- বইয়ের নামঃ প্রজাপতি রঙ
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১-০৫. আপনি বিশ্বাস না করলে
প্রজাপতি রঙ
০১.
আপনি বিশ্বাস না করলে কি করতে পারি বলুন! তবে জানবেন মাধবীকে আমি হত্যা করিনি।
হত্যা করেছেন তা কি আমি বলেছি হীরুবাবু? সুদর্শন মল্লিক মৃদু হেসে বলে, তা তো আমি বলিনি! তাছাড়া
সুদর্শন মল্লিক ঝানু ও.সি.। যেমন পালোয়ানের মত চেহারা তেমনি দুর্জয় সাহস।
চার-পাঁচজন ও.সি.-কে পর পর বদলি করার পর ডি.সি. নিজে বেছে বেছে তরুণ ও.সি-দের মধ্যে সুদর্শন মল্লিককেই শেষ পর্যন্ত ও তল্লাটের থানার ইনচার্জ করে বসিয়েছিলেন।
পোস্টিং অর্ডারটা দেবার সময় ডি.সি. বলেছিলেন সুদর্শন ইউ আর মাই চয়েস। ওই তল্লাটের দশ নম্বর পল্লীটাই আমি জানি যত রকম ক্রাইমের আড়া। যত রকমের চোরাইকারবার–কাছের রেলওয়ে ইয়ার্ড থেকে ওয়াগন ভেঙে হাজার হাজার টাকার মাল সরানো তো আছেই, সেই সঙ্গে বছরে চার-পাঁচটা খুন হবেই। অথচ আজ পর্যন্ত পুলিস ধরতেই পারল না কে বা কারা ওইভাবে খুন করেছে। আজ তিন বছরে পর পর পাঁচজন অফিসারকে ওখানে পোস্টিং করেছি, but none of them-তাদের মধ্যে কেউই ব্যাপারটার এতটুকু কোন হদিস করতে পারেনি। তাই আমার মনে হয়
কি স্যার?
একটা গ্যাং আছে ওই দশ নম্বর পল্লীর মধ্যে যারা ওই ক্রাইমের মূলে!
সুদর্শন বলেছিল, আমি চেষ্টা করব স্যার।
থানার চার্জ নিয়েই ওখানে এসে সুদর্শন পর পর কদিন দশ নম্বর পল্লীটার মধ্যে গিয়ে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে এসেছিল।
যাদের উপর তার সন্দেহ পড়েছিল, মনে মনে তাদের একটা লিস্টও তৈরি করে ফেলেছিল। এবং ঐ সন্দেহযুক্ত ব্যক্তিদের লিস্ট তৈরি করবার সময়ই হীরু সাহার উপর নজর পড়ে সুদর্শনের।
ব্যায়ামপুষ্ট তাগড়াই চেহারা হীরু সাহার। কাছেই যে জুটমিলগুলো আছে তারই একটায় চাকরি করে। বার-দুই স্কুল-ফাইন্যাল ফেল করে পড়াশুনোয় ইতি দিয়েছিল। বাড়িতে বিধবা মা আর ছোট একটি ভাই। পরনে সর্বক্ষণ টেরিলিনের প্যান্ট ও হাওয়াই শার্ট। মুখে সর্বক্ষণ সিগারেট। পল্লীর সবাই তাকে ভয় করে, সমীহ করে।
আলাপ করবার চেষ্টা করেছিল হীরু সাহার সঙ্গে একদিন সুদর্শন, কিন্তু হীরু সাহা পাত্তা দেয়নি। বলেছিল, অত খবরে আপনার দরকারটা কি স্যার! আমি কি করি, কখন বাড়ি ফিরি, কার কার সঙ্গে আমার দোস্তি—জানবার আপনার প্রয়োজনটা কি জানতে পারি কি?
সুদর্শন মল্লিক মৃদু হেসেছিল, তারপর বলেছিল, আপনাদের পাড়ায় এলাম, আলাপপরিচয় করব না?
বেশি আলাপ ভাল নয় স্যার, বুঝলেন!
কেন বলুন তো?
না, তাই বলছি। কথাটা বলে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল হীরু সাহা।
পাশের বাড়ির খগেন পাঠক বলেছিল, ওকে বেশি ঘাঁটাবেন না স্যার। কখন রাতেবিরেতে চোরাগোপ্তা চালিয়ে দেবে, সঙ্গে সঙ্গে একেবারে সোজা উপরতলার বাসিন্দা হয়ে যাবেন পার্মানেন্টলি! হেঁ-হেঁ, বুঝলেন না?
কথাগুলো বলে রহস্যময় হাসি হেসেছিল খগেন পাঠক।
খগেন পাঠকও ওই হীরু সাহারই সমবয়সী। সে একজন নামকরা মোটর-মেকানিক এবং ঐ পল্লীর বাসিন্দা-সুদর্শনের সন্দেহের তালিকার মধ্যে অন্যতম চিহ্নিত।
আরও একজনের উপর নজর পড়েছিল সুদর্শন মল্লিকের।
মাধবী ব্যানার্জি।
ওই পল্লীতেই থাকে। বাপ পতিতপাবন ব্যানার্জি অন্ধ। পূর্ববঙ্গের কোন এক স্কুলে মাস্টার ছিল। দেশ-বিভাগের ফলে ছিটকে ঘুরতে ঘুরতে ওই পল্লীতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বছরকয়েক আগে।
দুই ছেলে দুই মেয়ে। অবিনাশ-অমলেন্দু দুই ভাই আর দুই বোন মাধবী ও সাবিত্রী। বড় দুই ভাই স্কুলের চৌকাটটা ডিঙিয়েই লেখাপড়া ছেড়ে একজন ঢুকেছিল মিলে, অন্যজন মোটর-ড্রাইভিং শিখে হয়েছিল বাসের ড্রাইভার। দুই ভাইয়ে যা উপার্জন করে তাতে অভাব থাকার কথা নয়, কিন্তু সংসারে তারা বড় একটা উপুড়হস্ত করে না। অগত্যা মাধবীকেই হাল ধরতে হয়েছিল।
আই.এ. পাস করে একটা অফিসে চাকরি নিয়েছিল, ওই সঙ্গে অফিসের ক্লাবে ক্লাবে অভিনয় করত। অভিনয়ে বরাবরই একটা বেশ ন্যাক ছিল মাধবীর। ঐ অভিনয় করবার ক্ষমতার জন্যই অফিসের মাইনের দুগুণ তিনগুণ ইনকাম ছিল। অভিনয় করে নানা অফিস ক্লাবে ক্লাবে বেশ মোটা টাকাই উপার্জন করত মাধবী।
ছোট বোন সাবিত্রী কলেজে বি.এ. পড়ে।
গরিব রিফিউজি স্কুল-মাস্টারের মেয়ে হলে কি হবে, দেখতে দুটি বোনই সুন্দরী। তাহলেও দুজনের সৌন্দর্যের মধ্যে একটা যেন পার্থক্য ছিল।
মাধবীর দেহ ও চোখে-মুখে যেন একটা উগ্র যৌন আকর্ষণ ছিল, যেটা স্বভাবতই পুরুষকে আকর্ষণ করত। উগ্র স্পষ্ট যৌবন। দেহের প্রতিটি অঙ্গ, প্রতিটি ঢেউ যেন সোচ্চার। তার উপরে মাধবীর বেশভূষা, চালচলন, কথাবার্তা ও চোখের চাউনির মধ্যেও সর্বক্ষণ যেন একটা যৌন আবেদন স্পষ্ট হয়ে উঠত। তাই পল্লীতে অনেকেই বলাবলি করত ওর ইনকাম দেখে, কেবল চাকরি আর অভিনয়ই নয়—অন্যভাবেও উপার্জন হয় ওর।
অথচ ছোট বোন সাবিত্রী একেবারে তার বড় বোনের যেন সম্পূর্ণ বিপরীত। শান্ত নম্র। ধীর গম্ভীর।
পল্লীর সকলের সঙ্গেই ছিল মাধবীর আলাপ! পল্লীর সব যুবকেরই দৃষ্টি যে মাধবীকে সর্বক্ষণ ঘিরে ছিল, তাও জেনেছিল সুদর্শন মল্লিক। কিন্তু মাধবীর যে কারও প্রতি কোন বিশেষ পক্ষপাত আছে সে-সম্পর্কে কোন সংবাদই পায়নি সুদর্শন।
মাধবীর সঙ্গেও আলাপ করেছিল সুদর্শন একদিন ওদের বাড়িতে গিয়েই।
প্রথম আলাপের দিনই মাধবী বলেছিল, কি সৌভাগ্য, রাজার পদার্পণ কুঁড়েঘরে।
কেন ওকথা বলছেন, মাধবী দেবী? সুদর্শন কথাটা বলে হেসেছিল।
দেবী-টেবী নয়, আমাকে মিস ব্যানার্জী বলেই ডাকবেন দারোগাবাবু।
বেশ, তাই হবে। কিন্তু ওই কথা বললেন কেন? আপনাদের তল্লাটে নতুন এসেছি, একটু জানা-পরিচয় থাকাটা কি ভাল নয়?
কিন্তু আপনারা যে রাজার জাত! মাধবী একটু বাঁকা হাসি হেসে বলেছিল।
রাজার জাত মানে? সৌহার্দ্যের কণ্ঠে—খোঁচাটা যেন বুঝতেই পারেনি, এইভাবে কথাটা বলবার চেষ্টা করেছিল সুদর্শন মল্লিক।
তা বৈকি! খোদ সরকারের প্রতিভূ এবং এ তল্লাটের একেবারে হর্তাকর্তা দণ্ডমুণ্ডের বিধাতা!
সুদর্শন হেসে বলেছিল, তাই বুঝি?
নয়? ইচ্ছা করলেই তো একেবারে বেঁধে নিয়ে যেতে পারেন পাইক-পেয়াদা পাঠিয়ে!
সে যুগ আর সেই মিস ব্যানার্জি!
কে বললে নেই! মরা হাতি এখনও লাখ টাকা। তা যাক, তারপরই একটু থেমে বলেছিল, কিন্তু আপনাদের মত লোকের আমাদের সঙ্গে আলাপ করলে কি সুবিধা হবে।
কেন, কেন?
তা বৈকি! তাছাড়া কথায় বলে পুলিসে ছুঁলে আঠারো ঘা!
আবার হেসেছিল সুদর্শন মল্লিক।
হাসছেন যে?
আপনি দেখছি বেশ মিষ্টি করে হুল ফোঁটাতে পারেন!
ওমা, সে আবার কি? না, না–ছিঃ, আপনারাই হলেন আমাদের বলভরসা। আপনাদের হুল ফোঁটাব এমন ধৃষ্টতা কি থাকতে পারে! আচ্ছা চলি-আমার আবার
অফিসের টাইম হয়ে যাচ্ছে! নমস্কার।
নমস্কার।
.
০২.
মাধবীদের ঠিক একেবারে পাশের বাড়িরই সুবোধ মিত্রের সঙ্গেও সুদর্শনের ওইদিনই আলাপ। ফেরার পথে হঠাৎ দেখা।
সুবোধ মিত্র সেদিন অফিসে যায়নি। ওই দশ পল্লীরই বাসিন্দা হলেও যেন ওই পল্লীর একজন বলে মনে হয় না। বি.এ. পাস করে একটা মার্চেন্ট অফিসে চাকরি করে। রোগা দোহারা চেহারা। কালোর রঙের উপরেও একটা যেন জৌলুস আছে। চোখে-মুখে একটা বুদ্ধির দীপ্তি। জামা-কাপড়েই কেবল ধোপদুরস্ত নয়, কথাবার্তায়ও অত্যন্ত বিনয়ী ও নষ। বস্তির মধ্যে বসবাস করলেও নোকটার যে একটা রুচি আছে তা দেখলেই বোঝা যায়।
সমাদর করে ডেকে নিয়ে সুবোধ মিত্র সুদর্শনকে তার বাইরের বসবার ঘরে বসিয়েছিল।
বেতের একসেট সোফা, কাচের একটা আলমারি-ভর্তি বই। একদিকে একটি তক্তপোশ পাতা। উপরে একটি সুজনি বিছানো। এক কোণে একটি বুদ্ধমূর্তি ও ভাসে একগোছা ফুল। দেওয়ালে ঝোলানো একটি বেহালা।
গরিবের ঘরে যখন পায়ের ধুলো দিয়েছেন, এক কাপ চা অন্তত খেতেই হবে। সুবোধ বললে।
না, না—সে-সবের কোন প্রয়োজন নেই সুবোধবাবু। ওসব হাঙ্গামা করবেন না।
হাঙ্গামা আবার কি! বসুন।
সুবোধ মিত্র পরক্ষণেই ভিতরে চলে গিয়েছিল।
একটু পরে সুদৃশ্য দামী সৌখীন কাপে এক কাপ চা নিয়ে ফিরে এল, নিন।
দেখুন তো, এখন এই অবেলায় আবার চায়ের কি প্রয়োজন ছিল!
তা হোক, আপনার মত লোক এ বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েছেন–
ঘণ্টাখানেক প্রায় আলাপ করেছিল সুদর্শন মল্লিক। খুশী হয়েছিল আলাপ করে। এবং ফিরে আসবার সময় স্বভাবতই সুবোধ মিত্র তার মনের পাতায় দাগ কেটেছিল।
আরও একজন ছিল দশ নম্বর পল্লীর-কল্যাণ বসু। রোগা প্যাটার্নের চেহারা। কালো গায়ের রঙ। মাথায় ঘন চুল। অর্ধেক গাল পর্যন্ত জুলপি। রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে বিশেষ এক পার্টির চিহ্নিত লোক ওই পল্লীর। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হবে। বিশেষ রাজনৈতিক পার্টির কর্মী হিসাবে স্বভাবটা একটু রুক্ষ। এবং বেশ একটু দাপটের সঙ্গেই যেন পল্লীর মধ্যে থাকে। পৌর প্রতিষ্ঠানের একজন বি গ্রেড ক্লার্ক।
সে বলেছিল প্রথম আলাপের সময়েই, আপনি তাহলে আমাদের এ তল্লাটের নতুন ও.সি. হয়ে এলেন। যাক, টিকে থাকুন এই কামনা করি।
আমাদের আর টিকে থাকাথাকি কি বলুন, কল্যাণবাবু! কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। যতদিন রাখবে এ থানায় ততদিন থাকব। হুকুম এলেই চলে যেতে হবে। এই দেখুন না, গত বছর দুয়েকের মধ্যেই চারজন এল আবার গেল আমার আগে এ থানা থেকে। কিন্তু কেন বলুন তো?
কি–কেন?
মানে এই থানায় ও.সি.-রা এলে চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই আবার বদলি হয়ে যায়।
কল্যাণ কিন্তু সুদর্শন মল্লিকের কথার কোন জবাব দেয়নি। মৃদু হেসে বলেছিল, আপনাকে বোধ হয় অত তাড়াতাড়ি বদলি করবে না।
কি করে বুঝলেন?
আপনি বেশ এনারজেটিক। মানে?
এই দেখুন না এখানকার থানায় এসেই শুনেছি, আপনি আমাদের পল্লীতে প্রায়ই আসছেন। আচ্ছা মশাই!
কি?
আমাদের এ তল্লাটের এই পল্লীটা বড়কর্তাদের একটা হেডেক, তাই না?
কই, সেরকম তো কিছু শুনিনি!
শুনেছেন ঠিক স্যার, চেপে যাচ্ছেন।
সুদর্শন মল্লিক প্রত্যুত্তরে হেসেছিল। তবে বুঝেছিল কল্যাণ বসু গভীর জলের মাছ।
তবে কি জানেন মল্লিক মশাই,-পরক্ষণেই কল্যাণ বসু বলেছিল।
কি?
আপনি এ তল্লাটের থানার ও.সি., যেখানে সেখানে খুশি আপনার যাবার অধিকার আছে বৈকি, কিন্তু–
কিন্তু কি? বলুন না, থামলেন কেন কল্যাণবাবু?
এ পল্লীর লোকেরা পুলিসের লোকদের বড় একটা পছন্দ করে না। কিন্তু আমি তো
জানি, বন্ধু হিসেবেই হয়তো আলাপ-পরিচয় করতে আসেন, কিন্তু এরা হয়ত সাদা চোখে ব্যাপারটা নেবে না।
কেন–কেন?
হাজার হোক, আপনি তো জানেন, কথায় বলে পুলিস! ভাববে হয়ত কোন মতলব নিয়েই আপনি পল্লীতে ঘোরাফেরা করছেন!
সুদর্শন মল্লিক তাকিয়ে ছিল কল্যাণ বসুর দিকে।
কল্যাণ বসু হাসছিল।
.
সে যাই হোক, হীরু সাহা, খগেন পাঠক, কল্যাণ বসু, সুবোধ মিত্র ও মাধবী ব্যানার্জি দশ নম্বর পল্লীর বাসিন্দা হিসাবে তার মনের পাতায় বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল যেন। মাসচারেক তারপর নিরুপদ্রবেই কেটেছিল।
অবিশ্যি ইতিমধ্যে কানে যে আসেনি দু-চারটে ব্যাপার তা নয়। যেমন মদ চোলাই, চোরাই মাল পাচার, ওয়াগন ব্রেক। কিন্তু সুদর্শন মল্লিক কথাগুলো কানে এলেও যেন ব্যাপারগুলোতে তেমন কোন গুরুত্ব দেয়নি বাইরে থেকে, যদিও ভিতরে ভিতরে সে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছিল। সর্বক্ষণই সতর্ক সজাগ থাকত। এবং তারপরও দু-পাঁচ দিন দশ নম্বর পল্লীতে গিয়েছে, এর-ওর সঙ্গে আলাপ করে আবার চলে এসেছে।
তারপরই হঠাৎ এল দুঃসংবাদটা।
ফলে সুদর্শন মল্লিককে সরেজমিনে তদন্তে নামতেই হল।
নিষ্ঠুর এক হত্যাকাণ্ড।
.
০৩.
সময়টা শীতকাল।
পৌষ শেষ হয়ে মাঘের শুরু। শহরে বেশ শীত পড়েছে কদিন থেকে।
সকালবেলা থানার অফিসে বসে সুদর্শন মল্লিক দিন দুই আগে রাত্রে অল্পদূরে রেলওয়ে ইয়ার্ডে একটা লোডেড ওয়াগন থেকে দশ পেটি কাপড় ওয়াগন ভেঙে চুরি হয়েছে সেই সম্পর্কেই একটা রিপোর্ট খাড়া করছিল, এমন সময় দশ নম্বর পল্লীর হরগোবিন্দ ঘোষ নামে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে এসে থানায় ঢুকল।
দারোগাবাবু আছেন নাকি?
কে? ভিতরে আসুন।
হরগোবিন্দ এসে ঘরে ঢুকলো। হাঁপাচ্ছে সে তখন রীতিমত।
রোগা চেহারা। মাথার সামনের দিকটায় একগাছিও চুল নেই, চকচকে একটি টাক।
এই যে দারোগাবাবু, শিগগির চলুন!
কোথায়?
দশ নম্বর পল্লীর পিছনে যে মাঠটা আছে—সেখানে।
কেন, ব্যাপার কি?
খুন মশাই খুন!
খুন?
সুদর্শন ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
হ্যাঁ, খুন-নৃশংস খুন!
কে-কে খুন হল?
ওই পল্লীরই একটি যুবতী মেয়ে।
কি নাম বলুন তো?
ওই যে আমাদের পল্লীর অভিনেত্রী
অভিনেত্রী!
হ্যাঁ, যঁহ্যাঁ, পতিতপাবন ব্যানার্জি-ওই যে অন্ধ স্কুল-মাস্টার পতিতপাবন ব্যানার্জি–তারই বড় মেয়ে মাধবী!
সে কি?
সুদর্শন মল্লিক যেন দ্বিতীয়বার চমকে ওঠে কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে।
কখন খুন হল মাধবী ব্যানার্জি? জিজ্ঞাসা করে।
তা কি করে জানব মশাই বলুন! সকালবেলা উঠে একটু প্রাতঃভ্রমণ করা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আজও বের হয়েছিলাম। দশ নম্বর পল্লীর পিছনদিকে যে মাঠটা আছে—সেই মাঠেরই মধ্যে পড়ে আছে কি একটা দূর থেকে নজরে পড়ে আমার যাবার সময়ই, কিন্তু দৃষ্টি দিইনি তখন।
তারপর?
ভাল করে তখন আলোও ফোটেনি আকাশে। বেড়িয়ে ফেরার সময় তখন বেশ আলো ফুটেছে চারদিকে। কি খেয়াল হল এগিয়ে গেলাম, আর গিয়ে দেখি আমাদের পল্লীর মাধবী পড়ে আছে-হাত-পা ছড়িয়ে, চোখ দুটো ঠেলে বের হয়ে এসেছে, মুখটা হাঁ করা, মুখের ভেতরে জিভটা একটু বের হয়ে এসেছে–
পল্লীর সবাই শুনেছে?
আমিই সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে পল্লীতে খবরটা দিই। এতক্ষণে সেখানে হয়ত ভিড় হয়ে গিয়েছে। পরে মনে ভাবলাম, আমিই যখন ব্যাপারটা প্রথম দেখেছি, আমারই
পুলিসকে একটা খবর দেওয়া কর্তব্য, তাই চলে এসেছি।
খুব ভাল করেছেন। তা আপনিও বুঝি ওই পল্লীতেই থাকেন?
থাকি মানে! দশ বছর আছি!
কি নাম আপনার?
আজ্ঞে হরগোবিন্দ ঘোষ।
.
সুদর্শন মল্লিক আর দেরি করে না। চারজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে তখুনি হরগোবিন্দকেও সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে পড়ে।
সকাল খুব বেশি হলে তখন সাতটার বেশি নয়। শেষরাতের দিকে বিশ্রী ঘন কুয়াশা নেমেছিল, এখনও কুয়াশাটা ভাল করে পরিষ্কার হয়ে যায়নি। তবে দেখা যায় স্পষ্টই সব কিছু।
থানা থেকে দশ নম্বর পল্লীটা মিনিট কুড়ি হবে হাঁটাপথে। সেই পল্লীরই পিছনে
একটা খোলা মাঠের মত।
এদিক-ওদিক গোটা দুই খাটাল আর একটা পুরাতন গোরস্তান আছে। তার ওধারে প্রাচীর—প্রাচীরের অপর পার্শ্বেই রেলওয়ে ইয়ার্ড।
এই থানার চার্জ নেবার পর সুদর্শন ওই জায়গাটা, ওধারের রেলওয়ে ইয়ার্ডটা ঘুরে ঘুরে দেখে গিয়েছিল ইতিপূর্বে দিনতিনেক খুল ভাল করে, কারণ ওই ইয়ার্ড থেকেই ওয়াগন ভেঙে মাল সরাবার ব্যাপার প্রায়ই ঘটে থাকে।
এবং যেটা সুদর্শন মল্লিকের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, নিকটবর্তী দশ নম্বর পল্লীরই কারও-না-কারও সেটা কীর্তি আর তাই সে বন্ধুত্বের ভান করে পল্লীর মধ্যে গিয়ে সকলের সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছিল।
নানা জায়গা থেকে ওয়াগন ভর্তি হয়ে নানা ধরনের পণ্যদ্রব্য আসে কলকাতা শহরে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু সে-সব আর খালাস হয় না, কখনও পাঁচ-সাত-দশ দিন পর্যন্ত মাল ওয়াগনেই পড়ে থাকে।
মালগাড়িগুলো ইয়ার্ডের মধ্যে একধারে শান্টিং করা থাকে খালাসের অপেক্ষায়।
.
০৪.
সীমানা প্রাচীরের চার-পাঁচটা জায়গায় ভাঙা। বোঝা যায় দুষ্কৃতকারীরা ওই পথেই ইয়ার্ডে যাতায়াত করে ও ওয়াগন ভেঙে মাল সরায়।
তবে এও সুদর্শনের মনে হচ্ছে সুনিশ্চিত যে, ওয়াগন ভেঙে মাল পাচারের ব্যাপারে মালগাড়ির এঞ্জিন ড্রাইভার ও খালাসীদের হাতও আছে। তারাও ভাগীদার। তারাই সরবরাহ করে খবরটা। নচেৎ ওরা কেমন করেই বা জানতে পারে, কোন্ ওয়াগনে মাল আছে! একটা-আধটা মালগাড়ি তো নয়, অসংখ্য মালগাড়ি থাকে দাঁড়িয়ে ইয়ার্ডের এদিকওদিক ছড়িয়ে!
পথ চলতে চলতে একসময় হরগোবিন্দকে সুদর্শন মল্লিক শুধায়, ঘোষ মশাই!
আজ্ঞে, কিছু বলছেন?
কি করা হয় আপনার?
কাছেই আমার লেদ মেসিনের একটা দোকান আছে।
দশ নম্বর পল্লীরই বাসিন্দা যখন আপনি, নিশ্চয়ই মাধবীকে ভাল করেই চিনতেন?
চেনা মানে যাতায়াতের পথে সর্বদা দেখাশোনা হচ্ছে, একই পল্লীতে থাকি। কে চেনা নয়—সবাই তো চেনা!
তা বটে। তবে বলছিলাম, আলাপ-টালাপ ছিল না মেয়েটির সঙ্গে?
না মশাই, বড় দেমাক ছিল মেয়েটার। আমাদের বড় একটা মানুষের মধ্যেই গণ্য করত না।
বলেন কি!
হ্যাঁ! চাকরি করে, অভিনেত্রী-অ্যাকটো করে স্টেজে!
খুব ভাল অভিনয় করত বুঝি?
তা জানি না মশাই, তবে আমার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে সে যাতায়াত করত সর্বদা। দেখতাম প্রায়ই অনেক রাত করে ফিরত–
একা একা?
আগে আগে তো একা-একাই যাতায়াত করত, তবে ইদানীং দেখতাম—
কি?
সঙ্গে রয়েছে সুন্দরমত সুট-পরা এক বাবু!
কে সে? আপনাদেরই পল্লীরই নাকি?
না।
তবে?
জানি না। তারপরই বলে হরগোবিন্দ, বুঝলেন না, স্কুল-মাস্টারের মেয়ে হলে কি হবে-আর না বলাটা অন্যায়ই হবে, স্বভাবচরিত্র তেমন সুবিধের ছিল না!
কেন—কেন?
পল্লীর সব জোয়ান-মদ্দ ছোকরাগুলোই তো ওর চারপাশে ঘুরঘুর করত, হাসাহাসি ঠাট্টামস্করা চলত।
তাই বুঝি? তা কার সঙ্গে বেশি ভাব ছিল বলে আপনার মনে হয়?
কে জানে মশাই, ওসব গভীর জলের মাছ! হলও শেষ পর্যন্ত তেমনি, অপঘাতে মরতে হল। ওই সব চরিত্রের মেয়ের শেষ পর্যন্ত অমনটিই হয়, বুঝলেন না?
আচ্ছা ঘোষ মশাই।
বলুন।
আপনাদের পল্লীতে মাধবীর কোন লাভার—মানে প্রেমিক ছিল কিনা বলতে পারেন?
ওদের মত মেয়েছেলের কি একটা-আধটা প্রেমিক থাকে মশাই! কত প্রেমিক!
সুদর্শনের বুঝতে কষ্ট হয় না, যে কোন কারণেই হোক মাধবীর প্রতি হরগোবিন্দর একটা আক্রোশ ছিল মনের মধ্যে।
.
মিনিট পঁচিশের মধ্যেই এরা পৌঁছে গেল অকুস্থানে।
মিথ্যা বলেনি হরগোবিন্দ। ইতিমধ্যে দশ নম্বর পল্লীর অনেকেই এসে সেখানে ভিড় করেছে। নানা বয়েসী পুরুষই বেশি, তবে কিছু মেয়েও আছে। তাদের মধ্যে মাধবীর ছোট বোন সাবিত্রী আর বড় ভাই অবিনাশও ছিল।
আরও ভিড়ের মধ্যে নজরে পড়ে সুদর্শনের—খগেন পাঠক মোটর মেকানিক, মিলের কর্মী কল্যাণ বসু, রোগা পাকাটির মত চেহারা—ওই একই মিলের কর্মী এবং সুবোধ মিত্র—সেই ভদ্র কেতাদুরস্ত মানুষটিকে বিশেষ করে।
সুদর্শন মল্লিক ও তার সঙ্গের সেপাইদের দেখে ভিড় সরে গিয়ে ওদের এগোবার পথ করে দেয় আপনা থেকেই।
পত্রশূন্য বটগাছটার নিচেই পড়ে আছে মাধবীর দেহটা। চিৎ হয়ে পড়ে আছে। পরনে একটা দামী শাড়ি। ডানহাতে একগাছি সোনার চুড়ি, বাঁহাতে দামী একটা লেডিস রিস্টওয়াচ।
মুখটা সামান্য হাঁ হয়ে আছে। ঝকঝকে দাঁতের পাশ দিয়ে জিভটা যেন সামান্য বের হয়ে এসেছে। চোখের পাতা খোলা—চোখের মণি দুটো যেন বের হয়ে আসতে চায়। স্পষ্ট একটা আতঙ্ক ও সেই সঙ্গে যন্ত্রণার চিহ্ন দু-চোখের তারায়।
মুখে ও ঠোটে প্রসাধনের চিহ্ন বেশ বোঝা যায়। ডান পায়ের হাঁটুর কাছাকাছি শাড়িটা উঠে এসেছে। মৃতদেহটা পরীক্ষা করতেই বুঝতে পারে সুদর্শন, পুরোপুরি রাইগার মর্টিস সেট ইন করেনি। পরনের শাড়িটা বেশ এলোমেলো। গায়ের ব্লাউজটা দু-এক জায়গায় ফেঁসে গিয়েছে দেখা যায়।
মৃতদেহটাকে উপুড় করে দিতেই নজরে পড়ল সুদর্শনের-পরনের শাড়ি ও ব্লাউজে ধূলোমাটি লেগে আছে, এখানে ওখানে ফেঁসে গিয়েছে।
মনে হয় কেউ যেন পৈশাচিক হিংস্রতায় মহিলার গায়ের ব্লাউজখানা টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে।
দেহের কোথাও কোন ক্ষতচিহ্ন নজরে পড়ল না সুদর্শনের।
একফোঁটা রক্তের চিহ্ন নেই কোথাও। সুদর্শন আরও একটু ঝুঁকে পড়ে মৃতদেহের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতেই তার নজরে পড়ল মৃতদেহের গলায় যেন একটা আবছা কালসিটার দাগ আছে।
সুদর্শনের পরীক্ষা হয়ে গেলে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশের ভিড়কে লক্ষ্য করে বললে, আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে ভিড় করছেন কেন? যান সব!
একে একে সবাই চলে গেল। কেবল সাবিত্রী আর অবিনাশ তখনও দাঁড়িয়ে। অবিনাশ স্তব্ধ, সাবিত্রীর চোখে জল। সে নিঃশব্দে কাঁদছিল।
চোখ দুটো কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে উঠেছে।
.
০৫.
সাবিত্রীর বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে সুদর্শনের মনটা যেন হঠাৎ কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। তবু প্রশ্ন তো করতেই হবে, যা জানবার তাকে জানতেই হবে।
সাবিত্রী দেবী! সুদর্শন ডাকে।
সাবিত্রী সুদর্শনের দিকে অশ্রুভেজা লাল চোখ তুলে তাকাল।
কাল কি আপনার দিদির কোথাও অভিনয় ছিল?
ক্ষণকাল সাবিত্রী যেন একটু ইতস্তত করলে, তারপর কান্নাঝরা গলায় বললে, হ্যাঁ, একটা অফিস-ক্লাবে অভিনয় ছিল। বলে গিয়েছিল ফিরতে রাত হবে। বাবা তো দিদির অভিনয়ের ব্যাপারটা জানে না, তাই আমি জেগে অপেক্ষা করছিলাম।
তারপর?
অপেক্ষা করতে করতে কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর ভোরবেলা হরগোবিন্দবাবুর চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায়।
সকাল হয়ে গিয়েছে তখন?
হ্যাঁ, বেলা প্রায় পৌনে ছটা হবে। তবে—
কি?
কুয়াশার জন্যে আলো তখনও তত ফোটেনি ভাল করে। চেঁচামেচি শুনে দাদাও বাইরে এসেছিল। আমি আর দাদা জিজ্ঞাসা করি, ব্যাপার কি? হরগোবিন্দবাবু আমাদের বাড়ির বাইরে ডেকে নিয়ে বললেন, শিগগির চল পল্লীর পিছনের মাঠে।
দাদা জিজ্ঞাসা করে, কেন?
মাধবী—তোমার বোন—
কি—কি হয়েছে মাধবীর?
সে মরে গিয়েছে।
সুদর্শন প্রশ্ন করে, তারপর?
আমরা ছুটতে ছুটতে তখুনি এখানে চলে এসেছি, দাদা আর আমি।
আপনাদের মা-বাবা বোধ হয় এখনও শোনেননি কিছু?
সারাটা পল্লীই জেনে গিয়েছে। অবিনাশ বললে, তাদের কি আর এতক্ষণ কিছু জানতে বাকি আছে?
তা অবিশ্যি ঠিক। একটু থেমে সুদর্শন মল্লিক বলে, তাহলে এবার আপনারা বাড়ি যান।
অবিনাশ শুধায়, মৃতদেহ কখন পাব?
অনেক আইন-কানুনের ব্যাপার আছে, তাছাড়া পোস্টমর্টেম আছে। কাল বিকেলের আগে বডি পাবেন বলে তো মনে হয় না।
অবিনাশ সাবিত্রীর হাত ধরে চলে যাচ্ছিল, সুদর্শন আবার ডাকে, একটা কথা অবিনাশবাবু–
বলুন?
থানায় আপনাদের দুজনেরই একটা করে এজাহার দিতে হবে। সন্ধ্যার দিকে যদি একবার আসেন–
আসব।
অবিনাশ আর সাবিত্রী দাঁড়াল না। যাবার জন্য পা বাড়াল।
সুদর্শন আবার ওদের বললে, অমলেন্দুবাবুকেও আনবেন।
.
মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করতেই বেলা বারোটা বেজে গেল।
সুদর্শন মনে মনে যেন মাধবীর মৃত্যুর ব্যাপারটা ভেবে কিছুই কূল-কিনারা পাচ্ছিল না। মেয়েটাকে হত্যা করল কে আর কেনই বা হত্যা করল? হত্যা যে সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। এবং মৃতদেহ পরীক্ষা করে নিয়ে সুদর্শন যতটা বুঝতে পেরেছে, যে-ই হত্যা করে থাকুক-হয় হত্যার পর বা আগে হত্যাকারী মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে, তারপর হয়ত মৃতদেহটা ওইখানে নিয়ে গিয়ে ফেলা হয়েছে।
হত্যা সম্ভবত অন্যত্র হয়েছে–কিন্তু সে কোথায়?
আর একটা কথা মনে হয় সুদর্শনের। হত্যাকারী কি ওই দশ নম্বর পল্লীরই কেউ, না বাইরের কেউ?
