নচেৎ কথাটা আপনাকে আমি নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করতাম না।
অ্যাম স্যরি মিঃ রায়, আপনার ঐ প্রশ্নের আমি জবাব দিতে পারছি না। দুঃখিত। আপনার আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?
গগনবিহারীবাবুর সঙ্গে আপনার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাই নয় কি?
আলাপ-পরিচয় ছিল। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই দাদার বন্ধু হিসাবে তিনি আমাদের পরিচিত ছিলেন।
গগনবাবু আপনাদের ক্লাব মরালী সঙ্ঘের অন্যতম পেট্রোন ছিলেন, তাই নয় কি?
হ্যাঁ।
আপনি প্রায়ই তাঁর ওখানে যেতেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত থাকতেন–কথাটা কি সত্যি?
একসময় যেতাম, তবে ইদানীং যেতাম না। গত সাত–আট দিন একবারও যায়নি।
কেন? ঝগড়া হয়েছিল কি?
শমিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ।
কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল?
শমিতা যেন আবার মুহূর্তকাল চুপ করে রইল। তারপর বললে, ক্লাবেরই কোন ব্যাপারে মতান্তর হয়েছিল।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, কিন্তু আমি যদি বলি মিস সান্যাল, আপনি সত্যি বলছেন না?
হোয়াট ডু ইউ মী! রুক্ষ ও কঠিন শোনাল শমিতার কণ্ঠস্বর।
কথাটা আমার অস্পষ্ট নয়, আর দু’রকম অর্থও তার হয় না এবং আপনিও যে সেটা বুঝতে পারেননি তাও নয়। কিরীটীর গলার স্বরটা শান্ত কিন্তু কঠিন।
শমিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিঃশব্দে চেয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটীও কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থাকে শমিতার মুখের দিকে। তারপর বলে, আপনার বাঁ হাতের কব্জিতে একটা দেখছি প্লাস্টার লাগানো আছে। কি হয়েছে ওখানে মিস সান্যাল? কেটে গিয়েছিল বোধহয়?
কিরীটীর কথায় শমিতা যেন হঠাৎ কেমন একটু হকচকিয়ে যায়, মনে হল কিরীটীর। সঙ্গে সঙ্গে যেন তার প্রশ্নের জবাবটা দিতে পারল না শমিতা।
একটু যেন বিব্রত–কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য পরক্ষণেই বলে, হ্যাঁ, সামান্য একটু কেটে গিয়েছিল, তাই একটু প্লাস্টার লাগিয়ে দিয়েছিলাম। বলতে বলতে শমিতা যেন কিরীটীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে থেকে হাতটা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করে।
কি করে কাটল? কবে কাটল?
ঠিক মনে নেই, পরশু-তরশু হবে।
আপনার হাতে সরু একজোড়া সোনার রুলি দেখছি। ঐ সোনার রুলি ছাড়া আর কিছু বোধহয় আপনি কখনও হাতে পরেন না?
না।
মিস সান্যাল, আপনি সুবীরবাবু ও সুবিনয়বাবুকে নিশ্চয়ই চেনেন, গগনবাবুর বাড়িতে যখন আপনার যাতায়াত ছিল? কিরীটী প্রশ্নটা করে আবার তাকাল শমিতার মুখের দিকে।
সুবীরবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সামান্যই আমার। শমিতা বললে।
সুবিনয়বাবুর সঙ্গে হয়নি? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
না।
গগনবাবুর একটা অ্যালসেসিয়ান কুকুর আছে আপনি জানেন নিশ্চয়ই?
জানি। জ্যাকি।
মধ্যে মধ্যে তাকে আপনি এটা–ওটা খেতে দিতেন?
না। আই হেট ডগস।
গগনবাবু সেটা জানতেন?
তা জানতেন বৈকি। কিন্তু আপনার যা জিজ্ঞাসা করবার শেষ হয়েছে কি? মে আই লিভ দিস রুম? শরীরটা আমার ভাল নেই।
নিশ্চয়ই। আপনাকে এখুনি আমি ছেড়ে দোব। আর একটা প্রশ্নের জবাব দিলেই–
বলুন? কি প্রশ্ন আপনার?
আপনার সঙ্গে গগনবাবুর বিয়ে প্রায় সেটুল হয়ে গিয়েছিল মিস সান্যাল, তাই নয় কি?
প্রশ্নটা এমনি আকস্মিক ও সকলের সেখানে যারা উপস্থিত তাদের চিন্তারও বাইরে ছিল যেন। সকলেই যেন শমিতার মুখের দিকে তাকায়।
বিশেষ করে যোগজীবনবাবু যেন বোবা। কিছুটা বিলও।
শমিতাও যেন কয়েকটা মুহূর্তের জন্য বোবা হয়ে যায়। তার মুখ থেকেও কোন শব্দ নির্গত হয় না। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা যেন থমথম্ করে।
কিন্তু হঠাৎ সেই স্তব্ধতা ভেঙে খিলখিল করে হেসে ওঠে শমিতা। তারপর বলে, সত্যিই, মিঃ রায়, আই মাস্ট অ্যাডমিট আপনার কল্পনাশক্তি আছে। একটা ওল্ড ভালচার! তার সঙ্গে বিয়ে?
হয়নি সেরকম কোন কথা তাহলে কখনও আপনাদের মধ্যে–মানে এনি আন্ডারস্ট্যান্ডিং?
না মশাই–আমার তো কিছু মাথার গোলমাল হয়নি!
তাহলে—
কি তাহলে?
তাঁর সমস্ত কিছু আপনার নামে লিখে দিয়ে গেলেন কেন?
আমার নামে দিয়েছেন?
কেন, জানেন না আপনি কথাটা বলতে চান?
শমিতা হঠাৎ যেন আবার চুপ করে গেল। থমকে গিয়েছে যেন শমিতা।
কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তখনও শমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে, শান্ত গলায় সে বলতে থাকে, নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতে চলেছিল বলেই আপনাকে তিনি তাঁর সবকিছু উইল করে দিয়েছেন।
থামুন থামুন–হঠাৎ যেন চিৎকার করে উঠল শমিতা। তারপরে ঝড়ের মতই যেন ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ওদের দিকে তাকাল না পর্যন্ত।
ঘরের মধ্যে অকস্মাৎ যেন একটা হিমশীতল স্তব্ধতা নেমে এল। সবাই নিশ্চুপ– একেবারে যেন পাথর।
যোগজীবনবাবুর মুখোনা যেন ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
কিরীটী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, যোগজীবনবাবু, আজ যাই!
অ্যাঁ! চমকে উঠলেন যেন যোগজীবন।
আমরা যাই!
যাচ্ছেন?
হ্যাঁ। চল অরূপ, চল সুব্রত।
ওরা ঘর থেকে বের হয়ে গেল, আর যোগজীবন তখনও পাথরের মত বসে রইলেন।
০৯. রাত্রি তখন প্রায় সোয়া নটা
রাত্রি তখন প্রায় সোয়া নটা হবেই।
কিরীটী অরূপ সুব্রত সুব্রতর গাড়িতেই চলেছিল থানায় অরূপকে নামিয়ে দেবার জন্য।
শমিতা কিরীটীর বিস্ময়কর উক্তির পর সহসা ঘর ছেড়ে ঝড়ের মত বের হয়ে যাবার পর সকলের মধ্যেই যে স্তব্ধতা নেমে এসেছিল, চলমান গাড়ির মধ্যেও সেই স্তব্ধতাই যেন সকলকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।