একটু পরে আবার বলে, তাহলে চলুন, ওঠা যাক।
অ্যাঁ–হ্যাঁ, চলুন।
দোতলায় উঠে যোগজীবন তাঁর শয়নঘরে ওদের বসিয়ে শমিতার ঘরের দিকে পা বাড়ান।
বাড়িটা বেশ বড়। দোতলায় পাঁচটি ঘর, তিনতলায় তিনটি ঘর।
তিনতলাতেই একটি ঘর নিয়ে শমিতা থাকে।
একতলাটা ভাড়া দেওয়া একটি ঘর ছাড়া।
শমিতার ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল।
খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন যোগজীবন। ঘরের ভিতরে অন্ধকার। একটু ইতস্ততঃ করলেন যোগজীবন, তারপর মৃদু কণ্ঠে ডাকলেন, শমি!
কোন সাড়া এল না।
আবার ডাকলেন একটু উঁচু গলাতেই, শমি?
কে, দাদা? সাড়া এল এবার অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে।
হ্যাঁ।
এস।
যোগজীবন অন্ধকার ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন, আলো জ্বালাসনি কেন?
খট করে একটা শব্দ হল। ঘরের আলোটা জ্বলে উঠল পরমুহূর্তেই। যোগজীবন দেখলেন শমিতা একটা আরাম–কেদারার উপর দেহটা এলিয়ে দিয়ে পড়ে আছে।
সব সময়ই যে বেশভূষা ও প্রসাধন ছাড়া থাকে না তার আজ কোন বেশভূষা ও প্রসাধন নেই। পরনে সাধারণ একটা তাঁতের রঙিন শাড়ি। গেরুয়া রংয়ের হাতকাটা একটা ব্লাউজ গায়ে। মাথার চুল রুক্ষ, চিরুনি পড়েছে বলে মনে হয় না।
চোখেমুখে প্রসাধনের চিহ্নমাত্র নেই। চোখ দুটো যেন ঈষৎ রক্তিম।
সামনে ছোট একটা ত্রিপয়ের উপরে কাচের গ্লাসে রক্তিম তরল পদার্থ। গ্লাসটার প্রতি নজর পড়তেই যেন যোগজীবন একটু থমকে গেলেন। গ্লাসের রক্তিম তরল বস্তুটি যে কী যোগজীবনের বুঝতে কষ্ট হয় না।
শমিতা ড্রিঙ্ক করে জানতেন তিনি, কিন্তু সে সব কিছুই ক্লাবে। ঘরে বসেও যে শমিতা ড্রিঙ্ক করতে পারে এটা যেন ধারণার অতীত ছিল যোগজীবনের কাছে।
হঠাৎ যেন একটা ক্রোধের উদ্রেক হয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিলেন যোগজীবন। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, রায় সাহেব এসেছেন, আমার ঘরে বসে আছেন–তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও যোগজীবনের কণ্ঠস্বরটা যেন একটু রূঢ়ই শোনাল।
কি দরকার আমার সঙ্গে তাঁর? শমিতা একটু যেন রুক্ষ স্বরেই প্রশ্নটা করল।
জানি না। তোমাকে তো সকালেই বলেছিলাম, তিনি আসবেন আজ বিকেলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে।
বাট আই ডোন্ট লাইক টু মীট এনিবডি অ্যাট দিস্ মোমেন্ট!
শোন, শুধু রায় সাহেবই নন–থানা-অফিসারও এসেছেন।
বাট হোয়াই? কি চান তাঁরা আমার কাছে?
চেঁচিও না, শোন ওঁরা জানতে পেরেছেন গগনের সঙ্গে তোমার পরিচয় ছিল—
হোয়াটস টু দ্যাট–পরিচয় ছিল, তাতে হয়েছে কি?
তাছাড়া কাল রাত্রে তুমি ওখানে গিয়েছিলে—
ইটস্ এ ড্যাম লাই–মিথ্যে কথা।
মিথ্যে কথা!
নিশ্চয়ই। গত সাতদিন ধরে তার বাড়ির ছায়াও মাড়াইনি আমি। একটা ডার্টিফিলদি স্কাউনড্রেল!
