়েছেলেদের নিয়ে শোয়, অন্যটায় শিশিরাংশু শোয়।
খুশি হয়নি আদৌ সর্বাণী অত রাত্রে শমিতার আকস্মিক আবির্ভাবে। তার কারণও ছিল। শমিতা কথা বলছিল আর মুখ থেকে যে গন্ধটা বেরুচ্ছিল সেটা যে মদের গন্ধ সর্বাণীর সেটা বুঝতে দেরি হয়নি।
দুই বন্ধুর মধ্যে দেখাশুনা না হলেও ইদানীং দুই বৎসর সর্বাণী মধ্যে মধ্যে শমিতার বর্তমান উচ্ছল জীবনের খবর পেত এর-ওর মুখ থেকে। এবং শমিতা যে ক্লাবে ও হোটেলে গিয়ে পুরুষ-বন্ধুদের নিয়ে হৈচৈ করে মদ্যপান করে–খবরটা দিয়েছিল কিছুদিন আগে তারই আর এক বান্ধবী রমলা।
রমলা ঐ শ্রেণীর মেয়ে না হলেও, তার বড় চাকুরে স্বামী ও তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মধ্যে মধ্যে হোটেলে যেত ডিনার খেতে।
সে-ই দেখেছিল শমিতাকে।
বলেছিল, লেখাপড়ায় অত ভাল মেয়েটা, তার যে এতদূর অধঃপতন ঘটেছে ভাবতে পারিনি সর্বাণী। যেমন বিশ্রী পোশাক তেমনি নোংরা চালচলন। বরাবরই ও অবিশ্যি একটু চপল ও উচ্ছল প্রকৃতির ছিল।
সত্যি বলছিস? সর্বাণী শুধিয়েছিল। নিজের চোখেই যে দেখলাম রে! তাছাড়া কি এক ক্লাব করেছে মরালী সঙ্ঘ না কি–সেখানে শুনেছি একগাদা পুরুষ-মেয়ে জুটে মাঝরাত্তির পর্যন্ত বেলেল্লাপনা করে। আমার স্বামী সুহৃদ কি বলছিল জানিস?
কি?
ও একটা বেশ্যা। তা সত্যিই তো, বেশ্যা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে! এককালে তো তোর সঙ্গে গলায় গলায় ভাব ছিল, আসে না এখানে?