তাই নাকি?
হ্যাঁ।
ঐ সময় রুক্মিণী এসে ঘরে ঢুকল।
ছিপছিপে দেহের গড়ন, দেহে যৌবন যেন কানায় কানায় উপচে পড়ছে। দেহের প্রতিটি ভাঁজ, প্রতিটি ঢেউ স্পষ্ট, মুখর। বেশভূষা আদৌ দেহাতী স্ত্রীলোকদের মত নয় বরং অনেকটা শহরের আধুনিকাঁদের মত। মাথায় সামান্য ঘোমটা।
ঐ ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় মুখোনা। মুখোনা একটু ভোঁতা-ভোঁতা হলে কি হবে, দুটি চোখ যেন চকিতপ্রেক্ষণা! ইঙ্গিতপূর্ণ!
পাতলা দুটি ঠোঁটে ও ধারালো চিবুকে যেন একটা চাপা হাসির ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
অরূপ জিজ্ঞাসা করে, কি নাম তোর?
রুক্মিণী।
চাপা হাসির ঢেউটা যেন কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সারাটা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। আরও স্পষ্ট হল।
তোর মরদ রামদেও কোথায়?
হায় রাম! আমি কি করে জানব?
তুই জানবি না তো জানবে কে? তোরই তো জানবার কথা! তোর মরদ!
কে জানে, হয়তো বাজারে গিয়েছে।
এত সকালে বাজারে?
আর কোথায় যাবে তবে?
তা বাজারে গেলে এখনও ফিরছে না কেন?
আমি কি করে জানব?
জানিস না?
না।
এখানে তুই কি কাজ করিস? কি করতে হয় তোকে?
কিছুই করি না। আবার সেই চাপা হাসির ঢেউ ছড়িয়ে গেল দুই ওষ্ঠে ও চিবুকে।
কিছুই করিস না?
না।
বসে থাকিস?
বসে থাকব কেন?
তবে? কাজ করিস না তো কি করিস সারাদিন? মাইনে দিত না তোকে তোর সাহেব?
মাইনে–বলতে বলতে গলার সেই চাপা হাসির ঢেউ সারা মুখে ওর ছড়িয়ে পড়ল। বললে, , তবে সাহেব এখানে থাকতে দিত, জামাকাপড় খাওয়া দিত আর মধ্যে মধ্যে দু-চার টাকা বকশিশ দিত।
বকশিশ! হ্যাঁ।
গয়না দিত না?
একটা হার দিয়েছে–আবার সেই চাপা হাসির ঢেউ ছড়িয়ে গেল মুখে।
শুনলাম সাহেবের ঘরেই তুই সব সময় থাকতিস?
সাহেব ডাকলে আসতাম।
কখন ডাকত সাহেব? সন্ধ্যেবেলা?
হ্যাঁ, ডাকত।
রামদেও তোর মরদ জানত যে তুই সাহেবের ঘরে আসতিস?
না।
জানত না? সে তো পাশের ঘরেই থাকত।
ওকে তো প্রায়ই সাহেব ঐ সময়টা এটা ওটা আনতে পাঠাতো—
আর সেই সময়ই বুঝি ডাকত তোকে তোর সাহেব?
আবার সেই হাসির ঢেউ সারা মুখে ছড়িয়ে গেল।
সাহেব তোকে খুব পছন্দ করত বুঝি?
বোধ হয়।
কেন, জানিস না?
আবার সেই চাপা হাসির ঢেউ সারা মুখে ছড়িয়ে গেল।
তুই তাহলে লুকিয়ে লুকিয়ে তোর স্বামীকে না জানিয়ে তোর সাহেবের ঘরে আসতিস বল?
হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী হাতের বাহারে রেশমী চুড়িগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে, তোর হাতের ঐ চুড়িগুলো তোকে তোর সাহেব কিনে দিয়েছিল বুঝি?
না তো! ও তো আমার মরদ কিনে দিয়েছে!
কবে?
এই তো সেদিন।
কাল রাত্রে বাইরের সেই দিদিমণি তোর সাহেবের কাছে এসেছিল, জানিস?
জানি তো।
কখন চলে যায় জানিস সেই দিদিমণি?
অনেক রাতে।
কখন?