হরগোবিন্দ বর্ণিত সেই সুট-পরা বাবুটি, তার কথাটাও মনে পড়ে। তার খবরটাও যোগাড় করা দরকার।
পল্লীতে মাধবীর প্রেমাকাঙ্ক্ষী অনেকেই ছিল। অনেকেই আকৃষ্ট হয়েছে মাধবীর প্রতি। আর একটু কৃপালাভের আশায় অনেকেই তার চারপাশে মক্ষিকার মত গুঞ্জন করে ফিরেছে। তাদের কেউ একজন নয় তো?
প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিহিংসা গ্রহণ? কিন্তু কে?
হীরা সাহা, খগেন পাঠক, কল্যাণ বসু কিংবা হরগোবিন্দ ঘোষ?
হরগোবিন্দর কথায়বার্তায় মনে হয় মাধবীর প্রতি ওর একটা চাপা আক্রোশ ছিল যেন!
এমনও হতে পারে, প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে গিয়েই হয়ত ওই আক্রোশ দেখা দিয়েছিল।
কাজেই ঐ হরগোবিন্দ লোকটারও সংবাদ নেওয়া দরকার।
আর একজন—আরও একজনের কথা মনে পড়ে সুদর্শনের।
সুবোধ মিত্র।
মাধবীদের একেবারে পাশের বাড়িতেই সে থাকে। তাকেও দেখা গিয়েছিল সকালে ভিড়ের মধ্যে। একমাত্র দেখা যায়নি হীরু সাহাকে।
সে কি খবরটা পায়নি, না পেয়েও যায়নি?
রাত প্রায় আটটা নাগাদ এল অবিনাশ একাই। সাবিত্রী আসেনি।
সুদর্শন থানার অফিসঘরেই বসেছিল ওদের অপেক্ষায়।
আসুন। একা যে! আপনার ছোট ভাই আর বোন এলেন না? বসুন।
অমল তো এখানে নেই। বসতে বসতে বললে অবিনাশ।
কোথায় গিয়েছেন তিনি?
একদল বরযাত্রী নিয়ে গতকাল বিকেলে কৃষ্ণনগর গিয়েছে, এখনও ফেরেনি। তারপরই একটু থেমে অবিনাশ বললে, মা অত্যন্ত আঘাত পেয়েছেন, ঘন ঘন ফিট হচ্ছে তাঁর সংবাদটা পাওয়ার পর থেকেই, তাই সাবিত্রী আসতে পারল না।
ঠিক আছে। কাল যখন তোক একবার যেন সময় করে থানায় আসেন। অবিশ্যি আমিই যেতে পারতাম, কিন্তু আপনার মা-বাবার কথা ভেবেই যাইনি। একটু থেমে বললে, আপনার বাবা পতিতপাবনবাবু শুনেছেন?
হ্যাঁ।
খুব ভেঙে পড়েছেন বোধহয়?
কান্নাকাটি তো করছেন না, একেবারে চুপচাপ।
খুবই স্বাভাবিক। সুদর্শন বলে।
০৬-১০. অতঃপর সুদর্শন কিছুক্ষণ চুপচাপ
অতঃপর সুদর্শন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। মনে মনে গুছিয়ে নেয় কি ভাবে শুরু করবে।
আচ্ছা অবিনাশবাবু!
বলুন।
ব্যাপারটা ডেলিকেট হলেও বুঝতেই তো পারছেন, আইনের খাতিরেই আমাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ আপনাদের করতে হচ্ছে।
আপনি অত কিন্তু-কিন্তু করছেন কেন? তাছাড়া এমন একটা কিছু যে ঘটবে এ তো আমি জানতামই।
জানতেন?
হ্যাঁ। আপনি হয়তো জানেন না, ইদানীং ওর চালচলন যা হয়ে উঠেছিল—
কি রকম?
নিজের মায়ের পেটের বোন, তবু যা সত্যি তা বলতেই হবে আমাকে। ক্লাবে ক্লাবে অভিনয় করাটাই যে একদিন হবে ওর কাল আমি জানতাম
কেন, আজকাল তো অনেক মেয়েই অভিনয় করে অ্যামেচার ক্লাবে দু-পয়সা উপার্জন করে!
শুধু তো অভিনয়ই নয়, অভিনয় করতে গিয়ে অফিসের বাবুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি, সিনেমায় যাওয়া, হোটেল-রেস্তোরাঁতে খাওয়া—কি বলব, নানা জনে নানা কথা বলতে শুরু করেছিল বেশ কিছুদিন ধরেই, আর তারা যে মিথ্যা বলত তাও নয়—
আচ্ছা, শুনেছি ওঁর আয়েই ইদানীং আপনাদের সংসারটা চলত, কথাটা কি সত্যি?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন? আপনারা তো দুই ভাই-ই শুনেছি ভাল রোজগার করেন?
দেখুন, উচ্ছলতাকে আর অনাবশ্যক ব্যয়বাহুল্যকে কোনদিনই আমি প্রশ্রয় দিইনি। তাই বছরখানেক আমার খাওয়া-খরচ ছাড়া আমি কিছুই দিতাম না সংসারে।
আর আপনার ছোট ভাই অমলেন্দুবাবু?
ওর নিজেরই বাবুয়ানী করে আর ড্রিঙ্ক করে, পয়সায় কুলোয় না তো সংসারে দেবে কি?
খুব ড্রিঙ্ক করেন বুঝি?
একটা বেহেড মাতাল। অর্ধেক দিন তো বাড়িতেই ফেরে না রাত্রে।
এবার তো আপনার ঘাড়েই সব পড়ল।
ক্ষেপেছেন? আমি চলে যাব মিলের কোয়ার্টারে। ঝামেলার মধ্যে আমি নেই।
সুদর্শন বুঝতে পারে, লোকটা যেমন স্বার্থপর তেমন হৃদয়হীন।
যাক সে-সব কথা, অবিনাশ বললে, কেন আমায় ডেকেছেন বলুন?
দশ নম্বর পল্লীতে আপনারা কতদিন আছেন?
তা প্রায় বছর বারো তো হবেই।
আপনার বাবা শুনেছি অন্ধ—
হ্যাঁ, গ্লুকোমা হয়ে চোখ দুটো নষ্ট হয়ে গিয়েছে বছর সাতেক হল।
আপনার বোনের হত্যার ব্যাপারে—আপনার কি মনে হয়, সত্যি-সত্যিই তাহলে কেউ মাধবীকে খুনই করেছে? বাধা দিয়ে অবিনাশ প্রশ্ন করে।
আমার ধারণা তাই। তবে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত সঠিক করে কিছু বলতে পারছি না।
তাহলে বলি শুনুন, আমারও সত্যি কথা বলতে কি। তাই ধারণা—অবিনাশ বললে।
হুঁ। আচ্ছা বলছিলাম, আপনার বোনের হত্যার ব্যাপারে কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?
অবিনাশ চুপ করে থাকে। কোন জবাব দেয় না সুদর্শনের প্রশ্নের।
বলুন, কথাটা প্রকাশ পাবে না।
আপনি আমাদের দশ নম্বর পল্লীর হীরু সাহাকে চেনেন? কখনও দেখেছেন?
হ্যাঁ দেখেছি। আলাপও হয়েছে।
ও আমাদের মিলে—মানে অন্নপূর্ণা জুট মিলে কাজ করে।
জানি-শুনেছি।
আপনার জানা দরকার, ওই হীরুর মাধবীর ওপর নজর ছিল—
তাই নাকি?
হ্যাঁ। একবার মাধবীকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল।
তারপর?
মাধবী সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্যি তাকে না করে দিয়েছিল—
কি বলেছিলেন মাধবী দেবী?
বলেছিল, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন না দেখাটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়!
তারপর?
হীরু নাকি বলেছিল, বিয়ে তাকে হীরুকেই করতে হবে একদিন নাকি!
মাধবী দেবী কি বলেছিলেন?
বলেছিল, তার আগে সে একছড়া জুতোর মালা তাকে পাঠিয়ে দেবে!
তারপর? আর কোন দিন কিছু হীরু বলেছিল?
ওকে বলেনি, তবে আমাকে বলেছে।
আপনি কি জবাব দিয়েছিলেন?
বলেছিলাম, তেমন যদি কখনও অসম্ভব সম্ভব হয়ই, বোনকে আমিই গলা টিপে মেরে ফেলব।
বলেছিলেন আপনি?
হ্যাঁ। হীরুও বলেছিল, বহুৎ আচ্ছা, দেখা যাক তাহলে অসম্ভবই সম্ভব হয় কিনা! তোমার বোনটিকে আমার ঘরে এনে তুলতে পারি কিনা!
হুঁ। আর কাউকে সন্দেহ হয়?
না।
খগেন পাঠককে?
ওই মোটর-মেকানিকটা? ওটা তো একটা ছুঁচো!
কল্যাণ বসু?
ওটা একটু গোঁয়ার-গোবিন্দ বটে, তবে তার দ্বারা খুন করা সম্ভব নয়।
আর আপনাদের প্রতিবেশী—মানে ঐ—
কে, সুবোধ?
হ্যাঁ। ও অত্যন্ত নিরীহ টাইপের একজন ভদ্রলোক।
ওদের কারও আপনার বোনের প্রতি দুর্বলতা ছিল না?
দুর্বলতার কথা যদি বলেন তো আমাদের পল্লীর সকলেরই মাধবীর প্রতি রীতিমত দুর্বলতা ছিল।
আচ্ছা, যাদের কথা বললাম, ওদের কারও প্রতি আপনার বোনের কোন দুর্বলতা ছিল বলে আপনার মনে হয়?
না, সেরকম মনে হয় না।
কেন?
আমাদের পল্লীর কোন ছেলেকে সে কখনও ধর্তব্যের মধ্যেই আনত না।
কিন্তু আলাপ-পরিচয় তো ছিল!
আলাপ-পরিচয় থাকা আর দুর্বলতা থাকা বা প্রেম করা কি এক জিনিস মশাই?
তা অবিশ্যি নয়। আচ্ছা, আপনার বোনের রোজগারপাতি বেশ ভালই ছিল, তাই না?
ভাল মানে? রীতিমত ভাল ছিল। নচেৎ নিত্য নতুন অত দামী দামী শাড়ি, বিলিতি প্রসাধন সব আসত কোথা থেকে? ট্যাকশি ছাড়া তো সে এক পা কখনও চলতই না।
বলেন কি? তা অফিসে কত মাইনে পেত?
বোধ হয় শ’দুই।
মাত্র?
হ্যাঁ। কিন্তু অভিনয়ে-ইদানীং তো শুনতাম এক এক রাত্রের অভিনয়ে একশ সোয়াশ করে টাকা দিত। সপ্তাহে তিন-চারটে ক্লাবে অভিনয় তো তার বাঁধা ছিল বলতে গেলে।
ব্যাঙ্কে রাখত না কিছু?
তা জানি না। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বড় একটা ছিল না।
বোনকে আপনি ভালবাসতেন না?
বাসব না কেন? তাই বলে অন্যায় আমি সহ্য করি না কখনও।
আচ্ছা অবিনাশবাবু, বাইরের কাউকে—মানে কোন যুবককে কখনও আপনাদের বাড়িতে আসতে দেখেছেন বা আপনার বোন মিশতেন এমন কাউকে জানেন?
তা ঠিক জানি না, তবে একজন ভদ্রলোককে বার দুই দেখেছি ওর কাছে আসতে। মানে ঠিক আসা না, ওকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছে।
তার কোন পরিচয় বা নাম জানেন?
না।
বয়স কত হবে?
তা বয়স বছর আটত্রিশ-ঊনচল্লিশ হবে।
দেখতে কেমন?
মোটামুটি। তবে পরনের সুট দেখে মনে হয়েছে ভাল ইনকাম করেন ভদ্রলোক।
.
০৭.
আরও কিছু কথাবার্তার পর সাড়ে দশটা নাগাদ অবিনাশ বিদায় নিল।
সুদর্শন একটা সিগারেট ধরায়।
সিগারেটটা শেষ করে উঠতে যাবে, দরজার বাইরে কার চাপা সতর্ক গলা শোনা গেল, জয় রাধেশ্যাম! আসতে পারি স্যার?
কে? আসুন।
মোটাসোটা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ একটি প্রৌঢ় এদিক-ওদিক সতর্ক ভাবে তাকাতে তাকাতে ঘরের মধ্যে ঢুকল।
পরনে ধুতি, গায়ে পাঞ্জাবি। মাথায় পরিপাটি তেড়ি, উগ্র একটা তেলের গন্ধ নাকে আসে। গলায় কণ্ঠির মালা, চোখে রুপোর ফ্রেমের চশমা।
কোথা থেকে আসছেন? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
জয় রাধেশ্যাম! আজ্ঞে এই দশ নম্বর পল্লী থেকেই আসছি, আর কোথা থেকে আসব?
কি নাম আপনার?
রাধেশ্যাম! আজ্ঞে নরহরি সরকার।
কি করা হয়?
রাধেশ্যাম! আজ্ঞে ছোটখাটো একটা সোনার দোকান আছে বড় রাস্তার ওপর। চোখে অবিশ্যি পড়ার মত নয়—রাধাকৃষ্ণ জুয়েলারী। চেয়ারটায় বসব স্যার?
হ্যাঁ হ্যাঁ, বসুন।
নরহরি চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল।
উগ্র তেলের গন্ধে সুদর্শনের নাক জ্বালা করে।
আমার কাছে কি কিছু প্রয়োজন ছিল সরকার মশাই?
রাধেশ্যাম! প্রয়োজন তেমন কিছু নয়—বলছিলাম আজ সকালে মাঠের বটগাছতলায় যে যুবতীটিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, তার সম্পর্কে কিছু জানতে পারলেন?
আপনি কিছু জানেন নাকি?
রাধেশ্যাম! আমি–আমি কেমন করে জানব? তবে—
কি তবে?
যুবতীটি এই পল্লীতেই থাকত তো! তাই আর কি—একটা খোঁজ নেওয়া। রাধেশ্যাম!
ওরা কি আপনার কোন আত্মীয়-টাত্মীয়?
রাধেশ্যাম! ওঁরা হলেন ব্রাহ্মণ, আর আমি স্বর্ণবণিক!
কিন্তু আপনার কৌতূহল দেখে মনে হচ্ছে–
রাধেশ্যাম! না না, বিশ্বাস করুন, সেরকম কিছু নয়। তাহলে সত্যি কথাই বলি, আমি এসেছিলাম কয়েকটি সংবাদ আপনাকে দিতে। রাধেশ্যাম! তা আপনি যদি–
বেশ তো, বলুন না কি জানেন আপনি মাধবী দেবী সম্পর্কে?
কি জানেন? রাধেশ্যাম। মেয়েটি বিশেষ সুবিধের ছিল না।
কি রকম?
রাধেশ্যাম! মানে-ওই নষ্ট-দুষ্ট চরিত্রের আর কি!
তাই বুঝি?
রাধেশ্যাম! হ্যাঁ, নৌটঙ্কী মশাই-যাকে বলে নৌটঙ্কী! পল্লীর সব ছোকরাগুলোর সঙ্গে কি ঢলাঢলি, মাতামাতি!
আপনার সঙ্গে পরিচয় ছিল না?
রাধেশ্যাম! ক্ষেপেছেন মশাই? ওসব নষ্ট-দুষ্ট মেয়েছেলে যত এড়িয়ে চলা যায় ততই মঙ্গল। তবে, আসত-মধ্যে মধ্যে আমার দোকানে আসত।
গয়না গড়াতে বোধ হয়?
রাধেশ্যাম! আজ্ঞে না।
তবে আপনার গয়নার দোকানে কেন আসত?
রাধেশ্যাম! কথাটা তাহলে বলেই দিই। গিনি-বুঝলেন, গিনি—
গিনি!
হ্যাঁ, গিনি কিনতে আসত।
গিনি কিনতে?
রাধেশ্যাম! তাহলে আর বলছি কি? আগে আগে দিয়েছি, তবে ইদানীং সোনা কন্ট্রোল হয়ে যাবার পর-রাধেশ্যাম! গিনি আর কোথা পাব বলুন?
তা তো বটেই। তবুও আসত, তাই না?
রাধেশ্যাম! সোনার লোভ বড় লোভ, বুঝলেন না!
আচ্ছা সরকার মশাই?
রাধেশ্যাম! বলুন?
আপনি তো দশ নম্বর পল্লীর দীর্ঘদিনের বাসিন্দা?
রাধেশ্যাম! তা মনে করুন আপনার স্বর্গীয় পিতা,-তস্য স্বর্গীয় পিতার আমল থেকে ওইখানে আমাদের বাস। দশ নম্বর পল্লী বলে তখন তো কিছুই ছিল না, পরে ওই নাম দেওয়া হয়েছে। ছেলেছোকরাদের কাজ, বুঝলেন না? রাধেশ্যাম!
তাহলে তো আপনি সব খবরই রাখেন ওই দশ নম্বর পল্লীর?
রাধেশ্যাম! সব আমার নখদর্পণে!
তা তো হবেই। আচ্ছা, শুনেছি ওই দশ নম্বর পল্লীর মধ্যে একটা বিরাট চোরাকারবারের ঘাঁটি আছে!
রাধেশ্যাম! সে কি বলছেন হুজুর?
আমার পূর্ববর্তী পুলিশ অফিসাররা সেই রকম রিপোর্ট লিখে রেখে গিয়েছেন।
রাধেশ্যাম! না না, তা কখনও হতে পারে?
শুনেছি একজনের হাত দিয়েই মাল বেচা-কেনা হয়ে থাকে!
রাধেশ্যাম! আমি বৈষ্ণব মানুষ ওসব খবর আমি থাকলেও জানি না। ছোটখাটো একটা পৈতৃক আমলের দোকান আছে, তাই নিয়েই আছি। রাধেশ্যাম! আদার ব্যাপারী আমি, জাহাজের খবরের প্রয়োজনটা কি বলুন আজ্ঞে?
তা বটে।
রাধেশ্যাম! এবারে তাহলে হুজুরের আজ্ঞা হোক, আমি উঠি।
আসুন।
রাধেশ্যাম! রাধেশ্যাম! নরহরি সরকার উঠে পড়ল।
.
০৮.
সুদর্শন আবার একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করল। সিগারেট টানতে টানতে চিন্তা করে সুদর্শন।
মাধবী সম্পর্কে আর একটা নতুন সংবাদ পাওয়া গেল। মধ্যে মধ্যে সে নরহরির কাছে টাকা দিয়ে গিনি ক্রয় করতে যেত!
ব্যাঙ্কে সে টাকা রাখত না। অবিনাশের উক্তি থেকে বোঝা যায়, ইদানীং মাধবীর মাসিক আয় ভালই ছিল। একশোটা টাকা নিয়ে সপ্তাহে যদি তিন-চারটে অভিনয় করে, তাহলে কমপক্ষেও তার চাকরি নিয়ে ইনকাম বারো-চোদ্দশ টাকা ছিল মাসে।
আয়ের বেশ কিছুটা অংশ হয়ত সে ওইভাবে গিনি ক্রয় করে জমাত। কিন্তু গিনিগুলো সে কোথায় রাখত?
তাদের বাড়িতেই কি? তাই যদি হয়ে থাকে, বাড়ির আর কেউ না জানলেও মাধবীর বোন সাবিত্রী হয়ত জানলেও জানতে পারে। কেউ ওই অর্থের লোভেই মাধবীকে হত্যা করেনি তো? অসম্ভব একটা কিছু নয়। হয়ত ওই অর্থই তার মৃত্যুর কারণ! প্রেম-ট্রেম ঘটিত কোন ব্যাপার নেই। হয়ত সে ভুল পথেই এগোচ্ছিল!
নিঃসন্দেহে জটিল ব্যাপারটা।
খুব সতর্কভাবে থেকে অনুসন্ধানের ব্যাপারে অগ্রসর হতে হবে। মাধবীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যদি সব কিছু জানা যেত, হয়ত অনুসন্ধানের সুবিধে হত। কিন্তু কেমন করে জানা যায়?
.
পরের দিন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গেল।
Death due to strangulation! শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে মাধবীকে। শুধু তাই নয়, তার অনুমান ঠিক মৃত্যুর পূর্বে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল।
বোঝা যাচ্ছে, যে-ই হত্যাকারী হোক মাধবীর-মাধবীর প্রতি তার একটা আক্রোশ জমা ছিল মনে, যে আক্রোশের ফলে হত্যাকারী তাকে ধরে জোর করে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে। তারপর মৃতদেহ টেনে নিয়ে গিয়ে মাঠের মধ্যে বটগাছতলায় ফেলে রেখে এসেছে।
ডাক্তারের মতে রাত বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে মাধবীর মৃত্যু হয়েছে কোন এক সময়।
আরও মনে হয়, সাধারণ কোন চোর-চোড়ের কাজ নয় ওটা।
তাহলে তার হাতে বালা ও দামী সোনার রিস্টওয়াচ থাকত না। হত্যাকারীর সেদিকে কোন নজর ছিল না।
বেলা চারটে নাগাদ পরের দিন অবিনাশের হাতে মাধবীর মৃতদেহ তুলে দেওয়া হয়েছিল। সে ওই দশ নম্বর পল্লীরই কয়েকজনের সাহায্যে মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে গিয়েছে।
কিছুক্ষণ হল সন্ধ্যা হয়েছে। শীতের সন্ধ্যা ধোঁয়ায় শ্বাসরোধকারী।
সুদর্শন অফিসঘরের মধ্যে বসে মাধবীর হত্যার কেসের একটা প্রাথমিক রিপোর্ট লিখছিল, দারোয়ানজী এসে জানাল, একজন জেনানা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চায়।
যাও, ভিতরে পাঠিয়ে দাও।
মাথায় গুণ্ঠন এক নারী। গায়ে একটা কালো আলোয়ান। কক্ষের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান?
মাথার উপর থেকে অবগুণ্ঠন হাত দিয়ে তুলে দিল নারী। চিনতে পারল সুদর্শন ওকে—নিহত মাধবীর বোন সাবিত্রী।
সাবিত্রী দেবী! বসুন।
আপনি আমায় গতকাল আসতে বলেছিলেন, কিন্তু আসতে পারিনি। মার ঘন ঘন ফিট হচ্ছিল।
শুনেছি! তা আপনার মা এখন কেমন আছেন?
ওই রকমই। সকালে আমার এক বিধবা মাসিমা এসেছেন, তিনিই এখন মার কাছে আছেন।
বসুন, দাঁড়িয়ে কেন?
সাবিত্রী চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল।
সুদর্শন সাবিত্রীকে আসতে বলেছিল বটে, কিন্তু এখন কি ভাবে তার কথা শুরু করবে বুঝতে পারে না। অবশেষে সাবিত্রীই একসময় কথা বললে, আমাকে আপনি আসতে বলেছিলেন কেন?
আপনাকে আসতে বলেছিলাম আপনার দিদির সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করব বলে। কথাগুলো বলে সুদর্শন সাবিত্রীর মুখের দিকে তাকাল।
বিষণ্ণ মুখখানি। চোখের কোল ফোলা। মনে হয় সর্বক্ষণই কাঁদছে। দু-একগাছি চূর্ণকুন্তল কপালের উপরে এসে পড়েছে।
এত কাছাকাছি সুদর্শন ইতিপূর্বে সাবিত্রীকে দেখবার সুযোগ পায়নি। মাধবীর মত সাবিত্রীও দেখতে সত্যিই সুন্দরী। গাত্রবর্ণ রীতিমত উজ্জ্বল গৌর। মুখখানি একটু লম্বা প্যাটার্নের। টানা-টানা দুটি চোখ, উন্নত নাসা। সবচাইতে সুন্দর ছোট কপাল ও পাতলা দুটি ঠোঁট ও চিবুকের গঠনটি। বাঁ গালে একটা তিল আছে।
কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে যেন একটা শান্ত কমনীয় সৌন্দর্য আছে সাবিত্রীর চোখেমুখে—যেটা মাধবীর ছিল না। যৌবন উদ্ধত নয়, বিনম্র শান্ত সমাহিত।
মাধবীর চোখের দৃষ্টিতে ছিল যেন একটা স্পষ্ট যৌন আবেদন। সম্ভবত যেটা সব পুরুষকেই আকৃষ্ট করত-হয়ত তার অভিনয়শক্তিরও মূল উৎসই ছিল যৌনাশ্রিত চোখের চটুল দৃষ্টি।
কিন্তু সাবিত্রীর চোখের দৃষ্টি শান্ত, কোমল, ভীরু।
তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার যা সুদর্শনের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে, ইদানীংকার ওই বয়েসী মেয়েদের মত সাবিত্রীর পোশাকের মধ্যে দিয়ে দেহের যৌবনকে প্রকট করে অন্যের দৃষ্টির সামনে তুলে ধরার যেন বিন্দুমাত্র প্রয়াসও নেই।
সাধারণ ব্লাউজ ও শাড়ি, সাধারণ ঘরোয়া ভাবে পরা।
মাধবীর নামোল্লেখেই বোধ হয় সাবিত্রীর চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে। সে মাথা নিচু করে।
.
০৯.
সুদর্শন ধীরে ধীরে একসময় শুরু করে।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, বুঝতেই পেরেছেন, আপনার দিদির মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়, তাকে কেউ নিষ্ঠুরভাবে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে।
সাবিত্রী কোন জবাব দিল না, সে মুখ তুলে সুদর্শনের দিকে তাকাল। নীরব অশ্রুধারায় তার গণ্ড ও চিবুক প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে তখন।
সুদর্শন বলতে থাকে, আমি জানি, আপনার দিদিকে আপনি খুব ভালবাসতেন। আমার যা কিছু, মৃদুকণ্ঠে বললে সাবিত্রী, দিদিই ছিল।
বুঝতে পারছি। তাই তো আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি। কারণ তার সম্পর্কে আপনি আমাকে যতটা সংবাদ দিতে পারবেন, আর কেউ তা হয়ত পারবে না।
আমি এখনও যেন ভাবতেই পারছি না, দারোগাবাবু, দিদি নেই—দিদির মৃত্যু হয়েছে। একটু আমুদে, রহস্যপ্রিয় ও বেপরোয়া ছিল দিদি বরাবরই সত্যি, এভাবে যে তাকে কেউ খুন করতে পারে—আমার চিন্তারও অতীত ছিল।
শুনেছি আপনার দিদি ইদানীং সংসারটা আপনাদের চালাচ্ছিলেন!
হ্যাঁ। যে কাজ ছিল দাদা আর ছোড়দার উচিত-কর্তব্য—সেটা দিদিই করছিল। আর তাই তো আমি ভেবে পাচ্ছি না, এরপর আমাদের সংসারের কি অবস্থা হবে!
ভাবছেন কেন, এখন হয়ত দাদা আর ছোড়দাই দেখবেন। জানেন না আপনি তাদের, তারা, কিন্তু ঝোকের মুখে বলতে গিয়েও কথাটা বলল সাবিত্রী; হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় যে কথাটা বলবার জন্য উদ্যত হয়েছিল সেটা আর সে বলল, নিজেকে যেন সংযত করে নিল।
দিদি আপনাকে খুব ভালবাসতেন, তাই না?
আমার থেকে মাত্র তিন বছরের বড়, কিন্তু সে ছিল আমার সব—একাধারে সব কিছু।
এবারে তো আপনার বি. এ. পরীক্ষা দেবার কথা!
পরীক্ষা হয়ত আর দেওয়াই হবে না।
হঠাৎ কি হল সুদর্শনের, সে বলে বসল, কেন হবে না, নিশ্চয়ই হবে—শুনুন সেরকম যদি কিছু হয়ই, আপনি নিঃসঙ্কোচে আমাকে জানাবেন, আমি হয়ত আপনাকে সাহায্য করতে পারব। জানাবেন তো?
সাবিত্রী তার জলে-ভরা দুটি চোখ বারেকের জন্য সুদর্শনের প্রতি তুলে আবার নামিয়ে নিল। কোন জবাব দিল না।
তাছাড়া আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, যেমন করেই হোক, আপনার দিদির হত্যাকারীকে আমি খুঁজে বের করবই। তবে আপনার সহযোগিতা-সাহায্য কিন্তু আমার চাই।
আমার সাহায্য। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় সাবিত্রী সুদর্শনের মুখের দিকে।
হ্যাঁ, আপনার সাহায্য।
কিন্তু আমি–
সুদর্শন মৃদু হাসল। বললে, আপনার চাইতে বেশি সাহায্য কেউ আমাকে করতে পারবে না!
কিন্তু কেমন করে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি?
আপনার দিদির সম্পর্কে আমি যা-যা জানতে চাই, আপনি যদি আমাকে বলেন।
কি জানতে চান বলুন?
আমি জানি এবং খবরও পেয়েছি, আপনার দিদির প্রতি দশ নম্বর পল্লীতে অনেকেরই নজর ছিল!
বিরক্ত দিদিকে অনেকেই করত জানি–
কে কে বলুন তো? আচ্ছা, আমিই বলি। আমার যদি ভুল হয় তো আপনি শুধরে দেবেন, কেমন? একটু থেমে সুদর্শন বলে, হীরু সাহা, খগেন পাঠক, কল্যাণ বসু
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন আপনি।
আর কেউ?
আরও ছিল।
আর কে?
হরগোবিন্দ ঘোষ।
যার ওই লেদ কারখানা আছে?
হ্যাঁ। আগের দু-দুটো বৌ মারা গিয়েছে। দেখা হলেই দিদিকে বিয়ে করবার জন্য প্রায়ই তাকে পথে-ঘাটে বিরক্ত করত।
বলেন কি!
আরও-ওই যে নরহরি সরকার—
সেও? নরহরিও?
হ্যাঁ।
ওরও কি বৌ নেই?
না। বছরচারেক হল বৌ গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। একটা ছেলে ও একটা মেয়ে আছে। আর এক ভাগ্নে ছিল, তাকে দূর করে দিয়েছে বাড়ি থেকে।
হুঁ। আর কেউ?
আরও একজন দিদিকে বিয়ে করতে চেয়েছিল জানি, কিন্তু দিদি তাকে প্রত্যাখ্যান করায় আর সে কখনও উচ্চবাচ্চ্য করেনি।
কে সে?
সুবোধদা।
মানে আপনাদের পাশের বাড়ির সুবোধ মিত্র?
হ্যাঁ।
আচ্ছা একটা কথা, আপনার দিদির কারও ওপর দুর্বলতা ছিল, জানেন? মানে কাউকে লাইক করতেন? বুঝতেই পারছেন, আমি কি বলতে চাই! ..
ওদের কারও প্রতি দিদির কোন দুর্বলতা ছিল বলে অন্তত আমি জানি না, তবে–
কি, তবে?
সুবোধদার প্রতি হয়ত তার মনটা—ওদের প্রতি যেমন, তেমন বিরূপ ছিল না। হয়ত সুবোধদার প্রতি দিদির কিছুটা দুর্বলতা বা প্রশ্রয় ছিল।
কীসে বুঝলেন?
বুঝতে পেরেছিলাম।
.
১০.
আচ্ছা আপনাদের পল্লীর বাইরের এমন কেউ কি ছিল যার প্রতি হয়ত তার—আপনার দিদির কোন দুর্বলতা বা ভালোবাসা ছিল। এবারে সুদর্শন জিজ্ঞাসা করে।
মনে হয়নি কখনও সেরকম কিছু।
কি করে বুঝলেন?
হলে অন্তত আমি জানতে বোধ হয় পারতাম।
হুঁ। আচ্ছা আপনার দিদির কাছে কেউ আসত না? আর কারোর সঙ্গে তাঁর আলাপ ছিল না?
না।
কিন্তু আমি শুনেছি কে একজন সুট-পরা ভদ্রলোক নাকি মধ্যে মধ্যে মাধবী দেবীকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যেতেন।
কে—অমরবাবুর কথা বলছেন?
তা জানি না। অমরবাবু কে?
উনি এক অফিসে কাজ করেন। ওঁদের অফিসে থিয়েটার করতে গিয়ে দিদির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।
লোকটির বয়স কত হবে?
ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে বলে মনে হয়।
অমরবাবুর সঙ্গে আপনার দিদির কি রকম ঘনিষ্ঠতা ছিল?
আলাপ-পরিচয় ছিল জানি, তবে সেরকমের কিছু ঘনিষ্ঠতা হলে আমি জানতে পারতাম নিশ্চয়ই।
দিদি বুঝি সব কথাই আপনাকে বলতেন?
সবই বলত। রাত্রে আমরা এক বিছানায় শুতাম তো। শুয়ে শুয়ে গল্প হত।
অমরবাবুর কথা কখনও বলেননি?
না।
আপনার দিদি তাহলে কাউকে ভালবাসতেন বলে আপনার মনে হয় না?
মনে হয়নি কখনও।
আচ্ছা আপনার দিদি তো অনেক টাকা উপায় করতেন, তাই না?
তা বোধ হয় করত।
কেন, উপার্জনের কথা আপনাকে কখনও বলেননি?
না, আমিও জিজ্ঞাসা করিনি কখনও।
সব টাকা তো আর খরচ হত না, নিশ্চয়ই কিছু কিছু জমাতেন?
বোধ হয়।
জানেন না কিছু সে সম্পর্কে?
না, সঠিক কিছু জানি না। আমিও কখনও জিজ্ঞাসা করিনি, সেও বলেনি।
কোথায় টাকা রাখতেন—ব্যাঙ্কে?
হতে পারে। কারণ সব সময়ই দিদি আমাকে বলত, কিছু ভাবিস না সাবি, তুই পড়ে যা-যতদূর পড়তে চাস; তারপর খুব ভাল একটা ছেলে দেখে তোর বিয়ে দেব। আমি বলেছি, তুমি বিয়ে কর না। দিদি হেসেছে।
দিদির জামা-কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র কোথায় থাকত?
আমাদের ঘরে একটা সুটকেসের মধ্যে।
তার চাবিটা কোথায়?
আমি জানি না। চাবিটা সব সময় তার হ্যান্ডব্যাগেই বোধ হয় রাখত দিদি।
আগামী কাল আমি একবার আপনাদের বাসায় যাব ভাবছি।
কেন?
যদি কোন ক্লু তার মধ্যে পাওয়া যায়!
কখন যাবেন?
সকাল দশটার মধ্যেই যাব।
আচ্ছা।
আর একটা কথা, আপনার দিদিকে কেউ কখনও কোন চিঠিপত্র লেখেনি?
ইদানীং আর কোন চিঠি আসেনি, তবে বছর দেড়েক আগে পর্যন্ত মধ্যে মধ্যে আকাশ-নীল রঙের খামে দিদির কাছে চিঠি আসত।
কার চিঠি?
বলতে পারি না।
শোনেননি কিছু কখনও আপনার দিদির মুখে?
না।
আপনি জিজ্ঞাসা করেননি?
না, করিনি।
আপনার জানবার কৌতূহল হয়নি?
কোন জবাব দেয় না সাবিত্রী, চুপ করে থাকে।
হুঁ। কতদিন সেরকম চিঠি এসেছে?
