কতক্ষণ আমন অবস্থায় ছিলেন?
রাত্রি একটার পর আমি ঘুমাই, তখন পর্যন্ত ওই অবস্থায়ই ছিলেন। শেষের দিকে ঘুমের ওষুধ দেওয়ায় বোধ করি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
কে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল?
আমার ভাই শশাঙ্ক ডাক্তার। সে-ই দিয়েছিল।
রাত্ৰি কটা পর্যন্ত আপনার ভাই আপনাদের শয়নকক্ষে ছিলেন?
তীব্র দৃষ্টিতে রাণীসাহেবা কিরীটীর দিকে তাকালেন, পরে শান্ত স্বরে বললেন, তা রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত হবে। তার পর তাকে আমি একপ্রকার ঠেলোঁঠুলে শুতে পাঠাই।
সে রাত্রে আপনার ভাই শুতে যাওয়ার পর, যতক্ষণ আপনি জেগে ছিলেন, আপনাদের শয়নকক্ষে কোনরকম অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলেন বলে আপনার মনে হয়?
না।
সে রাত্রে কখন আপনার ঘুম ভাঙে?
শেষ রাত্ৰে।
তখন রাজবাহাদুর জেগে ছিলেন?
হ্যাঁ, জেগে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন।
হঠাৎ কিরীটী রাজাবাহাদুরের দিকে তাকিয়ে একটি অদ্ভুত অনুরোধ জানাল, রাজাবাহাদুর, আর একটি অনুরোধ আপনার কাছে আমার আছে।
বলুন।
আমি রাণীসাহেবকে একাকী কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই অর্থাৎ এ ঘরে আমি ও রাণীসাহেবা ছাড়া আর তৃতীয় কেউ থাকবে না।
বেশ তো, করুন। রাজাবাহাদুর উঠে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ ভাবে কিরীটী বসে রইল। ঘরের মধ্যে অখণ্ড স্তব্ধতা। ইতিমধ্যে সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে ঘরখানি অবলুপ্ত হয়েছিল। কিরীটী উঠে পকেট থেকে দেশলাই বের করে ফস করে সামনের শ্বেতপাথরের টেবিলের ওপরে রক্ষিত মোমবাতিটা জ্বালাল। নিমেষে। ঘরের অন্ধকার দূরীভূত হল।
রাণীসাহেবা মাথা নীচু করে বসে ছিলেন। কিরীটী রাণীসাহেবার দিকে একবার তাকিয়ে প্রশ্ন করল, রাণীসাহেবা, আপনার স্বামী কি সেদিনকার মত আর কখনও পূর্বে অসুস্থ হয়েছিলেন?
রাণীসাহেবা কিরীটীর দিকে চোখ তুলে চেয়েই, আবার দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন।
না।
এর আগে কখনও কোনদিনও আমনি অসুস্থ হন নি?
না।
আপনার ভাইয়ের পুরো নাম কি?
শশাঙ্কশেখর সান্যাল।
ডাঃ শশাঙ্কশেখর সান্যাল-আমি এক সান্যালকে জানি নামকরা ম্যাজিসিয়ান!
সেই ম্যাজিসিয়ানই আমার ভাই। আপনি তাকে চেনেন?
চিনি না, তবে দু-চারবার তাঁর মেসমেরিজম দেখেছি ইউনিভারসিটি ইনষ্টিটিউটে। তিনি একজন নামকরা বীণাবাদকও বটে, তাই না?
হ্যাঁ।
আপনার স্বামীও শুনেছি চমৎকার সেতার বাজান!
হ্যাঁ।
আচ্ছা, আপনি এবার যেতে পারেন রাণীসাহেবা।
***
পরের দিন সন্ধ্যার দিকে কিরীটী কলকাতায় চলে গেল। বলে গেল, দিন দুয়েকের মধ্যেই ফিরবে, এবং সত্যি-সত্যিই দিন দুই বাদে আবার ফিরে এল। মূর্তি প্রতিষ্ঠার আর মাত্র দুদিন বাকি আছে।
এসে শুনল রাণীসাহেবার ভাই ডাঃ সান্যালও এসেছেন।
দ্বিপ্রহরের দিকে রাজাবাহাদুরই স্বয়ং রাণীসাহেবার ভাইকে কিরীটীর ঘরে এনে আলাপ করিয়ে দিলেন। সুশ্ৰী চেহারা, দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরবর্ণ। বেজায় হাসি-খুশী ও আমুদে। কিরীটী ডাঃ সান্যালের সঙ্গে আলাপ করে মুগ্ধ হল।
কথায় কথায় কিরীটী ডাঃ সান্যালকে বললে, আপনার মেসমেরিজম করা দু-একবার আমি দেখেছি ডাঃ সান্যাল, আজ একবার দেখান না!
