চকচকে বস্তুটি কোনমতে বদ্ধ মুঠি থেকে বের করতে গিয়ে ভেঙে গেল। কিরীটী সেই ভাঙা বস্তুটি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। একবার দেখল ভাল করে জিনিসটা কি? ঠিক বুঝতে পারল না।
অরূপ পাশেই দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল, জিজ্ঞাসা করল, কি ওটা মিঃ রায়?
মনে হচ্ছে একটা ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরো।
ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরো!
তাই তো মনে হচ্ছে।
কিরীটী রেখে দিল পকেটের মধ্যে ভাঙা চুড়ির টুকরোটা।
হাতের মুঠোর মধ্যে কোথা থেকে এল ওটা?
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, হয়তো কোন পলাতকা প্রেয়সীর চিহ্ন রয়ে গিয়েছিল ভদ্রলোকের হাতের মুঠোর মধ্যে।
কি বলতে চান মিঃ রায়?
কিরীটী কিন্তু অরূপ মুখার্জীর সে প্রশ্নের কোন জবাব দিল না। সে তখন ঘরের চারদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে।
ঘরটা বেশ বড় সাইজের। দক্ষিণ ও উত্তরমুখী দুটো দুটো করে বড় সাইজের ডবল পাল্লার জানালা, জানালার গ্রিলস বসানো। ঘরের সংলগ্ন বাথরুম। ঘরে দুটো দরজা, একটা পাশের ঘরে যাবার তার মধ্যে।
কিরীটী বাথরুমের মধ্যে গিয়ে ঢুকল ঘর থেকে। ইটালিয়ান টাইলস দিয়ে বাথরুমের দেওয়ালের অধের্কটা মোড়া, মেঝে মোজাইকের। মস্ত বড় একটা বাথটব। আয়না বসানো দেওয়ালে। আয়নার নীচে কাচের সেল। সেলফের উপরে সেভিং সেটস্ সেভিং ক্রিম, ব্রাস, টুথপেস্ট, টুথব্রাস, টাংগ ক্লিনার, চিরুনি ও ব্রাস, সেভিং লোসন, ল্যাভেণ্ডার স্প্রে, নেইল কাটার সযত্নে সাজানো।
সবই পরীক্ষা করে দেখল কিরীটী-দামী ও বিলিতি। ব্লু রংয়ের একটা বেসিন। টাওয়েল র্যাকে ব্লু রংয়ের একটা টার্কিশ টাওয়েল এলোমেলো ভাবে ঝোলানো। টাওয়েলটা তুলে নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে নজরে পড়ল কিরীটীর, ফিকে লালচে অনেকটা ব্রাউন রংয়ের ছোপ ছোপ দাগ টাওয়েলের মধ্যে।
কিরীটী ঝুঁকে পড়ে বেসিনটা দেখতে লাগল। বেসিনের কলটা ভাল করে বোধ হয় টাইট করা নেই, ক্ষীণধারায় জল পড়ে যাচ্ছিল তখনও।
বেসিনের সাইডে সাবান রাখবার জায়গায় সাবানটাও ঠিকভাবে রাখা নেই মনে হয় যেন। সাবানটা তুলে নিয়ে ঝুঁকে দেখল কিরীটী, দামী গন্ধওয়ালা সাবান। সাবানটাও বিলিতি মনে হয়।
বাথরুমের ফ্লোরে এখানে ওখানে জল তখনও জমে আছে। ব্র্যাকেটে একটা ড্রেসিংগাউন ঝুলছে।
পুনরায় কাচের সেলফটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে হঠাৎ কিরীটীর নজরে পড়ল মাথার চিরুনির গায়ে কয়েকটা বড় বড় চুল আটকে আছে।
চিরুণি থেকে চুলগুলো ছাড়িয়ে একটা কাগজে মুড়ে কিরীটী পকেটে রেখে দিয়ে বাথরুম থেকে বের হতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
বাথরুমে মেথরদের যাতায়াতের যে দরজাটা তার পাল্লা দুটো ভেজানো থাকলেও ভিতর থেকে খিল দেওয়া নেই। খোলা।
কিরীটী দরজার পাল্লা দুটো টেনে খুলতেই নজরে পড়ল ঘোরানো লোহার সিঁড়িটা। ঐ সিঁড়িই মেথরদের বাথরুমে আসা-যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
বাথরুমের দরজাপথেই কিরীটীর নজরে পড়ে বাড়ির পিছনদিকে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা, ঘাস ও আগাছায় ভর্তি। দুরে প্রাচীর ঘেঁষে একেবারে ছোট একটা ঘর।
চারিদিকে দেখে কিরীটী দরজাটা টেনে দিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল আবার। ঘরের চারিদিক নজর করে আবার দেখে, একটা দামী সিঙ্গল খাট, একটা গোদরেজের আলমারি, ওয়ারড্রোব, তার উপরে একটা বুদ্ধমূর্তি ও একটা কাঠের হাতী।
অরূপ!