প্রায় বছরখানেক ধরে প্রতি মাসেই একখানা দুখানা। তারপর হঠাৎ একদিন আকাশনীল রঙের খামে চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল।
আপনার সে চিঠি সম্পর্কে, সত্যি বলবেন, কখনও কোন কৌতূহল হয়নি?
মিথ্যা বলব না-হয়েছে, জিজ্ঞাসাও করেছিলাম একবার, কে তোকে চিঠি লেখে রে দিদি?
তারপর?
দিদি জবাব দিয়েছিল, ও আমার এক বন্ধু। আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি কখনও তারপর।
আপনার দিদি সে-সব চিঠির নিশ্চয়ই জবাব দিতেন, নচেৎ আবার চিঠি আসবে কেন?
জবাব দিত কিনা জানি না, কখনও দিতে কিন্তু আমি দেখিনি।
থানার ঘড়িতে ওই সময় ঢংঢং করে রাত দশটা ঘোষণা করল।
অনেক রাত হল, এবার আমি যাই। সাবিত্রী উঠে দাঁড়ায়।
আর একটা কথা সাবিত্রী দেবী, আপনার দিদির গিনি জমাবার শখ ছিল, তাই না?
গিনি!
হ্যাঁ, গিনি।
তা—তা তো জানি না।
আপনি দেখেননি বা শোনেননি কখনও?
না।
আচ্ছা এবার আপনি যান—না, চলুন একা যাবেন না—রাত অনেক হয়েছে, থানা থেকে অনেকটা পথ। চলুন আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।
সুদর্শন উঠে দাঁড়াল ড্রয়ার থেকে টর্চটা বের করে পকেটে পুরে।
ইতিমধ্যে চারদিক কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। একে শীতের রাত, তায় প্রায় দশটা বেজে গেছে। অন্যান্য রাতের মত তখনও সে-রাত্রে কুয়াশা নামেনি।
রাতের আকাশ বেশ পরিষ্কার। চতুর্দশীর চাঁদের আলোয় চারদিক বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। বাইরে বেশ শীত। থানা থেকে বের হয়ে আসতেই সেটা উভয়েই টের পায়।
১১-১৫. আপনি আবার কষ্ট করে এলেন
১১.
আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন? সাবিত্রী বলে, একাই অনায়াসে আমি চলে যেতে পারতাম।
তা পারতেন, তবে এত রাত্রে এ পথটা খুব ভাল নয়। মিলের ওয়ার্কাররা এই সময়টা মদ খেয়ে ফেরে অনেকেই।
দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিল।
সাবিত্রী আবার মাথায় গুণ্ঠন তুলে দিয়ে আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল।
খুব শীত পড়েছে। সুদর্শন হাঁটতে হাঁটতে একসময় বলে।
সাবিত্রী সুদর্শনের কথার কোন জবাব দেয় না।
আচ্ছা সাবিত্রী–
হঠাৎ যে কেন সুদর্শন সাবিত্রীকে তুমি বলে সম্বোধন করে, নিজেও বুঝি বুঝতে পারে না।
বলুন?
তোমার দিদির কোন শত্রু ছিল বলে তোমার মনে হয়?
শত্রু?
হ্যাঁ।
না, তেমন তো কোন কিছু শুনিনি। তবে মনে হয় আমার, হীরু সাহার দিদির ওপর একটা আক্রোশ ছিল হয়ত!
কেন? আক্রোশের কারণ ছিল কি?
ছিল—
কি?
দিদিকে হীরু সাহা একসময় বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু দিদি flatly তাকে না করে দিয়েছিল।
তারপর?
সেই ব্যাপার নিয়ে দাদার সঙ্গে শুনেছি হীরু সাহার কথা-কাটাকাটি হয়েছিল।
পল্লীতে আর কারও কোন রকম তার প্রতি আক্রোশ ছিল না?
না। তাছাড়া আগেই তো আপনাকে বলেছি, দিদি অত্যন্ত বেপরোয়া আর দুঃসাহসী ছিল, কেউ আর থাকলেও দিদি কখনও বলেনি সে কথা আমাকে।
তোমার দাদাদের সঙ্গে দিদির সম্পর্ক কেমন ছিল?
দাদা দিদিকে দেখতে পারত না এতটুকু, ঠেস দিয়ে ছাড়া কথাই বলত না কখনও। দিদি অবিশ্যি কখনও কোন জবাব দেয়নি।
আর ছোড়দা?
ছোড়দা একটু বেশি রাগী হলেও দিদির সঙ্গে ভাল ব্যবহারই করত।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। মধ্যে মধ্যে টাকার দরকার হলে দিদির কাছেই যে তাকে হাত পাততে হত!
কেন? সে তো শুনেছি ভালই রোজগার করে!
করলে কি হবে, অত বাবুয়ানী করলে আর মদ খেলে টাকা থাকবে কোথা থেকে!
তোমার ছোড়দা ফিরেছে?
যখন বাড়ি থেকে বের হই তখনও আসেনি—
কাল যেন বাড়িতেই থাকে, আমি না যাওয়া পর্যন্ত—বোলো তাকে।
বেশ, বলব। কিন্তু—
যদি না ফিরে এসে থাকে, তবেই তো। না এলে আর কি করবে!
না, তা নয়—বলছিলাম, আর আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে না। আমি তো বাড়ির কাছে প্রায় এসেই গেছি, এবার একা-একাই আমি বাকি পথটুকু চলে যেতে পারব।
সুদর্শন বুঝতে পারে, সাবিত্রীর ইচ্ছা নয় সে আর তার সঙ্গে যায়।
সুদর্শন দাঁড়িয়ে গেল, বললে, বেশ, যাও।
সাবিত্রী পল্লীর দিকে এগিয়ে গেল। সুদর্শন কিন্তু তারপরও অনেকক্ষণ সেইখানেই পথের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে। সাবিত্রীর চলমান দেহটা ক্রমে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল একসময়।
চারদিকে একটু অদ্ভুত স্তব্ধতা। রাতের আকাশ থেকে নিঃশব্দে যেন শীতের হিম ঝরে পড়ছে। কোথায় যেন একটা কুকুর ডেকে উঠল। ধীরে ধীরে একসময় থানার পথে ফিরল সুদর্শন।
কয়েক পা অগ্রসর হতেই কানে এল একটা ক্ষীণ গানের সুর। কে যেন গান গাইতে গাইতেই পল্লীর দিকে এগিয়ে আসছে। ক্ষীণ হলেও গানের সুর ও কথাগুলি স্পষ্ট শুনতে পায় :
এত জল তোর কাজল চোখে পাষাণী আনলে বল্ কে—
সুদর্শন দাঁড়ায়।
গানের কথাগুলো কিছুটা যেন জড়ানো-জড়ানো। ক্রমশ গানের সুর আরও স্পষ্ট হয়। ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসে।
পরনে লংস ও গায়ে হাওয়াই শার্ট, মাথায় ও গলায় একটা কম্ফটার জড়ানো কে একজন গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে, আবছা-আবছা দেখতে পায় সুদর্শন। এবং প্রায় আসতে আসতে হঠাৎ বোধ হয় সুদর্শনকে দেখতে পেয়েই ওর হাত দুয়েক ব্যবধানে দাঁড়িয়ে পড়ে।
ঝাপসা ঝাপসা চাঁদের আলোয় সুদর্শন দেখতে পায়, লোকটা পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল। প্যাকেটে বোধ হয় একটাই সিগারেট অবশিষ্ট ছিল। সিগারেটটা মুখে দিয়ে পকেট হাতড়ে একটা দেশলাই বের করল। তারপর দুটো কাঠি জ্বালাবার চেষ্টা করল, কিন্তু একটাও জ্বলল না। আর কাঠি অবশিষ্ট ছিল না বোধ হয় দেশলাইয়ের বাক্সে।
বিরক্ত চিত্তে শূন্য দেশলাইয়ের বাক্সটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে দিতে বললে, লে বাবা, ফিনিশ!
হঠাৎ ওইসময় সামনে দণ্ডায়মান সুদর্শনের দিকে নজর পড়ায় ওর দিকে তাকাল এবং বললে, ম্যাচিস আছে নাকি স্যার?
সুদর্শন পকেট থেকে তার দেশলাইটা বের করে কয়েক পা এগিয়ে এসে লোকটির দিকে এগিয়ে ধরল।
.
১২.
লোকটি দেশলাইটা হাতে নিয়ে একটা কাঠি জ্বালিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে দেশলাইটা ফিরিয়ে দিয়ে জড়িত কণ্ঠে বললে, থ্যাঙ্কস!
ক্ষণপূর্বে দেশলাই-কাঠির আলোতেই লোকটিকে চিনতে পেরেছিল সুদর্শন—সাবিত্রীর ছোড়দা অমলেন্দু।
দেশলাইটা ফিরিয়ে দিয়ে আর একটি কথাও না বলে সিগারেট টানতে টানতে। অমলেন্দু পল্লীর দিকে এগিয়ে গেল। অমলেন্দুর দেহটা আবছা আলো-অন্ধকারে মিলিয়ে এ যেতেই সুদর্শন আবার থানার দিকে পা বাড়াল।
শীতের হিমঝরা রাত স্তব্ধ, নিঃসঙ্গ। থানার পথে ফিরতে ফিরতেই হঠাৎ কি মনে হয় সুদর্শনের, খানার দিকে না গিয়ে পল্লীর দিকেই চলতে লাগল আবার।
পল্লীর সব বাসিন্দাই ততক্ষণে যে যার ঘরে খিল এঁটে শয্যায় গা ঢেলে দিয়েছে। মাধবীদের গৃহের দিকে কেন জানি চলতে লাগল সুদর্শন। হঠাৎ কানে এল বেহালার একটা মিষ্টি সুর।
পল্লীর মধ্যেই কোথায় কে যেন বেহালা বাজাচ্ছে। সুরটা ভারি মিষ্টি এবং চেনাচেনা মনে হয় সুদর্শনের। সুরটা ধরা পড়ে—বাগেশ্রী। বাগেশ্রী সুরে চমৎকার আলাপ করছে বেহালায়। বেহালায় সেই সুরালাপের আকর্ষণে যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যায় সুদর্শন।
সুবোধ মিত্রের সেই চেনা বাড়িটার সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়ে গেল সুদর্শন। বাইরের দিককার একটা জানলা খোলা। খোলা জানলাপথে আলোর আভাস চোখে পড়ে।
সেই ঘর থেকেই বেহালার আলাপ ভেসে আসছে। এত রাত্রে সুবোধ মিত্রের বাড়িতে কে বেহালা বাজায়? সুবোধ মিত্রের বাড়ির বাইরের ঘর ওটা।
কদিন আগে দেখা ঘরের পরিচ্ছন্ন চেহারাটা যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুদর্শনের।
বেতের একসেট সোফা। কাচের একটা আলমারি-ভর্তি বই। একটি তক্তাপোশ এক কোণে—ওপরে সুজনি বিছানো। এক কোণে একটি ধ্যানস্থ বুদ্ধমূর্তি ও চিনেমাটির সুদৃশ্য একটি ভাসে একগোছা ফুল। দেওয়ালে ঝোলানো একটি বেহালার বাক্স।
আরও দুপা এগিয়ে গিয়ে জানলাপথে ভেতরে দৃষ্টিপাত করতেই সুদর্শনের নজরে পড়ল, ঘরের মধ্যে তক্তাপোশটার ওপর বসে চোখ বুজে আপন মনে বেহালা বাজাচ্ছে সুবোধ মিত্রই।
সুদর্শন মগ্ন হয়ে যায়। ভদ্রলোকের সঙ্গীতে ও বাদ্যযন্ত্রে চমৎকার দখল!
কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে বেহালা বাজনা শুনে সুদর্শন আবার পল্লী থেকে বের হয়ে এল।
মাঝামাঝি পথ এসেছে, হঠাৎ নজরে পড়ল আগাগোড়া একটা চাদরে আবৃত কে। একজন উল্টোদিক থেকে এগিয়ে আসছে।
হাতে ধরা একটা টর্চবাতি, মধ্যে মধ্যে টর্চের আলো এদিক-ওদিক ফেলছে সন্তর্পণে।
হঠাৎ টর্চের আলো সুদর্শনের গায়ে পড়তেই লোকটা বলে উঠল, কে? কে ওখানে?
সুদর্শন জবাব দেয় না। গলার স্বরেই চিনতে পেরেছিল অবিশ্যি–প্রশ্নকারী কে?
প্রশ্নকারী আরও কয়েক বা এগিয়ে এসে সরাসরি হাতের টর্চের আলো একেবারে সুদর্শনের মুখের ওপরে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে তার বিস্ময়-চকিত কণ্ঠ হতে নির্গত হয়, রাধেশ্যাম! দারোগা সাহেব যে!
নরহরিবাবু!
রাধেশ্যাম! প্রাতঃপ্রণাম।
প্রাতঃপ্রণাম কেন? এখন বোধ হয় রাত বারোটা—
রাধেশ্যাম! রাতের আর বাকি রইল কি?
তা এত রাত্রে ফিরছেন কোথা থেকে?
রাধেশ্যাম! কোথা থেকে আর-দোকান থেকেই ফিরছি।
সুদর্শন ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছিল, নরহরি সরকারের হাতে একটা ঝোলা। নরহরি যেন ঝোলাটা সামলাতে একটু ব্যস্তই হয়ে ওঠে।
এত রাত্রে দোকান থেকে?
রাধেশ্যাম! রাত আর কি? দোকানে তালাটালা দিয়ে বেরুতে বেরুতে একটু বিলম্ব হয়ে যায়!
তাই তো দেখছি। একটু বেশি বিলম্বই বোধহয় হয় আপনার!
রাধেশ্যাম! বিশ্বাস নেই, বুঝলেন দারোগা সাহেব, আজকালকার দিনে আর কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না তো। তাই নিজেকেই সব দেখাশুনো করে সামলে-সুমলে আসতে হয় আর কি! রাধেশ্যাম!
তা হাতে কি? র্যাশন নাকি?
রাধেশ্যাম! ঠিক ধরেছেন—র্যাশনই।
তা বাড়িতে আপনার কটি প্রাণী?
বেশি নয়—রাধেশ্যাম—তিনটি।
আপনি, আপনার ছেলেমেয়ে, এই তো?
রাধেশ্যাম! আজকাল দিনে তিনজনের খাইখরচাই কি কম? আপনিই বলুন না?
তা তো বটেই।
রাধেশ্যাম! অগ্নিমূল্য—সব অগ্নিমূল্য, বুঝলেন না? হাত দেবার জো আছে কি?
হাত পুড়ে ছাই হয়ে যায় যেন। রাধেশ্যাম! আচ্ছা চলি, প্রণাম-রাত হল।
আসুন।
নরহরি সরকার আর দাঁড়াল না। হনহন করে চলে গেল।
সুদর্শনের মনে হল যেন কতকটা দৌড়েই তার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল নরহরি সরকার।
.
১৩.
থানায় এক এক করে ডেকে এনে সুদর্শন পরের দিন সকাল থেকে দশ নম্বর পল্লীর অনেককেই নানা ভাবে জেরা করল।
সুদর্শন প্রথমেই ডেকেছিল হীরু সাহাকে।
হীরু সাহা থানায় ঢুকেই উদ্ধত ভঙ্গিতে বলে, কি ব্যাপার স্যার, বলুন তো? থানায় আসবার জন্যে জরুরী তলব পাঠিয়েছিলেন কেন?
বসুন।
না মশাই, বসে আড্ডা দেওয়ার সময় আমার নেই। কেন তলব পাঠিয়েছিলেন বলুন?
সুদর্শন আবার গম্ভীর গলায় কতকটা যেন আদেশের ভঙ্গিতেই বললেন, বসুন।
সুদর্শনের গলার স্বরেই বোধ হয় এবার হীরু সাহা খানিকটা থতমত খেয়ে যায়। সামনের খালি চেয়ারটায় বসে পড়ে। বসতে বসতে বললে, আশ্চর্য, এ তল্লাটে থানা অফিসার হয়ে এসেছেন বলে কি জুলুম করবেন সবার উপরে।
শুনুন হীরুবাবু, জুলুম নয়—আইনঘটিত একটা ব্যাপারের জন্যই আপনাদের পল্লীর প্রত্যেককেই আমাকে ডাকতে হয়েছে। কতকগুলো কথা আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই ও তার জবাব চাই।
বেশ। বলুন কি জানতে চান?
গত উনিশ তারিখে অর্থাৎ শনিবার যে রাত্রে মাধবী দেবী নিহত হন, সে রাত্রে কখন আপনি বাড়ি ফেরেন?
কেন বলুন তো?
যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দিন!
হীরু সাহা একবার তির্যক দৃষ্টিতে সুদর্শনের মুখের দিকে তাকাল। তারপর বললে, সে রাত্রে ভোর চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ বোধ হয় আমি ফিরেছিলাম বাড়ি।
বোধহয়? তা অত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?
যাত্রার রিহার্সাল ছিল আমাদের।
সারারাত ধরে যাত্রার রিহার্সাল?
হ্যাঁ, শনিবার শনিবার সারাটা রাত ধরেই প্রায় আমাদের রিহার্সাল হয়।
কোথায় রিহার্সাল হয়? যাত্রাদলের নাম কি?
নবীন অপেরা পার্টি।
কোথায় সেটা?
জুয়েলার নরহরি সরকারকে চেনেন?
দশ নম্বর পল্লীর আপনাদের নরহরি সরকার তো?
হ্যাঁ।
তা চিনি বৈকি।
তারই পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা দশ নম্বর পল্লীতে একটি যাত্রাপার্টি খুলেছি-নবীন অপেরা পার্টি।
কোথায় সেটা?
পল্লীতে ঢুকতে বড় রাস্তা পার হয়েই যে ছোট রাস্তাটার মুখে দোতলা লাল বাড়িটা–
যার দোতলায় একটা ব্যাঙ্ক আছে?
হাঁ। তারই একতলার ঘরে আমাদের নবীন যাত্রাপার্টির অফিস ও রিহার্সাল রুম।
কতদিন থেকে ওই যাত্রার দল খুলেছে?
বছর তিন হবে।
বটে! তা কি কি পালা করলেন?
পালা আজ পর্যন্ত দুটো হয়েছে। তৃতীয় নতুন পালার রিহার্সাল চলেছে।
কি পালা?
বীর ঘটোৎকচ।
বাঃ, বেশ নামটা তো! তা কার লেখা ওই পালাটা?
আমাদেরই দলের একজনের লেখা।
কে তিনি? আপনাদের দশের পল্লীর একজন কি?
হ্যাঁ, নরহরিদার নিজের লেখা।
বলেন কি, সরকার মশাই তো তাহলে দেখছি গুণী ব্যক্তি। তা উনিও যাত্রার দলের পার্ট করেন নাকি?
না।
কেন?
তাঁর সময় কোথায়?
খুব বিজি মানুষ, তাই না?
হ্যাঁ।
তা সে-রাত্রে রিহার্সালে আর কে কে ছিলেন?
আমরা জনা-চারেক।
মাত্র চারজনকে নিয়ে নতুন নাটকের রিহার্সাল প্রায় সারাটা রাত ধরে হল!
নতুন একটি মেয়ে নেওয়া হয়েছে যাত্রার দলে। সে-ই যাজ্ঞসেনী করবে। তাই মোশন মাস্টার তাকে আর আমাদের তিনজনকে নিয়ে বিশেষভাবে রিহার্সাল দিচ্ছিলেন।
.
১৪.
মোশনমাস্টারটি কে? সুদর্শন জিজ্ঞাসা করে।
অম্বিকাদা।
অম্বিকাদা! কে তিনি? আপনাদেরই দশ নম্বর পল্লীর কেউ?
হ্যাঁ।
তা ভদ্রলোক আর কি কাজকর্ম করেন?
স্টেট বাসের ড্রাইভার।
হুঁ। তা আপনারা তিনজন ছাড়া আর কে কে সেদিন রাত চারটে পর্যন্ত রিহার্সাল দিয়েছিলেন?
আমি, গোকুল খাঁ, আর ছিল অমলেন্দু—
অমলেন্দু, মানে অমলেন্দু ব্যানার্জী-মাধবী ব্যানার্জীর ভাই?
হুঁ।
সে-রাত্রে রাত চারটে পর্যন্ত রিহর্সালে ছিলেন অমলেন্দুবাবু?
না, রাত সাড়ে দশটা নাগাদ সে চলে যায়।
আপনি কখন রিহার্সাল-রুমে গিয়েছিলেন?
রাত সাড়ে নটা নাগাদ–খেয়েদেয়ে।
তাহলে রাত সাড়ে নটা থেকে রাত চারটে পর্যন্ত আপনি রিহার্সাল রুমেই ছিলেন?
তাই ছিলাম।
মধ্যে একবারও বাইরে যাননি?
না।
ঠিক করে মনে করে দেখুন-রাত সাড়ে দশটা থেকে রাত বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে!
না।
যাননি যে প্রমাণ করতে পারবেন তো?
পারব। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো?
মানে আপনাদের যার যার সঙ্গে মাধবী দেবীর পল্লীতে একটু ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাদের সে-রাত্রের গতিবিধি সম্পর্কে আমার জানা প্রয়োজন, তাই-
আমার সঙ্গে মাধবীর ঘনিষ্ঠতা ছিল, কে আপনাকে বললে?
ও কি আর চাপা থাকে মশাই, প্রেম-ট্রেমের ব্যাপার—
ভুল করেছেন তাহলে আপনি।
ভুল করেছি?
হ্যাঁ, রীতিমত ভুল। কারণ মাধবীর সঙ্গে আমার যাকে বলে ঝগড়াই ছিল। মুখদেখাদেখিও ছিল না ইদানীং।
ঝগড়ার কারণটা কি—প্রত্যাখ্যান?
আজ্ঞে না।
তবে?
সে আপনার শুনে কি হবে!
তবু না হয় শুনলাম।
বলতে আমি বাধ্য নই।
তাহলে আপনারই ক্ষতি—
মানে?
মানে তো সহজ। পুলিশ আপনাকেও মাধবীর হত্যাকারী হিসাবে সাসপেক্টসদের দলেই ফেলবে।
তার মানে বলতে চান আমি মাধবীকে হত্যা করেছি?
সেরকম ভাবাটা কি খুব অন্যায় কিছু? আপনিই বলুন না?
হঠাৎ যেন হীরু সাহা স্তব্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। সুদর্শনের মুখের দিকে। তারপর বলে, আপনি তাই বিশ্বাস করেন নাকি?
খানিকটা সন্দেহ থেকে যাচ্ছে বৈকি!
কেন?
সে-রাত্রে আপনার গতিবিধি সম্পূর্ণ না জানা পর্যন্ত সন্দেহের তালিকা থেকে তো আপনাকে বাদ দেওয়া যাবে না।
কিছুক্ষণ আবার হীরু সাহা চুপ করে থাকে। কি যেন ভাবে, তারপর বলে, আপনি বিশ্বাস না করলে কি করতে পারি বলুন! তবে জানবেন মাধবীকে আমি হত্যা করিনি।
হত্যা করেছেন–তা কি বলেছি হীরুবাবু? তাছাড়া–
সুদর্শন কথাটা শেষ করে না, হীরু সাহার মুখের দিকে তাকায়। হীরু সাহাও ওই সময় তার মুখের দিকে তাকায়।
তাছাড়া কি? হীরু সাহা মিনমিনে গলায় যেন প্রশ্নটা করে এবারে।
আমি জানি, আপনি মাধবীকে ভালবাসতেন!
কে-কে বললে?
হ্যাঁ, তাকে আপনি বিয়েও করতে চেয়েছিলেন; এবং প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন ইদানীং।
না।
নয়?
না, আপনি মিথ্যা খবর পেয়েছেন।
মিথ্যে খবর?
হ্যাঁ। ওর মত একটা সামান্য মেয়েকে ভালবাসতে যাব আমি কোন্ দুঃখে!
দুঃখে তো মানুষ ভালবাসে না, ভালবাসাটা আনন্দেরই প্রকাশ। যাক গে সে কথা, এবার বলুন তো, মাধবীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল আপনার কি নিয়ে?
সে সম্পূর্ণ আমার পার্সোনাল অ্যাফেয়ার!
সেটাও তাহলে বলবেন না?
বলবার কিছু নেই।
হুঁ। আচ্ছা, ওর দাদা অবিনাশবাবুর সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই হৃদ্যতা আছে?
ওটা তো একটা ছুঁচো। আই হেট হিম!
হুঁ। হীরুবাবু, কতদূর আপনি লেখাপড়া করেছেন? না সেটাও বলতে আপনার আপত্তি আছে?
আমি স্কুল-ফাইনাল পাস।
কবে কত বছর আগে পাস করেছেন?
মাধবীর দু বছর আগে।
সুদর্শন মল্লিক হীরু সাহাকে মাধবীর নামোচ্চারণ করতে শুনে মৃদু হাসল।
আচ্ছা, অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে আপনার হৃদ্যতা আছে কি?
অশিক্ষিত একটা বাস-ড্রাইভার, তায় বেহেড মাতাল! ওর সঙ্গে কথা বলতেও ঘৃণা হয়।
আর খগেন পাঠক?
কে, খগনা? ওই মোটর-মেকানিকটা? ওটা তো একটা বুদ্ধু দি গ্রেট নাম্বার ওয়ান!
আর কল্যাণবাবু?
ও তো আমাদের মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের পাণ্ডা। ওকে শ্রদ্ধা করে না এ তল্লাটে কে এমন আছে?
আর সুবোধ মিত্র—আপনাদের দশ নম্বর পল্লীর?
ও আমাদের পল্লীতে থাকে বটে, তবে আমাদের কারও সঙ্গে কখনও মেশেই না। বি. এ. পাস। অফিসে ভাল চাকরি করে। তার উপর আবার চমৎকার বেহালা বাজায়। ওর সঙ্গে আমাদের মত সাধারণ লোকের বন্ধুত্ব হবে, তাহলেই হয়েছে।
আচ্ছা, নরহরি সরকার লোকটা কেমন?
কেন বলুন তো! নরহরিদার ওপরেও আপনার সন্দেহ হয় নাকি?
ছি ছি, কি যে বলেন। সাত্ত্বিক, বৈষ্ণব মানুষ, ওঁকে সন্দেহ করব কি? এমনি জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম।
তা এবারে আমি যেতে পারি?
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। যাবেন বৈকি।
তাহলে চললাম। নমস্কার।
সুদর্শন কোন জবাব দেয় না। সে যেন অন্যমনস্কভাবে তখন কি ভাবছিল।
হীরু সাহা বের হয়ে যায় থানার অফিসঘর থেকে।
.
১৫.
হীরু সাহার পর সুদর্শন খগেন পাঠক ও কল্যাণ বসুকেও ডেকে পাঠিয়েছিল থানায়।
তাদের দুজনের কারও কাছ থেকেই বিশেষ কোন সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেনি সুদর্শন।
কল্যাণ বসু ওই দিন রাত্রে অর্থাৎ গত উনিশে শনিবার ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে আগের দিন থেকেই শয্যায় শুয়েছিল।
আর খগেন পাঠক নাকি ওই দিন রাত্রে ঘুমিয়েছিল। সে সত্য বলছে কি মিথ্যা বলছে, বাড়ির লোকদের জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে।
তাছাড়া কল্যাণ বসু লোকটার সরু পাকাটির মত যেরকম চেহারা, তাতে করে মাধবীর মত স্বাস্থ্যবতী ও পূর্ণযৌবনা একটি মেয়েকে গলা টিপে হত্যা করাটা অত সহজ নয়। অতএব ওদের দুজনের ওপরই সন্দেহটা সুদর্শনের তেমন জোরাল হয় না।
ঐদিনই বিকেলের দিকে এল অমলেন্দু, মাধবীর ছোড়দা।
অমলেন্দু প্রথমটায় আসতে চায়নি—আসেওনি। কিন্তু সাবিত্রী যখন বললে, ছোড়দা, থানার দারোগা ডেকে পাঠিয়েছেন-একবার ঘুরে আসতে ক্ষতি কি, অমলেন্দু কি জানি কেন আর আপত্তি জানায়নি।
কি একটা ছুটির দিন যেন ছিল ওই দিনটা। তাছাড়া অফ-ডিউটিও ছিল তার।
মাধবীর হত্যা-রহস্যের ব্যাপারটাই বিকেলের দিকে থানা-অফিসঘরে একা বসে বসে ভালছিল সুদর্শন, এমন সময় অমলেন্দু এল।
সে ঘরে ঢুকেই নিজে থেকেই বলল, আমার নাম অমলেন্দু ব্যানার্জি-মাধবীর ছোড়দা আমি। আমাকে আপনি ডেকেছেন শুনলাম।
বসুন, বসুন।
অমলেন্দু বিনাদ্বিধায় একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল।
অমলেন্দুর চেহারাটা খুব রোগা নয়, আবার মোটাও নয়-মাঝামাঝি। চোখের কোণে কালি, ভাঙা চোয়াল-দেখলেই মনে হয় দেহের ওপর রীতিমত অত্যাচার করে লোকটা। পরনে একটা পায়জামা ও একটা পাঞ্জাবি, তার ওপরে একটা আলোয়ান জড়ানো।
আপনিই তাহলে সাবিত্রী দেবীর ছোড়দা? সুদর্শন বললে।
হ্যাঁ, বললাম তো!
আচ্ছা, গত উনিশে শনিবার সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন?
আমি ও সময়টা কৃষ্ণনগরে একদল বরযাত্রী নিয়ে বাস চালিয়ে গিয়েছিলাম।
ঠিক বলছেন?
কেন, বেঠিক বলব কেন?
কিন্তু আমি যে খবর পেয়েছি অন্যরকম।
কী খবর পেয়েছেন, জানতে পারি কি?
আপনি সন্ধ্যে থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত যাত্রার রিহার্সাল দিয়েছেন!
বাজে কথা! একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা!
বলছেন মিথ্যে কথা?
আলবৎ। কিন্তু কোন্ শালা অমন মিথ্যে কথাটা বলেছে, বলুন তো?
তা জেনে আপনার কি হবে? আপনি বলছেন রিহার্সাল দেননি, ফুরিয়ে গেল! তবে এটা যদি প্রমাণিত হয় পরে যে আপনি রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত রিহার্সাল-রুমে রিহার্সাল দিয়েছেন, ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে দাঁড়াতে পারে এই আর কি!
মানে?
মানে সেই রাত্রেই কিছু পরে আপনার বোন মাধবীকে হত্যা করা হয়েছিল কিনা!
কি বলছেন স্যার? আপনি কি শেষ পর্যন্ত তাহলে আমাকেই আমার বোনের হত্যাকারী বলে ঠাওরালেন নাকি?
সে-রাত্রে ওই সময়টা—মানে রাত দশটা থেকে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত আপনার মুভমেন্ট সম্পর্কে যদি সঠিক প্রমাণাদি না দিতে পারেন, পুলিস আপনাকেও সন্দেহ করবে বৈকি।
বাঃ, মশাই, বেশ! চমৎকার বুদ্ধি! ভাই হয়ে আমি আমার বোনকে খুন করব।
তা প্রয়োজনে ও স্বার্থে ভাই বোনকে, বোন ভাইকে, স্বামী স্ত্রীকে ও স্ত্রী স্বামীকেও খুন অনেক সময় করে বৈকি!
হঠাৎ যেন অমলেন্দু কেমন বোবা হয়ে যায়। তারপর একসময় ধীরে ধীরে বলে,, না, স্যার, আপনি বিশ্বাস করুন, আমি তাকে সত্যিই খুব ভালবাসতাম। ব্যাপারটা শোনা অবধি কেবলই ভাবছি, কে তাকে খুন করতে পারে। যে-ই তাকে খুন করুক, যেমন করে হোক, তাকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে।
তাহলে বলছেন না কেন, ওই সময়টা সে-রাত্রে আপনি কোথায় ছিলেন? কারণ আমি জানি, আপনি আদৌ কৃষ্ণনগরে সে-রাত্রে বাস নিয়ে যাননি—যদিও সবাই তাই জানে, আপনিও সবাইকে তাই বলেছেন।
অমলেন্দু, সুদর্শনের শেষের কথায় হঠাৎ কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে যায় আবার।
কি, তাই সত্যি নয় কি? আপনি যাননি সে-রাত্রে বাস নিয়ে কৃষ্ণনগরে?
না, যাইনি।
তবে রাত সাড়ে দশটায় রিহার্সাল ক্লাব থেকে উঠে কোথায় গিয়েছিলেন? আর তার পরের দুটো দিন কোথায়ই বা ছিলেন রাত এগারোটা পর্যন্ত?
একটা বিশেষ কাজে আমাকে এক জায়গায় যেতে হয়েছিল।
কি কাজ? কোথায় যেতে হয়েছিল?
বলতে পারব না আমি।
বলবেন না!
বললাম তো বলতে পারব না।
হুঁ। আচ্ছা, বাসের ড্রাইভারি করে আপনি কত পান?
মাইনে ও উপরি-মানে ওভারটাইম নিয়ে শতিনেক মত পাই।
তবু আপনি সংসারে কিছু তো দিতেনই না, এমন কি মধ্যে মধ্যে আবার মাধবী দেবীর কাছ থেকেও টাকা নিতেন, সত্যি কিনা?
নিতাম। তা এত খবর পেলেন কোথায়?
যেখানেই হোক পেয়েছি, কিন্তু এখন বলুন তো, একা মানুষের অত টাকার আপনার কি এমন প্রয়োজন হত?
একটু-আধটু ড্রিঙ্ক করি আমি–
তাও আমি জানি। তা এখন কি করবেন? মাধবী দেবীই তো শুনেছি এতদিন আপনাদের সংসারটা চালাতেন!
কি আর করব—ও শালার মদটাই হয়ত শেষ-বেশ ছেড়ে দিতে হবে দেখছি।
পারবেন?
বোধ হয় পারব না। তবু চেষ্টা তো করতে হবে। কারণ বড়বাবু এর মধ্যেই নোটিশ দিয়ে দিয়েছেন, বাড়িতে আর তিনি থাকবেন না, মিলের কোয়ার্টারে চলে যাবেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। বড়বাবু আমাদের সুখের লোটন পায়রা। অত ঝামেলা তার সইবে কেন? তাই আমিও বলে দিয়েছি
কি বলে দিয়েছেন?
যেদিন খুশি যেখানে খুশি তার সে যেতে পারে।
১৬-২০. সুদর্শন একটু থেমে বললে
১৬.
সুদর্শন একটু থেমে বললে, তা সংসারে তো আপনাদের লোক কম নয়! একা একা চালাতে পারবেন?
যেমন করে তোক চালাব—চালাতেই তো হবে।
আচ্ছা শুনেছি সাবিত্রী দেবীর পড়ার খরচ মাধবী দেবীই দিতেন?
হ্যাঁ।
এখন আপনার বোন সাবিত্রীর পড়ার কি হবে?