ডাঃ সান্যাল হাসতে হাসতে বললেন, বেশ তো, খাওয়াদাওয়ার পর হবে’খন আজি রাত্রেই। জামাইবাবু চমৎকার মিডিয়াম। চট্ট করে ওঁকে মেসমেরাইজ করা যায়।
তাই নাকি, রাজাসাহেব! আমিও এককালে যখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ি যাদুকর গণপতির কাছে মেসমেরিজম বিদ্যা শিক্ষা করেছিলাম।
সত্যি? আপনিও জানেন নাকি?
সামান্যই, তবে ভাল মিডিয়াম হলে কখনও কখনও কৃতকার্য হয়েছি।
***
রাত্রি তখন বোধ করি নটা সাড়ে নটা হবে।
ঠিক হল আগে কিছুক্ষণ গান-বাজনা হবার পর ম্যাজিক শুরু করা যাবে।
কিরীটীর ঘরেই সকলে সমবেত হয়েছেন; কিরীটী, রাজাবাহাদুর জ্ঞানদাশঙ্কর, ডাঃ সান্যাল ও রাণীসাহেবা মালতী দেবী।
প্রথমে সকলের অনুরোধে কিরীটী ব্যাঞ্জো বাজালে। সকলেই মুগ্ধ হল। তার পর রাজাবাহাদুর। তাঁরও বাজনার হাত চমৎকার।
সর্বশেষ পড়ল ডাঃ সান্যালের পালা। কিন্তু তিনি তার পার্শ্বস্থিত খাপে মোড়া প্রকাণ্ড বীণাখনির দিকে সন্দেহে একবার দৃষ্টিপাত করে সখেদে বললেন, আমার বীণার একটা অংশ গাড়িতে আসবার সময় ফেটে গেছে। আজ বীণা থাক। আপনাদের আজ আমি বঁশের বাঁশী শোনাব। ডাঃ বাঁশীতে সুর দিলেন। বাঁশীতেও তাঁর শক্তি অদ্ভুত। মূহুর্তের মধ্যে তিনি ঘরের মধ্যে অপূর্ব সুরের জাল সৃষ্টি করলেন সামান্য সেই বাঁশের বাঁশীতেই, বীণাখনি পাশেই পড়ে রইল। বাজানা থামবার পর আবার সকলের অনুরোধে ডাঃ সান্যাল বাঁশী তুলে নিলেন। এবার তিনি বাজালেন জয়-জয়ন্তী সুর। নিশীথের নিস্তব্ধতায় সামান্য বাঁশের বাঁশী থেকে যে সুরের ঝর্ণ প্রবাহিত হল তা সত্যই অপূর্ব।
বাজনা শেষ হতেই কিরীটী আচমকা উঠে দাঁড়াল, রাজাবাহাদুর, এবারে আমি আমার ম্যাজিক দেখাব। কিন্তু তার আগে আমি ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে রাখি। ঘরের মধ্যে এখন যাঁরা উপস্থিত আছেন, তাদের মধ্যে দুজন, কাকাবাবু ও ডাঃ সান্যাল, আপনাদের কাছেই বিশেষ করে আমার ক্ষমা চাওয়া; কেন যে ক্ষমা চেয়ে রাখছি, এর পর যা ঘটবে, সেটা থেকেই আপনারা দুজনে সহজেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু যাক সে কথা। রাজাবাহাদুর, আপনি আমার সামনে এসে বসে, আমার চোখের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে থাকুন তো। আমার চোখে একটা অদ্ভুত নীল আলো লুকানো আছে। ম্যাজিকের প্রভাবে সেটা সকলের দৃষ্টিগোচর করতে পারি। একে একে আমি সকলকেই দেখােব। শুরু হোক রাজাবাহাদুর থেকে।