কিছু বলছিলেন? কিরীটীর ডাকে ওর দিকে তাকাল অরূপ কথাটা বলে।
তোমার সব জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে?
না।
তাহলে শুরু করে দাও!
আপনি এখন চলে যাবেন?
না। তোমার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হোক, তারপর যাব।
তাহলে চলুন পাশের ঘরে যাওয়া যাক।
ডেড বডি সরাবার ব্যবস্থা করেছ?
করেছি, ফোন করে দিয়েছি।
পাশের ঘরে এসে সকলে বসল। ওটাই বসবার ঘর। চমৎকার ভাবে সাজানো। একপাশে ফোনও আছে।
যোগজীবনবাবু কাঁদছিলেন। চোখ দুটো তাঁর লাল হয়ে উঠেছিল। কিরীটী যে সোফাটায় বসে, যোগজীবনবাবু সে সোফাতেই কিরীটীর পাশ ঘেঁষে বসলেন।
রায় সাহেব! যোগজীবনবাবু রুদ্ধ গলায় ডাকলেন।
বলুন?
এ কি হল বলুন তো! গগনকে এমন নিষ্ঠুরভাবে কে হত্যা করল? যোগজীবন যেন কান্না রোধ করতে পারছিলেন না।
আমি বুঝতে পারছি সান্যাল মশাই, বন্ধুর মৃত্যুতে খুব শ হয়েছেন, তবে—
কি তবে?
ওঁর মৃত্যুর–মানে অপঘাত মৃত্যুর জন্য আমার মনে হচ্ছে যেন উনিই দায়ী?
গগন নিজে দায়ী?
তাই তো আপাততঃ মনে হচ্ছে আমার।
কেন?
কিরীটীর জবাবটা আর দেওয়া হল না, সুবিনয় এসে ঘরে ঢুকল।
অরূপ সুবিনয়ের দিকে তাকিয়ে বললে, বসুন সুবিনয়বাবু।
সুবিনয় বসল।
আপনিই তো প্রথম দেখেন মৃতদেহ, তাই না?
না মিঃ মুখার্জী, আমি না, বাহাদুর। সে-ই প্রথমে দেখে, দেখে আমাকে ডেকে আনে।
হুঁ। কাল রাত্রে আপনি তো বাড়িতেই ছিলেন?
হ্যাঁ। কাল শনিবার ছিল, বেলা চারটে নাগাদ অফিস থেকে ফিরে আসি, তারপর আর বের হইনি। নীচে নিজের ঘরেই ছিলাম।
কখন শুতে যান?
আমার বরাবর একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়াই অভ্যাস রাত্রে। দশটা নাগাদ শুয়ে পড়েছিলাম।
আর সুবীরবাবু?
সে বিকেলেই সেজেগুঁজে বের হয়ে গিয়েছিল, আজ সকালে ফিরেছে। রাত্রে বাড়িতে ছিল না।
আর আপনার মামা গগনবাবু? তিনি কাল বের হননি কোথাও?
মামাও কাল বের হননি।
কেউ তাঁর কাছে এসেছিল?
হ্যাঁ। রাত তখন বোধ করি সাড়ে নটা কি পৌনে দশটা হবে–ঠিক সময়টা মনে নেই, আমার খাওয়া হয়ে যাবার পরই শমিতা দেবী এসেছিলেন।