বিষ যেন উগারিত হল শমিতার কণ্ঠ থেকে।
সত্যি–সত্যি শমি–তুই কাল গগনের বাড়িতে যাসনি?
সিওরলি নট!
তবে যে গগনের বাড়ির লোকেরা কেউ কেউ বললে, তোকে তারা যেতে দেখেছে গত রাত্রে গগনের ঘরে?
কে–কে বলেছে?
বললাম তো, গগনের বাড়ির লোকেরা বলেছে।
মিথ্যে কথা। কাল আমি রাত আটটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ক্লাবে ছিলাম। এভরিবডি নোজ দ্যাট–সবাই সেখানে তার সাক্ষী আছে।
কিন্তু–
ব্যাপার কি বল তো দাদা? তুমি কি বিশ্বাস করছ না আমার কথাটা?
শমিতা উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে।
না, মানে—
ঠিক আছে, চল, তোমার থানার ও. সি. কি বলতে চায় শুনে আসি। আর তোমার রায় সাহেবেরই বা কি বলবার আছে শুনি।
চল্।
ভাই-বোনে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
পাশের ঘরে ঢুকে যোগজীবন বললেন, রায় সাহেব, এই আমার বোন শমিতা।
কিরীটী চোখ তুলে তাকাল, নমস্কার মিস সান্যাল। বসুন।
আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন? শমিতা প্রশ্নটা করে বসল না, দাঁড়িয়েই রইল।
কিরীটী আবার বললে, বসুন।
না–বসলে হবে না। কি আপনি জানতে চান বলুন আমার কাছে!
রায় সাহেব–
যোগজীবনের কণ্ঠস্বরে কিরীটী তাঁর দিকে ফিরে তাকাল। যোগজীবন বললেন, শমিতা বলছে কাল রাত্রে ও আদৌ ওখানে নাকি যায়ইনি।
কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শমিতাকে দেখছিল, যোগজীবনের কথায় ফিরে তাকাল না। কেবল প্রশ্ন করল, আপনি বলছেন কাল রাত্রে গগনবাবুর বাড়িতে যাননি?
না।
কিন্তু—
কি?
রামদেও আর সুবিনয়বাবুরা আপনাকে দেখেছে। কেবল তাই নয়, রুক্মিণী আপনার গলা শুনেছে গগনবাবুর শোবার ঘরে। কিরীটী বললে।
রামদেও বলেছে? সুবিনয় বলেছেন তিনি আমাকে দেখেছেন কাল রাত্রে সেখানে?
সেই কথাই তো তারা তাদের জবানবন্দিতে বলেছে।
ইটস এ ড্যাম লাই। ডাকুন তো তাদের, আমি জিজ্ঞাসা করছি কখন তারা আমাকে দেখেছে?
নিশ্চয়ই–জিজ্ঞাসা করা হবে বৈকি। কিন্তু আপনি যে সত্যি–সত্যিই কাল রাত্রে সেখানে যাননি তার কোন প্রমাণ আছে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
নিশ্চয়ই।
কি প্রমাণ? কিরীটী শমিতার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার প্রশ্ন করে।
কাল রাত্রে ক্লাবে আমাদের যারা ছিল তাদের জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন কথাটা আমার সত্যি না মিথ্যে।
আপনি তাহলে বলছেন কাল রাত্রে ক্লাবেই ছিলেন? কিরীটীর গলার স্বর যেন অতিরিক্ত শান্ত–ঠাণ্ডা।
হ্যাঁ।
কখন ক্লাবে গিয়েছিলেন আর কতক্ষণ বা কাল রাতে সেখানে ছিলেন, নিশ্চয়ই মনে আছে আপনার?
নিশ্চয়ই, মনে আছে বৈকি। আটটায় গিয়েছিলাম, রাত সাড়ে এগারোটায় ফিরে আসি। বাড়িতে?
না।
তবে কোথায়?
সে কথা জানবার আপনার কি কোন প্রয়োজন আছে, মিঃ রায়?