আমিও ঐ উত্তরটাই আপনার কাছে আশা করেছিলাম সান্যাল মশাই।
সত্য আর গরলকে চাপা দিয়ে রাখা যায় না চিরদিন, একদিন-না-একদিন সে প্রকাশ হয়ে পড়েই–তাছাড়া শমিতা যেমন আমার সহোদরা বোন তেমনি গগনও ছিল আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। আমার–হ্যাঁ, আমারও কিছু দোষ আছে বৈকি। গগন আর শমিতা সম্পর্কে আমার কানে ইদানীং কিছুদিন ধরে অনেক কথাই আসছিল, কিন্তু তবু আমি সতর্ক হইনি।
হওয়া বোধ হয় উচিত ছিল আপনার সান্যাল মশাই!
এখন বুঝতে পারছি উচিত ছিল। তবে বিশ্বাস করুন রায় সাহেব, এতটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
এবারে বাড়ি যান সান্যাল মশাই।
যোগজীবন বিদায় নিয়ে গৃহের দিকে চলা শুরু করলেন।
কিরীটীও তার গৃহের দিকে পা পাড়াল।
.
বেলা দশটা প্রায় হয়ে গিয়েছিল সেদিন কিরীটীর গৃহে ফিরতে। কৃষ্ণা উদ্বিগ্ন হয়ে ঘর–বার করছিল–সুব্রতকেও ফোন করে আনিয়েছিল।
কিরীটী এসে যখন গৃহে প্রবেশ করল, জংলী তখন আবার কিরীটীর সন্ধানে চতুর্থবার লেকের দিকে যাচ্ছিল। কিরীটীকে দেখে সে দাঁড়াল, বাবুজী, কোথায় ছিলে তুমি এতক্ষণ?
কেন রে?
মাইজী খুব ব্যস্ত হয়েছে–যাও। উপরে যাও।
দেড়তলার বসবার ঘরে ঢুকতেই সুব্রত বলে ওঠে, কি রে, কোথায় গিয়েছিলি?
কেন?
কেন মানে? সেই সকাল সাড়ে তিনটেয় লেকে বেড়াতে গিয়ে আর পাত্তা নেই?
কৃষ্ণা বলে, সত্যি–আশ্চর্য মানুষ তুমি!
কিরীটী সোফার উপর বসতে বসতে বললে মৃদু হেসে, হারিয়ে যাব না সে তত জানতেই প্রিয়ে–আর সেরকম কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই আগে সে সংবাদ পেতে।
থাক। আর বাহাদুরিতে প্রয়োজন নেই। তা চা খেয়েছ, না তাও পেটে পড়েনি এখনও?
পড়েছিল সেই ঘন্টা তিনেক আগে এক কাপ, তাও সম্পূর্ণ নয়। এক কাপ পেলে মন্দ হত না।
কৃষ্ণা উঠে গেল। সুব্রত আবার জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
আর বলিস কেন! গিয়েছিলাম অবিশ্যি একটি রেয়ার ফুল দেখতে–অবশেষে জড়িয়ে পড়লাম এক খুনের ব্যাপারে।
খুন! কোথায়? কে?
ধীরে বন্ধু ধীরে। তারপর একটু থেমে কিরীটী বলে, নিহত হয়েছেন এক এক্স আর্মি কর্নেল। মৃত্যুর কারণ ছুরিকাঘাত–স্থান অনতিদূরে, সাদার্ন অ্যাভিনুতে।
তা তুই তো গিয়েছিলি লেকে বেড়াতে—
বললাম যে, বেড়ানো শেষ হবার পর গিয়েছিলাম সান্যাল মশাইয়ের গৃহে একটা রেয়ার ফুল দেখতে!
সান্যাল মশাই কে?
লেকের ভ্ৰমণবন্ধু–এক প্রৌঢ় রিটায়ার্ড ভদ্রলোক এবং যিনি নিহত হয়েছেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
তারপর?
সান্যাল মশাইয়ের ওখানে ফোন এল বন্ধুটি তাঁর নিহত। তখন তিনি–মানে তাঁরই অনুরোধে তাঁর সঙ্গে যাই।
চায়ের কাপ হাতে কৃষ্ণা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, তা সেখান থেকে একটা ফোন করে দিতে কি হয়েছিল?