ও বলছিল ছেড়ে দেবে। পরীক্ষা আর দেবে না। তা আমি বলে দিয়েছি, পরীক্ষা শালা দিতেই হবে। বি. এ. পাস তাকে করতেই হবে। বাবার খুব দুঃখ, তার একটা ছেলেমেয়েও বি. এ. পাস করল না।
কেন, মাধবী দেবী?
মাধবীটা কোনমতে থার্ড ডিভিসনে আই. এ. পাস করেছিল। তারপরই তো ঢুকে গেল চাকরিতে—আর সঙ্গে সঙ্গে অভিনয় করতে শুরু করে দিল।
আপনার বাবা মাধবী দেবীর অভিনয় করার ব্যাপারটা জানাতেন?
না। তিনি কোনদিনই জানতে পারেন নি। তারপর একটু থেমে অমলেন্দু বললে, বাবার ইচ্ছা ছিল ও চাকরি করতে করতেই বি. এ. পরীক্ষাটা দেয়, কিন্তু ওই বয়সে কাচা পয়সা হাতে এলে যা হয়—গেল মাথাটা বিগড়ে।
কেন, বিগড়ে গেল বলছেন কেন?
তাছাড়া কি! যা খুশি তাই তো করে বেড়াচ্ছিল।
যা খুশি তাই করছিলেন মাধবী দেবী? প্রশ্নটা করে তাকাল সুদর্শন অমলেন্দুর মুখের দিকে।
নয় তো কি! সেই কোন সকালে বের হয়ে যেত, তারপর রাত বারোটা সাড়ে বারোটার আগে কোনদিনই তো বাড়িতে ফিরত না।
থিয়েটার করত তো-হয়তো থিয়েটারের রিহার্সালে আটকা পড়ত।
হ্যাঁ, রিহার্সালই বটে। যাক গে, ওসব কথায় আর কাজ কি! কতদিন বলেছি, মাধু, এত রাত করে ফিরিস না, বয়সের মেয়েছেলে তুই, কখন একটা বিপদ-আপদ ঘটাবি। শেষ পর্যন্ত তাই ঘটল। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায় অমলেন্দু, কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
তারপর কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই বলে, কি যে হল—
সুদর্শন দেখতে পায়, অমলেন্দুর চোখের কোল দুটো যেন ছলছল করছে।
অমলেন্দুবাবু!
বলুন স্যার?
আপনার বোনের হত্যার ব্যাপারে কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?
সন্দেহ।
হ্যাঁ। মানে পল্লীর কাউকে—বাইরের কাউকে?
না না, পল্লীর কেউ তা করতে যাবে কেন? কত ছোট থেকে ওকে সবাই দেখে এসেছে–
কিন্তু আমি খবর পেয়েছি–
কি খবর পেয়েছেন?
অনেকেরই ওর ওপরে দৃষ্টি ছিল। এমন কি বিয়েও করতে চেয়েছিল মাধবীকে কেউ কেউ। প্রত্যাখ্যানের সেই আক্রোশে হয়ত–
এসব কথা আপনি কার কাছে শুনলেন?
শুনেছি। বিশেষ করে ওই হীরু সাহা—
মনে হচ্ছে, বড়বাবুই আপনাকে হয়ত ওই সব বলেছে!
তিনি তো বলেছেনই, আপনাদের পল্লীরই আরও দু-একজনের মুখেও শুনেছি।
অমলেন্দুকে যেন সহসা কেমন একটু বিব্রত বোধ হয়। একটু চুপ করে থেকে বললে, কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। কিন্তু তাই বলে সেই আক্রোশে–না না—
তাহলে আপনার কারও ওপর সন্দেহ হয় না?
না।
আরও কিছুক্ষণ এটা-ওটা কথাবার্তার পর অমলেন্দুকে ছেড়ে দিল সুদর্শন।
নাঃ, সমস্ত ব্যাপারটা যেন ক্রমশ বেশ জটিল হয়ে উঠছে!
সুদর্শন যেন কোন কূল-কিনারাই দেখতে পাচ্ছে না।
.
আরও দশ-বারো দিন কেটে গেল ঐ ঘটনার পরে।
মাধবীর আকস্মিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দশের পল্লী ও তার আশপাশে যে কৌতূহলের চাঞ্চল্য জেগেছিল, ধীরে ধীরে ক্রমশ সেটা যেন কেমন থিতিয়ে আসে।
পল্লীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আবার পূর্বের মতই চলতে শুরু করল, কিন্তু সুদর্শন মল্লিকের মনে যেন শান্তি নাই।
মাধবীর মৃত্যুটা যেন তাকে রীতিমত বোকা বানিয়ে দিয়েছে।
নানাজনকে সন্দেহ করেছে, নানা দিক দিয়ে ব্যাপারটা চিন্তা করবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোথায়ও কিছু যেন দানা বেঁধে ওঠেনি। অথচ তার দৃঢ় বিশ্বাস মাধবীর হত্যাকারী বাইরের কেউই নয়—ঐ পল্লীরই কেউ। কিন্তু কে?
ঠিক এমনি সময় একদিন বিকেলের দিকে একটা কালো রঙের ফিয়াট গাড়ি থানার সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ি চালাচ্ছিল লম্বা রোগা এক শ্বেতশুভ্র দাড়ি ও মাথায় পাগড়ি পাঞ্জাবী ড্রাইভার।
গাড়িটা থানার সামনে এসে দাঁড়াবার পর ড্রাইভার হীরা সিং গাড়ির দরজা খুলে দিল।
পরনে পায়জামা ও গরমের পাঞ্জাবি ও তার উপরে দামী একটা শাল জড়ানো, চোখে মোটা কালো সেলুলয়েডের চশমা, মুখে চুরুট, প্রায় ছফুটের কাছাকাছি লম্বা সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নামল।
থানার প্রহরাধীন সেপাইকে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করে, ও. সি. সাহেব আছেন?
জী হাঁ। যাইয়ে না, অফিস-কামরামেই সাব বৈঠা হ্যায়।
আগন্তুক এগিয়ে গেল অফিস কামরার দিকে। দরজা খোলাই ছিল।
আগন্তুকের খোলা দরজাপথে নজরে পড়ল, ও. সি. সুদর্শন মল্লিক গভীর মনোযোগের সঙ্গে সামনে টেবিলের ওপরে একটা মোটা ফাইল নিয়ে কি সব দেখছে।
আগন্তুক ভিতরে পা দিল, সুদর্শন!
চমকে মুখ তুলল সুদর্শন মল্লিক। তারপরই আগন্তুকের দিকে তাকিয়েই সোল্লাসে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, দাদা, আপনি! আসুন আসুন, বসুন-বসুন এই চেয়ারটায়।
সুদর্শন নিজের চেয়ারটাতেই আগন্তুককে বসবার জন্য অনুরোধ জানায়।
পাগল নাকি! ওটা হচ্ছে ও. সি.-র চেয়ার। আমি এই যে বসছি।
আগন্তুক বসল।
সুদর্শন যে কি করবে ভেবে পায় না। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, উঃ, সত্যি দাদা, আমি ভাবতেই পারছি না আপনি আমার এখানে আসবেন! দাদা, কি খাবেন বলুন? চা, না কফি?
কফি-চা করবেটা কে? আগন্তক মৃদু হেসে বলে, এখন তো বিয়েই করলে না—
একটা ভাল কমবাইন্ড হ্যান্ড পেয়েছি, জানেন দাদা!
তাই নাকি?
হ্যাঁ, শ্রীমান গোবর্ধন। বলতে বলতে হাসে সুদর্শন।
নামটি তো বেশ। তা পেলে কোথায় আজকালকার এই ভৃত্যসঙ্কটের দিনে?
পেয়ে গিয়েছি গুরুকৃপায়।
বল কি? গুরুও একটা পাকড়াও করেছ নাকি ইতিমধ্যেই?
গুরু লাভ তো আমার বহু পূর্বেই হয়ে গিয়েছে দাদা!
তাই বুঝি?,তা সে মহাশয় ব্যক্তিটি কে যে তোমার মত ঘোর নাস্তিক ও অবিশ্বাসীকে কৃপা করল?
কিরীটী রায়।
অ্যাঁ!
হ্যাঁ দাদা, আপনি। মনে মনে একলব্যের মত সেই কিশোরকাল থেকেই গুরু পদে বরণ করেছিলাম আপনাকে।
কিরীটী মৃদু হাস্যে বলে, কিন্তু কেন? হঠাৎ ও দুর্মতি হল কেন?
জানেন দাদা, প্রথমে ছিলেন হিরো-হিরো-ওয়ারশিপ, তারপর হলেন গুরু, পথপ্রদর্শক—বসুন দাদা, গোবর্ধনকে চায়ের কথা বলে আসি।
সুদর্শন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
১৭.
বছর সাতেক আগে এক ট্রেনের কামরায় কিরীটীর সঙ্গে সুদর্শনের আকস্মিক ভাবে প্রথম আলাপ হয়।
কিরীটী ও কৃষ্ণা মুসৌরী যাচ্ছিল ট্রেনে।
সেই ট্রেনেই যাত্রী ছিল সুদর্শন। সে তখন সবে বি.এস-সি পাস করে যা হোক। কিছু একটা চাকরির ধান্দায় ঘুরছে।
কাগজে বহুবার কিরীটীর ফটো ইতিপূর্বে দেখেছিল সুদর্শন এবং তাহার রহস্য উদ্ধারের অনেক অত্যাশ্চর্য কীর্তি-কাহিনী পড়ে পড়ে তার এক অন্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছিল।
একটা বড় জংশন স্টেশনে গাড়ি তখন থেমেছে। সবে ভোর হয়েছে। প্ল্যাটফর্মে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ ফার্স্ট ক্লাস কামরার জানলার ধারে উপবিষ্ট কিরীটীকে দেখতে পায় সুদর্শন।
চমকে ওঠে সুদর্শন। কি আশ্চর্য, কিরীটী রায়!
গাড়ি চলতেই সুদর্শন লাফিয়ে সেই ফার্স্ট ক্লাস কামরাতে উঠে পড়ে। তারপর বলে, আমার কিন্তু স্যার ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট নয়–থার্ড ক্লাসের–
তবে এ গাড়িতে উঠলে কেন? কিরীটী শুধিয়েছিল।
আপনাকে এই জায়গায় দেখে আপনার সঙ্গে আলাপ করবার লোভটা সামলাতে পারলাম না। তাতে যদি ফাইন দিতে হয় তো দেব।
তুমি আমাকে চেনো?
না চিনলে উঠেছি?
সুদর্শনের গন্তব্যস্থল ছিল হরিদ্বার—তার পিসেমশাইয়ের ওখানে। কিন্তু যে-যাত্রায় সে কিরীটীর সঙ্গে আলাপ হবার পর বেমালুম হরিদ্বারের কথা ভুলে গিয়ে সোজা তাদের সঙ্গে মুসৌরী চলে গিয়েছিল। তারপরই ঘনিষ্ঠতা।
কিরীটীই তার পরিচিত পুলিস-কমিশনারকে ধরে পরে সুদর্শনের চাকরি করে দিয়েছিল।
.
একটু পরে সুদর্শনের পিছনে-পিছনে চা নিয়ে এল গোবর্ধন ট্রেতে করে।
চা পান করতে করতে সুদর্শন একসময় বলে, ভগবান বোধহয় আপনাকে আজ হঠাৎ এভাবে আমার মুশকিল-আসানের জন্যেই পাঠিয়েছেন দাদা।
তোমার আবার মুশকিলটা কি হল সুদর্শন। কিরীটী মৃদু হেসে শুধায়।
বিশ্রী একটা হত্যা-মামলা—
হত্যা মামলা?
হ্যাঁ, দাদা। কদিন ধরে যত ভাবছি ততই যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, দাদা। মনে মনে বোধ হয় তাই আপনাকেই খুঁজছিলাম-ডাকছিলাম—
তোমার রহস্যের কথা শুনব, তার আগে আমার কিছু সংবাদ চাই।
কীসের সংবাদ দাদা?
জান তো, তোমার এই থানা এলাকাতেই অল্প দূরে রেলওয়ে ইয়ার্ডটা আছে—মানে হাওড়ার রেলওয়ে ইয়ার্ড–
হ্যাঁ, জানি তো–আমারই এলাকা।
গত কয়েক বছর ধরে ওয়াগন থেকে হাজার হাজার টাকার মাল চুরি যাচ্ছে। বিশেষ করে ধুতি-শাড়ির পেটি, কেরোসিন, সরষের তেলের ও ঘিয়ের টিন আর দামী দামী ওষুধপত্রের বড় বড় প্যাকিং। অথচ রেল পুলিস আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যাপারটার কোন কিনারা করতে পারেনি–
জানি, সব জানি। এখানে পোস্টিংয়ের সময় বড়কর্তা আমায় সব বলেছিলেন, যদিও আমি কিন্তু দাদা চেষ্টা করে আজ পর্যন্ত কিছু ধরতে পারিনি।
সেই ব্যাপারটারই একটা হদিস খুঁজে বের করবার ভার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে আমার কাধে গত মাসে চাপানো হয়েছে।
সত্যি!
হ্যাঁ। তাই এই তল্লাটের একটা খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানলাম, এই থানায় তুমি কিছুদিন হল এসেছ ইনচার্জ হয়ে। ভাবলাম তোমার সঙ্গেই তাহলে সর্বাগ্রে একবার দেখা করা প্রয়োজন।
তাই এসেছেন?
তাই।
ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে রীতিমত রহস্যজনক দাদা, কারণ আমার আগে চারজন থানা অফিসারকে এক বছর দেড় বছরের মধ্যেই বদলি করা হয়েছে তাদের অপটুতার জন্যে। যদিও আমার ধারণা–
কি?
আমার পূর্বতন অফিসারদের ওই ব্যাপারে কিছুটা ইচ্ছাকৃত অবহেলাছিল।
কেমন করে বুঝলে?
অবিশ্যি তারা হয়ত প্রাণের ভয়েই চুপচাপ থেকেছে বা এড়িয়ে গেছে। ব্যাপারটা–
প্রাণের ভয় ছিল কিনা জানি না, তবে একটা সংবাদ ওই চারজন অফিসার সম্পর্কেই আমি যোগাড় করেছি ইতিমধ্যে।
কি সংবাদ পেয়েছেন?
দুজন তাদের মধ্যে কলকাতার বাইরে জমিজমা কিনেছে, মেয়ের বিয়ে দিয়েছে খরচপাতি করে ভাল ঘরে, আর একজন জমি কিনেছে ও একজন বাড়ি করছে–
বলেন কি দাদা! তার মানে–
তার মানে ঠিক যা স্বাভাবিক তাই। তাদের পরোক্ষ প্রশ্রয় ছিল ওই ব্যাপারে। হয়ত প্রাণের ভয়টাও ছিল, একটু আগে তুমি যা বলছিলে—
.
১৮.
সুদর্শন অতঃপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। তারপর বলে, জানি না দাদা তারা কতটুকু জানতে পেরেছিল। তবে আমি এই চার মাসে নির্ভরযোগ্য তেমন কিছুই জানতে পারিনি। অবিশ্যি না জানতে পারলেও একটা কথা আমার মনে হয়—
কি?
কাছেই একটা জায়গা আছে, যাকে এ তল্লাটের লোকেরা দশ নম্বর পল্লী বলে থাকে–
আমিও জেনেছি সেটা।
ঐ পল্লীতে বহু লোকের বাস। অনেকদিন আগে থাকতে ঐ অঞ্চলে লোকের বসবাস ছিল, তারপর বহু ঘর রিফিউজি এসে আশপাশের পড়ো জমি জবরদস্তি দখল করে ঘরবাড়ি তুলে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করে দেয়। ফলে একটা মিশ্র অথচ যৌথ বিরাট অঞ্চল গড়ে ওঠে ক্রমশ গত পনেরো-কুড়ি বছর ধরে। এবং সকলে মিলে নাম দিয়েছে তার দশ নম্বর পল্লী।
কেন, দশ নম্বর পল্লী নাম হল কেন?
এ তল্লাটে আশেপাশে ওই ধরনের ছোট ছোট আরও নটি পল্লী আছে। অবিশ্যি ভেতরে গেলে আপনার মনে হবে বিরাট একটা কলোনী যেন। বেশ কিছু পাকা বাড়ি, ইলেকট্রিক তো আছেই-রাস্তাঘাটও চলাচলের পক্ষে ভাল করা হয়েছে
আর পল্লীবাসীরা?
শিক্ষিত অশিক্ষিত নানা শ্রেণীর মানুষ আছে। অফিসের কেরানী থেকে শুরু করে প্রফেসার, স্কুলমাস্টার, মেকানিক, মোটর-ড্রাইভার, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, বহু ভদ্র গৃহস্থ পরিবার আছে। এবং আছে সামনের অন্নপূর্ণা জুট মিলের বহু কর্মী। আমার মনে হয়, সামনের ইয়ার্ডের ওয়াগন-ব্রেকের ব্যাপারে যারা জড়িয়ে আছে, তাদের বেশ কিছু ওই দশ নম্বর পল্লীরই বাসিন্দা।
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে সুদর্শন, তোমার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে।
ও-কথাটা ভাববার অবিশ্যি আমার আরও একটা কারণ আছে দাদা।
কি?
নিষিদ্ধ অনেক ব্যাপার ওই পল্লীতে চলে। যেমন চোরা কারবার, মদচোলাই—
মিল ওয়ার্কাররা থাকলে তা তো হবেই।
আরও আছে, সুদর্শন বলে, গত তিন বছরে পাঁচটা খুন হয়েছে ওই তল্লাটে।
তাও জানি।
এবং তারা সবই পুরুষ। গত ১৯শে শনিবার শেষ খুন হয়েছে—
তাও জানি-একটি মেয়ে–
হ্যাঁ। একটি মেয়ে, তাও আপনি জানেন দেখছি! তা ওই খুনের ব্যাপারটাই আপনাকে আমি বলব ভাবছিলাম। ব্যাপারটা যেন আগাগোড়াই একটা মিস্ত্রি-ধোঁয়াটে–
মেয়েটির বয়স কত? চব্বিশ-পঁচিশ ছিল না?
হ্যাঁ। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত এক অন্ধ স্কুল-মাস্টারের মেয়ে। আই. এ. পাস করে শর্টহ্যান্ড শিখে একটা অফিসে চাকরি করছিল, আর সেই সঙ্গে—মেয়েটির চমৎকার অভিনয়-প্রতিভা ছিল, অ্যামেচার ক্লাবে অভিনয় করেও বেশ উপার্জন করত—
আর কিছু জানতে পারনি মেয়েটির সম্পর্কে?
না।
স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল?
বোধহয় খুব পরিষ্কার ছিল না।
প্রেমঘটিত ব্যাপার?
তাও তেমন শুনিনি, তবে—
কি?
ওর প্রতি সকলেরই নজর ছিল।
স্বাভাবিক। মেয়েটি বোধহয় দেখতে সুন্দর ছিল।
বলতে পারেন সত্যিকারেরই সুন্দরী।
অর্থাৎ সুন্দরী, যুবতী—
হ্যাঁ।
আলাপ হয়েছিল?
হয়েছিল। একটু যেন ফ্লার্টারিং টাইপের ছিল। সংক্ষেপে ব্যাপারটা আপনাকে বলি দাদা, সব শুনলে হয়ত আপনি মোটামুটি একটা কিছু আন্দাজ করতে পারবেন মেয়েটি সম্পর্কে।
ইতিমধ্যে শীতের বেলা ঝিমিয়ে এসেছিল। বিষণ্ণ আলোয় চারদিক ম্লান হয়ে উঠেছিল।
কিরীটী বললে, তোমার কাহিনী শুরু করবার আগে আর এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা কর সুদর্শন।
নিশ্চয়ই দাদা, এখুনি ব্যবস্থা করছি।
সুদর্শন উঠে গেল।
খোলা দরজা-পথে বাইরের স্লান বিষণ্ণ আলোর দিকে চেয়ে চুপচাপ বসে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে কিরীটী ধূমপান করতে থাকে।
বেশ শীত-শীত লাগে।
.
সুদর্শনের কাহিনী শেষ হতে ও সকলের জবানবন্দি পড়তে পড়তে রাত প্রায় নটা হয়ে গেল।
কিরীটী মধ্যে মধ্যে দু-একটা প্রশ্ন করেছে-যেমন, ওই পল্লীর যে সব লোকেদের তুমি ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছ সুদর্শন, তারা ছাড়াও তো অনেকে আছে?
তা আছে।
পল্লীর দু-চারজন বৃদ্ধ বা প্রৌঢ় ব্যক্তিকেও ডেকে তোমার জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত ছিল।
তা হয়ত ছিল, কিন্তু আমার মনে হয় দাদা–
বুঝতে পারছি সুদর্শন—ওই হীরু সাহা, খগেন পাঠক, কল্যাণ বসু, হরগোবিন্দ ঘোষ, নরহরি সরকার, অবিনাশ ও অমলেন্দু ব্যানার্জি-ওরাই তোমার মনে বিশেষভাবে রেখাপাত করায় তুমি তোমার অনুসন্ধানী দৃষ্টিটা ওদের ওপরেই ফেলেছ, তাই নয় কি!
কতকটা তাই–
.
১৯.
কিরীটী মৃদু হাসল, তারপর হাতের চুরুটে একটা টান দিয়ে বললে, সুদর্শন।
বলুন দাদা?
কথামালার একচক্ষু হরিণের গল্পটা তোমার মনে আছে? সেই যে—যে দিকটা সম্পর্কে সে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত ছিল, অবশেষে সেই দিক থেকেই এল মৃত্যুর আঘাত?
আপনি কি বলতে চান দাদা!
এসব ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব করেছ কি পদস্খলন অনিবার্য।
বুঝতে পারলাম না ঠিক দাদা আপনার কথা!
বলছি শ্রীমতী সাবিত্রী দেবীর কথা—
সহসা সুদর্শনের চোখ-মুখ যেন লাল হয়ে ওঠে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, মেয়েটি সত্যিই ভাল, আর মাধবীর আকস্মিক মৃত্যুতে এমন অসহায় হয়ে পড়েছে–
কিরীটী সুদর্শনের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু মদু হাসে।
ওকে দেখলে আপনারও সিমপ্যাথি হবে–
তা হয়ত হবে—যখন তোমার ইতিপূর্বেই হয়েছে। তবে কি জান—
কি?
ক্ষেত্রবিশেষে সিমপ্যাথি ব্যাপারটা যেমন প্রশংসনীয় ও একান্ত প্রয়োজনীয়, তেমনি ক্ষেত্রবিশেষেই আবার হয় মারাত্মক। যাক, আজ আমি এবার উঠব। রাত অনেক হল।
কিন্তু দাদা, আপনি তো কিছুই বললেন না?
বলব, বলব।
কখন?
দুটো দিন ব্যাপারটা আমায় একটু ধীরে-সুস্থে ভাবতে দাও।
কিন্তু–
কিরীটী ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। বললে, আজ বুধবার, সামনের শনিবার এই সময় আসব।
আসবেন আবার?
হ্যাঁ, ইয়ার্ডটা রাতের অন্ধকারে একবার ঘুরে দেখা প্রয়োজন।
কিরীটীকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সুদর্শনও উঠে দাঁড়ায় সঙ্গে সঙ্গে।
গাড়িতে ওঠবার পর হীরা সিং গাড়িতে যখন স্টার্ট দিয়েছে, কিরীটী বললে, সুদর্শন, ছোটবেলায় যে যোগ অঙ্ক শিখেছিলে, দুয়ে দুয়ে যোগ করে চার হয়—সে অঙ্কটা ভুলে যেয়ো না!
সুদর্শন প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসে।
গাড়ি চলতে শুরু করে। কিরীটীর শেষ কথাটা সুদর্শনের কানে আসে, দুয়ে দুয়ে যোগফল চারই হয়—পাঁচও হয় না, তিনও হয় না। কম-বেশি হবার উপায় নেই।
গাড়িটা চোখের সামনে থেকে বের হয়ে গেল।
সুদর্শন ধীর পদক্ষেপে থানায় তার অফিস-ঘরে ফিরে আসে। কিরীটীর শেষের কথাগুলো তখনও তার মধ্যে আনাগোনা করছে।
কিরীটী যে ইঙ্গিতটা দিয়ে গেল, তার অর্থ কি? তবে কি সে আগাগোড়াই ভুলপথে চলেছে? হাতের সামনে সব থাকা সত্ত্বেও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে?
হয়ত তাই। দুটো ব্যাপারের সঙ্গে হয়ত সত্যিই একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। সেই দিক থেকে অগ্রসর হতে পারলেই মাধবীর হত্যা-রহস্যটা হয়ত পরিষ্কার হয়ে যাবে।
নাঃ, আর একবার দশ নম্বর পল্লীটা তাকে ভাল করে ঘুরে দেখতেই হবে।
সত্যিই হয়ত সে বিশেষ কয়েকটা মানুষ সম্পর্কেই কেবল চিন্তা করছে বলেই আসল কালপ্রিটের কোন সন্ধানই এখনও পর্যন্ত পায়নি।
মাধবীর হত্যা-রহস্যের সঙ্গে হয়ত ওই লোকগুলোর কোন সম্পর্কই সত্যিই নেই।
নতুন করে আবার সমস্ত ব্যাপারটা আগাগোড়া ভাববার চেষ্টা করে সুদর্শন।
শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে যায় সুদর্শনের। এবং শুতে যখন যায় তখন সে ভাবতেও পারেনি, পরের দিন প্রত্যুষে জটিলতর আর একটি সংবাদ তার জন্য অপেক্ষা করছে।
একটু বেলাতেই সুদর্শনের ঘুম ভাঙে গোবর্ধনের ডাকাডাকিতে।
বাবু, বাবু—
কি রে? ভোরবেলা চেঁচামেচি শুরু করেছিস কেন?
আজ্ঞে সেপাই রামলোচন আপনাকে ডাকছে।
কেন, কি হয়েছে?
.
২০.
গরম আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে, চপ্পলের মধ্যে কোনমতে পা দুটো গলিয়ে ঘুমজড়ানো চোখে শোবার ঘর থেকে বের হয়ে এল সুদর্শন।
সামনেই দাঁড়িয়ে রামলোচন সিকদার। ছোকরা কনস্টেবল। বছর দুই চাকরিতে ঢুকেছে—যেমন চালাক, তেমনি চটপটে।
কি রামলোচন, কি খবর?
হুজুর, এ তল্লাটে আবার একটা খুন হয়েছে।
খুন! হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খায় সুদর্শন। ঘুমের শেষ রেশটুকু যেন সঙ্গে সঙ্গে চোখের পাতা থেকে মুছে যায়। বললে, কোথায়? কে খুন হল আবার? পল্লীর কেউ নাকি?
আজ্ঞে, লোকটা এক পাঞ্জাবী। দশ পল্লীর কেউ নয়।
পাঞ্জাবী?
হ্যাঁ। লোকটাকে একদিন আমি দিন-পনেরো আগে ওই যে—যে মেয়েটির বড় ভাইয়ের সঙ্গে বড় রাস্তায় যে কানন রেস্টুরেন্টটা আছে, সেই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোতে দেখেছিলাম।
ডেড বডি কোথায়?
ওই মাঠটার মধ্যে।
সুদর্শন আর দেরি করে না, চটপট জামা-কাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে জমাদার রামশরণ সিং, জনা-চারেক কনস্টেবল ও সঙ্গে রামলোচনকে নিয়ে বের হয়ে পড়ল।
মৃতদেহটা সেই মাঠের বট গাছটার সামনে পড়েছিল।
উপুড় হয়ে পড়ে আছে মৃতদেহটা। পরনে দামী ক্রিম কালারের ট্রপিক্যাল স্যুট, পায়ে দামী গ্লেসকিডের সু, মাথায় পাগড়ি, মুখে দাড়ি। পৃষ্ঠদেশের ঠিক মাঝামাঝি একটা ক্ষতস্থান। প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল মনে হয় ক্ষতস্থান থেকে।
পিঠের জামার যে অংশটায় গুলি বিধেছিল তার চারপাশ রক্তে ভেজা। লাল হয়ে আছে। মৃতদেহের হাত দুটো ছড়ানো।
দশ নম্বর পল্লীর লোকেরা বোধ হয় ব্যাপারটা জানতেও পারেনি তখনও, কারণ আশপাশে কেউ ছিল না। কাউকেই সেখানে দেখতে পেল না সুদর্শন। আশপাশের ঘাস তখনও শিশিরসিক্ত।
সুদর্শনের বুঝতে কষ্ট হয় না লোকটা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে, এবং পেছন দিক থেকেই তাকে কেউ গুলি করেছিল।
হয়ত এমনও হতে পারে, সুদর্শনের মনে হয়, হত্যাকারী লোকটাকে অনুসরণ করেছে পিছন থেকে, তারপর সুযোগ বুঝে গুলি করেছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, লোকটা এই জায়গায় কেন এসেছিল?
আরও একটা কথা, হত্যাকারী কি জানত যে লোকটা এখানে আসবে কিংবা তাকে হত্যা করার জন্যই ফাঁদ পেতে এই নির্জন জায়গায় ডেকে আনা হয়েছিল, যাতে করে হত্যাকারীর সুবিধা হয় হত্যা করতে এবং গুলির শব্দটাও যাতে কেউ শুনতে না পায়।
নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিচু হয়ে বসে মৃতদেহটা উলটে দিল সুদর্শন।
বেশ বলিষ্ঠ লম্বা-চওড়া গঠন লোকটার, যেমন সাধারণত পাঞ্জাবীরা হয়। বাঁ হাতে একটা লোহার বালা, ডান হাতে একটা দামী সোনার রিস্টওয়াচ।
পকেট হাতড়ে একটা দামী সেন্টের গন্ধসিক্ত সিল্কের রুমাল, কিছু চিউয়িংগাম ও একটা দামী চামড়ার পার্স পাওয়া গেল।
পার্সের মধ্যে লোকটার একটা ফটো ও নামধাম পাওয়া গেল।
গুলজার সিং। ১৪নং ক্যামাক স্ট্রীট। গগনচারী ম্যানসন, থার্ড ফ্লোর, রুম নাম্বার ৫৬।
আর পাওয়া গেল পার্সের মধ্যে খান-দুই একশো টাকার ও দশ পাঁচ ও এক টাকার খুচরো নোটে মোট দুইশত আটান্ন টাকা। এছাড়াও গোটা দুই পেট্রোলের ভাউচার ও ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের একটা টেলারিং শপের ক্যাশমেমো দুশো সাতাত্তর টাকা এবং একটা চাবির রিং কোটের পকেটে।
মৃতদেহের ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ ছিল। রাইগার মর্টিস সেট-ইন করায় মুষ্টিটা শক্ত হয়ে গিয়েছিল।
আঙুলে বড় বড় নখ। নখের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটা বস্তু সুদর্শনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাদা রঙের খানিকটা পশম।
আঙুলের নখ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পশমটা একটা কাগজের মোড়ক করে সুদর্শন তার পকেটে রেখে দিল।
আরও একটি বস্তু প্যান্টের হিপ পকেটে পাওয়া গেল—ছোট একটি আমেরিকান ছয় চেম্বারের অটোমেটিক পিস্তল। পিস্তলের ছয়টি চেম্বারই গুলি-ভর্তি।
গুলজার সিংয়ের চেহারা ও প্যান্টের হিপ পকেটে লোডেড পিস্তল দেখে মনে হয় সুদর্শনের, লোকটা আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার কোন সুযোগই পায়নি হয়ত।
আততায়ী পেছন থেকে তাকে গুলি করেছে এবং খুব ক্লোজ রেঞ্জ থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে, লোকটা আত্মরক্ষার কোন সুযোগই পায়নি।
ক্ষতস্থানের চারপাশে জামার ওপরে কিছু কার্বন ডিপোজিট দেখা যায়।
পূর্বের সন্দেহটা তার মনে আরও দৃঢ় হয়, নিশ্চয় আততায়ী তার অলক্ষ্যে নিঃশব্দে তাকে ফলো করে পেছনে-পেছনেই আসছিল–প্রথম সুযোগেই পেছন দিক থেকে গুলি চালিয়েছে।
আশেপাশে কোন রক্তের চিহ্ন চোখে পড়ে না সুদর্শনের এবং কোন স্ট্রাগলের চিহ্নও। কোথাও নজরে পড়ে না তার।
২০-২৫. মৃতদেহটা দুজন সেপাইয়ের প্রহরায়
২১.
মৃতদেহটা দুজন সেপাইয়ের প্রহরায় রেখে সুদর্শন ফিরে এল থানায়।
মৃতদেহটা মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে এবং কোয়ার্টারে হোমিসাইডাল স্কোয়াডকে একটা সংবাদ পাঠাতে হবে।
সব ব্যবস্থা করতে করতে ঘণ্টা দুই লেগে গেল সুদর্শনের।
ইতিমধ্যে দশের পল্লীর বাসিন্দাদের মধ্যে সংবাদটা ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই তল্লাটে আবার একজন খুন হয়েছে। মাঠের মধ্যে ক্রমশ ভিড় জমে যায়।
রামশরণ সিং অনেককেই প্রশ্ন করে, তাদের মধ্যে কেউ গুলজার সিংকে চিনতে পারছে কিনা, আগে কখনও কেউ তাকে দেখেছে কিনা ঐ তল্লাটে!
ভিড়ের মধ্যে হীরু সাহা, খগেন পাঠক, অমলেন্দু ও হরগোবিন্দ ঘোষও ছিল।
তাদেরও রামশরণ ওই একই প্রশ্ন করে। কিন্তু তারা মাথা নাড়ে সকলেই-কেউ তারা ইতিপূর্বে লোকটাকে দেখেওনি, চেনেও না।
কেবল একজন বললে, ওকে বার-দুই দেখেছে কানন রেস্টুরেন্টে অবিনাশের সঙ্গে। তবে সেও চেনে না লোকটাকে।
যে গুলজার সিংকে দেখেছে বললে, সকলেই তার মুখের দিকে তাকায়।
চব্বিশ-পঁচিশ বছরের এক যুবক। পরিচয় জানা গেল স্কুল-ফাইন্যাল পাস করে আর পড়াশুনা করেনি। খুরোট রোডে একটা ছাপাখানায় কাজ করে, কম্পোজিটার। বেশ নাদুসনুদুস নাড়ুগোপাল প্যাটার্নের চেহারা। নাম জয়ন্ত বোস।
ইতিমধ্যে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে গেল।
মৃতদেহটা স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে মর্গে রওনা করে দিয়ে জমাদার রামশরণ সিং একজন সেপাইকে অকুস্থলে প্রহরায় রেখে থানায় ফিরে এল।
সুদর্শন তখন ফোনে কিরীটীর সঙ্গে কথা বলছিল।
হ্যাঁ দাদা, আবার একটা খুন হয়েছে কাল রাত্রে।
কিরীটী ফোনে শুধায়, তোমার ঐ দশ নম্বর পল্লীরই কেউ নাকি?
