কথাটা সুবিনয় শেষ করল একবার আড়চোখে কিরীটীর পার্শ্বে উপবিষ্ট যোগজীবনের দিকে তাকিয়ে।
অত রাত্রে শমিতা দেবী এসেছিলেন।
হ্যাঁ, প্রায়ই তো আসতেন। তবে ইদানীং হপ্তাখানেক আসছিলেন না, মামাও বের হতেন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে দেখছিলাম।
শমিতা দেবী কে? অরূপ প্রশ্ন করল।
যোগজীবনবাবুর বোন!
অরূপ যোগজীবনবাবুর মুখের দিকে তাকাল।
যোগজীবনবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমার বোন। গগন ওকে ছোটবেলা থেকেই চিনত। তাছাড়া শমিতাদের মরালী সঙেঘর পেট্রোন ছিল গগন।
গগনবাবুর সঙ্গে আপনার অনেক দিনের পরিচয় বলুন তাহলে?
হ্যাঁ, দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব আমাদের পরস্পরের।
আচ্ছা, শমিতা দেবী বিবাহিত, না অবিবাহিত?
জবাবটা দিল সুবিনয়ই, বিবাহ করেছিলেন তবে বছর দুই আগে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। মামাবাবুর সঙ্গে বেশ ভাল পরিচয়ই ছিল শমিতা দেবীর।
তা কখন শমিতা দেবী চলে যান আবার রাত্রে?
বলতে পারি না। আমি ঘুমোবার পর হয়তো চলে গিয়েছিলেন। বাহাদুর বলছিল—
কি বলছিল?
রাত এগারোটা নাগাদ নাকি কাল গিয়েছিলেন শমিতা দেবী।
আপনি জানতে পারেননি কখন গিয়েছেন?
না।
আপনি তাহলে জানতেই পারেননি কখন শমিতা দেবী চলে গেলেন? কিরীটীই প্রশ্নটা করে আবার।
না।
আচ্ছা সুবিনয়বাবু–
বলুন।
আপনার মামার একমাত্র ছেলে তো বিলেতেই সেটে। শুনেছিলাম আর ফিরবে না?
সেই রকমই শুনেছি।
আপনার মামাকে তাঁর সম্পর্কে কখনও কিছু বলতে শুনেছেন?
না।
তিনি চিঠিপত্র লিখতেন না তাঁর বাবাকে?
না, শুনিনি কখনও।
তাহলে তো দেখা যাচ্ছে গগনবাবুর যা কিছু আছে, এই বাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তি টাকাকড়ি সব কিছুর ওয়ারিশন আপনি ও সুবীরবাবুই?
তা আমি কি করে বলব, কাকে তিনি সব কিছু দেবেন বা না দেবেন!
উইল-টুইল কিছু করেছিলেন?
মাসখানেক আগে শুনেছি উইল করেছিলেন মামাবাবু।
কার কাছে শুনলেন?
সুবীরদার মুখে।
তিনি কেমন করে জানলেন কথাটা?
জানি না।
জিজ্ঞাসা করেননি?
না।
অরূপ, সুবিনয়বাবুকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবে?
আপাত না। আপনি সুবিনয়বাবু এখন যেতে পারেন। সুবীরবাবুকে পাঠিয়ে দিন এ ঘরে। সুবিনয় চলে গেল, আর একটু পরেই সুবীর এসে ঘরে ঢুকল।
অরূপই প্রশ্ন শুরু করে, সুবীরবাবু, কাল রাত্রে শুনলাম আপনি এ বাড়িতে ছিলেন না!
না।
কোথায় গিয়েছিলেন?
এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে বেলগাছিয়ায় গিয়েছিলাম। রাত্রে ফিরতে পারিনি। সকালে ফিরেই তো ব্যাপারটা জানতে পারলাম।
কিরীটী ঐ সময় বলে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে বোধ হয় থানায় ফোন করেন!
ঠিক তখুনি ফোন করিনি, কিছুক্ষণ বাদে করি।
আচ্ছা সুবীরবাবু, শমিতা দেবীকে আপনি চিনতেন?
চিনতাম বৈকি। তিনি তো এখানে কাকার কাছে প্রায়ই সন্ধ্যায় আসতেন!
