খোঁজ পেলেও জেনো, সেও হয়তো সহজে মুখ খুলবে না। শোন অরূপ, আরও একটা কাজ তোমায় করতে হবে।
বলুন।
ভাল করে খোঁজ নিয়ে দেখ সত্যিই গগনবিহারী কোন উইল করে গিয়েছেন কিনা? তাঁর আইন–পরামর্শদাতা কে ছিলেন? তাঁর খোঁজ পেলে হয়তো তাঁর কাছেই খোঁজটা পাবে। সত্যিই যদি উইল একটা হয়ে থাকে তো জেনো এই হত্যা-মামলায় সেই উইলের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। কিন্তু আর না। আজ চলি–রাত অনেক হল।
ভাবছি ঐ রুক্মিণীকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে আসব। ও মাগী নিশ্চয়ই জানে রামদেও কোথায় গিয়েছে বা আছে।
তাড়াহুড়ো করে কিছু করো না। ঘটনাকে তার স্বাভাবিক গতিতেই চলতে দাও। ঘটনার স্বাভাবিক গতি আপনা থেকে অনেক কিছুই জানিয়ে দেয়। ঘটনার ধর্মই তাই।
অতঃপর অরূপ গাড়ি থেকে নেমে গেল।
আর ওরা কিরীটীর গৃহের দিকে চলল।
.
যোগজীবন পাথরের মতই যেন বসেছিলেন।
কিরীটীর শেষ কথাগুলো ও শমিতার ঐ ধরনের ব্যবহার যোগজীবনকে যেন অকস্মাৎ একটা পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছিল।
একমাত্র বোন ঐ শমিতা। বয়সেও তাঁর চাইতে অনেক ছোট ও বলতে গেলে সন্তানের মতই। চিরদিনই তাই একটু বেশী প্রশ্রয় ও ভালবাসাই সে পেয়ে এসেছে যোগজীবনের দিক থেকে। ভালবেসে নিজের পছন্দমত বিয়ে করেছিল শমিতা এবং সে বিবাহে তাই কোন বাধা দেননি যোগজীবন।
ভালবাসার বিবাহবন্ধনও টিকলো না, ডিভোর্স হয়ে গেল।
ঘর ভেঙে গেল।
প্রথমটায় ভেবেছিলেন যোগজীবন সব দোষটাই বুঝি শমিতার স্বামী অমলেন্দুরই। সে-ই নিশ্চয়ই মানিয়ে নিতে পারেনি–যার ফলে ভালবাসার বন্ধনটাও ছিঁড়ে গেল। তাছাড়া কে-ই বা আপনজনের দোষ দেখে বা দেখতে চায়! তাই শমিতার দিক থেকে যে কোন দোষ থাকতে পারে সেটা তিনি ভাবতেই চাননি।
ভুলটা ভাঙতে যোগজীবনের খুব দেরি হল না। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে শমিতা তাঁর গৃহে এসে উঠবার পর কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন অমলেন্দুর দোষ যতটুকুই থাকুক না কেন বিচ্ছেদের ব্যাপারে ঘর বেঁধে কোথাও সুখে বাস করবার মেয়ে নয় শমিতা।
আত্মসুখপরায়ণ, উচ্ছল, বিলাসী জীবনের প্রতিই ঝোঁক বেশী শমিতার।
মনে মনে দুঃখ পেয়েছিলেন যোগজীবন, কিন্তু তবু মুখে কিছু বলতে পারেননি।
শমিতা চাকরি করে। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত ক্লাবে হৈ-হৈ করে কাটায়, সেখানে মদ্যপানও করে। কোনটাই তাঁর পছন্দ ছিল না, কিন্তু তবু বোনকে মুখ ফুটে কিছু বলেননি।
ইদানীং গগনবিহারীর সঙ্গে অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠতার কথাটাও যে কানে আসেনি তাঁর তাও নয়, সেটাও তাঁর কানে এসেছিল এবং তার জন্য শমিতার উপরে যতটা নয় তার চাইতে বেশী বিরক্ত হয়েছিলেন যোগজীবন গগনবিহারীর উপরেই।
