শমিতা কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না। সোজা সিঁড়ি বেয়ে পরক্ষণেই ফ্ল্যাট–হীল জুতোর খটখট শব্দ তুলে উপরে চলে গেল।
তিনতলায় নিজের ঘরে ঢুকে একটা সুটকেস টেনে নিয়ে ক্ষিপ্র হাতে কিছু জামাকাপড় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সুটকেসের মধ্যে ভরে আলমারি খুলে টাকা নিয়ে সুটকেসটা হাতে ঝুলিয়ে আবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল।
যোগজীবনের সামনে দিয়েই খটখট করে ফ্ল্যাট-হীল শব্দ তুলে শমিতা বের হয়ে গেল।
যোগজীবন দাঁড়িয়ে রইলেন। একটি কথাও আর বললেন না।
শমিতার জুতোর শব্দটা ক্রমশঃ মিলিয়ে গেল।
সহসা যোগজীবনের চোখের কোল দুটো যেন জ্বালা করে ওঠে। দরজাটায় খিল তুলে দিয়ে যোগজীবন এসে আবার বাইরের ঘরের সোফাটার উপর বসলেন।
যোগজীবনের মনে পড়ে স্ত্রী প্রভাবতীর কথা ঐ মূহর্তে। বলতে গেলে শমিতা তাঁর সন্তানের বয়েসী–মা–বাবার শেষ বয়েসের সন্তান।
যোগজীবনের অনেক বছর পরে শমিতা জন্মেছিল। প্রভাবতী তখন বৌ হয়ে ওঁদের বাড়িতে এসেছেন–তাঁর একটি কন্যাসন্তানও হয়েছে।
শমিতার জন্মের পরই তাঁর মা যে শয্যা নিয়েছিলেন, আর উঠে বসেননি। চার বৎসর। রোগভোগের পর মারা গিয়েছিলেন। তার পরের বৎসর যোগজীবনের বাবারও মৃত্যু হয়।
স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালবাসতেন যশোদাজীবন। যোগজীবনের বাবা স্ত্রীর মৃত্যুর শোকটা সামলে উঠতে পারলেন না। |||||||||| শমিতার সকল দায়িত্ব এসে পড়ল ওঁদেরই উপর। বাচ্চা শমিতা মাত্র চার বছরের মেয়ে তখন।
যোগজীবনের নিজের প্রথমা কন্যা-সন্তানের চাইতেও দু বছরের ছোট বয়সে।
পিসি ভাইঝি একসঙ্গে মানুষ হতে থাকে। মাঝখানে প্রভাবতীর আর একটি সন্তান হয়েছিল, কিন্তু মৃত। প্রভাবতীর আর কোন সন্তান হয়নি।
কন্যা সবিতার সঙ্গেই নামে নাম মিলিয়ে প্রভাবতী ছোট্ট ননদিনীর নাম রেখেছিলেন শমিতা।
সবিতার যখন সতেরো বছর বয়স তখন বিবাহ হয়ে গেল। লেখাপড়ায় তার মন ছিল না–লেখাপড়া সে করেনি। কিন্তু অসাধারণ বুদ্ধিমতী ছিল শমিতা।
শমিতা তখন স্কুল ফাইনাল পাস করে আই. এ. পড়ছে কলেজে।বিবাহের পর সবিতাকে তার স্বামী সঙ্গে করে সুদূর মালয় দেশে চলে গেল।
শমিতারও বিয়ের চেষ্টা করছিলেন যোগজীবন কিন্তু শমিতা বেঁকে বসল। বললে, না, বি. এ. পাস না করে সে বিবাহ করবে না।
প্রভাবতী বললেন, আহা থাক। সবিতার বিয়ে হয়েছে, কোথায় কোন্ দূর দেশে চলে গেছে। দু বছর তিন বছরের আগে আসবেও না। থাক, ওর বয়েসই বা এমন কি হয়েছে? পাস–টাস করুক, তারপর না হয় বিয়ে দেওয়া যাবে।
শমিতা যখন এম. এ পড়ছে সেই সময় হঠাৎ স্ট্রোকে প্রভাবতী মারা গেলেন। শমিতা এম. এ পাস করল, তারপর এক বেসরকারী কলেজে অধ্যাপিকার কাজ নিল।