দিনের বেলায় আসতেন না?
হ্যাঁ, আসতেন।
আপনার কখনও কোন কৌতূহল হয়নি, কেন ঘন ঘন শমিতা দেবী আপনার কাকার কাছে আসতেন!
শুনেছিলাম ওঁদের ক্লাবের উনি পেট্রোন একজন। তা ছাড়া ওঁদের দীর্ঘদিনের পরিচয়।
দুজনের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাই না?
সুবীর ইতস্ততঃ করে। কিরীটীর পার্শ্বে উপবিষ্ট যোগজীবনের দিকে তাকায়।
বলুন না। ওঁকে দেখে কোন সংকোচের আপনার কারণ নেই। যা বলতে চান বলুন!
আপনি যখন বললেন বলতে বলছি, ওর বন্ধু–আমার পূজনীয় কাকা, তা হলেও বলব তাঁর অল্প বয়সের স্ত্রীলোকদের ওপরে কেমন একটা দুর্বলতা ছিল, প্রশ্রয় ছিল।
আপনার চোখে কখনও কিছু পড়েছে?
না।
তবে? একথা আপনার মনে হয়েছিল কেন?
চোখে না পড়লেই কি সব কথা সব সময় অস্বীকার করতে পারি আমরা! সুবীর বললে।
তা অবিশ্যি ঠিক। তবু বুঝতেই পারছেন আমি আর একটু স্পষ্ট করে শুনতে চাই কথাটা আপনার মুখ থেকে!
সুবীর এবারে একধারে একটা বুক–কেসের উপরে সাজানো ম্যাগাজিনগুলো দেখিয়ে বলে, ঐ ম্যাগাজিনগুলো একবার উল্টেপাল্টে দেখুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। সব নৃড় পিকচার্সে ভর্তি–সর্বক্ষণই ঐসব নিয়ে মশগুল থাকতেন কাকা!
কিরীটী উঠে গিয়ে সযত্নে রক্ষিত ম্যাগাজিনের থাক থেকে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে সেটা পুনরায় যথাস্থানে রেখে দিয়ে সোফায় এসে বসল।
দেখলেন!
হ্যাঁ। সব ম্যাগাজিনগুলোই অমনি জানলেন কি করে আপনি? আপনিও নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে আপনার কাকার অ্যাবসেন্সে ম্যাগাজিনগুলো উল্টেপাল্টে দেখেছেন! তাই কি?
না। ওসব নোংরা জিনিস আমি হাতে ধরি না।
০৬. কিরীটী সুবীরের কথায় মৃদু হাসল
কিরীটী সুবীরের কথায় মৃদু হাসল।
আচ্ছা সুবীরবাবু, ঐ শমিতা দেবী ও তাঁর ক্লাবের ব্যাপার এবং ঐ ম্যাগাজিনগুলো ছাড়া আর কখনও কিছু আপনার কাকার ব্যাপারে চোখে পড়েছে?
কেন, ঐ যে রামদেওর যুবতী তৃতীয় পক্ষের বৌটা! সে তো সব সময়ই এ ঘরে থাকত শুনেছি!
কিরীটী আবার মৃদু হাসল।
এসব কারণে আপনি মনে হচ্ছে আদৌ আপনার কাকার উপরে সন্তুষ্ট ছিলেন না!
সুবীর কিরীটীর কথার কোন জবাব দেয় না।
ভাল কথা, সুবিনয়বাবু বলছিলেন, আপনি নাকি তাঁকে বলেছিলেন আপনার কাকা উইল করেছেন?
শুনেছি।
আপনিও শুনেছেন?
হ্যাঁ, শোনা কথা আমারও।
কার কাছে শুনলেন?
রামদেওই বলেছিল।
রামদেও মানে সেই চাকরটা?
হ্যাঁ।
তার সঙ্গে আপনার খুব কথাবার্তা হত, তাই না সুবীরবাবু?
মানে?
তার মুখ থেকেই সব খবরাখবর উপরের তলার নিতেন আপনি?
ও ধরণের প্রবৃত্তি আমার নেই।
কিরীটী আবার মৃদু হাসল। তারপর বললে, ঠিক আছে। আপনার উপরে কাকার মনোভাবটা কেমন ছিল?