মফঃস্বল থেকে দুদিন টুর করে সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে সুবিনয় ফিরেছে। ফিরেই সে, মামার চিঠিটা পেয়েছে।
এক কাপ চা পান করতে করতে সুবিনয় মামার চিঠিটার কথাই ভাবছিল।
মামা বড়লোক। মিলিটারিতে বড় অফিসার। তাদের সমপর্যায়ের মানুষ নন। তাছাড়া ঐ মামার সঙ্গে তার বাবা কল্যাণ সান্যালের বিশেষ কোন একটা প্রীতির সম্পর্কও কোনদিনই ছিল না।
বরং বলা যায় বরাবর একটা মন-কষাকষিই ছিল। কারণ ছিল তার। তার বাবার সঙ্গে তার মায়ের বিয়ের ব্যাপারটা কর্নেল চৌধুরী কখনও ক্ষমার চোখে দেখেননি।
ঐ একটিমাত্র বোন তার মা বাসন্তী দুই ভাইয়ের। গগনবিহারী মিলিটারির চাকরিতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন ভারতবর্ষের সর্বত্র। বড় ভাই বিজনবিহারী বর্ধমান জেলায় এক ছোট জায়গায় স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক ছিলেন। সামান্য আয়।
স্ত্রী, বিধবা মা ও ছোট ঐ বোন বাসন্তী। ছোট সংসার। মা যতদিন বেঁচে ছিলেন গগনবিহারী। মধ্যে মধ্যে দুশো-একশো করে টাকা পাঠাতেন। মধ্যে মধ্যে চিঠিপত্র আসত তবে সে চিঠি গগনবিহারীর লেখা নয়, তাঁর স্ত্রী নিমাল্যের।
চাকরি-জীবনে গগনবিহারী যখন কিছুদিনের জন্য এলাহাবাদে পোস্টেড, সেই সময়ই ওখানকার এক ধনী কন্ট্রাক্টার পুরোপুরি সাহেবী ভাবাপন্ন নিমাল্যের বাবা যতীন মিত্রের সঙ্গে আলাপ হয়।
আলাপটা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে মিত্র সাহেবের একমাত্র কনভেন্টে পড়া বিদুষী কন্যা নিমাল্যকে কেন্দ্র করে। সেই ঘনিষ্ঠতার ফলেই পরবর্তীকালে বিবাহ।
বিবাহের পূর্বে কিছু জানাননি মাকে বা দাদাকে গগনবিহারী। জানানো বোধ হয় প্রয়োজন বোধ করেননি। বিবাহের পরে একটা চিঠিতে দু-লাইনে লিখে সংবাদটা দিয়েছিলেন মাত্র। মা এবং ভাই দুজনেই অবিশ্যি আশীবাদ পাঠিয়েছিলেন গগনবিহারী ও নিমাল্যকে।
তারই কিছুদিন বাদে নিমাল্যর চিঠি এল শাশুড়ীর কাছে তাঁকে প্রণাম দিয়ে। শাশুড়ী জীবিতা থাকবার সময় বার-দুই নিমাল্য বর্ধমানের সেই অজ পাড়াগাঁয়ে গিয়েছিল। একবার দশদিন ও একবার সাতদিন কাটিয়েও এসেছিল সে শ্বশুরবাড়িতে।
সুবীরের.বয়স তখন বারো কি তেরো। স্কুলের ছাত্র।
আর একমাত্র বোন বাসন্তীর বয়স বছর-কুড়ি। প্রাইভেটে সে ম্যাট্রিক পাস করে বাড়িতে বসে লেখাপড়া, ছুঁচের কাজ ও অন্যান্য ঘরের কাজ করে।
সুবিনয়ের বাবা কল্যাণ সান্যাল ঐ সময় বিজনবিহারীর স্কুলে নতুন টিচার হয়ে যান। সেই সূত্রেই কল্যাণ সান্যালের সঙ্গে বিজনবিহারীর পরিচয় ও পরে ঘনিষ্ঠতা হয়।
কল্যাণ সান্যাল বাসন্তীকে বিবাহ করে। বিবাহ স্থির হওয়ার পর বিজনবিহারী ভাইকে চিঠি দিয়েছিলেন সব কথা জানিয়ে। ছেলেটি যদিও স্কুলমাস্টার, সামান্য মাইনে পায়, তাহলেও লেখাপড়ায় ও চরিত্রে আদর্শ মনে হয়েছিল বিজনবিহারীর।