না, পল্লীর কেউ নয়।… হ্যাঁ, আইডেনটি তার পকেটেই পাওয়া গেছে। লোকটা পাঞ্জাবী-নাম গুলজার সিং।
তাহলে গুলজার সিংহকে নিয়ে খুনের সংখ্যা হল সাত! কিরীটী বললে।
তাই। তবে ওই পল্লীর একজন মাধবী ছাড়া আর সব বাইরের লোক।
তারপর মোটামুটি মৃতদেহ সম্পর্কে ও যা বুঝতে পেরেছিল সব বলে গেল কিরীটীকে ফোনেই।
তোমার কি মনে হচ্ছে সুদর্শন?
কিরীটী প্রশ্ন করে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সুদর্শনের বিস্তারিত বিবরণ শুনে।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে দাদা, সব হত্যা-ব্যাপারগুলোই এক সূত্রে গাঁথা। আপনার কি মনে হয়? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
তাই তো মনে হচ্ছে আপাতত। কিরীটী জবাব দেয়।
কিন্তু একজন ছাড়া কেউ পল্লীর বাসিন্দা নয়।
না হোক, তবু একটা কথা ভুলো না ভায়া, সব কটি হত্যাই ওই পল্লীর আশেপাশে সংঘটিত হয়েছে-যা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে একজন ছাড়া সবাই বাইরের লোক হলেও ঐ জায়গায় সবারই গতিবিধি হয়ত ছিল—which has got an importance।
সুদর্শন কোন জবাব দেয় না।
কিরীটী আরও বলে, তাছাড়া ঐ হত্যাকাণ্ডগুলোর আরও একটি দিক আছেতোমার মনে হয়েছে কিনা জানি না!
কি বলুন তো দাদা?
যদি ধরে নিই, প্রত্যেকটি হত্যার সঙ্গেই তোমার ওই দশ নম্বর পল্লীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে এবং ওই পল্লীরই এক বা একাধিক ব্যক্তির বিশেষ কোন স্বার্থের সঙ্গে ও হত্যাকাণ্ডগুলো জড়িয়ে—তাহলে–
আপনি কি বলতে চান দাদা?
সুদর্শনকে থামিয়ে দিয়ে কিরীটী বলে, যা বলতে চাই তা যদি হয় তো ওই পল্লীর মধ্যেই কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই হত্যার বীজ লুকিয়ে আছে।
কিন্তু মাধবীর হত্যার ব্যাপারটা
তুমি কিন্তু প্রথম থেকেই একটু ভুল করছ সুদর্শন!
ভুল?
হ্যাঁ। মাধবীর হত্যার ব্যাপারটাকে প্রথম থেকেই আলাদা করে ভাবার বা দেখবার চেষ্টা করছ। প্রেম বা প্রতিহিংসা হয়ত কিছু তার হত্যার ব্যাপারে থাকতে পারে এবং থাকাটা অসম্ভবও নয়, তাহলেও আমার মনে হচ্ছে—কিন্তু মূল উদ্দেশ্যটা তা নয়, মূলে হয়ত সেই একই কার্যকারণ যা গত তিন বছর ধরে এতগুলো লোকের প্রাণহানি ঘটিয়েছে।
একটু থেমে তারপর কিরীটী বলে, ভাল কথা, সাবিত্রীর সঙ্গে আলাপ কেমন হল?
কেন বলুন তো?
Dont neglect her! বলে কিরীটী ওপাশে ফোনটা নামিয়ে রাখল মৃদু হাসির সঙ্গে।
.
২২.
কিরীটীর শেষ কথাগুলো সুদর্শনকে যেন নতুন করে ভাবিয়ে তোলে।
সে ফোনটা নামিয়ে রেখে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরায়। মনে মনে ভাবে, তবে কি সে সত্যি-সত্যিই আগাগোড়া একটা ভুল পথ ধরে চলেছে?
কিন্তু তাহলেও মনে হচ্ছে, মাধবী-ওই ওয়াগন ভেঙে চুরি যারা করে এবং দীর্ঘদিন ধরে এ তল্লাটে যারা চোরা কারবার চালিয়ে এসেছে, তাদেরই দলের একজন—এ সম্ভাবনাটায় কেন যেন তার মন সায় দেয় না। ঐ দিক দিয়ে কথাটা যেন সে কিছুতেই ভাবতে পারে না।
মাধবী কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির ও showy টাইপের মেয়ে ছিল নিঃসন্দেহে এবং অফিসে চাকরি করার বাইরে তার অভিনেত্রী জীবনের মধ্যে হয়ত কিছুটা যৌন উচ্ছৃঙ্খলতাও ছিল।
কিন্তু তাই বলে অমন একটি শিক্ষিত মেয়ে চোরাকারবারীদের দলে যে ভিড়ে যেতে পারে, অতটা নিচে যে নামতে পারে—ভাবতে মনটা কেন যেন তার কিছুতেই সায় দেয় না।
তবে মনুষ্যচরিত্র নাকি বিচিত্র এবং বিশেষ করে নারীচরিত্র।
তাছাড়াও আজও কিরীটীর কথার ভাবে বোঝা গেল সাবিত্রী সম্পর্কে সে একটু উৎসুক, কিন্তু কেন? তবে কি সাবিত্রীকেই কিরীটী সন্দেহ করে।
কিরীটীর কথায় আরও একটা ব্যাপার স্পষ্টই মনে হল, এ তল্লাটের সব হত্যাব্যাপারগুলোই নাকি একই সূত্রে গাঁথা। সব কিছুর মূলে একই কার্যকারণ। এবং হত্যার বীজ ওই পল্লীর মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার মতে!
পল্লীর সকলকে সুদর্শন চেনে না। চেনার বা জানবার সুযোগও তার হয়নি আজ পর্যন্ত। তবে মোটামুটি যাদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে বা যারা তার মনের মধ্যে আঁচড় কেটেছে, তারাও যে একেবারে সবাই খাঁটি ও নির্দোষ, তাও যেন মন তার মেনে নিতে চায় না।
হীরু সাহা, খগেন পাঠক, কল্যাণ বসু, হরগোবিন্দ, নরহরি সরকার, অমলেন্দু, অবিনাশ…
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে অবিনাশ ও জয়ন্ত বোসের কথা এবং মনে পড়ে জমাদার রামশরণ সিং বলছিল, ওই জয়ন্ত বোসই গুলজার সিংকে নাকি দিন-দুই কানন রেস্টুরেন্টে অবিনাশের সঙ্গে দেখেছিল।
তাতে করে অন্তত এটা প্রমাণিত হচ্ছে গুলজার সিংয়ের এ তল্লাটে যাতায়াত ছিল। এ তল্লাটে গুলজার সিং লোকটা একেবারে অপরিচিত নয়।
আরও একটা কথা, পূর্বে মাধবী ছাড়া আরও পাঁচজন যে নিহত হয়েছিল গত তিন বছরে, তারাও পল্লীর কেউ নয়—বাইরেরই লোক।
তাদের মধ্যে দুজন ছিল যা পূর্ববর্তীদের থানার ডাইরির রেকর্ড থেকে জানতে পারা গেছে-দুজনেই বাঙালী, নাম সুধাংশু আর গোবিন্দ—দুজনেই লরী-ড্রাইভার।
আর একজন পাঞ্জাবী মুসলমান আনোয়ার খাঁ, সেও দূরপাল্লার লরী-ড্রাইভার ছিল।
একজন মাদ্রাজী সেলসম্যান একটা বিলাতি ওষুধ কোম্পানির, নাম থিরুমল ও একজনের পরিচয় যা সংগৃহীত হয়েছিল সে উত্তরপ্রদেশের লোক-মহারাজ চৌধুরী, লোকটার লরীর ব্যবসা ছিল।
গুলরাজ সিংয়ের অবিশ্যি পুরো পরিচয়টা এখনও পাওয়া যায়নি, তবে আর যাদের পরিচয় ডাইরির রেকর্ডে আছে, তারা সবাই লরী-ড্রাইভার বা লরীর মালিক।
কথাটা ভাবতে থাকে সুদর্শন।
লোকগুলো কেউ ছিল লরী-ড্রাইভার, কেউ ছিল লরীর মালিক।
অবিশ্যি থানার লিখিত ডাইরি ঐ লোকগুলো সম্পর্কে যদি সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় তাহলে কেউই তাদের মধ্যে চোরাকারবারী বলে মনে হয় না।
হয়ত আসল কারবারী যারা তার নেপথ্যেই থেকে গিয়েছে বরাবর পুলিসের সন্দেহ দৃষ্টি বাঁচিয়ে-ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আচ্ছা এমন কি হতে পারে, তারা এই দশ নম্বর পল্লীর কেউ।
তাই যদি হয় তো কে হতে পারে?
.
২৩.
চকিতে একটা সম্ভাবনার কথা সুদর্শনের মনে মধ্যে উদয় হয়। হয়ত ওয়াগন ভেঙে যেসব মাল চুরি করা হত, সে-সব কলকাতা শহরে বা অন্যান্য জায়গায় লরী করে পাচার করা হত এবং এখনও হচ্ছে।
ওয়াগন ভেঙে মাল চুরির ব্যাপারটাও গত তিন-চার বছর ধরে চলেছে-যা থানার পূর্ববর্তী অফিসারদের ডাইরির রেকর্ড থেকেই জানা যায়।
দশ নম্বর পল্লী ও তার পেছনের খোলা মাঠটার ওপাশেই রেলওয়ে ইয়ার্ড, যেখানে সব মালগাড়ি সান্টিং করা থাকে, অনেক সময় বাইরে থেকে লোডেড হয়ে আসবার পর ও এখান থেকে মাল লোডিংয়ের পরেও।
সব চাইতে বড় কথা, হত্যাগুলোও সব দশ নম্বর পল্লীর আশেপাশে সংঘটিত হয়েছে।
সব কিছু পর পর চিন্তা করলে স্বভাবতই মনে হয় একের সঙ্গে অন্যের একটা ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র কোথাও যেন আছে। আর থাকাটা কিছু বিচিত্র নয়।
সব গিঁটগুলোই সম্ভবত একটা দড়ির মধ্যেই রয়েছে।
রামশরণ জয়ন্ত বোসকে মাঠ থেকে আসার সময় সঙ্গে করেই এনেছিল, যদি সুদর্শন তাকে কোন প্রশ্ন করতে চায় এই ভেবে। জয়ন্তকে রামশরণ থানার বাইরের ঘরেই বসিয়ে রেখেছিল।
থানার ছোটবাবু সিদ্ধেশ্বর চক্রবর্তী সুদর্শনের সামনে এসে দাঁড়াল—স্যার?
অ্যাঁ? কিছু বলছিলেন মিস্টার চক্রবর্তী?
বলছিলাম স্যার, জয়ন্ত বোসকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবেন?
কে জয়ন্ত বোস?
ওই দশ নম্বর পল্লীতেই থাকে, একজন কম্পোজিটার। যে রামশরণকে বলেছে ওই মৃত ব্যক্তি গুলজার সিংকে নাকি দিন-দুই কানন রেস্টুরেন্টে দেখেছে।
হ্যাঁ, ডাকুন তো লোকটিকে।
জয়ন্ত এসে সুদর্শনের কামরায় ঢুকল।
সুদর্শন মুখ তুলে তাকাল লোকটার দিকে। বেশ নাদুসনুদুস নাড়ুগোপাল প্যাটার্নের চেহারা। দু-চোখে শশকের ভীত-চকিত দৃষ্টি।
বসুন। আপনার নাম জয়ন্ত বোস? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে স্যার।
দশ নম্বর পল্লীতেই থাকেন?
আজ্ঞে না, খুরোট রোডে থাকি।
এখানকার দশ নম্বর পল্লীতে আপনার যাতায়াত আছে শুনলাম?
হ্যাঁ স্যার, এখানে আমার দু-চারজন জানা লোক থাকে।
হুঁ, তা আপনি কোথায় কাজ করেন?
সুধাকর প্রিন্টিং ওয়ার্কসের আমি একজন কম্পোজিটার স্যার।
গুলজার সিং—মানে ওই মৃত লোকটাকে আপনি দেখেছিলেন কানন রেস্টুরেন্টে?
হুঁ স্যার, দিন-দুই দেখেছি অবিনাশবাবুর সঙ্গে।
কি করছিল?
আজ্ঞে চা-টা খাচ্ছিল ওরা।
সঙ্গে অবিনাশ ছাড়া আর কেউ ছিল?
আজ্ঞে আর কাউকে দেখিনি। একাই ছিল।
কোন্ সময় ওদের রেস্টুরেন্টে দেখেছিলেন?
দুদিনই সন্ধ্যার পর—মানে তখন সাড়ে সাতটা-আটটা হবে।
ওই সময় আপনি রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন কেন?
আজ্ঞে প্রেস থেকে ফেরার পথে ঐ সময় রোজই আমি ওখানে এক কাপ চা খেয়ে আসি।
ওখানে বুঝি খুব ভাল চা হয়?
হ্যাঁ স্যার। এলাচদানা-টানা কি সব মিশিয়ে একরকম স্পেশাল চা করে। চমৎকার খেতে।
স্পেশাল চা।
আজ্ঞে স্যার। ওই পথ দিয়ে মিলের সব পাঞ্জাবী লেবাররা যায়, তারা ওখানে চায়ের জন্য ভিড় করে। খুব বিক্রী।
হুঁ। রেস্টুরেন্টটার মালিক কে?
আজ্ঞে স্যার, গুলাব সিং।
পাঞ্জাবী?
হ্যাঁ। তবে অনেক দিন—প্রায় জন্ম থেকেই বাংলাদেশে আছে তো—ঠিক আমাদের মতই বাংলা বলতে পারে, পড়তেও পারে।
দশ নম্বর পল্লীর অনেকেই ওখানে চা খেতে যায় বোধ হয়?
তা ঠিক জানি না স্যার। তবে—
তবে?
দু-চারজন ছাড়া অন্য কেউ আমার নজরে বড় একটা পড়েনি। তবে আমি তো খানিকটা বে-টাইমে যাই
আর কাকে কাকে দেখেছেন?
আজ্ঞে আমাদের হীরু সাহা, অবিনাশ-অমলেন্দু, দুই ভাই, আর একদিন দেখেছিলাম সুবোধবাবুকেও।
মানে ওই সুবোধ মিত্র?
আজ্ঞে স্যার।
ওদের প্রত্যেককেই আপনি চেনেন?
চিনি।
রেস্টুরেন্টটা কেমন, পরিষ্কার?
হ্যাঁ স্যার। রেডিও আছে, রেডিওগ্রাম আছে, লেডিজদের জন্য স্পেশাল বন্দোবস্তও আছে দোতলায়।
দোতলা তো নয় রেস্টুরেন্টটা!
আজ্ঞে ঠিক তা নয়—তবে ভিতরে কাঠের আর একটা ফ্লোর আছে মাথার ওপরে, তাই বলছিলাম আর কি–
মেয়েছেলেরাও যায় তাহলে বলুন সেখানে?
নিশ্চয়ই, স্যার, যায় বৈকি। তাদের বসবার জন্য স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে কানন রেস্টুরেন্টে।
.
২৪.
সুদর্শন অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করে।
জয়ন্তবাবু!
আজ্ঞে?
কয়েক দিন আগে এই পল্লীর যে মেয়েটি খুন হয়েছে, তাকে চিনতেন না?
কে, মাধবীদি তো স্যার? নিশ্চয়ই। ভাল চাকরি করত, সুন্দর থিয়েটারও করত। একবার দেখেছিলাম মাধবীদির থিয়েটার। কি ফার্স্ট ক্লাস যে অ্যাকটিং করত স্যার মাধবীদি। আহা, আমি তো কেঁদেই ফেলেছিলাম।
তাই বুঝি?
আজ্ঞে ভারি প্যাথেটিক সিনটা ছিল কিনা।
কোথায় দেখেছিলেন থিয়েটার তার?
কলকাতার রঙমহল থিয়েটারে। আমাকে হীরু একটা কার্ড দিয়েছিল।
কে দিয়েছিল কার্ড! সুদর্শন যেন চমকে প্রশ্নটা করে।
আজ্ঞে স্যার, হীরু সাহা। খুব গায়ে জোর, দশ পল্লীর শ্রী।
পল্লীর শ্রী?
আজ্ঞে স্যার, গত বছর সবাই ওকে ওই টাইটেল আর রুপোর মেডেল দিয়েছিল।
সুদর্শন বুঝতে পারে, মানুষটা সরল এবং কিছুটা বোকা টাইপের। নচেৎ থানায় বসে অমন করে থানা-অফিসারের সামনে মন খুলে কথা বলতে পারত না।
জয়ন্তবাবু!
বলুন স্যার? আপনি লেখাপড়া কতদূর করেছেন?
স্কুল-ফাইনাল পাস করেছিলাম স্যার, কিন্তু মামা আর পড়াল না। বললে, এবার নিজের রাস্তা দেখ। কি আর করি, ঢুকে পড়লাম ছাপাখানায়।
মামা কে? কি তার নাম?
আজ্ঞে ওই যে দশ নম্বর পল্লীতে থাকে—রাধেশ্যাম—
রাধেশ্যাম।
কেমন যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই প্রশ্নটা করে সুদর্শন তাকাল জয়ন্তর মুখের দিকে।
হ্যাঁ স্যার। দেখেননি তাকে? ওই যে নরহরি সরকার-দিনরাত মুখে রাধেশ্যাম বুলি—
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় নরহরি সরকারকে সুদর্শনের। বলে, আপনি তাঁরই ভাগ্নে নাকি?
আজ্ঞে সম্পর্কে তাই, তবে রাধেশ্যাম স্বীকার করে না।
স্বীকার করে না!
না।
কেন?
গরিব বিধবা বোনের ছেলে। স্কুল-ফাইনাল পর্যন্ত পড়িয়েছে, খেতে দিয়েছে তাই যথেষ্ট–
কিন্তু ওঁর তো শুনেছি বেশ টাকা-পয়সা আছে?
হ্যাঁ স্যার ঠিক শুনেছেন। অমন ন্যালাখ্যাপার মত থাকলে কি হবে, একটি ঘুঘু। তাই বুঝি?
হ্যাঁ। আর টাকার কুমীর।
অনেক টাকা বুঝি?
অনেক।
ওই তো ছোট্ট একটা সোনা-রুপোর দোকান। সেই দোকান থেকে কত আয় ইনকাম হয়।
তা জানি না স্যার। রাধেশ্যাম যে কোথা থেকে টাকা আনে তা সে-ই জানে—তবে তার অনেক টাকা। সত্যি কথা বলতে কি, সেই কথাটা আমি জানতে পেরেছি জেনেই সে আমায় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
নরহরির তো শুনেছি বৌ নেই-এক ছেলে, এক মেয়ে!
মামীমা ছিল লক্ষ্মী স্যার। মামী মারা যাবার পরই তো রাধেশ্যাম আমাকে তাড়িয়ে দিল বাড়ি থেকে।
তা নরহরির ছেলে কি করে?
কি আর করবে! রাধেশ্যামের যাত্রার দলে সখী সাজে। লেখাপড়া তো করল না!
আর মেয়ে?
রাধা মেয়েটা বড় ভাল স্যার। লেখাপড়াতেও ভাল ছিল খুব, কিন্তু রাধেশ্যাম তাকে পড়াল না। স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে এনে বাড়িতে বসিয়ে রেখেছে। বলে বিয়ে দেব। বিয়ে দেবে না ছাই দেবে! বেটা চামার, কেবল টাকাই চেনে। স্যার, অনেক কথা রাধেশ্যাম সম্পর্কে আপনাকে বললাম, ও যেন না জানতে পারে। জানলে আমায় ঠিক একদিন খুন করে ফেলবে।
না না, জানতে পারবে না। আপনার ভয় নেই।
দেখবেন স্যার—লোকটা কিন্তু ডেঞ্জারাস। মুখে কেবলই রাধেশ্যাম বুলি আওড়ালে কি হবে, তলে তলে কেবল শয়তানী মতলব।
আচ্ছা আমি শুনেছিলাম আপনার মামা নাকি মাধবীকে বিয়ে করবার জন্য একময় ক্ষেপে উঠেছিল।
কার কাছে শুনলেন স্যার কথাটা?
শুনেছি। সত্যি নাকি কথাটা?
সত্যি। তেমন খেয়েছিলও মাধবীদির কাছে পটাপট!
কি খেয়েছিল?
কেন, ছাতার বাড়ি!
তাই নাকি? সুদর্শন হেসে ফেলে। যাঃ, আপনি বাড়িয়ে বলছেন!
হ্যাঁ, স্যার। সত্যি বলছি, গড় প্রমিস।
কিন্তু আমি তো শুনেছি, আপনার মামার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতাই ছিল মাধবী দেবীর। যাতায়াত ছিল তার ওই দোকানে।
কার কাছে কথাটা শুনলেন স্যার?
শুনেছি আমি।
না স্যার, যে বলেছে স্রেফ গুল দিয়েছে। এক-আধবার মাধবীদি হয়ত গিয়ে থাকবে রাধেশ্যামের দোকানে গয়না-টয়না গড়াতে। রাধেশ্যামকে তো জানি, ওই সময়েই হয়ত হাতটাত ধরবার চেষ্টা করেছিল মাধবীদির, সঙ্গে সঙ্গে পটাপট ছাতার বাড়ি!
আচ্ছা জয়ন্তবাবু?
বলুন স্যার।
আপনার মামা বন্ধকী কারবারও করেন, তাই না?
রাধেশ্যাম যে কি করে আর কি না করে ভগবানও জানেন না। বললাম তো স্যার, ও একটি বাস্তুঘুঘু। কিন্তু এবারে আমি উঠতে পারি স্যার?
উঠবেন?
হ্যাঁ স্যার, প্রেসে যেতে হবে।
আচ্ছা আপনি আসুন।
জয়ন্ত যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায় এবং যাবার আগে আবার বলে, দেখবেন স্যার, রাধেশ্যামের কানে যেন এসব কথা না যায়।
না না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
জয়ন্তকে সুদর্শন বিদায় দিল।
.
২৫.
বাইরে জীপের শব্দ শোনা গেল ঐসময়।
তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে সুদর্শন।
লালবাজার থেকে বোধ হয় হোমিসাইডাল স্কোয়াডের কেউ এল।
সুদর্শনের অনুমান মিথ্যা নয়। হোমিসাইডাল স্কোয়াডের রাজেন বোস ইন্সপেক্টার জীপ থেকে নামলেন।
নমস্কার মিস্টার মল্লিক।
আসুন মিস্টার বোস।
চলুন, একবার স্পটটা ঘুরে আসি তাহলে?
চলুন।
রাজেন বোসের জীপেই উঠে বসে সুদর্শন। জীপে যেতে যেতে দুজনের মধ্যে। কথা হয়।
আপনার কি মনে হয় মিস্টার মল্লিক? রাজেন বোস প্রশ্ন করেন।
খুনটা এই তল্লাটেই গতরাত্রে কোথাও কোন এক সময় হয়েছে, তারপর হয়ত ডেড বডিটা ওইখানে নিয়ে গিয়ে ফেলে এসেছে হত্যাকারী ও তার দলবল। সুদর্শন বললে।
আপনার তাহলে মনে হয় এর পিছনে একটা গ্যাং আছে?
আমার তো অন্তত ধারণা তাই। সুদর্শন বলে।
ডি. এস. ও. সব শুনে তাই বলছিলেন। তিন বছরের মধ্যে এই তল্লাটে এতগুলো খুন, অথচ আজ পর্যন্ত খুনগুলোর কোন একটা হদিস পাওয়া গেল না।
আমার মনে হয় মিস্টার বোস, খুনগুলো সব একই সূত্রে গাঁথা–
কি রকম?
ওই ওয়াগন ভেঙে ইয়ার্ড থেকে মাল সরাবার ব্যাপারে সে গ্যাংটা কাজ করছে, এ তাদেরই কীর্তি।
আশ্চর্য নয় কিছু। তাছাড়া দেখুন না, ইয়ার্ডে এত পুলিস-প্রহরা রেখেও আজ পর্যন্ত ওই ওয়াগন থেকে মাল সরাবার ব্যাপারের কোন হদিস পাওয়া গেল না। বেটারা যে কি করে আগে থাকতেই টের পায়! চটপট হাওয়া হয়ে যায়!
সুদর্শন প্রত্যুত্তরে বললে, হয়ত যারা মাল খালাস করে বা মাল লোড করে, তাদেরই কেউ সন্ধান দেয় ওদের কিংবা রেলওয়ের কোন অফিসার বা ক্লার্ক। দলের মধ্যে হয়ত তারাও আছে।
সে সন্দেহ যে আমাদেরও মনে আসেনি মিস্টার মল্লিক, তাও নয়। যথেষ্ট সাবধানতাও নেওয়া হয়েছে সেজন্য।
ইতিমধ্যে জীপ মাঠের মধ্যে এসে গেল।
বটতলায় গাড়িটা রেখে ওরা হেঁটে এগিয়ে গেল স্পটে। যে সেপাইটা প্রহরা দিচ্ছিল সে সেলাম করল।
সুদর্শন আঙুল দিয়ে একটা জায়গা দেখিয়ে বললে, there you are, exactly এইখানেই ছিল ডেড বডি পড়ে।
রাজেন বোস সুদর্শন-প্রদর্শিত জায়গাটির দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ধরে জায়গাটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে কি সব দেখলেন।
তারপর বললেন, আগের বারে সেই মেয়েটির ডেড বডিটা ওই বটগাছতলাতেই পড়েছিল মিস্টার মল্লিক, তাই না?
হ্যাঁ।
আচ্ছা এমনও তো হতে পারে মিস্টার মল্লিক, এখানেই গুলজার সিংহকে হত্যা করা হয়েছিল?
পিস্তলের গুলিতে যখন মারা হয়েছে তখন কি আশেপাশে তাহলে রক্তচিহ্ন থাকত না?
কিন্তু ডেড বডি টেনেহিঁচড়ে এখানে আনার তো কোন চিহ্ন চোখে পড়ছে না আশেপাশের মাটিতে! রাজেন বোস বলেন।
কিন্তু একটা কথা ভুল করছেন কেন মিঃ বোস, ডেড বডি ক্যারি করে এখানে নিয়ে আসা হলে সেরকম কোন চিহ্ন কি থাকত না? আর তাই আমার মনে হয়, ওই হত্যার ব্যাপারে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি নিশ্চয়ই জড়িত ছিল। সুদর্শন বলে।
তা অবিশ্যি হতে পারে। কিন্তু একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না, ডেড বডিটা রাস্তায় কোথাও না ফেলে এই মাঠের মধ্যেই বা হত্যাকারীরা বয়ে আনতে গেল কেন?
সেটা হয়ত যেখানে হত্যা করা হয়েছে, ঠিক তার আশেপাশে কোথাও ডেড বডিটা পড়ে থাকলে পুলিসের ওই জায়গাটার ওপর নজর পড়তে পারে বলেই হত্যার পর বেশ কিছুটা দূরে ডেড বডিটা এনে ফেলে দিয়েছে যাতে করে অকুস্থান সম্পর্কে আমরা সচেতন হতে না পারি।
অস্বীকার করছি না, কিন্তু এই মাঠেই বা কেন ফেলা হল? যাকগে, চলুন ফেরা যাক।
ওরা আবার জীপে গিয়ে উঠল।
.
পরের দিন বিকেলের দিকে।
কিরীটী সুদর্শনকে ফোনে ডেকে পাঠিয়েছিল। সুদর্শন হাওড়ায় এসে একটা বালিগঞ্জ অভিমুখী বাসে উঠতেই সাবিত্রীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সাবিত্রী একটা সীটে বসেছিল।
সুদর্শনই প্রথমে সাবিত্রীকে দেখতে পেয়ে বলে, সাবিত্রী, তুমি!
সাবিত্রী সুদর্শনের মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসে।
সুদর্শনের বসবার জায়গা ছিল না। কিন্তু সাবিত্রীর পাশের সিটটা তখনও খালিই ছিল।
সাবিত্রী ডাকে, এখানে এসে বসুন না।
সুদর্শন এগিয়ে গিয়ে সাবিত্রীর পাশেই বসে পড়ে।
কোথায় যাচ্ছ? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
দিদির এক বন্ধু অরুণাদি মীর্জাপুর স্ট্রীটে থাকে, তার কাছে যাচ্ছি। অরুণাদি একটা স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। দেখি তাকে বলে, একটা চাকরি যদি করে দিতে পারে তার স্কুলে।
কেন, সত্যিই কি তুমি পরীক্ষা দেবে না?
ফিস যোগাড় হলে দেব। কিন্তু সে কথা তো পরে ভাবলেও চলবে। আপনি তো সবই জানেন। আপাতত সংসারটা তো চালাতে হবে?
কেন, অবিনাশবাবু আর অমলেন্দুবাবু কি সত্যিই কোন সাহায্য করবেন না?
দাদা তো গতকালই চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে মিলের কোয়ার্টারে—
চলে গেছেন?
হ্যাঁ।
আর অমলেন্দুবাবু?
ছোড়দা অবিশ্যি বাড়ি ছেড়ে যায়নি, তবে—
কি, তবে?
তাকেও তো আর একটা সংসার টানতে হয়।
তার মানে?
প্রশ্নটা করে সুদর্শন সাবিত্রীর মুখের দিকে তাকাল।
সাবিত্রীও মনে হয় যেন হঠাৎ ঐ কথাটা বলে থমকে গিয়েছে, কেমন যেন একটু বিব্রত।
সুদর্শন আবার প্রশ্ন করল, আর একটা সংসার টানতে হয়—কি বলেছিলে সাবিত্রী! কথাটা তো ঠিক বুঝলাম না!
২৬-৩০. আমাদের পাড়ার হরগোবিন্দ
২৬.
আমাদের পাড়ার হরগোবিন্দকে চেনেন?
কে? যার ওই লেদ মেশিনের কারখানা আছে?
হ্যাঁ। তার মেয়ে সবিতা। তার সঙ্গে ছোড়দার খুব ভাব। বিয়ে করবে তাকে। মাতাল, হরগোবিন্দ সংসারে বিশেষ কিছুই দেয় না। ছোড়দাই তো সবিতাদের সংসারটা বলতে .. গেলে চালায়।
তাই নাকি? তা কই, অবিনাশবাবু-তোমার দাদা তো সেকথা বললেন না?
দাদা বা দিদি কেউই ব্যাপারটা জানত না। একমাত্র আমিই জানি।
তা এক কাজ করলেই তো পারেন অমলেন্দুবাবু, মেয়েটিকে বিয়ে করে নিয়ে এলেই তো হয়। দুটো সংসার আর টানতে হয় না।
বিয়ে ছোড়দা করবে না।
কেন?
ছোড়দাও ভীষণ মদ খায়।
জানি।
কিন্তু সবিতা সেকথা জানে না।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তাছাড়া সবিতা মাতালকে ভয়ানক ঘৃণা করে। মদ তো ছোড়দা ছাড়তে পারবে —অথচ বিয়ে করে সবিতাকে বাড়ি নিয়ে এলে হয়ত সব একদিন-না-একদিন জানাজানি হয়ে যাবে, তাই হয়তো–
বিচিত্র ব্যাপার দেখছি!
আরও একটা ব্যাপার আছে।
কি?
সবিতাকে ছোড়দা অনেকবার বলেছে, সে নাকি মদ স্পর্শও করে না!
জনবহুল রাস্তা ধরে বাস ছুটে চলেছিল। শীতের আলো ইতিমধ্যেই ম্লান হয়ে এসেছিল। রাস্তার আলো জ্বলতে শুরু করেছিল একটি দুটি করে।
সুদর্শন একসময় ডাকে, সাবিত্রী!
সাবিত্রী সুদর্শনের দিকে তাকাল।
বলছিলাম, আমি যদি তোমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিই?
দেবেন? সত্যিই? সাবিত্রীর চোখের মণি দুটে-প্রত্যাশার আনন্দে যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
দেব। তবে আগে পরীক্ষাটা দিতে হবে তোমায়—তারপর।
কিন্তু–
সাবিত্রী কি বলবার চেষ্টা করে, কিন্তু একপ্রকার স্মিতহাস্যে থামিয়ে দিয়েই মুখের দিকে তাকিয়ে সুদর্শন বলে, কোন কিন্তু না, পরীক্ষা তোমাকে দিতেই হবে। তোমার পরীক্ষার ফিস আমিই দেব। তুমি অমত করতে পারবে না।
সাবিত্রী যেন কেমন মনে হল থমমত খেয়ে গিয়েছে সুদর্শনের কথায়।
একটু মৃদু কণ্ঠে বলে, আপনি দেবেন!
তাই যদি দিই?
না না, তা হয় না।
কেন হয় না সাবিত্রী?
না, আপনার টাকা আমি নিতে পারি না।
বেশ তো, মনে কর না, এমনি নিচ্ছ না—তুমি টাকাটা ধার নিচ্ছ আমার কাছ থেকে। তারপর চাকরি হলে শোধ করে দিয়ো না হয়।
না। কথাটা বলে সাবিত্রী মুখটা ঘুরিয়ে নিল রাস্তার দিকে।
সাবিত্রী, আমি ওই কথাটা বলায় কি তুমি রাগ করলে?
সাবিত্রী কোন জবাব দেয় না, বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিন্তু তুমি বিশ্বাস কর সাবিত্রী, আমি তোমাকে কোনরকম অপমান করতে চাইনি। বন্ধু হিসাবে
আমরা গরিব বলেই তো, সাবিত্রী ওর মুখের দিকে তাকাল। তার দু-চোখে জল, গলার স্বরটা যেন বুজে আসে কান্নায়।
ছি ছি সাবিত্রী, একবারও ওকথা আমার মনে হয়নি। তুমি এত করে পড়াশুনা করলে, পরীক্ষার জন্য বছর দুই ধরে নিজেকে তৈরি করলে, অথচ কয়েকটা টাকার অভাবে পরীক্ষাটা তোমার দেওয়া হবে না—তাই বলেছিলাম কথাটা।
ইতিমধ্যে বাস কলেজ স্ট্রীট হ্যারিসন রোডের জংশনে পৌঁছে গিয়েছিল।
সাবিত্রী উঠে দাঁড়াল।আমি এখানে নামব।
সাবিত্রী নেমে গেল।
বাস আবার গন্তব্যপথে ছুটে চলে।
.
সুদর্শন যখন কিরীটীর গড়িয়াহাটের বাড়িতে পৌঁছল, তখন প্রায় সাড়ে ছটা বাজে। শীতের সন্ধ্যা, অন্ধকার হয়ে গিয়েছে বেশ-শহরের সর্বত্র আলো জ্বলে উঠেছে।
গড়িয়াহাটার নম্বরগুলো কেমন যেন এলোমেলো ভাবে এদিক-এদিক ছড়ানো। নম্বরটা খুঁজে পেতে বেশ একটু সময়ই লাগে সুদর্শনের।
দরজার বেল টিপতেই জংলী এসে দরজা খুলে দিল।
বাবু আছেন?