ক্ষমা করো দেবী–মনে পড়েনি।
তা মনে পড়বে কেন? খুনখারাপির গন্ধ পেলে কি আর কিছু মনে থাকে?
কিরীটী কৃষ্ণার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে কাপে চুমুক দিতে দিতে মৃদু মৃদু হাসে।
শোন, বস–খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার!
থাক তোমার ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, আমার শোনার প্রয়োজন নেই। কৃষ্ণা বলে।
প্রসীদ দেবী! তুমি মুখ ভার করলে এ অভাজনকে নিজগৃহেই যে পরবাসী হতে হবে! ঘটনাটা সত্যিই রোমাঞ্চকর। শোনই না।
না–ও শোনায় আমার কোন লাভ নেই।
বল কি? আমাকে যারা ভালবাসে তারা শুনলে যে তোমায় ধিক্কার দেবে! কিরীটী-কাহিনী শুনতে চায় না এমন মতিচ্ছন্ন যার হয়েছে তাকে—
সেই তো একঘেয়ে ব্যাপার। হয় টাকাপয়সা না হয় প্রতিহিংসা–না হয় কোন এক স্ত্রীলোকের বা পুরুষের প্রেমের জ্বালা। বিয়ে হওয়া অবধি তোমার মুখে ঐসব শুনতে শুনতে।
থাক্ গিয়ে। তা ও ছাড়া আর ক্রাইম জগতে কি আছে বল? পাপিষ্ঠ–পাপিষ্ঠার দল ঐ পাকচক্রেই ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে যে অহরহ!
সুব্রত হাসছিল। এবারে বললে, নে, বল্ শুনি তোর এক্স আর্মি অফিসারের নিধন ব্যাপারটা!
তুইও সুব্রত দাউ টু ব্রুটাস! তুইও ব্যাপারটাকে লাইট করে নিচ্ছিস?
কিন্তু ব্যাপারটা বলবি তো?
কিরীটী অতঃপর সমস্ত ব্যাপারটা সংক্ষেপে বিবৃত করে যায়।
সব শুনে সুব্রত বলে, এ তো মনে হচ্ছে—
কি, বল?
বিকৃত এক লালসার পরিণতি।
আমারও যেন মনে হচ্ছে তাই। কারণ লালসা বস্তুটা মানুষের অন্যতম রিপু হিসাবে–অর্থাৎ নারী–পুরুষের চরিত্রের অচ্ছেদ্য এক ধর্ম, ওটা বাদ দিয়ে মানুষ যেমন কোন যুগেই চলতে পারেনি এ যুগেও পারবে না, এবং ভবিষ্যতেও বোধ হয় কখনও পারবে না।
কথাটা শেষ করল সুব্রত, তাই খুনখারাপি হবেই। কিন্তু গগনবিহারীর অমন মতিচ্ছন্ন হল কেন?
আরে প্রৌঢ় ও বৃদ্ধের দলই তো ঐ ধরনের বিকৃত লালসার বড় ভিকটিম হয়!
কিন্তু একটা ব্যাপারে কেমন যেন আমার খটকা লাগছে কিরীটী! সুব্রত বললে।
ঐ অ্যালসেসিয়ান কুকুরটা তো?
হ্যাঁ। হত্যাকারী কুকুরটাকে ম্যানেজ করল কি করে?
সে আর এমন দুরূহ ব্যাপার কি! আগে থেকেই হয়ত কুকুরটাকে সরিয়ে ফেলেছিল কৌশলে। তবে এও ঠিক, শেষ পর্যন্ত হয়ত ঐ কুকুরটাই হবে তার মৃত্যুবাণ। ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস বলতে বলতে উঠে গিয়ে কিরীটী অরূপকে ফোনে ডাকল।
বালীগঞ্জ থানার ও. সি. কথা বলছি–সাড়া এল অপর প্রান্ত থেকে।
অরূপ–আমি কিরীটী। একটা কথা তখন তোমাকে তাড়াতাড়ি বলতে ভুলে গিয়েছি—
কি কথা?
একজন ভেটানারী সার্জেনকে দিয়ে কুকুরটাকে একবার পরীক্ষা করবার ব্যবস্থা করতে পার?