যোগজীবন কিছু বললেন না।
দুজনে এগিয়ে গিয়ে গাড়িবারান্দায় উঠল।
ভৃত্য রতন ও বাহাদুর সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। যোগজীবনকে দেখে বাহাদুর সেলাম দিল, বাবুজী!
বাহাদুর?
সাব চলা গিয়া বাবুজী! বাহাদুরের গলায় কান্নার আভাস। চোখে জল।
কেইসে হুঁয়া কুছ পাতা মিলা বাহাদুর?
নেহি বাবুজী, আভিতক সমঝ মে নেহি আতা হ্যায় এইসা কেইসে হো সেকতা!
তুমি তো কাল রাত্রে বাড়িতে ছিলে?
জী।
রামদেও-ও কিছু জানে না? সেও কিছু বলতে পারছে না? যোগজীবন আবার প্রশ্ন করলেন।
রামদেকো পাতাই নেহি মিলতা বাবুজী সুবেসে!
কেন, সে কোথায় গিয়েছে?
কা জানে কিধার গিয়া, আভিতক নেহি লৌটা।
ওর বৌজেনানা কোথায়?
উপরমে হ্যায়।
ওর বৌ তো পাশের ঘরেই থাকত, সেও কিছু বলতে পারছে না?
নেহি বাবুর্জী, বেচারী রোতা হ্যায় শুনকর।
কিরীটী ঐ সময় প্রশ্ন করে, রামদেওর বৌ এখানে থাকত নাকি?
হ্যাঁ। বেটার তৃতীয় পক্ষের বৌ, কিছুদিন হল এসেছে এখানে।
বয়স তো তাহলে খুব অল্প?
হ্যাঁ, মোল-সতের হবে।
দেখতে কেমন?
দেখতে মোটামুটি ভালই।
চলুন উপরে যাওয়া যাক, কিরীটী বললে।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে বারান্দায় পৌঁছতেই সুবীরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
এই যে স্যার, আপনি এসে গিয়েছেন, যান ভিতরে গিয়ে দেখুন, কাকা কথাটা শেষ করতে পারে না সুবীর, কান্নায় যেন তার গলাটা বুজে আসে।
কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুবীরকে দেখছিল।
বেশ সুন্দরই চেহারা, তবে রোগা। গায়ের রং সুবীর বংশের ধারা অনুযায়ীই পেয়েছিল। রীতিমত ফসা। মাথাভর্তি চুল ব্যাকব্রাস করা, তারই মধ্যে দু-একটা রূপালী চুল চোখে পড়ে। চোখ দুটি বড় বড়, টানা টানা। উন্নত নাসা। ধারালো চিবুক। চোখে সৌখীন ফ্রেমের চশমা।
পরনে পায়জামা ও পাঞ্জাবি। ইতিমধ্যে সুবীর বাইরের বেশ বদলে ফেলেছিল।
কিরীটীই প্রশ্ন করে, বাইরে পুলিস দেখলাম, থানার ওসি এসেছে বোধহয়?
হ্যাঁ, মিঃ মুখার্জী।
অরূপ, না?
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সুবিনয় বাইরে এল ঐ সময় ঘর থেকে।
রায় সাহেব—এই সুবিনয়, গগনের ভাগ্নে।
কিরীটী তার অনুসন্ধানী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি একবার বুলিয়ে নেয় সুবিনয়ের সর্বাঙ্গে।
বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। গায়ের রংটা একটু চাপা। মাথার চুল রুক্ষ, বিস্রস্ত। চোখেমুখে একটা দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতার ছাপ পড়েছে যেন। পরনে একটা লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত।
আপনি এসেছেন! যোগজীবনের দিকে তাকিয়ে বলে সুবিনয়, যান ভিতরে যান, থানা-অফিসার ভেতরেই আছেন। কথাটা বলে সুবিনয় সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকায়।
কিরীটী যোগজীবনকে বললে, চলুন সান্যাল মশাই, ভেতরে যাওয়া যাক।
হ্যাঁ, চলুন।
দুজনে এগিয়ে গেল।
০৫. মৃতদেহ পরীক্ষান্তে অরূপ মুখার্জী
মৃতদেহ পরীক্ষান্তে অরূপ মুখার্জী তখন ঘরের চারদিকে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিল। যোগজীবন আগে ও পরে কিরীটী ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল।
পদশব্দে চোখ তুলে তাকাতেই অরূপের সঙ্গে কিরীটীর চোখাচোখি হল, অরূপের চোখের তারা দুটো যেন আনন্দে চকচক করে ওঠে।
মিঃ রায়, আপনি!