জংলী বললে, বাবু একটু বের হয়েছেন, এলে আপনাকে বসতে বলে গিয়েছেন। সিঁড়ির ঘরে যান।
দোতলার ও একতলার মাঝামাঝি মেজোনিন ফ্লোর। ঘরে আলো জ্বলছিল।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই কৃষ্ণাকে দেখতে পেল সুদর্শন। কৃষ্ণা ঘরের মেঝেতে কার্পেটের ওপর বসে সেতার বাজাচ্ছিল। সুদর্শন কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই বাজনা থামিয়ে সেতারটা নামিয়ে রাখল কৃষ্ণা।
আসুন সুদর্শনবাবু!
আপনি বাজনা থামালেন কেন বৌদি?
কৃষ্ণা মৃদু হাসে। আপনার দাদা একটু বেরিয়েছে, আপনাকে বসতে বলে গেছে। বসুন, চা করে আনি।
আপনি ব্যস্ত হবেন না বৌদি, বসুন।
ব্যস্ত কি! আমারও চায়ের পিপাসা পেয়েছে। বসুন, আসছি আমি।
কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
২৭.
কিরীটীর নতুন বাড়িতে আগে আর আসেনি সুদর্শন।
মেজোনিন ফ্লোরের ঘরটা নেহাত ছোট নয়, আকারে বেশ বড়ই হবে। একধারে সোপা সেট ও একধারে সোফা-কাম-বেড একটি।
এক কোণে পাশাপাশি দুটো আলমারি। একটাতে ঠাসা বই, অন্যটায় নানা ধরনের সব কিউরিও।
ছোট আলমারিটার মাথায় একটা মাটির বুদ্ধের ধ্যানস্থ মুখ। কৃষ্ণনগরের তৈরি। আলমারির মাথায় একটা দামী জার্মান ক্যাজেল ঘড়ি। সোফার একপাশে ফোন। বিদেশী ফোন-সাদা রঙের।
মাঝখানে ডিম্বাকৃতি সেন্টার টেবিল–ওপরে কাচ বসানো। টেবিলের ওপরে ফ্লাওয়ার ভাসে এক গাছা টাটকা রজনীগন্ধা। ঘরের মধ্যে ধূপ ও ফুলের মিশ্র একটা গন্ধ বাতাসে।
ফোনের পাশে কিছু স্পন, সোভিয়েত ল্যান্ড, নবকল্লোল ইত্যাদি মাসিক ও পাক্ষিক পত্র। একটা নবকল্লোল টেনে নিয়ে সুদর্শন পাতা ওলটাতে থাকে। মিনিট পনেরো বাদেই কৃষ্ণা ভৃত্যের হাতে চায়ের ট্রে ও প্লেটে কিছু মিষ্টি নিয়ে কাচের দরজা ঠেলে এসে ঘরে প্রবেশ করল।
ও কি বৌদি, প্লেটে এত কি খাবার এনেছেন? ও কথা তো ছিল না! বলেছিলেন তো কেবল চায়ের কথা!
আপনার দাদার হুকুম।
তার মানে?
হ্যাঁ। আমাকে বলে গিয়েছে, আজ যেন আপনাকে মিষ্টিমুখ করানো হয়।
হঠাৎ দাদার অমন নির্দেশ দেবার হেতু?
তা তো জানি না। বলে গিয়েছে মিষ্টিমুখ করাতে আপনাকে, তাই নিয়ে এলাম।
কথাগুলো বলে মৃদু হাসে কৃষ্ণা।
ঠিক আছে, তাহলে আগে দাদা আসুন, শুনি আগে কেন তিনি আমাকে মিষ্টিমুখ করাতে চান—তারপর না হয় দেখা যাবে। বলতে বলতে একটা চায়ের কাপ হাতে তুলে নিল সুদর্শন।
কৃষ্ণাও একটা কাপ তুলে নিয়েছিল। সে তখনও মৃদু মৃদু হাসছে।
হঠাৎই যেন একটা সম্ভাবনার কথা চকিতে সুদর্শনের মনের পাতায় উঁকি দিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখটা লাল হয়ে ওঠে।
কৃষ্ণা তখনও হাসছে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি।
সুদর্শন মুখটা নামিয়ে নেয়। নিজেকে সুদর্শন কেমন যেন বিব্রত বোধ করে—কেমন একটা অস্বস্তি।
কৃষ্ণার চোখের দিকে কয়েকটা মুহূর্ত যেন তাকাতে পারে না সুদর্শন।
তারপর আপনার খবর কি বলুন? কৃষ্ণা স্মিতকণ্ঠে শুধায় একসময়।
ওই একরকম চলে যাচ্ছ।
ওই একরকম কেন? ও যে বলছিল—
কি বলছিলেন দাদা?
নতুন যেখানে পোস্টিং হয়েছেন, আপনার থানা এলাকাটা বেশ ভালই!
ভাল না ছাই! চোরাকারবারির আচ্ছা একটা। তিন বছরে সাত-সাতটা খুন!
আহা, সে-সব তো সব থানাতেই থাকে। নচেৎ আপনাদের প্রয়োজনটাই বা কি? তাছাড়া ওই সঙ্গে কোন আনন্দের উৎসও তো থাকতে পারে।
কৃষ্ণার কথা এবার আর অস্পষ্ট নয়—এবং কৃষ্ণার আলোচনার গতিটা যে কোন্ দিকে চলেছে সুদর্শনের বুঝতে কষ্ট হয় না।
তবু সুদর্শন বলে, থানা-অফিসারদের জীবনে, বিশেষ কর আজকালকার দিনে, কোন আনন্দই আর নেই বৌদি। হাজারটা ঝামেলা—প্রবলেম
আরে ভাই, প্রবলেম না হলে জীবন কি?
সুদর্শন হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরে দরজার দিকে ফিরে তাকায়।
ইতিমধ্যে কখন যে কিরীটী ঘরের কাচের দরজা ঠেলে জাপানী রবারের চপ্পল পায়ে নিঃশব্দে ভেতরে পা দিয়েছে, ও জানতেও পারেনি।
কিরীটী একটা সোফার ওপর বসতে বসতে বললে, তারপর সুদর্শনবাবু, তোমার সেই তিনির খবর বল?
সুদর্শনের মুখটা সহসা আবার লাল হয়ে ওঠে।
কিগো সুদর্শনবাবু?
কি যে যা-তা বলেন দাদা!
আহা যা-তা নয় হে, যা-তা নয়। আমি জিজ্ঞাসা করছি, সবচাইতে বেশি ইম্পর্টেন্ট নিউজ যেটা—অর্থাৎ তোমার সাবিত্রী দেবীর খবর কি?
দাদা, আপনি যদি ওই রকম করেন তো আমি উঠে যাব বলছি!
আরে বস বস। তুমি জান না কিন্তু তাকে আমি না দেখে তোমার মুখ থেকে শুনেই বুঝতে পেরেছি সাবিত্রী মেয়েটি সত্যিই ভাল। অপাত্রে তুমি মন দাওনি।
সবটাই আগাগোড়া আপনারা একটা কল্পনা। ক্ষীণকণ্ঠে যেন প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করে সুদর্শন আবার।
কল্পনা কেন হবে, চাক্ষুষ পরিচয় হয়েছে।
মানে? সাবিত্রীকে আপনি দেখলেনই বা কখন—পরিচয়ই বা হল কি করে তার সঙ্গে আপনার?
হয়েছে হে ভায়া হয়েছে। তারপই কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, জান কৃষ্ণা, সত্যিই সাবিত্রী মেয়েটি বড় ভাল। অবিশ্যি তারও লাক আছে বলব, নচেৎ সুদর্শনের নজরে সে পড়ে?
দাদা, থামবেন আপনি!
থামতে আমি রাজি আছি ভায়া, কিন্তু সেটা তো আর কিছু তোমার মনের সত্যিকারের কথা নয়।
আপনি কি ওই সব আজেবাজে কথা বলবার জন্যেই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন দাদা?
আজেবাজ কি হে! এর চাইতে প্রয়োজনীয় কথা—
সম্পূর্ণ আজেবাজে।
না হে না। সাবিত্রীর বোন মাধবী নিহত না হলে সাবিত্রী যেমন এত তাড়াতাড়ি তোমার অত কাছে আসত না, তেমনি মাধবী নিহত না হলেও বোধ করি এত তাড়াতাড়ি তোমার দশ নম্বর পল্লীর হত্যারহস্যগুলির মূল সূত্রটিও আমি খুঁজে পেতাম না।
কিরীটীর কথায় যেন হঠাৎ চমকে ওঠে সুদর্শন।
কি বলছেন দাদা!
ঠিকই বলছি ভায়া। হত্যাকারী মাধবীকে হত্যা করেই কেবল যে তার জীবনের সর্বাপেক্ষা বড় ব্লান্ডার করেছে তাই নয়, সেই সঙ্গে ইতিপূর্বে ওই অঞ্চলে যে সব হত্যাব্যাপার সংঘটিত হয়েছে, সেই রহস্যের অন্ধকারেও আলোকসম্পাত করেছে নিজের
অজ্ঞাতেই।
কিছু বুঝতে পারছি না দাদা! মাধবীকে হত্যা করে হত্যাকারী ভুল করছে কেন বলছেন?
আরে ভায়া, এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি নারী-হৃদয়ের রহস্য উদঘাটনে অগ্রসর হয়েছ।
আঃ দাদা, প্লীজ!
শোন সুদর্শন, আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো—যে প্রেম মানুষকে ক্ষেত্রবিশেষে নিঃস্ব বৈরাগী করে তোলে, সেই প্রেমই আবার ক্ষেত্রবিশেষে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যে কি নিষ্ঠুর, নৃশংস, প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে, মাধবীর মৃত্যুই তার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। তবে এও আমি বলব, সেটা হয়ত ঠিক প্রেম নয়—বলতে পার মানুষের আদিম রিপুর দহন অথবা একটা অত্যন্ত রূঢ় যৌন আকর্ষণ।
যৌন আকর্ষণ।
কিরীটী সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে আবার বললে, হ্যাঁ। যা তোমার মাধবী দেবীর সারাটা দেহ জুড়ে ছিল এবং পুরুষ মাত্রেরই বুকে যা মারাত্মক লোভের আগুন জ্বালিয়ে তুলত সর্বদা!
আপনি তাহলে বলতে চাইছেন–
সুদর্শনকে বাধা দিয়ে কিরীটী বলে, সেই মারাত্মক যৌন আকর্ষণের অতৃপ্তিরই শেষ পরিণতি এবং যা স্বাভাবিক ওই সব ক্ষেত্রে অর্থাৎ সেই রিভেঞ্জ নিতে গিয়েই মাধবীর হত্যাকারী নিজেই আমার চোখে কেবল যে এক্সপোজডই হয়ে গিয়েছে তাই নয়, সেই সঙ্গে ইতিপূর্বে যেসব হত্যা-ব্যাপার সংঘটিত হয়েছে, সেই রহস্যর অন্ধকারেও নিজের অজ্ঞাতে আলোকসম্পাত করেছে–যা তোমাকে একটু আগেই আমি বলছিলাম!
.
২৮.
কিরীটীর শেষের কথায় সুদর্শন যেন উত্তেজনায় ভেঙে পড়ে। বলে, সত্যি-সত্যিই আপনি জানতে পেরেছেন দাদা, মাধবীর হত্যাকারী কে?
কেবল মাধবীরই বা কেন? গুলজার সিংয়েরও! কিরীটী বলে।
জানতে পেরেছেন?
এটা তো স্বীকার করবে ভায়া, ঐ সবগুলো হত্যার সঙ্গেই ঐ তল্লাটের ওয়াগন ভেঙে মালচুরির ব্যাপারটার একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে আর তাতেই আমার মনে। হয়—
তাহলে কি দাদা আপনি–
কিরীটী মৃদু হেসে বাধা দিয়ে বলে, সঠিক একবারে জানতে না পারলেও অনুমান করতে কিছুটা পেরেছি বৈকি। এবং এও বুঝতে পেরেছি একই ব্যাক্তি উভয়ের হত্যাকারী–হ্যাঁ, অন্তত সেটা বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি।
কে-কে সে দাদা?
মনে হয় দু-একদিনের মধ্যেই তুমিও জানতে পারবে।
তাহলে আপনি কি বলতে চান, গত তিন বছর ধরে যেসব হত্যা ওই অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে, সব একজনেরই কীর্তি?
তা হয়ত হতেও পারে, নাও হতে পারে।
তবে?
তবে এটা ঠিক, হত্যাকারীও ওই ওয়াগন থেকে মাল চুরির ব্যাপারে কোন-না-কোন। ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল।
অর্থাৎ তাদেরই একজন ছিল?
নিঃশন্দেহে।
তবে কি মাধবীও–
জোর গলায় কিছু বলা যায় না সুদর্শন। কারণ একটা ব্যাপার তুমি সহজ ভাবে বিচার করে দেখলে বুঝতে পারবে, মাধবী ওই অঞ্চলেই বসবাস করত এবং থিয়েটারের ব্যাপারে তাকে প্রায়ই অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরত হত। সেক্ষেত্রে তার পক্ষে আকস্মিক ভাবে কিছু দেখে ফেলা বা জানতে পারাটা এমন কিছু আশ্চর্যের ব্যাপার যেমন ছিল না, তেমনি পরে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক তাদের দলে গিয়ে ভিড়ে পড়াটাও কিছু অস্বাভাবিক ছিল না।
আচ্ছা আপনার কি ধারণা দাদা, ওই ওয়াগন ভেঙে মাল সরাবার ব্যাপারটা এই অঞ্চলেরই কোন এক বিশেষ ব্যক্তির কীর্তি?
ঐ অঞ্চলেরই অবিশ্যি—তবে—
তবে?
ব্রেন নিঃসন্দেহে একজনের। বাকি সব ছিল হয়ত তার হাতে দড়ি-বাঁধা পুতুলনাচের পুতুল মাত্র। কিন্তু আর ভয় নেই ভায়া—আজ এই পর্যন্ত, কাল বাদে পরশু তুমি এস –আশা করছি তোমার দশ নম্বর পল্লীর রহস্যের যবনিকা উত্তোলন করত পারব।, তুমি বরং তোমার বৌদির সঙ্গে গল্প কর।
কিরীটী বের হয়ে যাবার পরও অনেকক্ষণ সুদর্শন বসে কৃষ্ণার সঙ্গে গল্প করল।
.
পরের দিনই সন্ধ্যার দিকে সুদর্শন কিরীটীর একটা জরুরী কল পেয়ে তার গড়িয়াহাটার বাড়িতে এসে হাজির হল।
কি ব্যাপার দাদা, হঠাৎ জরুরী তলব?
হ্যাঁ, চল।
কোথায়?
তোমারই তল্লাটে। তোমার সঙ্গে আজ রাত্রে একবার ঘুরে দেখব।
বেশ তো, চলুন। কিন্তু হঠাৎ সেখানে?
কিরীটী বলে, একটা ফাঁদ পাতা হয়েছে। বাঘ হয়ত সে ফাঁদে পড়লেও পড়তে পারে, যদি অবিশ্যি লাক আমাদের ফেভার করে!
কৃষ্ণা বলে, এখনি বেরুবে নাকি?
হ্যাঁ।
ফিরবে কখন?
সে কি এখন-এখনই বলা যায়।
তাহলে তো তার কোন ঠিক নেই?
তা নেই।
তবে কিছু খেয়ে যাও।
না। পেটে কিছু পড়লেই ঘুম পাবে। তুমি বরং এক কাজ কর কৃষ্ণা!
কি?
কিছু স্যান্ডউইচ তৈরি করে দাও, আর ফ্লাস্কে কফি তিনজনের মত।
কৃষ্ণা উঠে গেল।
সুদর্শন, তুমি বরং কিছু খেয়ে নাও না?
না দাদা, আমার ক্ষিধে নেই।
আহা, এখন না থাকলেও একটু পরে পেতেও তো পারে!
না , ক্ষিধে পাবে না।
বাইরে ওই সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।
কিরীটী মুহূর্তকাল কান পেতে সিঁড়িতে জুতোর শব্দটা শুনে বলে, সুব্রত এসে গেল বোধ হচ্ছে!
সত্যিই সুব্রত এসে পরক্ষণে ঘরে ঢুকল।
সুব্রতর পরিধানে গরম লংস ও গায়ে বাদামী একটা গলাবন্ধ গ্রেট কোট।
পায়ে ভারী রবার সোলের জুতো।
সুব্রতর দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, দ্যাটস গুড! তুই বস্ সুব্রত, আমি চট করে জামা-কাপড়টা পালটে আসি। কথাগুলো বলে কিরীটী উঠে পাশের ঘরে চলে গেল।
সুব্রত বসতে বসতে বলে, তারপর সুদর্শনবাবু, কতক্ষণ?
এই কিছুক্ষণ। আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন মনে হচ্ছে!
হ্যাঁ। কারণ ব্যাপারটার মধ্যে যথেষ্ট রিস্ক আছে। দলে আমরা যতটা ভারী থাকি, ততই শেফ।
তাই যদি হয় তো দাদা আমাকে আগে বললেই তো পারতেন, থানা থেকে কিছু পুলিশ-ফোর্সের ব্যবস্থা করা যেত।
কিরীটী ওই সময় পাশের ঘর থেকে সাড়া দেয়, না হে, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হয়—আমাদের দেশের একটা প্রবাদ আছে, জান না? তাছাড়া রক্তলোভী ব্যাঘ্র চতুর, চট করে ফাদে পা বাড়ায় না!
.
২৯.
কথাগুলা বলতে বলত কিরীটী এসে ঘরে প্রবেশ করল।
দেখা গেল কিরীটী খুব দ্রুত তার বেশ পরিবর্তন করেছে ইতিমধ্যেই। মুখে চাপদাড়ি, মাথায় পাগড়ি, পরিধানে কালো গরম সুট। হঠাৎ কোন পাঞ্জাবী বলে ভুল হয়।
এ কি দাদা, এই বেশে যাবেন নাকি? সুদর্শন শুধায়।
যস্মিন দেশে যদাচার ভায়া! বলতে বলতে হাতঘড়ির দিকে তাকাল কিরীটী, দশটা বাজতে বাজতে আমরা আমাদের গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যেতে পারব বোধ হয়—এখন নটা বাজতে দশ মিনিট বাকি!
কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকল। হাতে তার একটা প্যাকেট আর ফ্লাক্স ঝোলানো।
ওগুলো সুব্রতকে দাও কৃষ্ণা।
সুব্রত হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে পকেটে ভরে নিল আর ফ্লাস্কটা ঝুলিয়ে নিল কাধে।
সুব্রত, তোর গাড়ি এনেছিস তো?
হ্যাঁ।
চল, তাহলে আর দেরি নয়—বের হয়ে পড়া যাক। চল সুদর্শন।
সুদর্শন উঠে দাঁড়াল।
গাড়িতে যেতে যেতে কিরীটী বলে, মৌকা একটা হঠাৎ এসে গেল সুদর্শন। দুপুরেই ট্র্যাফিক সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছ থেকে ফোন পেয়ে ভাবলাম, এক ঢিলে যদি দুই পাখি মারা যায় তো মন্দ কি! ভাল কথা সুদর্শন
বসুন, দাদা?
তোমার সঙ্গে অস্ত্র আছে তো?
অস্ত্র!
হ্যাঁ, তোমার আগ্নেয়াস্ত্রটি?
না, আনিনি তো সঙ্গে।
তাহলে এক কাজ কর—
বলুন?
তোমাকে বড় রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিচ্ছি। তুমি থানায় গিয়ে অস্ত্রটি লোড করে নিয়ে ঠিক রাত এগারোটা নাগাদ বের হয়ে পড়বে।
তারপর?
সোজা চলে যাবে রেলওয়ে ইয়ার্ডে।
কিন্তু আপনারা?
আমরা তোমাকে খুঁজে নেব।
কেমন করে? যা অন্ধকার রাত আজ—
সঙ্গে তোমার সিগারটে-লাইটারটা থাকবে তো?
সব সময়ই তো পকেটে থাকে।
সেটা পর পর তিনবার জ্বেলো। তাহলেও তোমাকে আমরা স্পট করতে পারব।
বেশ, তাই হবে।
সুব্রত আর কিরীটী পাশাপাশি সীটে বসেছিল, সুদর্শন সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে বসেছিল।
মিশির!
ড্রাইভার কিরীটীর ডাকে সাড়া দেয়, জী সাব!
তুমি আমাদের নামিয়ে দিয়ে সোজা থানায় চলে যাবে।
থানায়?
হ্যাঁ। যেখানে আমরা নামব তারই বাঁ দিক দিয়ে যে পুবমুখো রাস্তাটা চলে গেছে, সেটা ধরে সোজা গেলেই থানায় পৌঁছে যাবে। থানা সেখান থেকে খুব বেশি দূর নয়।
বহুৎ আচ্ছা সাব।
হঠাৎ ওই সময় সুব্রত প্রশ্ন করে, গুলজার সিংয়ের ব্যাপারটা কিছু জানতে পারলি কিরীটী?
হ্যাঁ, তোর ধারণাটাই ঠিক। ফ্রি স্কুল স্ত্রীটে ওর একটা ইলেকট্রিক্যাল গুডস, রেডিও, রেডিওগ্রাম, ফ্রিজ প্রভৃতির ঝকঝকে সাজানো-গোছানো দোকান আছে-ইস্টার্ন ইলেকট্রিক কোম্পানি। আর খুব সম্ভবত ঐ দোকানটি ও ব্যবসাই ছিল গুলজার সিংয়ের কামোফ্লাজ।
দোকানে কর্মচারী নেই?
আছে জনা-পাঁচেক। দুটি অল্পবয়সী ছোকরা পাঞ্জাবী, দুটি বাঙালী আর একটি অ্যাংলো মেয়ে-বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। সেই অ্যাংলো মেয়েটিকে আমি আগে থাকতেই চিনতাম, মিসেস শেয়েল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। একসময় ফ্রিজার কর্পোরেশনে ও সেলস-গার্ল ছিল। আমাকে দেখেই চিনতে পারল। ইশারায় তাকে বাইরে ডেকে সোজা গিয়ে উঠলাম একটা রেস্তোরাঁয়। তার কাছে সিংয়ের অনেক কিছু জানতে পারলাম।
কি রকম?
বম্বের ফিল্ম মার্কেটে ও একজন ফিনানসিয়ার। হুঁণ্ডিতে টাকা ধার দেয়। বুঝলাম সেটা দশ-পাঁচ হাজার টাকার ব্যাপার নিশ্চয়ই নয়—হিন্দিফ্লিম মানেই লাখ নিয়ে কারবার! কাজেই বুঝতে কষ্ট হল না ইস্টার্ন ইলেকট্রিক কোম্পানি থেকে ওই টাকা আসে না–আসতে পারে না। ওই টাকা অন্য খাতে আসে তার পকেটে।
তাহলে তো দেখতে পাচ্ছি, লোকটাকে হত্যা করবার কারণ ছিল! সুব্রত বললে।
তা ছিল বৈকি। বিনা কারণে কেউ কি কাউকে হত্যা করে? কিরীটী বললে।
সুদর্শন ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারে, ও যখন থানার মধ্যে বসে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিল, তখন কিরীটী অনেকটা এগিয়ে গেছে।
কিরীটী ওই সময় বলে, তবে এটাও ঠিক সুব্রত, গুলজার সিং নিহত না হলে হয়ত এত তাড়াতাড়ি ঐ গোলকধাঁধার সহজ রাস্তাটা আমি খুঁজে পেতাম না।
কিরীটী পকেট থেকে চুরুট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বলে আবার, কিন্তু এখনও একটা ব্যাপার আমার কাছে অস্পষ্ট রয়ে গেছে, গুলজার সিংয়ের মত ধূর্ত লোক অমন করে ফাদে পা দিয়েছিল কি করে? সে যে মাধবীর ব্যাপারটা, জানতে পারেনি তাও তো মনে হয় না!
সুদর্শনই ওই সময় প্রশ্ন করে, মাধবী? মাধবীর সঙ্গে গুলজার সিংয়ের কোন সম্পর্ক ছিল নাকি?
নিঃসন্দেহে। কিন্তু কতখানি ঘনিষ্ঠতা ছিল জানি না।
কি করে বুঝলেন?
পুলিশ গুলজারের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তার ফ্ল্যাট সার্চ করতে গিয়ে তার শোবার ঘরে ড্রয়ারের মধ্যে মাধবীর একটা ফটো পেয়েছে।
সে কি! সুদর্শন বলে ওঠে।
শুনে খুব শকড় হলে সুদর্শন, তাই না? জান না চলতি প্রবাদটা। নারী চরিত্র দেবতারই অগম্য-তা মানুষ কি কথা!
আমার কেমন যেন সব ঘুলিয়ে যাচ্ছে দাদা! সুদর্শন বলে।
যাবে ভায়া—আরও যাবে। যখন মাধবীর হত্যাকারীকে তুমি চিনতে পারবে।
মাধবীর হত্যাকারী কি ওই গুলজার সিংই নাকি?
না। মৃদু হেসে কিরীটী বলে।
তবে?
তবে যদি অনুমানটা আমার মিথ্যা না হয় তো গুলজার সিং পূর্বাহ্রেই মাধবীর মৃত্যুর ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছিল। অর্থাৎ সে জানতে পেরেছিল মাধবীর হত্যাকারী কে আর সেই কারণেই সে হত্যাকারীর সঙ্গে একটা মোকাবিলা করবার জন্য সে-রাত্রে ওইখানে এসেছিল এবং কথাটা সম্পূর্ণ না জেনেই সে হত্যাকারী যে আসতে পারে অনুমান করে তার জন্য পূর্বাহ্নেই ফাঁদ পেতে রেখেছিল।
কিরীটী বলতে বলতে একবার হাতের চুরুটের ছাইটা গাড়ির মধ্যস্থিত অ্যাসট্রেতে ঝেড়ে ফেলে তার অর্ধসমাপ্ত কথার মধ্যে ফিরে যায়।
বলে, অবিশ্যি গুলজার সিংয়ের প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যাবার আক্রোশ ও সেই সঙ্গে তার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসও তাকে মৃত্যু-ফঁদের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল সে-রাত্রে। এবং যার ফলে দুটো ব্যাপার হল।
দুটো ব্যাপার? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। প্রথমত, গুলজার সিং দিল প্রাণ, আর দ্বিতীয়ত, হত্যাকারী আবার ভুল করল আর একটা-এবং সেটাই হল তার সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ভুল।
আবার কি ভুল করল?
কতকটা যেন ছেলেমানুষের মতই সুদর্শন প্রশ্ন করে। সে যেন গল্প শুনছে আর কিরীটী যেন গল্প বলে চলেছে।
প্ৰথম ভুল করেছিল সে মাধবীকে হত্যা করে, দ্বিতীয় ভুল করল সে গুলজার সিংকে হত্যা করে।
কেন, ভুল করল কেন?
ভুল করল এই কারণে যে গুলজার সিং যে মাধবীর অন্যতম প্রেমিক বা প্রণয়প্রার্থী, এবং যে ব্যাপারটা কারও জানবার কথা নয়, সেটাই প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্ধ আক্রোশে হত্যাকারী আমার চোখে স্পষ্ট করে দিল—and I also got my clue! অর্থাৎ গুলজার সিং নিহত না হলে আমরা বোধ হয় এত তাড়াতাড়ি রহস্যের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারতাম না। আরও বেশ কিছুদিন অন্ধকারেই হাতড়ে বেড়াতে হত। কিন্তু আর নয়, আমরা বোধ হয় এসে গেলাম। মিশির?
জী সাব!
আউর থোড়া যাকে ডাইনা তরফ গাড়ি রোখো, সুদর্শন সাব উতার যায়গা। সুদর্শন, তোমাকে যা বলেছি মনে থাকে যেন। রাত এগারোটার আগে বেরোবে না, তাড়াহুড়ো করবে না।
সুদর্শন মৃদুকণ্ঠে বলে, না দাদা, যেমন বলেছেন তাই করব।
.
৩০.
সুদর্শনকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি আরও কিছুটা এগোতেই কিরীটী মিশিরকে বলল, এইখানেই গাড়ি রাখ মিশির।
মিশির গাড়ি থামায়।
কিরীটী ও সুব্রত গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। মিশির ওদের নামিয়ে দিয়ে তার প্রতি কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত থানার দিকেই গাড়ি চালায়। গাড়িটা ক্রমে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
কিরীটী হাতঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দশটা বাজতে আর মিনিট তিনেক আছে।
রাস্তায় মানুষের, বাস, মোটর, সাইকেল ও সাইকেল-রিকশার চলাচল তখনও বেশ আছে—যদিও শীতের রাত। তবে অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেকটা কম। ভিড় অনেকটা পাতলা হয়ে এসেছে। ক্রমশ পাতলা হচ্ছে আরও। তা প্রায় দোকানপাঠ বন্ধ, বললেই চলে।
কিছুটা এগিয়ে এসে বাজারের পরে যে রাস্তাটা পূর্বদিকে চলে গেছে, কিরীটী ও সুব্রত সেই রাস্তা ধরেই চলতে থাকে।
আগে একদিন কিরীটী ওই রাস্তাটা ধরে হেঁটে যতটা সম্ভব দেখে গিয়েছিল, কাজেই রাস্তাটা তার অপরিচিত নয়। সে স্বচ্ছন্দ গতিতেই এগিয়ে চলছিল।
প্রায় আধমাইলটাক হাঁটার পর বাঁয়ে মোড় নিল কিরীটী। একটা পুকুরের ধার দিয়ে সরু পায়ে-চলা আর একটা রাস্তা, এবারে সেই রাস্তাটাই ধরল কিরীটী। সুব্রত নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে।
এদিকটায় তেমন আলোর ব্যবস্থা না থাকায় বেশ অন্ধকার। কিরীটী পকেট থেকে টর্চটা বের করে সাবধানে সেই টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে অগ্রসর হয়।
সাবধানে আয় সুব্রত-বেকায়দায় এদিকে-ওদিকে পা পড়লে কিন্তু এই শীতের রাতে সোজা হয় পানাপুকুরের জলে, না হয় কাঁচা নর্দমার পঙ্করাশির মধ্যে প্রপাত হবি। কারণ একদিকে পানাপুকুর,অন্যদিকে কাচা ড্রেন। কিরীটী চাপা গলায় বলল।
ড্রেনের দুর্গন্ধ ও কচুরিপানার একটা আঁশটে গন্ধে সুব্রত আগেই বুঝতে পেরেছিল, আশেপাশে কোথাও কাচা ড্রেন আছে। সেটা যে একেবারে পাশেই জানতে পেরে সুব্রত আরও সাবধানে হাঁটতে লাগল আবছা অন্ধকারে।
পুকুরটা শেষ হল একসময়। তারপর কিছু বস্তি-বাড়ি। রাস্তা সেখানেও রীতিমত সঙ্কীর্ণ। আলোর কোন ব্যবস্থাই নেই। প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটবার পর একটা ভাঙা প্রাচীরের ভেতর দিয়ে ওরা পড়ল এসে রেলওয়ে ইয়ার্ডে।
অন্ধকার এখন আর অত মনে হয় না, কারণ ইয়ার্ডের আলোয় খুব স্পষ্ট না হলেও এরা দেখতে পাচ্ছে এখন চারদিক আবছা-আবছা।
এদিকে-ওদিকে সিগন্যালের লাল ও সবুজ আলো আকাশের অন্ধকারে পড়ে।
অসংখ্য ইস্পাতের লাইন এঁকেবেঁকে সাপের মত চলে গেছে।
ইঞ্জিনের শব্দ। একটা বোধ হয় মেল ট্রেন চলে গেল পশ্চিমগামী।
এখানে-ওখানে সারা ইয়ার্ডে ছড়িয়ে আবছা আলো-অন্ধকারে মালগাড়ি ও প্যাসেঞ্জার বগিগুলো দাঁড়িয়ে।
৩১-৩৫. সন্তর্পণে কিরীটী এগিয়ে চলে
৩১.
সন্তর্পণে কিরীটী এগিয়ে চলে।
ওরা স্টেশনের দিকেই এগিয়ে চলে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা মালগাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।
আর ঠিক সেই সময়ই হঠাৎ ওদের কানে এল একটা যান্ত্রিক শব্দ। লোহা জাতীয় কোন কিছুর মেটালিক শব্দ বলে যেন সেটা মনে হল।
কিরীটী হাতের টর্চটা আগেই নিভিয়ে দিয়েছিল। অন্ধকারে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে কিরীটী তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টিতে। কোথা থেকে ঐ শব্দটা আসছে জানবার বুঝবার চেষ্টা করে। শব্দটা এক-একবার হচ্ছিল। আবার একটুক্ষণের জন্যে থামছিল।
ক্রমশ বুঝতে পারে কিরীটী শব্দটা মালগাড়ির অন্য দিক থেকে আসছে।
শব্দটা অনুসরণ করে এবারে এগোয় কিরীটী। কয়েক পা সন্তর্পণে এগোতেই ঝাপসা ঝাপসা অন্ধকারে কিরীটীর নজরে পড়ে, দুজন লোক কি একটা ভারী মত বস্তু অন্ধকারে মাথায় করে বয়ে রেল-লাইন দিয়ে প্রাচীরের দিকে এগিয়ে চলেছে সতর্ক ভাবে।
তারপরই ওদের কানে এল সতর্ক একটা গলার স্বর, কটা হল রে?
দশটা। অন্য কে একজন জবাব দিল।
সবই মনে হচ্ছে কাপড়ের পেটি। প্রথম জনের গলার স্বর আবার শোনা গেল।
আরও একজনের—অর্থাৎ এবার তৃতীয় ব্যক্তির গলার স্বর শোনা গেল, আসল মালটা বোধ হয় এই কাপড়ের পেটির মধ্যেই আছে!
ঠিক গুনেছিস তো? এটাই ষোল নম্বর ওয়াগন তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। না গুনে ওয়াগন ভেঙেছি নাকি? দ্বিতীয় ব্যক্তি জবাব দেয়।
তৃতীয় ব্যক্তি বলে, এবারে শালা ওই বুড়ো শকুনিটা যদি মোটা মত লাভের অঙ্ক থেকে না দেয় তো আমারই একদিন কি ওরই একদিন।
অন্য একজন বলে, শালা একের নম্বরের কঞ্জুষ, স্বার্থপর। কেবল নিজের কোলের দিকেই ঝোল টানে।
ও শালার মরণের পাখনা গজিয়েছে। ওকেও দেখ না গুলজার সিংয়ের পথেই পা বাড়াতে হবে একদিন।…কটা মাল নামালি রে? দ্বিতীয়ের গলা।
দশটা পেটি। তৃতীয় বক্তা বলে।
দূরে ঐ সময় সুব্রতর নজরে পড়ে লাইটারের আলো-তিনবার জ্বলল, আবার নিভে গেল।
সুব্রত! চাপা গলায় ডাকে কিরীটী, চট করে যা—সুদর্শনকে এখানে ডেকে নিয়ে আয়।
সুব্রত শিকারী বিড়ালের মতই সতর্ক ও ক্ষিপ্র গতিতে যেন কিরীটীর নির্দেশমত সুদর্শনের দিকে চলে গেল।
সুব্রত চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় ব্যক্তির চাপা গলার স্বর কিরীটী আবার শুনতে পায়, ওহে, ভাল মনে হচ্ছে না।
তৃতীয় ব্যক্তি শুধোয়, কেন? কি হল আবার?