ইচ্ছা হয়েছিল দু-একবার গগনকে কথাটা বলেন–গগন, ব্যাপারটা বড় দৃষ্টিকটু লাগছে–কিন্তু তাও বলেননি।
সমস্ত ব্যাপারটার কুশ্রীতা তাঁর রুচিবোধকে পীড়িত করলেও কেন যেন মুখ ফুটে কাউকেই কিছু বলতে পারেননি।
তাঁর সহজ সৌজন্য ও স্বাভাবিক রুচিবোধ তাঁকে নিরস্ত করেছে।
কিন্তু আজ কিরীটী যা স্পষ্ট করে সবার সামনে বলে গেল, তারপর লজ্জায় যেন মাথাটা আর তিনি তুলতে পারছিলেন না। কেবলই মনে হচ্ছিল, ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
একেই তো আত্মীয়স্বজনরা সব সময়েই নানা ধরনের ইঙ্গিত করে শমিতার চরিত্র সম্পর্কে। এই ব্যাপার জানাজানি হবার পর তারা নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে এবার নিশ্চয়ই।
হঠাৎ চমক ভাঙল যোগজীবনের পদশব্দে। দেখলেন সাজগোজ করে শমিতা বের হয়ে যাচ্ছে।
উঠে দাঁড়ালেন যোগজীবন। ডাকলেন, শমি!
শমিতা ঘুরে দাঁড়াল।
এত রাত্রে কোথায় আবার বেরুচ্ছ?
দরকার আছে–শমিতা বললে।
যতই দরকার থাক এখন যেও না এই রাত্রে।
কি ব্যাপার বল তো দাদা? রাত্রে কি আজ আমি প্রথম বেরুচ্ছি? শমিতা একটু যেন ক্ষুণ্ণ হয়েই প্রশ্নটা করে।
যা বললাম তাই শোন। যোগজীবনের কণ্ঠস্বর গম্ভীর।
আমার কাজ আছে বলে আর দাঁড়াল না শমিতা। সদর গেটের দিকে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে চলল।
যা ইতিপূর্বে কখনও হয়নি, যোগজীবন যেন দপ্ করে জ্বলে উঠলেন। কঠিন কণ্ঠে ডাকলেন, শোন শমিতা! দাঁড়াও!
শমিতা ঘুরে দাঁড়াল এবারে।
বারান্দার আলো শমিতার সঙ্গে পড়েছে। পরনে একটা দামী শাড়ি ও গায়ে একটা অনুরূপ ব্লাউজ। সাধারণতঃ যেভাবে বেশভূষা করে শমিতা বের হয় সেই রকমই বেশভূষা, হাতে একটা ব্যাগ। পায়ে ফ্ল্যাট-হীল জুতো।
আমি বারণ করলুম বেরুতে তবু বের হবে?
কয়েক পা এগিয়ে এসেছেন যোগজীবন তখন ওর সামনে।
আমার কাজ আছে বললাম তো।
না। এখন তোমার বেরুনো হবে না! পূর্ববৎ কঠিন কণ্ঠস্বর যোগজীবনের।
শমিতা যোগজীবনের মুখের দিকে তাকাল। শমিতার মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে। সে শান্ত গলায় যোগজীবনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে বেরুতেই হবে।
না! তোমার অনেক উচ্ছঙ্খলতাই আমি সহ্য করেছি এতদিন, আর আমি সহ্য করব না। বেরুনো তোমার হবে না। আর আমার কথা অমান্য করে তুমি যদি বের হও তো জানবে–
বল। থামলে কেন? তাহলে কি?
আমার এখানে আর থাকা চলবে না।
শমিতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েকটা মুহূর্ত তার গলা দিয়ে কোন স্বরই বের হয়।
না। কেবল অপলক চেয়ে থাকে যোগজীবনের মুখের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, বেশ, তাই হবে। আমি এখুনি তোমার বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি।