স্তব্ধতা ভঙ্গ করে অরূপই প্রথমে কথা বলল, মিঃ রায়, গগনবিহারী যে তাঁর উইলে শমিতাকে সব কিছু দিয়ে দিয়েছেন আপনি জানতে পারলেন কখন?
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল, জানতে তো এখনও আমি পারিনি!
তবে যে আপনি বললেন?
সম্পূর্ণ অনুমানের ওপরে নির্ভর করে অন্ধকারে একটা ঢিল নিক্ষেপ করেছিলাম মাত্র।
তবে কথাটা সত্যি নয়! অরূপের কণ্ঠে রীতিমত বিস্ময় যেন প্রকাশ পায়।
সত্যও হতে পারে–মিথ্যাও হতে পারে। অবশ্য সত্যি-সত্যিই যদি তিনি উইল করে থাকেন। তবে আমার ধারণা–
কি?
আমার অনুমানটা হয়ত মিথ্যে নয়, নচেৎ ঐভাবে হঠাৎ তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ জানিয়ে মিস সান্যাল ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন না। শুধু তাই নয়, আরও আমার ধারণা, ওঁদের পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বিবাহের স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
বলেন কি! অরূপ বললে, শমিতা সান্যালের মত একটি মেয়ে গগনবিহারীর মত এক বৃদ্ধকে বিবাহ করতে মনস্থ করেছিলেন? এ যে আমি ভাবতেও পারছি না মিঃ রায়!
ভাবতে তো আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি দিয়ে অনেক কিছুই পারি না অরূপ! তবে অনেক কিছুই ঘটে এ সংসারে, আর ঘটছেও। তাই নয় কি?
কিন্তু–
সামান্য পরিচয়ে মিস সান্যালকে যতটুকু আমি বুঝতে পেরেছি, ওঁরা হচ্ছেন সেই শ্রেণীর স্ত্রীলোক যাঁরা খানিকটা উচ্ছঙ্খলভাবে স্বাধীনচেতা এবং যাঁদের কাছে নিরঙ্কুশভাবে জীবনটা ভোগ করাই একমাত্র লক্ষ্য। এবং তার জন্য তাঁরা অনেক কিছুই হাসিমুখে ত্যাগ করতে পারেন। হয়ত বিবাহের পর স্বামীর সঙ্গে ঐখানেই মিস সান্যালের সংঘাত বেধেছিল–যার ফলে ডিভোর্স।
শমিতার শুনেছি যাঁর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল তাঁর অবস্থাও ভাল, বড় চাকরিও করেন, তাই হয়ত জীবনটাকে পুরোপুরি ভোগ করার জন্য সব চাইতে যে বস্তুটির বেশি প্রয়োজন–অর্থ–তার অভাব ছিল না। এবং শমিতার স্বামীর হয়ত আবার সেটা পছন্দ ছিল না। ফলে যা অবশ্যম্ভাবী ঐ ধরনের স্ত্রীলোকের পক্ষে তাই হয়ে গেল।
সুব্রত ঐ সময় বলে, তোর বন্ধু যোগজীবনবাবুর অবস্থাও তো খারাপ বলে মনে হল না।
যোগজীবনবাবু! কিরীটী বললে, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ এবং সঞ্চয়ী ছিলেন। তাই হয়ত ঐ বাড়িটা করতে পেরেছেন। কিন্তু আজ তাঁর অবসর জীবন। শমিতা যে অর্থের সচ্ছলতার আকাঙ্ক্ষী সেরকম সচ্ছলতা যোগজীবনবাবুর কোথায়! থাকা সম্ভবও নয়।
শমিতা দেবীও তো চাকরি করেন।
তা করেন কিন্তু সেটা একান্ত দায়ে পড়েই। ভাইয়ের কাছ থেকে সেরকম অর্থ পাওয়া যাবে বলেই। এবং তাই বা তাঁর প্রয়োজনের পক্ষে কতটুকু? সেদিক দিয়ে ভেবে দেখ, গগনবিহারীর স্কন্ধারূঢ় হতে পারলে কত সুবিধা! সামান্য একটু যৌবনের ছলাকলা দিয়েই তাই হয়ত শমিতা প্রৌঢ় কামুক গগনবিহারীকে ধরাশায়ী করেছিল। অবিশ্যি গগনবিহারীকে করায়ত্ত করার আরও কারণ ছিল আমার মনে হয়!
কি? অরূপ প্রশ্ন করে।
প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব তো হবেই না, ঐ সঙ্গে সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশভাবে যে জীবনের সঙ্গে সে অভ্যস্ত সে জীবনও সে নিশ্চিন্তে চালিয়ে যেতে পারবে। ভোগের জীবনে একটানা ভেসে চলতে পারবে। কিন্তু ঐখানেই শমিতা ভুল করেছিল।
ভুল?
হ্যাঁ–গগনবিহারীর চরিত্রের সে সম্যক পরিচয় পায়নি। তাঁর দিকে তাঁর যে হাত প্রসারিত হয়েছিল, অনুরূপ ঘটনা ঘটলে যে সেই হাত দুটি আবার অন্যত্রও প্রসারিত হতে পারে সেটাই বুঝতে হয়ত পারেনি শমিতা। আর খটকা লাগছে আমার ঐখানেই।
খটকা?
হ্যাঁ। শমিতার মত মেয়ের সে কথাটা তো না বোঝার কথা নয়। তবে সে গোড়া থেকেই সতর্ক হল না কেন? কিংবা হয়ত এও হতে পারে, তার নিজের উপরে আত্মবিশ্বাসই তাকে শেষ পর্যন্ত চরম আঘাত হেনেছে।
বুঝলে অরূপ, কিরীটী একটু থেমে বলে, ব্যাপারটা অত্যন্ত জটিল। এবং জেনো, ঐ জটিলতার গিট খুলতে পারলেই তোমার কাছে বর্তমান হত্যারহস্যের সবটুকুই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিছুই আর ঝাঁপসা অস্পষ্ট থাকবে না, রহস্যাবৃতও মনে হবে না।
গাড়ি ইতিমধ্যে থানার কাছে এসে থেমে গিয়েছিল।
ওরা গাড়ির মধ্যে বসে কথা বলছিল।
আপনি কি বুঝতে পেরেছেন মিঃ রায়, গগনবিহারীর হত্যাকারী কে? হঠাৎ ঐ সময় প্রশ্ন করে অরূপ।
অনুমান করতে পেরেছি বৈকি কিছুটা।
তবে কি শমিতা দেবীই?
এটা অবিশ্যি মিথ্যে নয় যে, কোন কিছুর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে গেলে প্রত্যেক পুরুষ ও নারীই তখন কিছুটা হিংস্র হয়ে ওঠে ঠিকই এবং কাউকে হত্যা করতে হলে বিকৃত একটা মনোবলের প্রয়োজনও হয়। কিন্তু বর্তমান হত্যার ব্যাপারটা–অর্থাৎ যেভাবে নিহত হয়েছেন। গগনবিহারী–সেটার কথা ভুললে তো তোমার চলবে না অরূপ। কে হত্যা করেছে তাঁকে সে কথাটা চিন্তা করার আগে তোমাকে চিন্তা করতে হবে কার পক্ষে গতরাত্রে গগনবিহারীকে হত্যা করা সম্ভব ছিল এবং হত্যার উদ্দেশ্যটাও সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে। নচেৎ ভুলপথে তুমি গিয়ে পড়বে। ভাল কথা, রামদেওর কোন সংবাদ পেলে?
না।
আর একটা কথা—
বলুন?
সুবীরবাবুর জবানবন্দিটা ও সেই সঙ্গে শমিতা দেবীর ও রুক্মিণীর জবানবন্দিটারও ভাল করে খোঁজখবর নাও। কারণ আমার ধারণা ওরা তিনজনেই মিথ্যে বলেছে।
শমিতা দেবী যে মিথ্যে বলেছেন সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু সুবীরবাবু আর রুক্মিণী–
কেউই সব সত্যি প্রকাশ করেনি।
রামদেওটার খোঁজ পেলে হয়ত অনেক কিছুই জানা যাবে।