আমি কি ঘড়ি দেখতে জানি?
তুই তখন কোথায় ছিলি?
আমার ঘরে।
আর রামদেও?
সে নীচে ছিল।
নীচে? হ্যাঁ
হ্যাঁ, ও ঐ সময়টা দারু পিত।
দারু? কোথায় পেত দারু?
সাহেবের আলমারি থেকে সরাত। আমিও নিয়ে দিতাম–মধ্যে মধ্যে—
সাহেব টের পেত না?
পাবে কি করে–চাবি তো ওর কাছেই থাকত দারুর আলমারির!
খুব দারু খেত বুঝি রামদেও?
মাঝে মাঝে খুব পিত। মাতোয়ালা হয়ে যেত।
কাল রাত্রে কোন গোলমাল বা চেঁচামেচি শুনেছিলি তোর সাহেবের ঘরে?
না।
কেন, তুই পাশের ঘরেই তো থাকিস?
কাল রাত্রে আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল–ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
অতঃপর বাকি ছিল দারোয়ান জানাল সিং। তাকেও কিছু প্রশ্ন করে ওদের তখনকার মত কাজ শেষ হল।
» ০৭. মৃতদেহ মর্গে পাঠিয়ে
মৃতদেহ মর্গে পাঠিয়ে কিরীটীর নির্দেশমত সুবীর সুবিনয় বাহাদুর প্রিয়লাল ও অন্যান্য ভৃত্যদের আপাততঃ পুলিসের বিনানুমতিতে বাড়ি ছেড়ে কোথাও না যেতে বলে বাড়িটা পুলিস পাহারায় রেখে অরূপ ও অন্যান্য সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে এল।
কিরীটী আর যোগজীবন পাশাপাশি হাঁটছিল।
সান্যাল মশাই!
বলুন!
শমিতা দেবীকে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই, অবিশ্যি যদি আপনার আপত্তি না থাকে?
আপত্তি হবে কেন? বলব শমিকে—
আমি বিকেলের দিকে যাব আপনার ওখানেই–উনি যদি সে সময় থাকেন!
বলে দেব থাকতে ঐ সময়।
যোগজীবনকে কিরীটীর মনে হল যেন বেশ কেমন একটু অন্যমনস্ক।
তাহলে এবারে আমি চলি–বলে কিরীটী উল্টোদিকে বাড়াতেই যোগজীবন ডাকেন, রায় সাহেব!
কিরীটী ঘুরে দাঁড়াল, কিছু বলছিলেন?
হ্যাঁ–একটা কথা!
বলুন?
আচ্ছা আপনি কি গগনের হত্যার ব্যাপারে আমার বোন শমিকে কোন রকম সন্দেহ করছেন?
দেখুন সান্যাল মশাই, ওকে আমি দেখিনি আজ পর্যন্ত–তবে আপনাদের সকলের মুখ থেকে যেটুকু জানতে পারলাম তাতে করে–
কি রায় সাহেব?
তার চরিত্রে কিছুটা স্বেচ্ছাচারিতা ও উজ্জ্বলতা আছেই।
না না–সে রকম যা আপনি ভাবছেন তেমন কিছু নয়। ক্লাব নিয়ে হৈচৈ করে, একটু-আধটু ড্রিঙ্ক করে ঠিকই, কিন্তু সে সত্যিই সেরকম উচ্ছল প্রকৃতির বলতে যা বোঝায় সে ধরণের মেয়ে নয়। তাছাড়া আজকালকার দিনে ওরকম তো প্রায়ই দেখা যায় বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে।
আপনি কিছু ভাববেন না সান্যাল মশাই–সত্যিই গতরাত্রের ব্যাপারের সঙ্গে যদি তার কোন সম্পর্ক না থাকে তো কেউ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আর একটা কথা–
কি?
আপনি যদি চান তো আমি আপনার বন্ধুর হত্যার ব্যাপার থেকে একেবারে সরে দাঁড়াতে পারি!
না, না–তার কোন প্রয়োজন নেই। দৈবক্রমে ঘটনাচক্রে যখন আপনি ব্যাপারটার মধ্যে গিয়েই পড়েছেন, আপনার করণীয় অবশ্যই আপনি করবেন।