নতুন থানায় বদলি হয়ে এসে অরূপ কিরীটী তার এলাকাতেই আছে জানতে পেরে নিজেই একদিন গিয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আলাপ করে এসেছিল।
কাজেই পরস্পর পরস্পরের কাছে তারা অপরিচিত নয়।
কিরীটী যোগজীবনকে দেখিয়ে বললে, হ্যাঁ অরূপ, উনি আসবার সময় আমায় ধরে নিয়ে এলেন, ফোনটা যখন যায় আমি ওঁর ওখানে বসে চা খাচ্ছিলাম।
খুব ভাল হয়েছে আপনি এসেছেন। কিন্তু উনিওঁর পরিচয়? অরূপ যোগজীবনকে দেখিয়ে প্রশ্ন করল।
যোগজীবন সান্যাল, রিটায়ার্ড লাইফ লিড করছেন। কাছাকাছিই বাড়ি। গগনবিহারীর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আই সি! আপনাকে বুঝি ফোনে সংবাদ দিয়েছিল কেউ? যোগজীবনকে প্রশ্ন করে অরূপ।
হ্যাঁ। ফোন পেয়েই তো আসছি।
কে ফোন করেছিল?
সুবীর, গগনের ভাইপো।
কিরীটী ইতিমধ্যে ভূপতিত মৃতদেহটার সামনে এগিয়ে গিয়েছিল।
মৃতদেহের সামনে তখন জ্যাকি বসে আছে।
সে তাকালও না। পৃষ্ঠদেশে ছোরাটা আমূল বিদ্ধ হয়ে আছে। খানিকটা বাঁদিক ঘেঁষে ছোরাটা বিদ্ধ করা হয়েছে। বোঝা যায় ঐ ছুরিকাঘাতেই সম্ভবতঃ মৃত্যু হয়েছে গগনবিহারীর।
একটু দুরে দামী খাট, উপরে আধুনিক ডিজাইনের শয্যা, শয্যার চাদর এলোমেলো, বালিশ দুটোও যথাস্থানে নেই। খাটের নীচে খানিকটা জায়গা জুড়ে মেঝেতে দামী একটা কার্পেট বিছানো, বাকি মেঝেটায় কোন কার্পেট নেই।
সাদা কালো ডিজাইনের মোজাইক টাইলসয়ের মেঝে ঘরে। ঝকঝকে পরিষ্কার মেঝে। খাটের হাত পাঁচেক দূরে মৃতদেহটা উত্তর-দক্ষিণ ভাবে কোণাকুণি পড়ে আছে।
বড় সাইজের মিরার বসানো একটা গড়রেজের স্টীলের আলমারির গা ঘেঁষে।
কিরীটী নীচু হয়ে বসল মৃতদেহের সামনে। চোখেমুখে মৃতদেহের যেন একটা সুস্পষ্ট যন্ত্রণার চিহ্ন অঙ্কিত হয়ে আছে।
বুকের ছোরাবিদ্ধ রক্তাক্ত ক্ষতস্থান ছাড়া মৃতের ডানদিককার গালে একটা সরু লম্বা ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়ল, ডান হাতটা মৃতের মুঠো করা।
হাতের পাতায় খানিকটা রক্ত জমে আছে কালো হয়ে।
কিরীটী মৃতদেহের বদ্ধ মুঠি খোলবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। কি যেন একটা চকচক করছে মুঠির মধ্যে, ওর নজরে পড়ে। রাইগার মর্টিস সেট ইন করেছিল মৃতদেহে।