দ্বিতীয় ব্যক্তির গলার স্বর শোনা যায়, দূরে একটা কীসের আলো যেন তিনবার জ্বলে নিভে গেল!
প্রথম ব্যক্তির গলার স্বর আবার শোনা গেল, তখুনি বলেছিলাম, গুলজার সিংয়ের মরার পর এত তাড়াতাড়ি আবার এদিকে না আসতে। শুনলে না তো আমার কথা?
চতুর্থ ব্যক্তির গলার স্বর আবার শোনা গেল, থাম থাম, আর উপদেশ ছড়াসনি!
সে তুমি যাই বল—আমার কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ ভাল মনে হচ্ছে না। প্রথম ব্যক্তির গলার স্বর আবার শোনা গেল।
পঞ্চম ব্যক্তির গলার স্বর, আরে যানে দো ইয়ার—এই ঠাণ্ডিকো রাতমে কৌন তুমারা পিছে পড়েগী! চল, জলদি মাল উঠাও!
প্রথম ব্যক্তির গলার স্বর, আর দুটো বাকি আছে।
সুদর্শন ততক্ষণে ওইখানে পৌঁছে গেছে।
প্রথম ব্যক্তির গলার স্বর আবার শোনা যায়। কি ব্যাপার, ওরা যে গাড়িতে মাল তুলে দিতে গেল তো গেলই! ফেরার আর নাম নেই!
স্পষ্ট গলার স্বর।
মনে হয় যেন সুদর্শনও গলার স্বরটা শুনতে পেয়েছিল। পরিচিত গলার স্বরটা শুনে সে যেন হঠাৎ চমকে ওঠে।
হয়ত তার মুখ দিয়ে নামটা বের হয়েই আসত, কিন্তু তার আগেই কিরীটী ওর মুখে হাত চাপা দেয় এবং হিহি করে বলে, উঁহু, উত্তেজিত হয়ো না ভায়া।
এ সময় কিরীটীর নজরে পড়ল, বোধ হয় ওদের মধ্যে যে লোক দুটো মাল নিয়ে গিয়েছিল—তারা লাইন টপকে টপকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঐদিকেই ছুটে আসছে।
লোক দুটো ওয়াগনগুলোর ওদিকে চলে গেল। দ্রুত পায়ের শব্দ।
কি রে, কি ব্যাপার? প্রথম ব্যক্তি শুধোয়।
পুলিস!
পুলিস? কোথায়?
লরি ঘিরে ফেলেছে। ভোলা আর হোঁৎকা সটকেছে—
শালা কুত্তার বাচ্চা। প্রথম ব্যক্তি বলে।
দূর থেকে একটা মালগাড়ি আসছে মনে হয়—তারই শব্দ। শব্দ তুলে মালগাড়িটা ওদের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলে।
সুদর্শন, রেডি-চল ওদিকে! কিরীটী বললে এবারে।
কিন্তু দুটো ওয়াগনের মধ্যবর্তী ফাঁক দিয়ে অন্যাদিকে আসবার পর দেখা গেল কেউ সেখানে নেই। গোটা দুই পেটি কেবল পড়ে আছে। রেললাইনের ওপরে আর একটা ওয়াগনের দরজার লক ভাঙা, কপাট খোলা।
রেললাইন ধরে দুটো লোক ছুটছিল, হঠাৎ কানে এল পর পর কটা ফায়ারিংয়ের আওয়াজ। ফারারিংয়ের আওয়াজ ইয়ার্ডের মধ্যে ছড়িয়ে গেল।
কিরীটী হুইসেল বাজাল একটা।
দেখতে দেখতে কয়েকজন আর্মড পুলিস ঘটনাস্থলে খোলা ওয়াগনটার সামনে এসে পড়ে ছুটতে ছুটতে।
ইন্সপেক্টার কল্যাণ মিত্র বলেন, কি ব্যাপার? ওয়াগন ভেঙেছে দেখছি!
কিরীটী বললে, হ্যাঁ, মিস্টার মিত্র-ইউ আর লেট।
আমরা কাছেই ছিলাম—শেষ ওয়াগনটার ধারে!
দেখতে পেলেন না তবু? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না।
অন্তত ঘণ্টাখানেক হবে ওরা এসে ওয়াগন ভেঙেছে। কিরীটী বললে।
আমি ভেবেছিলাম, হয়ত রাত আরও বেশি হলে–
ঠিক আছে, এখানে দুজন আমর্ড পুলিশ পাহারা রেখে আপনারা থানায় যান, আমরা থানায় আসছি একটু পরে।
কিরীটী কথাগুলো কল্যাণ মিত্রকে বলে সুদর্শনের দিকে তাকাল, চল সুদর্শন, তোমার দশ নম্বর পল্লীতে যাওয়া যাক।
কিন্তু সেখানে কি আর এখন তাকে পাওয়া যাবে দাদা?
চলই না হে, একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতিটা কি!
ইয়ার্ড থেকে মাঠের ভেতর দিয়ে দশ নম্বর পল্লীতে পৌঁছতে মিনিট কুড়ি লাগে হেঁটে।
পল্লীর মধ্যে পৌঁছে সুদর্শন নিজের মনেই এগোচ্ছিল, কিন্তু কিরীটী তাকে হঠাৎ বাধা দিল, ওদিকে কোথায় চলেচ ভায়া?
ওকে অ্যারেস্ট করবেন না?
আরে ব্যস্ত কি—আগে অন্য একটা জায়গা একটিবার ঘুরে আসি চল!
কোথায় যাবেন?
তোমার সাবিত্রী দেবীর কুঞ্জে—
কোথায়?
বললাম তো। তোমার সাবিত্রী দেবীর কুঞ্জের কাছে। চল।
সুদর্শন যেন ব্যাপারটা সম্যক উপলব্ধি করতে পারেনি, তাই কতকটা যেন হতভম্ব হয়েই দাঁড়িয়ে থাকে অনড় অবস্থায়।
কি হল, দাঁড়িয়ে রইলে কেন—চল!
কিন্তু দাদা, সাবিত্রী
আহা, চলই না হে! তোমার সেই একচক্ষু হরিণের মত নিবুদ্ধিতা না করে ফিরে হয় একবার তাকালেই অন্য দিকে! চল চল, hurry up!
সুদর্শন অতঃপর যেন কতকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেই কিরীটীর নির্দেশমত সাবিত্রীদের গৃহের দিকে অগ্রসর হয়।
সুব্রত তখন মিটিমিটি হাসছিল।
ওরা বুঝতে পারেনি যে ব্যাপারটা তখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
.
৩২.
সাবিত্রীদের গৃহের কাছাকাছি পৌঁছতেই একটা বেহালার সুর ওদের কানে এল।
কে যেন বেহালায় দরবারী কানাড়া আলাপ করছে।
বাঃ ভারি মিষ্টি হাত! কিরীটী বলে, কে বেহালায় দরবারী কানাড়া বাজাচ্ছে হে সুদর্শন?
জানি না তো!
তোমার সাবিত্রী দেবী নয় তো?
জানি না।
বল কি! সে বেহালা বাজাতে পারে কিনা সে খবরটি এখনও অজ্ঞাত তোমার! তবে কি ছাই ভালবাস!
আঃ, দাদা—
যাই বল ভায়া, চমৎকার দরবারী কানাড়া আলাপ জমিয়েছে। কিরীটী আবার বললে।
হঠাৎ ওই সময় ওদের নজরে পড়ল সামনেরই একটা বাড়ির সামনের ঘরেরই ঈষৎ খোলা জানালা-পথে মৃদু আলোর আভাস আসছে এবং মনে হল বেহালার সুর সেই আলোকিত কক্ষ হতেই ভেসে আসছে।
কিরীটী দাঁড়াল, সুদর্শন।
দাদা?
ওইটিই তোমার মিত্র মশাই—অর্থাৎ আমাদের সুবোধ মিত্র মশাইয়ের বাড়ি না?
সুদর্শন মৃদু গলায় বলে, হ্যাঁ।
মিত্র মশাই-ই মনে হচ্ছে আমাদের এই মধ্যরাত্রের সুরকার!
হ্যাঁ। ওঁর ঘরে বেহালা দেখেছিলাম মনে পড়েছে, প্রথম দিন আলাপের সময়।
অমন ভাল সুরকার একজন, অথচ তুমি তাকে অবহেলাই করেছ! প্রথম দিন সামান্য আলাপের পর আর তার সঙ্গে আলাপ জমাবারই চেষ্টা করনি-কে-কে ওখানে?
আজ্ঞে স্যার আমি!
অন্ধকারে কিরীটীর প্রশ্নে দুটো বাড়ির মধ্যবর্তী স্থান থেকে কে একজন আত্মগোপনকারী বের হয়ে এল আলো-আঁধারি থেকে নিঃশব্দে।
সুদর্শন চমকে ওঠে আগন্তুককে চিনতে পেরে যেন।
মানুষটি আর কেউ নয়, ব্যায়ামপুষ্ট তাগড়াই চেহারার অন্নপূর্ণা জুট মিলের লেবারার হীরু সাহা–যাকে ঘিরে প্রথম দর্শন থেকেই সুদর্শন একটু বেশি মাত্রায় সন্দিগ্ধ হয়েছিল।
কিন্তু অতঃপর সব যেন কেমন ঘুলিয়ে যাচ্ছে সুদর্শনের। সুদর্শন যেন বোবা।
.
হীরু সাহা তখন কিরীটীকে বলছে চাপা গলায়, দেখলেন স্যার, আমি আপনাকে বলিনি!
হ্যাঁ, এখন দেখছি তুমি ঠিকই বলেছিলে হীরুবাবু। তা কোন্ পথে ফিরল?
এই পথেই নাকি? কিরীটী শুধায়।
বলতে পারি না স্যার। ফিরতে আমি দেখিনি।
ওই বাড়িতে পিছন দিয়ে ঢোকাবার আর কোন রাস্তা আছে?
তা একটা আছে স্যার।
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি এখানে একটু অপেক্ষা কর হীরুবাবু। চল হে সুদর্শন।
কোথায়? সাবিত্রীদের বাড়িতে এই রাত্রে হানা দেবেন নাকি এখন?
সেটা কি ভাল দেখাবে হে! তার চাইতে চল দেখি, মিত্র মশাইকে দিয়ে যদি সাবিত্রী দেবীকে তার ওখানেই ডেকে আনানো যায় একবার! এস।
সুদর্শন এগিয়ে গেল কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে যেন একটু অনিচ্ছার সঙ্গেই।
সুবোধ মিত্রের বাড়ির সামনে এসে ওরা তিনজনে দাঁড়াল।
সদর দরজা বন্ধ। কিরীটী এগিয়ে গিয়ে বন্ধ দরজার গায়ে ধাক্কা দিল। কিন্তু দু-দুবার ধাক্কা দেওয়া সত্ত্বেও দরজা খুলল না। বেহালার বাজনাও থামল না।
সুদর্শন এবারে কিরীটীর ইঙ্গিতে বেশ জেরেই দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকে, সুবোধবাবু-–ও মশাই সুবোধবাবু, দরজাটা খুলুন!
এবারে বাজনা থেমে গেল। একটু পরে দরজাও খুলে গেল।
আলোকিত কক্ষের খোলা-দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে সুবোধ মিত্র। পরনে একটা লুঙ্গি, গায়ে একটা শাল জড়ানো।
কে? আমি সুদর্শন মল্লিক, থানার ও. সি.-
আসুন, আসুন। কি ব্যাপার মল্লিক মশাই—এত রাত্রে?
একটু বিশেষ প্রয়োজন আছে। চলুন ভেতরে।
সুবোধ মিত্র দরজা ছেড়ে দাঁড়াল, সকলে ভেতরে প্রবেশ করল। প্রথমে সুদর্শন, তার পশ্চাতে কিরীটী ও সুব্রত।
সুদর্শনের সঙ্গে আরও দুজন অপরিচিত ব্যক্তিকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সুবোধ মিত্র হঠাৎ যেন কেমন একটু বিস্মিতই হয়েছে, তার মুখের চেহারা দেখে মনে হল।
সুদর্শনবাবু, এঁরা? সুবোধ মিত্র প্রশ্ন করে।
সুদর্শন বলে, এঁকে দেখেননি হয়ত, তবে নাম নিশ্চয়ই এঁর শুনেছেন সুবোধবাবু! কিরীটী রায়—আর উনি সুব্রত রায়!
নমস্কার। সুবোধ মিত্র হাত তুলে নমস্কার জানায়।
কিরীটীও প্রতিনমস্কার জানায়।
কিরীটী হঠাৎ প্রশ্ন করে সুবোধ মিত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে, বাইরে তো বেশ ঠাণ্ডা, আপনার কপালে দেখছি ঘাম! এত শীতেও ঘামছেন আপনি?
সুবোধ মিত্র তাড়াতাড়ি কম্পিত হাতে কপালের ঘামটা মুছে ফেলবার চেষ্টা করতে করতে বলে, ওই মানে-আমার বরাবরই একটু গরমটা বেশি!
তাই দেখছি। কিরীটী কথাটা বলে মৃদু হাসল।
.
৩৩.
কিরীটীর দুটি চোখের সন্ধানী দৃষ্টি কিন্তু কথার মধ্যেও ঘরের চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
আবার সুবোধ মিত্রের খালিপায়ের দিকে তাকিয়ে কিরীটী প্রশ্ন করে, আপনি বুঝি। বাড়িতে খালিপায়েই থাকেন সাধারণত। কোন চটি বা চপ্পল দেখছি না ঘরে?
চপ্পল-মানে, ওই বাইরের বারান্দাতে আছে।
সুব্রত আর সুদর্শন দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। কিরীটীই আবার প্রশ্ন করে, কিন্তু হাতে আপনার অত তেল-ময়লা লেগেছে কেন সুবোধবাবু?
কিরীটীর কথায় সকলেরই নজরে পড়ে, সুবোধ মিত্রের হাত দুটো—দুই হাতের পাতা ও আঙুলেই তেল-কালি ময়লা লেগে আছে।
সুবোধ মিত্র যেন হঠাৎ কেমন বোবা হয়ে গেছে।
ফ্যালফ্যাল করে প্রশ্নকারী কিরীটীর মুখের দিকে একবার তাকায়, তারপরই নিজের কালি-তেল-ময়লা-মাখা হাত দুটোর দিকে তাকায়।
এত রাত্র হাতে আপনার তেল-কালি-ময়লা লাগল কি করে সুবোধবাবু?
ঐ মানে—ফিরে এসে একটা মেসিন সারাচ্ছিলাম।
মেসিন, কীসের মেসিন?
ঐ–-
কিরীটীর স্বর হঠাৎ গম্ভীর শোনাল এরপরে যখন সে বলল, তাড়াতাড়িতে হাত দুটোও সাফ করবার সময় পাননি মনে হচ্ছে!
না না, তা নয়—
তবে?
কিরীটীর দুটো শ্যেন চক্ষুর দৃষ্টি সুবোধ মিত্রের ওপরে স্থির নিবদ্ধ—মিত্র মশাই, একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন যে!
কি বলছেন?
আমি যে কি বলছি, শান্ত কঠিন গলায় কিরীটী বলে, আপনার না বোঝাবার কথা নয়। বুঝতে পারছেন না—হাতে ঝুল-কালি, কপালে ঘাম। বেহালার হাতটি আপনার সত্যিই মিষ্টি মিত্র মশাই, কিন্তু সুরসৃষ্টি করে নিজেকে আপনি আড়াল করতে পারেন। নি, কারণ সুরের মধ্যে তাল কেটে যাচ্ছিল মধ্যে মধ্যে!
কি বলছেন, তাল কেটে যাচ্ছিল?
হ্যাঁ, বুঝতে পারেননি। কিন্তু কেন বলুন তো? অবিশ্যি অশান্ত মনে, উদ্বেগে সুরসৃষ্টি হয় না, তালও কাটতে পারে!
আজ্ঞে—
তা হলেও আই মাস্ট প্রেজ ইয়োর নার্ভ সুবোধবাবু!
সুদর্শনবাবু, এসবের মানে কি—আমি জানতে পারি কি? রুক্ষ গলায় সুবোধ মিত্র প্রশ্ন করে, কেন এভাবে আপনারা মাঝরাতে আমার বাড়িতে ঢুকে–
জবাব দিল কিরীটী। তীক্ষ্ণ শাণিত কণ্ঠস্বরে বললে, শুনুন মিত্র মশাই, অকারণে উনি আসেননি এই মধ্যরাত্রে এখানে-আপনার নামে গুরুতর অভিযোগ আছে!!
অভিযোগ? হোয়াট ড়ু ইউ মীন? কীসের অভিযোগ?
গত তিন বছর ধরে এ তল্লাটে ওয়াগন ভেঙে যে সব মালপত্র চুরি যাচ্ছে ইয়ার্ড থেকে—সেই দলেরই রিং-লিডার হিসাবে আপনাকে উনি গ্রেপ্তার করতে এসেছেন।
কি পাগলের মত আবোল-তাবোল বকছেন মশাই? ওয়াগন ভেঙে মাল চুরি করেছি আমি?
সুবোধবাবু! কিরীটী আবার বলে, আপনি যদি জানতেন কার সামনে দাঁড়িয়ে আপনি প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করছেন গলা চড়িয়ে, তার সত্য পরিচয়টা?
থামুন মশাই, থামুন!
সুদর্শন ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল। ব্যাপারটা তখনও যেন তার স্বপ্নেরও অতীত।
কিরীটী বলতে থাকে, শুধু তাই নয় মিত্র মশাই, ওইটি ছাড়াও আর একটি গুরুতর অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে আছে, মাধবীকে হত্যা করেছেন আপনিই!
থামবেন মশাই? এটা আমার বাড়ি-পাগলা গারদ নয়।
কিন্তু সুবাধ মিত্রের কথাটা শেষ হল না, সহসা খোলা দরজার ওদিক থেকে এক নারী-কণ্ঠস্বর ভেসে এল, হা হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই ধরেছেন! ও-ই দিদিকে খুন করেছে।
কে? এ কি, সাবিত্রী।
বিস্মিত হতভম্ব সুদর্শনের কণ্ঠ থেকে একটা অস্ফুট শব্দের মত কথাগুলো স্বতোচ্চারিত হল যেন।
সাবিত্রী তখন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। উত্তেজনায় সে হাঁপাচ্ছে।
সাবিত্রী! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে সুবোধ মিত্র।
করুন—করুন সুদর্শনবাবু, ওকে গ্রেপ্তার করুন। সাবিত্রী বলে, ও-ই আমার দিদিকে হত্যা করেছে। একসঙ্গে দুজনে সে-রাত্রে দিদির শো ভাঙবার পর ফিরেছেন জানি, আমি সব জানি—শয়তান, খুনী! তোমার-তোমার ফাঁসি হোক, এই আমি চাই।
তবে রে হারামজাদী।
সহসা বাঘের মত সুবোধ মিত্র সাবিত্রীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে তার গলাটা দুহাতে। চেপে ধরে।-খুন করব তোকে আজ।
সুব্রত প্রথমটায় ঘটনার আকস্মিকতায় একটু হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সুবোধ মিত্রের পর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একটা জুজুৎসুর প্যাচ দিয়ে তাকে ফেলে দেয়।
সাবিত্রী পড়ে যায় ওই সঙ্গে।
কিন্তু সুবোধ মিত্র তখন যেন মরীয়া হয়ে উঠেছে এবং সুব্রত বুঝতে পারে সুবোধ মিত্র লোকটা গায়ে যথেষ্ট শক্তি ধরে। সুব্রত তাকে জাপটে ধরেছিল, কিন্তু সুবোধ মিত্র সুব্রতর কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয় এবং খোঁচা খাওয়া হিংস্র বাঘের মত উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গিয়ে ঘরের কোণে যে বড় ফ্লাওয়ার ভাসে একগোছা রজনীগন্ধা ছিল, সেটার মধ্যে চকিতে হাত ঢুকিয়ে ছোট একটা অটোমেটিক পিস্তল বের করে সাবিত্রীকে লক্ষ্য করে পর পর দুটো গুলি চালায়।
একটা গুলি মিস করে, কিন্তু অন্যটা সাবিত্রীর ডানহাতে বিদ্ধ হয়।
চিৎকার করে ওঠে সাবিত্রী।
ইতিমধ্যে সুদর্শনও তার পকেট থেকে পিস্তল বের করেছিল, কিন্তু মাঝখানে সাবিত্রী থাকায় সে গুলি চালাতে পারে না। সাবিত্রী টলে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুদর্শন সুবোধ মিত্রের হাত লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
সুবোধ মিত্রের হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে মাটিতে পড়ে যায়।
সেই অবসরে সুব্রত ঝাপিয়ে পড়ে সুবোধ মিত্রকে দুহাতে সবলে জাপটে ধরে।
.
৩৪.
এবারে আর সুবোধ মিত্র সুব্রতর কবল থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করেও সফল হয় না।
সুদর্শনও ইতিমধ্যে এগিয়ে আসে সুব্রতর সাহায্যে।
বাইরে দুজন প্রহরী পূর্ব হতেই কাছে মোতায়েন ছিল। কিরীটীর নির্দেশে তাকে ডেকে তাদের সাহায্যে সুবোধ মিত্রের হাতে হাতকরা পরিয়ে দিল সুব্রত।
সুবোধ মিত্র এতক্ষণে চুপচাপ হয়ে যায়।
সুদর্শন সাবিত্রীর ক্ষতস্থানটা পরীক্ষা করছিল।
কিরীটী বললে, তুমি ডাক্তার নও ভায়া, চটপট ওকে হাওড়া জেনারেল হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা কর।
আমার জীপটা নিয়ে আসি। সুদর্শন বলে।
তাই যাও।
আহত সাবিত্রীকে হাওড়া জেনারেল হাসপাতালে সুদর্শনের সঙ্গেই কিরীটী পাঠিয়ে দেয় পুলিশের জীপে।
রাত তখন প্রায় তিনটে বেজে গেছে। দশ নম্বর পল্লীতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। অনেকেরই ইতিমধ্যে গোলমালে ও গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সবাই ছুটে আসে সুবোধ মিত্রের বাড়ির আশেপাশে।
কিরীটী বললে, এখানে আর নয়—চল থানায় যাওয়া যাক।
সকলে অতঃপর হাতকড়া-পরা সুবোধ মিত্রকে নিয়ে থানার দিকে অগ্রসর হল।
বহু লোক থানার আশেপাশে এসে ভিড় করে উকিঝুঁকি দিতে থাকে।
কিরীটী আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল।
সেই ব্যবস্থা মতই খগেন পাঠক, কল্যাণ বোস, অবিনাশ ও নরহরি সরকারকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছিল।
একটা বেঞ্চে সবাই পাশাপাশি বসে সশস্ত্র পুলিস প্রহারায়। সুবোধ মিত্রকে থানায় কয়েদঘরে হাতকড়া পরিয়ে আমড় প্রহরায় রাখার ব্যবস্থা হল।
ঘণ্টাখানেক বাদে সুদর্শন হাসপাতাল থেকে ফিরে এল।
ব্যবস্থা করে এলে? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ দাদা। সাবিত্রীকে ও. টি.-তে নিয়ে গিয়েছে, খুব ব্লিডিং হচ্ছে।
ভয় নেই। মনে হয় মারাত্মক কিছু নয়। দেখ তো ভায়া, একটু চায়ের ব্যবস্থা করা যায় কিনা!
এখুনি ব্যবস্থা করছি।
সুদর্শন ভিতরে চলে গেল।
.
আরও আধ ঘণ্টা পরে থানায় সুদর্শনের অফিসঘরের মধ্যে।
রাত তখন সোয়া বারোটা হবে।
কিরীটী, সুব্রত, কল্যাণ মিত্র ও সুদর্শন বসেছিল থানায় সুদর্শনের অফিস ঘরে।
কিরীটী একটা চুবরাটে অগ্নিসংযোগ করে গোটা দুই টান দিয়ে বলে, এখন তো বুঝতে পারছ সুদর্শন, তোমারও ঠিক সেই কথামালার একচক্ষু হরিণের দশা হয়েছিল! সব দিকেই তুমি নজর দিয়েছিলে—দাওনি কেবল মিত্র মশাইয়ের দিকে!
আমি সত্যি বলছি, কল্পনাও করতে পারিনি দাদা যে ওই সুবোধ মিত্রের মত একজন ভদ্রলোক, মিষ্টভাষী, শিক্ষিত শিষ্টাচারী—
সুদর্শনকে বাধা দিয়ে কিরীটী বলে, প্রজাপতির রঙটা দেখেই তুমি ভুলেছিলে ভায়া, কিন্তু সেই মন-মাতানো রূপের পেছনে যে কাটাওলা শুয়োপোকার একটা ইতিহাস থাকে, সেটা একবারও মনে পড়ল না কেন তা তুমিই জান!
মাথা নিচু করে সুদর্শন।
কিরীটী বলে, অবশ্যি এও সত্যি, আমি আশা করিনি, মিত্র মশাই আমার পাতা ফাঁদে অত সহজে অমন করে এসে আজ পা বাড়াবেন! ভাবছিলাম পর পর দুটো খুন হয়ে গেল, এখন কিছুদিন হয়ত মিত্র মশাই একটু সাবধানে পা ফেলার চেষ্টা করবেন। কিন্তু লোভ বড় সাংঘাতিক বস্তু। বুকের মধ্যে লোভের আগুন একবার জ্বললে সহজে নিভতে চায় না। আর লোভের ধর্মই হচ্ছে, হাত সে বাড়িয়েই চলে।
কিন্তু দাদা-সুদর্শন যেন কি বলবার চেষ্টা করে।
কিরীটী তাকে বাধা দিয়ে বলে, অবিশ্যি শুধু লোভই নয়, পরম আত্মম্ভরিতাও সুবোধ মিত্রকে আজ রাত্রে চরম সর্বনাশের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।
আপনি কি দাদা, সুদর্শন আবার বলে, প্রথম থেকেই সুবোধ মিত্রকে সন্দেহ করেছিলেন?
হ্যাঁ, কতকটা বলতে পার। তবে অবিশ্যি আমার মনের সিক্সথ সেন্স কাজ করেছিল। একটু থেমে কিরীটী আবার বলে, তুমি জান না, তোমাকে বলিওনি-এ অঞ্চলের ওয়াগন থেকে মাল চুরি যাবার রহস্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারটা তোমাদের উপরওয়ালার একান্ত অনুরোধে হাতে নেওয়ার পরই এখানে এসে আমি ছদ্মবেশে দশ-বারো দিন ঘুরে ঘুরে বেড়াই।
আশ্চর্য! সুদর্শন বলে।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ, কেন জানাইনি—জানতে তোমাকে দিইনি কেন জান? কারণ তুমি জানা মানেই সুবোধ মিত্র ও তার দলবলেরও জানতে পারা!
কিন্তু–
বুঝতে পারছ না, কেন? আমার এ তল্লাটে আনাগোনা শুরু হয়েছে আর কেউ না জানুক সুবোধ মিত্র জানতে পারতই। তার ফলে যা হবার তাই হত–অর্থাৎ দশজোড়া চোখ সর্বক্ষণ তোমাকে পাহারা দিত এবং তার দলবল সতর্ক হয়ে যেত, যেটা আমি আদৌ চাইনি-আর তাতে করে অনুসন্ধানের ব্যাপারটাও চালানো এত সহজে যেত না। কিন্তু যা বলছিলাম, একা তো আমার পক্ষে সব সংবাদ সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। এবং এ তল্লাটে অনুসন্ধানের কাজ গোপনে চালাতে হলে এমন একজনকে চাই যে এ তল্লাটেরই একজন। অথচ বিশ্বাসী কে এমন আছে- কাকে পাই? খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম গোপনে গোপনে। এখানকার রেস্টুরেন্টের গোলাব সিং আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত, তাকেই ধরলাম ঐ ব্যাপারে। সেই-ই আলাপ করিয়ে দিল আমায় হীরু সাহার সঙ্গে। বললে, সাচ্চা আদমী, বিশ্বাসী। হীরু সাহাকেই দলে নিলাম।
আশ্চর্য! অথচ হীরুর প্রতি আমার
বরাবরই একটা সন্দেহ ছিল, তাই না ভায়া? না হে, গোলাব সিং মিথ্যা বলেনি–লোকটা শুধু সৎ-ই নয়, সরল। তবে হ্যাঁ, একটু রাগী গোয়ারগোবিন্দ টাইপের-অবশ্যি সেইখানেই হীরুর চরিত্র সম্পর্কে তোমার ভুল হয়েছিল।
তারপর?
তারপর থেকে হীরুই সব সংবাদ আমাকে সরবরাহ করত। এতে একটু সুবিধা হয়েছিল আমার–
কি?
হীরু দশ পল্লীরই একজন ও গুণ্ডাপ্রকৃতির বলে তার উপরে কারও সন্দেহ পড়েনি।
তারপর?
হীরু সাহাকে দলে পাওয়ায় আমার আরও একটা সুবিধা হয়েছিল।
কি?
হীরুকে পল্লীর কেউ চট করে ঘাঁটাবার সাহস পেত না। সে-ই আমাকে একটা বিশেষ সংবাদ দেয়।
বিশেষ সংবাদ!
হ্যাঁ, মাধবী-হত্যার রাত্রে সে মাধবী ও একজনকে মাঠের দিকে যেতে দেখেছিল গোটা বারোর সময়। মাধবীকে সে চিনতে পেরেছিল, কিন্তু অন্যজনকে পারেনি।
থামলেন কেন, বলুন দাদা! সুদর্শন বলে।
ইতিমধ্যে সব ব্যাপারটা আগাগোড়া পর্যালোচনা করে একটা কথা আমার মনে হয়েছিল–
কি? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
.
৩৫.
কিরীটী বলতে থাকে সুদর্শনের প্রশ্নের জবাবে।
প্রথমত, ইয়ার্ড থেকে ওয়াগন ভেঙে মাল সরানোর ব্যাপারে যারা জড়িত, তাদের সঙ্গে হয় ওই দশ নম্বর পল্লীর কারও-না-কারোর সঙ্গে যোগাযোগ নিশ্চয়ই আছে, নয়ত দশ নম্বর পল্লীরই লোক তারা।
এবং দ্বিতীয়ত, পর পর যে হত্যাগুলো এ তল্লাটে সংঘটিত হয়েছে, সে হত্যাব্যাপারগুলো পৃথক কিছু নয়—ওই ওয়াগন ভাঙার ব্যাপারেরই খণ্ডাংশ বা ওরই সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কাজেই সর্বাগ্রে তখন যে কথাটা আমার মনে হয়, সেটা হচ্ছে ওই দশ নম্বর পল্লী থেকেই আমায় অনুসন্ধান শুরু করতে হবে। করলামও তাই। এবং ভাগ্যক্রমে আগেই বলেছি, হীরু সাহাকে সাহায্যকারী পেয়ে গিয়েছিলাম!
কিন্তু সুবোধ মিত্রকে সন্দেহ করলেন কেন?
প্রথমে তার ওপর আমার সন্দেহ হয়নি। সন্দেহটা প্রথম জাগে মাধবীর মৃত্যুর পর।
কেন?
কারণ হীরু সাহার মুখে যে কথাটা শুনেছিলাম, তাছাড়াও আরও দুটো সংবাদ তার কাছ থেকে পেয়েছিলাম!
কি সংবাদ?
প্রথমত, বাইরে দশ নম্বর পল্লীর সবাই যদিও জানত, সুবোধ মিত্রের সঙ্গে মাধবীর কোন যোগাযোগ ছিল না—সেটা সত্য নয়, আসলে মাধবীই ছিল সুবোধ মিত্রের দক্ষিণ বাহুঁ। এবং শুনলে তুমি আশ্চর্য হবে ভায়া—
কি?
আসলে সুবোধ মিত্রের রক্ষিতা ছিল মাধবী!
সে কি! অর্ধস্ফুট কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে সুদর্শন।
জানতাম কথাটা শুনে তুমি বিস্ময়ের প্রচণ্ড এক ধাক্কা খাবে। কিন্তু কথাটা নির্মম সত্য। বাইরে সে দেখাত বটে সুবোধ মিত্রকে ঘৃণা করে, এবং সুবাধ মিত্রও তার সঙ্গে যে কোন যোগাযোগ আছে হাবেভাবে আদৌ তা প্রকাশ করত না। কিন্তু হলে কি হবে, সকলের চোখে তারা ধুলো দিলেও একজনের চোখে তারা ধুলো দিতে পারেনি—সে সবই জানত-বলতে পার জানতে পেরেছিল—
কে?
বল তো কে?
কে?
তোমার সাবিত্রী। বলেন কি দাদা! সাবিত্রী জানত?
হ্যাঁ, ভায়া, জানত। ভুলে যাচ্ছ কেন, একঘরে তারা শুতো—দুই বোন। আর সুবোধ মিত্র ছিল তাদের ঠিক নেক্সট-ডোর নেবার। মাধবীর হত্যার রাত্রে তাই সাবিত্রী জেগে ছটফট করছিল তার দিদির প্রতীক্ষ্ণয়। কারণ সে তো জানতই যে মধ্যে মধ্যে তার দিদির বাড়ি ফিরতে রাত হয় এবং তার কারণ থিয়েটার বা রিহার্সাল নয়—সুবোধ মিত্র–
আশ্চর্য!
এখনও তোমার বয়স অল্প, অভিজ্ঞতাও তোমার সামান্যই ভায়া। তাই তুমি জান না নারীচরিত্র কি দুজ্ঞেয়, কি বিচিত্র!
সুদর্শন আবার তার কথাটার পুনরাবৃত্তি করে, আশ্চর্য! সাবিত্রী জানত অথচ–
অথচ তোমাকে সে বলেনি! আরে গর্দভ, এটা বুঝতে পারছ না কেন, কিরীটী সুদর্শনকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলে, প্রথম প্রেমের মুহূর্তে কোন মেয়ে কখনও তাদের সংসারের লজ্জার কথা মুখ ফুটে প্রেমাস্পদের কাছে বলে না-বলতে পারে না।
কিন্তু দাদা—
ভয় নেই ভায়া, সাবিত্রী খাটি হীরে। অপাত্রে তুমি হৃদয় দান করোনি। কিরীটী হাসতে হাসতে বলে।
সুদর্শনের মুখটা সহসা লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। সে আর কিরীটীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না।
কিরীটী বলে, মনে আছে তোমার, মাধবীহত্যার রাত্রে সাবিত্রী তার দিদির অপেক্ষায় জেগে থাকতে থাকতে নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিল।
হ্যাঁ।
আসলে তা নয়। তবে?