গগনবিহারী, বলাই বাহুল্য, সে চিঠির জবাব দেননি। তবে নির্মাল্য দিয়েছিল চিঠির জবাব ও পাঁচশো টাকা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
এসব কথা সুবিনয়ের বড় মামার মুখেই শোনা।
ঐ কাহিনী শোনার পর থেকেই সুবিনয়ের মনে ঐ মিলিটারি অফিসার বড়লোক মামার প্রতি কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণার ভাব ক্রমশঃ জেগে ওঠে।
পরে অবিশ্যি ঐ মামার সঙ্গে বার-দুই দেখা হয়েছে তার।
একবার দিল্লীতে বছর সাতেক আগে, আর শেষবার লক্ষ্ণৌতে বছর দুই আগে। এবং ঐ দেখা হওয়া মাত্রই তার বেশি কিছু না।
গগনবিহারী তাঁর চিঠিতে লিখেছিলেন সুবিনয়কে—সে যেন তার মা ও ছোট বোনকে নিয়ে তাঁর বালিগঞ্জের বাড়িতেই এসে ওঠে। গ্রামের বাসা আর রাখার দরকার নেই।
সুবিনয় চা পান করতে করতে তার মামার চিঠিটার কথাই ভাবছিল, এমন সময় সুবীর তার মামাতো ভাই এসে ঘরে ঢুকল।
সুবীর বলতে গেলে তার চাইতে বছর তেরোর বড়। কিন্তু ছোটবেলায় পাশাপাশি একই জায়গায় মানুষ হওয়ায় দীর্ঘদিন থেকেই পরস্পরের মধ্যে রীতিমত একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল।
কলকাতায় দুজনে দুজায়গায় থাকলেও মধ্যে মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ হত।
সুবীর ঘরে ঢুকতেই সুবিনয় বলে, এই যে সুবীরদা, এস। চা হবে নাকি?
বল।
সুবিনয় উঠে গিয়ে মেসের চাকরকে চেঁচিয়ে এক কাপ চা উপরে দিয়ে যেতে বলে আবার এসে চৌকিটার উপর বসল।
সুবিনয় বললে, একটু আগেই তোমার কথাই ভাবছিলাম সুবীরদা।
সুবীর সে কথার কোন জবাব না দিয়ে বলল, কাকার একটা চিঠি পেয়েছি আজ সুবিনয়।
তাই নাকি? আমিও মামার একটা চিঠি পেলাম আজ ফিরে এসে।
কি লিখেছেন রে কাকা তোকে?
সুবিনয় চিঠিটা বালিশের তলা থেকে বের করে সুবীরের হাতে দিল, পড়ে দেখ না।
সুবীর চিঠিটা পড়ল। পড়ে ফিরিয়ে দিল আবার সুবিনয়কে।
ইতিমধ্যে চাকর এসে এক কাপ চা রেখে যায় ওদের সামনে।
সুবীর পকেট থেকে তার চিঠিটা বের করে সুবিনয়কে দিল, পড়ে দেখ আমার চিঠিটা।
মোটামুটি ঐ একই বয়ান দুটি চিঠির। দুজনের ওপরেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চিঠিতে তারা যেন অবিলম্বে গিয়ে বাড়ির কেয়ারটেকার জানাল সিংহের সঙ্গে দেখা করে এবং বালিগঞ্জ টেরেসে গিয়ে গগনবিহারীর বন্ধু সোমেশ্বর ব্যানার্জীর সঙ্গে দেখা করে টাকা নিয়ে কিছু আসবাবপত্র পছন্দমত কিনে বাড়িটাকে সাজিয়ে ফেলে। টাকার জন্যে যেন কৃপণতা কোন রকম না করা হয়। যে টাকাই লাগুক সোমেশ্বর দেবেন। তাঁকে চিঠিতে তিনি সেই রকমই নির্দেশ দিয়েছেন।