যোগজীবন মধ্যে মধ্যে বিয়ের কথা বলতেন কিন্তু জোরজারি করতেন না। কারণ মৃত্যুর সময় প্রভাবতী স্বামীকে বলে গিয়েছিলেন, বিয়ের ব্যাপারে ওকে যেন চাপাচাপি না করা হয়। সেটাও এক কারণ ছিল আর শমিতা চলে গেলে একা পড়বেন, তাও এক কারণ ছিল।
তারপর হঠাৎ একদিন শমিতা অমলেন্দুকে সঙ্গে করে এনে তাঁর সামনে দাঁড়াল। তার এক সহকর্মী বান্ধবীর ভাই।
ভাল বংশের ছেলে, শিক্ষিত, ভাল চাকরি করে। দেখতেও সুশ্রী।
ইদানীং শমিতার ব্যাপারে একটু চিন্তিতই যেন হয়ে উঠেছিলেন যোগজীবন। শমিতার স্বভাবের মধ্যে কেমন যেন একটা উচ্ছলতা দেখা দিয়েছিল। তার চাল–চলনে, বেশভূষায়–সব কিছুতেই।
এমন কি বোনের বেশভূষার দিকে তাকাতেও যেন যোগজীবনের কেমন লজ্জা হত।
কিন্তু তবু কিছু তিনি বলেননি কোনদিন বোনকে।
কেমন যেন মায়া হয়েছে, কেমন যেন একটা সংকোচ বোধ করেছেন।
ঐ ঘটনার বছরখানেক আগে রিটায়ার করেছিলেন যোগজীবন কাজ থেকে।
শমিতা অমলেন্দুকে দেখিয়ে বললে, তাকে বিবাহ করবে। তারা পরস্পর পরস্পরকে কথা দিয়েছে।
যদিও এক জাত নয় তথাপি যোগজীবন সে বিবাহে অমত করেননি শমিতা সুখী হবে ভেবে।
বিবাহ হয়ে গেল।
শমিতা একদিন চলে গেল স্বামীর ঘরে।
কলকাতায় এক বনেদী অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে অমলেন্দু। কলকাতাতেই শ্যামবাজার অঞ্চলে বাস করে। মধ্যে মধ্যে দুজনে আসত যোগজীবনের সঙ্গে দেখা করতে।
যোগজীবন তখন নিজের বাড়ির একতলাটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু শমিতা এসে মধ্যে মধ্যে দু’একদিন থাকত বলে তিনতলাটা ভাড়া দেননি। সেটা খালিই পড়ে ছিল।
দুটো বছরও গেল না বিবাহের পর, ডিভোর্স হয়ে গেল শমিতা ও অমলেন্দুর।
শমিতা যোগজীবনের কাছে ফিরে এল আবার এক শীতের মধ্যরাত্রে।
সেই সময়ই শমিতা মরালী সঙঘ নামে ক্লাবটা গড়ে তোলে। এবং কিছুদিন পরে শমিতা আবার চাকরি নিল অন্য একটা কলেজে।
ডিভোর্স করে ফিরে আসবার পর যেন শমিতা আরও বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল দিনকে দিন।
ক্লাব, পার্টি, হৈ–চৈ, নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান–সর্বক্ষণ ঐ সব নিয়েই মেতে রইল।
যোগজীবন মনে মনে ভাবলেন, আহা থাক। যাতে সুখী হয় তাই করুক।
কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে যোগজীবনের, সেদিন অমন করে রাশটা ছেড়ে না দিলে বোধ হয় এত বড় কলঙ্ক তাঁকে মাথায় নিতে হত না।
যাক চলে গিয়েছে, ভালই হয়েছে।
আর শমিতার মুখদর্শনও তিনি করবেন না।
১০. শমিতা বাড়ি থেকে বের হয়ে
শমিতা বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছুদূর হাঁটতেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল। তখন রাত প্রায় দশটা।