ইদানীং পতিতবাবুর স্ত্রী—ওদের মা, মাধবীর গতিবিধি সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন। তাই সাবিত্রী ঘুমোয়নি, জেগেই ছিল-এবং সম্ভবত সুবোধ ও মাধবীকে একত্রে দেখেছিল।
কিরীটী আবার বলতে শুরু করে, থাক যা বলছিলাম, সাবিত্রী ভয়েও খানিকটা মুখ খুলতে পারেনি। মিত্র মশাইটি তো আমাদের সহজ চীজ নন! একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে শুরু করে, মাধবীর সঙ্গে মিত্র মশাইয়ের যোগাযোগের ব্যাপারটা যেমন আমাকে চমকে দেয়, ঠিক তেমনি নরহরি সরকারের ওখানে মাধবীর যাতায়াতটাও দুইয়ে দুইয়ে চারের মত মিত্র মশাইয়ের প্রতি মনটা আমার আরও সন্দেহযুক্ত করে তোলে। আর ওই শেষোক্ত কারণেই মিত্র মশাইয়ের ওপর আমার সমস্ত সন্দেহটা গিয়ে পড়ে। তারপরই আমি মিত্র মশাইয়ের ওপর কড়া নজর রাখি।
৩৬-৪০. কিন্তু সুবোধ মিত্রই যে দোষী
৩৬.
কিন্তু সুবোধ মিত্রই যে দোষী, সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হলেন কখন? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
গুলজার সিংয়ের মৃত্যুর পর। কিরীটী রায় জবাব দেয়।
কেন? প্রশ্নটা করে সুদর্শন কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
তোমার হয়ত মনে আছে সুদর্শন, মৃত গুলজার সিংয়ের মুঠির মধ্যে এক টুকরো সাদা পশম পেয়েছিলে—পরে যেটা তুমি আমাকে দেখিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
সেই পশমটুকুই আমার দৃষ্টির সামনে সত্যকে উদ্ঘাটিত করে দিল।
কি রকম?
মিত্র মশাইকে তুমি যদি ভাল করে স্টাডি করতে বিশেষ তার বেশভূষা, তাহলেই নজরে পড়ত তোমার, সাদা রঙের ওপর তার একটা স্বাভাবিক প্রশ্রয় আছে। সাদা ভয়েল পাঞ্জাবি, সাদা শাল, উলের সোয়েটার। ব্যাপারটা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি।
ওই সাদা পশমটুকু গুলজার সিংয়ের হাতের বড় বড় নখে আটকে গিয়েছিল, হয়ত ধস্তাধস্তির সময় এই পশমটুকু মিত্র মশাইয়ের সে-রাত্রে যে গরম হাতে-বোনা সোয়েটারটা ছিল তা থেকেই ছিঁড়ে এসেছিল।
হয়ত গুলজার সিংয়ের সঙ্গে সে-রাত্রে মিত্র মশাইয়ের মারামারির মত কিছু একটা হয়েছিল প্রথমে, তারপরই হয়ত প্রথম সুযোগেই ক্লোজ রেঞ্জ থেকে মিত্র মশাই গুলজারকে গুলি করে হত্যা করে। অবিশ্যি তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি উন্ডের গায়ে কার্বনডিপজিট থেকে।
গুলজার সিংও তাহলে ওই দলের?
নিঃসন্দেহে। নচেৎ বোম্বাই ফিল্মে ফাইনান্স করবার মত অত টাকা সে কোথায় পেত?
গুলজার সিংকে মিত্র মশাই কেন মেরেছেন বলতে পারেন দাদা?
মনে নেই তোমার, গাড়িতে আসতে আসতে আজ রাত্রেই তোমাকে বলেছিলাম, গুলজার সিংয়ের ফ্ল্যাট সার্চ করতে গিয়ে তার ঘরে মাধবীর একটা ফটো পাওয়া গিয়েছে!
হ্যাঁ।
হয়ত সেই ফটোই হয়েছিল তারপর কাল। মাধবী ছিল মিত্র মশাইয়ের রক্ষিতা কাজেই গুলজার সিংয়ের ঘরে যদি মাধবীর ফটো থাকে আর মিত্র মশাই কোনমতে সেটা জানতে পারেন, ব্যাপারটা তিনি ভাল চোখে অবশ্যই দেখবেন না—দেখতে পারেন না। হয়ত ওই রকম কিছু হয়েছিল, যদিও সেটা আমার অনুমান—আর তাতেই হতভাগ্য গুলজার সিংকে প্রাণ দিতে হল। এবং সেটাই হল মিত্র মশাইয়ের সর্বাপেক্ষা বড় ভুল, সবচেয়ে বেশি অবিবেচনার কাজ।
কেন?
কারণ গুলজার সিং নিহত না হলে এত তাড়াতাড়ি হয়ত সমস্ত রহস্যটা চোখের সামনে আমার পরিষ্কার হয়ে যেত না। মিত্র মশাইয়ের ঝাপসা চেহারাটাও এত সহজে স্পষ্ট হয়ে উঠত না। এমনিই হয় সুদর্শন, কোন গ্যাংয়ের মধ্যে কোন নারী থাকলে শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই নারীই সমস্ত গ্যাংটার মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে। মিত্র মশাইয়েরও হল তাই।
আচ্ছা চোরাই মালের বেচা-কেনাটা কোথায় হত বলে আপনার মনে হয় দাদা?
তা অবিশ্যি সঠিক জানি না, তবে এটা ঠিক, একটা লভ্যাংশ নিয়ে মাল সব পাচার করত তোমার ঐ রাধেশ্যাম অর্থাৎ নরহরি সরকার। এবং মালের দাম হিসেবে টাকাকড়ি নয়, তাকে দিতে হত সোনার বার বা গিনি-গুনে গুনে। আর গিনিগুলো আসত ঐ মাধবীর হাত দিয়ে।
ক্রমশ এখন সব বুঝতে পারছি দাদা–
অথচ নরহরি জানত না, মাধবী কার হাতে গিনি বা সোনার বার পৌঁছে দেয়। সব কিছুর মূলে যে আছেন আমাদের মিত্র মশাই,-সভ্যভব্য শিক্ষিত সুরকার শান্ত মানুষটি, নরহরির সেটা কল্পনাতেও কখনও আসেনি।
কিন্তু–
কেন আসেনি, তাই না?
হ্যাঁ।
সে-কথা ভাববার তার সময় কোথায় ছিল! সে তো সর্বক্ষণ মাধবীকে পাওয়ার স্বপ্নেই মশগুল ছিল।
মাধবীরও তাহলে লুঠের মালের ভাগ ছিল?
নিঃসন্দেহে। আর তার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
কি প্রমাণ?
কিরীটী বলে, তোমাকে সেকথা বলা হয়নি, তার অফিসের ডেক্সে সেভিংস ডিপজিটের পাসবই পাওয়া গিয়েছে।
পাসবই।
হ্যাঁ, আর সেই পাসবইয়ের মধ্যে কত জমা আছে জান?
কত?
তাতে জমা আছে ত্রিশ হাজার টাকা!
সত্যি? বলেন কি দাদা? কথাটা বলে সুদর্শন তাকায় বিস্ময়ে কিরীটর দিকে।
খুব বিস্ময় লাগছে, তাই না? হাসতে হাসতে কিরীটী বলে, পাখি হয়ত একদিন অকস্মাৎ ডানা মেলে তোমার ওই দশ নম্বর পল্লীর ছোট ঘর থেকে উড়ে যেত, তখন তুমি হয়ত কেবল ভাবতে মাধবী কারও সঙ্গে ভেগেছে! কিন্তু তুমি কল্পনা করতে পারতে না, তার পশ্চাতে ফেলে যাওয়া তার সত্যকারের ইতিহাসটা!
তারপর ক্রমশ সমস্ত ব্যাপারটা হয়ত একদিন কেবলমাত্র একটি মেয়ের গৃহত্যাগের ব্যাপারেই পর্যবসিত হত। কিন্তু বিধি হল বাম। বেচারী জানতেও পারেনি ইতিমধ্যে কখন তার ভাগ্যাকাশে ঘন কালো মেঘ সঞ্চারিত হয়েছে।
যাক ভোর হয়ে এসেছে, আর এক প্রস্থ চায়ের যোগাড় কর, তারপর শুরু করা যাবে মিত্র মশাইকে জিজ্ঞাসাবাদ। দেখা যাক, ভদ্রমহোদয় মুখ তার খোলেন কিনা!
সত্যিই ইতিমধ্যে কখন রাত্রির অন্ধকার শেষ হয়ে ভোরের প্রথম আলো ফুটে উঠেছে একটু একটু করে চারধারে।
সুদর্শন উঠে গেল চায়ের ব্যবস্থা করতে।
.
৩৭.
চা-পানের পর আবার যখন সকলে একত্রিত হল, সকাল তখন ছটা প্রায়।
সকলে এসে পাশের ঘরে ঢুকল।
চারজন তখনও পাশাপাশি বেঞ্চের ওপরে বসে। কেবল তাদের মধ্যে একজন ছিল না ধৃত ব্যক্তিদের মধ্যে।
সুবোধ মিত্রের হাতে হাতকড়া লাগানো পুলিস-প্রহরায় তাকে ওদের চোখের আড়ালে থানার কয়েদঘরে রাখা হয়েছিল।
ওদের সকলকে ঘরে ঢুকতে দেখে নরহরি সরকারই প্রথমে বিরক্তিসূচক কণ্ঠে বলে ওঠে, রাধেশ্যাম! আমাদের এভাবে এনে থানায় আটক করে রাখার কারণটা কি মল্লিক সাহেব?
নরহরি সুদর্শনকে লক্ষ্য করেই কথাটা বলে।
এখনও বুঝতে পারেননি, সরকার মশাই! ব্যঙ্গভরা স্বরে সুদর্শন জবাব দেয়।
রাধেশ্যাম। আজ্ঞে না।
বোঝেননি?
না।
এখন বলুন তো সরকার মশাই, ওয়াগান ভেঙে যেসব মাল রেলওয়ে ইয়ার্ড থেকে চুরি যেত তার কি ব্যবস্থা আপনি করতেন?
রাধেশ্যাম! এসব কি বলছেন? ছি ছি, শোনাও পাপ। রাধেশ্যাম!
তাহলে তাই করবেন—সবাইকে তো চালান দিচ্ছি, গাওনা যা গাইবার আদালত কক্ষে জজ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে করবেন সকলে মিলে। জমবে ভাল, যাত্রার দল তো আপনার তৈরি আছেই। সুদর্শন আবার বলে।
রাধেশ্যাম! সম্রান্ত ভদ্র ব্যক্তিদের এইভাবে ধরে হেনস্তা করা–
অকস্মাৎ যেন সুদর্শন খিঁচিয়ে ওঠে নরহরির মুখের দিকে তাকিয়ে থামুন চোরচূড়ামণি! লজ্জা করছে না আপনার, এখনও মুখে রাধেশ্যাম বুলি কপচাচ্ছেন! আপনাকে গুলি করে মারা উচিত।
পিপীলিকা পাখা ধরে মরিবার আশাতেই। হঠাৎ খগেন পাঠক বলে ওঠে পাশ থেকে।
কিরীটীই এবারে কথা বলে, পাঠক মশাই, এখনও হয়ত জানেন না আপনি, আপনার সাঙ্গোপাঙ্গরাই শুধু নন—আপনাদের দলপতিও ধরা পড়েছেন!
কথাটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সুদর্শনের যেন মনে হল, নরহরি ও কল্যাণ বোস চমকে উঠল।
কি কল্যাণবাবু, একেবারে যে চুপচাপ! সুদর্শন আবার বলে, সেদিন চোখে আমার খুব ধুলো দিয়েছিলেন!
আজ্ঞে বিশ্বাস করুন স্যার, এসবের মধ্যে আমি আদৌ নেই, বিন্দুবিসর্গও এসবের আমি জানি না। কল্যাণ বলে ওঠে।
কিছুই জানেন না?
আজ্ঞে বিশ্বাস করুন স্যার—
আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কি আসে-যায়! আদালতে হাকিম সাহেবকে যদি বিশ্বাস করাতে পারেন, তাহলেই হবে।
খগেন পাঠক অনুচ্চ কণ্ঠে ওই সময় বলে, শালা।
সুদর্শন হেসে ফেলে।
কিরীটী আবার বলে, এখনও সবাই আপনারা যে যতটুকু জানেন স্বীকার করুন, আইনের হাত থেকে—গুরুদণ্ড থেকে যদি বাঁচতে চান!
অবিনাশ ওই সময় বলে ওঠে, ওই—ওই শালা পাঠকই যত নাটের গুরু। ওই-ই টাকার লোভ দেখিয়ে আমাকে ওদের দলে টেনেছিল।
আর আপনিও সুবোধ বালকের মত ভ্যান লুট করবার ব্যাপারে লেগে গেলেন, তাই না অবিনাশবাবু! এবং শুধু তাই নয়, নিজের মায়ের পেটের বোনটিও যে ওই দলে ভিড়েছে—জেনেও চুপ করে রইলেন! বলে ওঠে সুদর্শন।
হঠাৎ যেন খগেন, অবিনাশ ও নরহরির মুখটা চুপসে গেল সুদর্শনের শেষ কথায়।
কি, মুখ শুকিয়ে গেল যে একেবারে অবিনাশবাবু আপনাদের?
সুদর্শন! কিরীটী ডাকল।
দাদা!
যাও, ওদের দলপতিকে ওদের সামনে এনে একবার দাঁড় করাতে বল।
সুদর্শন বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
ওরা সকলই উপস্থিত পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।
একটু পরে হাতকড়া পরা অবস্থায় সুবোধ মিত্রকে দুজন আমর্ড কনস্টেবল ঘরে এনে ঢোকাতেই সকলের গলা থেকেই বিস্ময়ভরা স্বর নির্গত হয় একত্রে যেন।
নরহরি বলে, সুবোধ!
খগেন পাঠক বলে, সুবোধবাবু!
অবিনাশ বলে, সুবোধ!
কল্যাণ বসু বলে, সুবোধবাবু।
আর সুবোধ ওদের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
কিরীটী বলে, কি হল সরকারমশাই, আপনার তো আজ অত চমকাবার কথা নয় আপনি তো বোধ হয় দু-একদিন আগেই ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছিলেন।
রাধেশ্যাম! তাহলে সত্যিই ড়ুবলাম?
হ্যাঁ, একবারে অগাধ জলে!
.
বুঝতে কারোই আর কষ্ট হয় না, হাতকড়াবদ্ধ অবস্থায় ঐভাবে সুবোধ মিত্রকে। সামনে দেখে ও কিরীটীর কথা শুনে সকলেরই মনোবল যেন ভেঙে গিয়েছে তখন।
কি, এবারে নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন আপনারা যে যা জানেন! কিরীটী বলে সকলের ॥ মুখের দিকে তাকিয়ে।
সকলেই পর্যায়ক্রমে একে একে তখন নরহরির মুখের দিকে তাকাচ্ছ শ্যেনদৃষ্টিতে।
কিরীটী ব্যাপারটা বুঝতে পারে। বলে, মনে হচ্ছে আপনারা ঐ রাধেশ্যামকেই চিনতেন!
একে একে সকলেই স্বীকার করে, তারা নরহরিকেই চিনত। ওয়াগন ভেঙে মাল চুরি করে নরহরির নির্দেশমতই ট্রাকে মাল চালান করে দিত, তারপর নরহরিই সকলকে যা টাকা-পয়সা দেবার দিত।
নরহরি বলল, দোহাই ধর্মের, আমি বিশেষ কিছুই জানি না। মাল শুধু পাচার করে দিতাম মাধবীর নির্দেশমত এবং মাধবী যেমন যেমন বলে যেত তেমনিই করা হত। দোহাই হুজুরের। রাধেশ্যাম! আমি কখনও মাল চুরিও করিনি-মালে হাতও দিইনি!
হ্যাঁ, কেবল বেচা-কেনাটা করেছেন! কিরীটী হাসতে হাসতে বললে।
সুবোধ মিত্র কিন্তু একটি কথাও বললে না। মুখ বন্ধ করেই রইল আগাগোড়া।
বেলা দশটা নাগাদ পুলিশ ভ্যানে চাপিয়ে হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি—সকলকে কলকাতায় লালবাজারে চালান করে দিল সুদর্শন।
দশ নম্বর পল্লীর ঘরে ঘরে তখন গুঞ্জন। সমস্ত পল্লীতে যেন সাড়া পড়ে গেছে।
আর এক প্রস্থ চা-পানের পর কিরীটী ও সুব্রত অনেক আগেই বিদায় নিয়েছিল।
কল্যাণ মিত্র পুলিস-ভ্যানের ইনচার্জ হয়ে গেল।
.
৩৮.
দশ নম্বর পল্লীতে সুবোধ মিত্রের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে রীতিমত যেন একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা যেন সত্যিই কল্পনারও অতীত। সুবোধ মিত্রের মত একজন শিক্ষিত নির্বিরোধী ভদ্র যুবক—সে যে মালগাড়ির দরজা ভেঙে মালপাচার করতে পারে ও মাধবী ও গুলজার সিংকে হত্যা করতে পারে অমন নৃশংসভাবে, ব্যাপারটা যেন পল্লীর সকলকে একেবারে বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। সকলের মুখেই এক কথা, শেষে ঐ সুবোধ–সুবোধের কাজ! তাও তো ভিতরের আসল ব্যাপারটা-মাধবীর সঙ্গে সুবোধ মিত্রের সত্যিকারের কি সম্পর্ক ছিল, সেটা কেউ জানতে পারেনি!
অবিশ্যি আর কেউ না জানতে পারলেও মাধবীর মা-বাবা জানতে পেরেছিলেন। দুজনেই যেন একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। তার উপর বড় ছেলে অবিনাশ, সেও ঐ দলে ছিল—সে সংবাদটাও তাদের পক্ষে কম মর্মান্তিক ছিল না।
ঐ ঘটনার দিন-দুই পরে।
দুটো দিন সুদর্শন অত্যন্ত ব্যস্ত ছিল রিপোর্ট তৈরি করবার ব্যাপার নিয়ে।
তৃতীয় দিন সকালের দিকে সুদর্শন কিরীটীর ফোন পেল।
কিরীটী বলে গিয়েছিল সুদর্শনকে, সন্ধ্যার দিকে যেন সে একবার তার ওখানে যায় তার এদিককার কাজকর্ম সেরে।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ সুদর্শন বের হল।
প্রত্যেহই সাবিত্রীর খোঁজ নিয়েছে সে হাসপাতালে। সাবিত্রী ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠছে। কিরীটীর ওখানে যাবার জন্য বের হয়ে প্রথমেই সুদর্শন গেল হাসপাতালে।
হাসপাতালের কেবিনেই কিরীটীর নির্দেশমতই সাবিত্রীকে চব্বিশ ঘণ্টা পুলিস প্রহরার মধ্যে রাখা হয়েছিল।
বাইরের কাউকে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছিল না।
হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা, সাবিত্রী চোখ বুঝে শয্যার ওপর শুয়ে ছিল।
সুদর্শন কেবিনে এসে প্রবশ করল।
পদশব্দে সাবিত্রী চোখ খুলে সুদর্শনের দিকে তাকাল।
সাবিত্রী!
মৃদু গলায় ডাকল সুদর্শন শয্যার কাছে গিয়ে।
সাবিত্রী মুখটা ঘুরিয়ে নেয়।
কাছে গিয়ে পাশের টুলটায় বসে সুদর্শন সাবিত্রীর রুক্ষ চুলে একখানি হাত রেখে স্নেহ-কোমল কণ্ঠে বলে, কেমন আছ সাবিত্রী?
সাবিত্রী কোন সাড়া দেয় না। মুখটা ঘুরিয়েই থাকে।
কথা বলবে না সাবিত্রী! আমার দিকে তাকাও সাবিত্রী!
সাবিত্রী সাড়া দেয় না, মুখ ঘুরিয়েই থাকে।
সাবিত্রী, লক্ষ্মীটি, শোন!
তবু সাবিত্রী সাড়া দেয় না।
তাকাও সাবিত্রী আমার দিকে! আবার বলে।
সাবিত্রী তথাপি নীরব, নিশ্চল।
আবারও ডাকে সুদর্শন।
এতক্ষণে সাবিত্রী মুখ ফিরিয়ে তাকাল সুদর্শনের দিকে। তার দুচোখে জল।
সাবিত্রী!
কেন এসেছেন আপনি? ছি ছি, লোকে কি ভাববে—এখন স্মাগলারের বোন—
তার জন্যে তো তোমার কোন অপরাধ নেই সাবিত্রী–
না, না। সাবিত্রী দুহাতে মুখ ঢাকে।
সাবিত্রী, শোন–
না, না। আপনি যান—যান।
কিরীটী রায় বলেছেন, তুমি খাঁটি হীরে, নিষ্পাপ।
না, না, আমি হীরে নই, নিষ্পাপও নই—আমারও দোষ ছিল।
কি দোষ ছিল তোমার?
সব কথা আপনাকেও বলিনি—বলতে পারিনি—
বলনি ঠিকই, কিন্তু তাতে তোমার অপরাধটা কোথায়?
অপরাধ নেই?
ন।
আপনি বিশ্বাস করেন সে-কথা?
করি।
সত্যি বলছেন?
সত্যি বলছি।
কিন্তু কেউ তো সে-কথা বিশ্বাস করবে না। বলবে আমার বোন—আমার ভাই–
তোমার দিদি-তোমার দাদা যদি কোন অপরাধে অপরাধী হয়, তার জন্য তোমাকে কেন অপযশ কুড়াতে হবে?
হবে, আপনি জানেন না—
কিছু হবে না।
এ আপনি কি বলছেন?
ঠিকই বলছি।
সাবিত্রীর দুচোখে জল।
কান্নাঝরা গলায় বলে, কিন্তু এরপর কেমন করে আবার আমি ঐ পল্লীতে সবার সামনে ফিরে যাব!
ফিরবেই বা কেন সেখানে আবার তুমি?
তবে কোথায় যাব?
যদি তোমার আপত্তি না থাকে—
কি?
আমার কাছে তুমি যাবে।
আপনার কাছে?
হ্যাঁ, আমার ঘরে।
সাবিত্রীর দুচোখের কোল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
শোন সাবিত্রী, তুমি সুস্থ হয়ে ওঠার আগেই সব ব্যবস্থা আমি করে ফেলব। কালই ডি. সি.-কে আমায় নতুন থানায় পোস্টিং করবার জন্য বলব। সেখানে নতুন কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে তোমাকে আমি তুলব।
মা, বাবা—
অবশ্য তাদের মত নেব বৈকি! কি, রাজী তো?
সাবিত্রী কোন জবাব দেয় না, চোখ বুজিয়ে ফেলে।
সাবি!
ছোড়দা এসেছিল, কিন্তু তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি এরা—
দেয়নি?
না।
সুদর্শন বলে, যা ঘটে গিয়েছে তার জন্য তুমি নিজেকে বিব্রত বা অপরাধীই বোধ করছ কেন সাবিত্রী!
সাবিত্রী বললে, কেমন করে ভুলব বলুন তারা আমারই দিদি, আমারই দাদা
তা হলেই বা। ওসব চিন্তা তুমি মন থেকে তোমার মুছে ফেলে দাও। যা হয়ে গিয়েছে গিয়েছে, সামনে তোমার নতুন জীবন!
সাবিত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করে, একটা কথা বলল?
বল।
বাবা সব জানেন? জানতে পেরেছেন?
যতটা শুনেছি বোধ হয় সব না হলেও কিছু কিছু জানতে পেরেছেন। সংসারে দুঃসংবাদ দেবারও লোকের অভাব হয় না সাবিত্রী। তাছাড়া দুঃসংবাদ হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। আর এখনও যদি না জানতে পেরে থাকেন সব কথা—কিন্তু আর চাপাও থাকতে পারে না, কানে যাবেই তাঁর।
জানি। আমি যদি হাসপাতাল না আসতাম হয়ত একটা ব্যবস্থা হত। আর বাড়িতে এখন কেউ নেই–
কেন, তোমার ছোড়দা তো আছেন?
তা আছেন।
তবে?
ছোড়দা অত বুঝেসুঝে চলতে পারে না কোনদিনই, তাই ভাবছি—
কি?
বাবা হয়ত সব শুনে আর বাঁচবেন না। দিদিকে যে তিনি কি ভালবাসতেন আর কেউ না জানলেও আমি তো জানি। আর বাবা জানতে পারবেন বলেই এতদিন দিদির সব কিছু ব্যাপার জেনেও মুখ বুজে থেকেছি।
তোমার দিদি জানত যে তুমি সব জান?
বোধ হয় না।
আচ্ছা একটা কথার জবাব দেবে সাবিত্রী?
কি?
কেমন করে প্রথম তুমি জানতে পেরেছিলে সব?
হঠাৎ একদিন রাত্রে—
বল, থামল কেন?
মধ্যে মধ্যে ফিরতে দিদির রাত হত, এমন কি কখনও কখনও রাত সাড়ে বারোটা একটা। কেউ জানত না। আমিই সদর দরজা খুলে দিতাম দিদি ডাকলে। আমি যে তার পথ চেয়ে জেগে বসে থাকি তা দিদি জানত না। সে জানত ঘুম আমার পাতলা, এক ডাকেই উঠে পড়ি। তাই যে রাত্রে ফিরতে দেরি হত, আমাকে বলে যেত। আর আমি এদিকে দিদি কখন ফিরবে সে আশায়—পাছে তার অত রাত্রে আসার কথা কেউ জানতে পারে, পাছে দিদির ডাকাডাকিতে মা-বাবার ঘুম ভেঙে যায় সেই ভয়ে-জেগে বসে থাকতাম।
.
৩৯.
সুদর্শন একটু থেমে প্রশ্ন করে, তোমার দিদির সঙ্গে যে সুবোধবাবুর ঘনিষ্ঠতা ছিল জানলে কি করে প্রথম?
আমার ওদের হাবভাব দেখে সন্দেহ যে হয়নি তা নয়, তবে এতটা যে ভাবতে পারিনি কখনও।
তারপর?
এক রাত্রে, আমি জেগেই ছিলাম দিদির অপেক্ষায়, হঠাৎ দিদি ও সুবোধদার গলার স্বর আমার কানে এল। আমাদের দরজার বাইরে ওরা দাঁড়িয়ে কথা বলছে–
তোমার দিদি আর সুবোধবাবু?
হ্যাঁ।
কি কথা বলছিল তারা?
দিদি বলছিল, এবার যাও, সাবি জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হবে!
সুবোধা হেসে জবাব দিল, কি আর কেলেঙ্কারি হবে! দুচারটে সোনার গয়না দিলেই চুপ করে যাবে। তোমাদের মেয়েদের চরিত্র তো আমার কিছু জানতে বাকি নেই!
সবাই মাধবী ভাবো, তাই না সুবোধ? দিদি জবাব দিল।
ভাবি বৈকি। সুবোধদা বললে।
তারপর সুবোধদা চলে গেল, দিদিও এসে দরজায় টোকা দিল। আমি উঠে দরজা খুলে দিলাম। তা সত্ত্বেও ওদের মধ্যে যে অতটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছে বুঝতে পারিনি। সাবিত্রী চুপ করল।
বল, থামলে কেন?
সাবিত্রী বলতে লাগল, দিন কয়েক বাদে অমনি এক রাত্রে দিদির অপেক্ষায় জেগে আছি, হঠাৎ ওদের দুজনের গলার স্বর কানে এল। কি খেয়াল হল, জানলা দিয়ে উঁকি দিলাম জ্যোৎস্না ছিল অল্প অল্প সে-রাত্রে, রাত বারোটা বেজে গিয়েছে, দেখলাম
কি?
সুবোধা—
বল, বল!
সুবোধা দিদিকে দুহাতে বুকে জাপটে ধরে–, সাবিত্রী আর বলতে পারে না, থেমে গেল। একটু থেমে আবার সাবিত্রী বলতে শুরু করে, আর এক রাত্রে–
কি?
অমনি জেগে ছিলাম, হঠাৎ দিদি আর সুবোধদার গলা শোনা গেল। শুনলাম দিদিকে সুবোধা বলছে, কাল একবার রাত্রে রাধেশ্যামের সঙ্গে দেখা করো, গতবারের মালের টাকা এখনও দেয়নি।
এবারে কি মাল ও পাচার করেছে? দিদি শুধায়।
সুবোধদা জবাব দেয়, দশ পেটি টেরিলিন ও সিল্ক–বেশ মোটা দাঁও—
ব্যাপারটা কিন্তু খুব risky সুবোধ—
ধ্যাৎ, no risk–no gain! বেঁচে থাক্ railway yeard যাক যা বললাম মনে থাকে যেন, বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার মাল হবে—অনেক টাকা পাব শালার কাছে
দিদি তারপরই বললে, যাই বল সুবোধ, আমার বড় কেন যেন ভয় করে ওর কাছে যেতে রাত্রে–
কেন?
ও এমন শকুনের মত আমার দিকে তাকায়।
দোব হারামজাদার চোখ দুটো একদিন লোহার শলা দিয়ে গেলে। দিতামও—কেবল লোকটা বিশ্বাসী, তাই চুপ করে আছি।
তারপরই দিদি বললে, গতবার তুমি আমাকে কিছুই দাওনি—
দোব। এবারে এক থেকে দুহাজার দোব। সুবোধদা হাসতে হাসতে দিদিকে বললে।
শুনতে শুনতে আমি তখন যেন পাথর হয়ে গেছি। বলতে লাগল সাবিত্রী।
তারপর?
ঐ ঘটনারই দিন দুই বাদে হঠাৎ একদিন দিদির ব্যাগে দেখি দুটো সোনার বার আর আশিটা গিনি। আমার কিছুই আর তখন জানতে বাকি থাকে না।
আশ্চর্য! সুদর্শন বলে।
কি?
কিরীটীদা কিন্তু একেবারে ঠিক ঠিক অনুমান করেছিলেন!
কিরীটী কে?
আমার দাদা—কিরীটী রায়, বিখ্যাত সত্যসন্ধানী। সেদিন রাত্রে সুবোধের বাড়ি রেড করবার সময় যাকে আমার পাশে দেখছিলে—লম্বা, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা–
হঠাৎ সাবিত্রী বলে, একটা কথা বলব?
কি?
আমাকেও বোধ হয় বিচারের সময় আদালতে গিয়ে সাক্ষী দিতে হবে?
কেন?
আমারই তো ভাই-বোন ছিল তারা। তাছাড়া—
তা কেন হবে?
সুবোধদা যদি আদালতে দিদির কথা তোলে!
মনে হয় তুলবে না। তবে যদি তোলেই, তোমাকে যাতে না যেতে হয় সেই চেষ্টাই করা হবে। তাছাড়া তোমার নাম রিপোর্টে কোথাও নেই—থাকবেও না।
সত্যি?
হ্যাঁ।
সত্যি বলছ? আদালতে আমাকে যেতে হবে না?
না।
কিন্তু
বল!
মা-বাবা—
না, তাঁদেরও যাতে না যেতে হয় সেই ব্যবস্থাই করা হবে। তবে—
তবে কি?
তোমার ছোড়দাকে হয়ত একবার যেতে হতে পারে।
সাবিত্রী হাত বাড়িয়ে সুদর্শনের একটা হাত চেপে ধরে।–আঃ, তুমি আমায় বাঁচালে। আদালতের কথা ভাবতে ভাবতে আমার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল এ কদিন।
এখন আর ভয় নেই তো? সুদর্শন মৃদু হেসে সাবিত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
না।
সত্যি বলছ?
সত্যি।
একটু পরে আবার সুদর্শন মৃদু গলায় ডাকে, সাবিত্রী!
সাবিত্রীর একটা হাত তখনও সুদর্শনর হাতের মধ্যে ধরা।
সাবিত্রী!
বল।
এবারে তাহলে আমি উঠি আজকের মত?
যাবে?
হ্যাঁ।
কাল আসবে না?
আসব বৈকি।
কখন?
বিকেলে।
.
৪০.
হাসপাতাল থেকে যখন বের হল সুদর্শন, বিকেলের আলো মিলিয়ে গিয়েছে। বুকের মধ্যে তার যেন একটা খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছিল।
সাবিত্রী—তার সাবিত্রী-আজ বুঝতে কষ্ট হয়নি, তার সাবিত্রী তার প্রতি আসক্ত। তাই কেবল নয়—এক-একবার মনে হয় সুদর্শনের, কিরীটীর ওখানে আজ আর যাবে না, এখানে-ওখানে খানিকটা ঘুরে ঘুরে বেড়াবে।
তারপরেই আবার মনে হয়, কিরীটী তাকে যেতে বলেছেন—না গেলে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন।
মনের মধ্যে যেন একটা সুর গুনগুনিয়ে চলেছে।
কিরীটীর গৃহ পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল সুদর্শনের।
সুদর্শন কিরীটীর মেজোনিন ফ্লোরের ঘরের কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে পা দিতেই স্মিতকণ্ঠে কিরীটী আহ্বান জানাল, এস, এস ভায়া! তারপর সংবাদ সব শুভ তো?
কীসের সংবাদ দাদা?
যে সংবাদের জন্য অধীর প্রতীক্ষ্ণয় আছি! কিরীটী বলে হাসতে হাসতে।
তা না বললে বুঝব কি করে?
বুঝতে পারছ না? কোন্ সংবাদের জন্য অধীর হয়ে আছি?
না।
কৃষ্ণা!
কিরীটী কৃষ্ণার মুখের দিকে এবারে তাকাল।
তুমিই তাহলে সংবাদটা নাও!
কৃষ্ণাও ঘরে ছিল। সে বললে, হাসপাতালে গিয়েছিলেন সুদর্শনবাবু?
হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। অসতর্ক ভাবেই যেন কথাটা বলে ফেলে সুদর্শন।
কিরীটী হো হো করে হেসে ওঠে।
এবারে কৃষ্ণাই বলে, সাবিত্রী কেমন আছে?
ভাল।
কিরীটী ঐ সময় বলে ওঠে, তাহলে ভায়া, এক প্রজাপতি তার রঙের খেলায় তোমার চোখ ধাঁধিয়ে দিলেও অন্য প্রজাপতি সত্যিই তোমার জীবনে রঙ নিয়ে এল।
দাদা, আপনি যদি কেবলই ওই সব কথা বলেন তো আমি উঠে যাব!
আরে না না-বসো। আরও একটা সুখবর আছে হে।
সুখবর!
হ্যাঁ। কিরীটী বললে, তোমার কর্তার সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল আজই দুপুরে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, বললেন, তোমার প্রমোশনের জন্য তিনি রেকমেন্ড করবেন।
কৃষ্ণা বললে, বসো তোমরা, আমি চা নিয়ে আসি।
কিরীটী বলল, সুদর্শনের জন্য মিষ্টিও এনো কৃষ্ণা।
কৃষ্ণা হাসতে হাসতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
তারপর? সাবিত্রী কি বললে? কিরীটী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়।
আপনার ধারণাই ঠিক দাদা।
সুদর্শন বলতে শুরু করে সাবিত্রীর মুখ থেকে শোনা কাহিনী।