রাজাবাহাদুর ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই দেওয়ালের গায়ে চোরা দ্বারটি অদৃশ্য হয়ে গেল। নিরেট পাথরের দেওয়াল, কোথাও দ্বারের কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
রাজাবাহাদুর এগিয়ে এসে একটি আরাম-কেদারা অধিকার করে বললেন, আমি ভেবেছিলাম, এ গোপন দ্বারপথের রহস্য রাত্রে আপনার কাছে ভেদ করব। তা যাকগে, সকলের সামনে দিয়ে এ বাড়ির চিরন্তন নীতি ভঙ্গ করে আপনাকে অন্দরমহলে নিয়ে যেতে পারব না। তাই ঠিক করে রেখেছিলাম, এই দ্বারপথ দিয়ে অন্দরমহলে আপনাকে নিয়ে যাব রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে। বিশ্রামের কোন ব্যাঘাত হয়নি তো?
না। কিরীটী মৃদুস্বরে জবাব দিল।
দু-চারটে কথাবাতাঁর পর রাজাবাহাদুর গোপন দ্বারপথেই আবার বিদায় নিলেন।
রহস্যের খাসমহলাই বটে এ রাজবাটী। গতরাত্রে ট্রেনে সহযাত্রী ব্যারিস্টার মিঃ সান্যালের কথা কিরীটীর মনে উদিত হল।
***
গভীর রাত্রি। একটু আগে রাজবাড়ির পেটা ঘড়িতে রাত্রি একটা ঘোষণা করেছে। কিরীটী একাকী শয্যায় জেগে বসে আছে রাজাবাহাদুরের অপেক্ষায়। তিনি বলেছিলেন রাত্রি এগারটার পর আসবেন। কিন্তু এখনও তার দেখা নেই। কিরীটী চিন্তিত হয়ে ওঠে।
হঠাৎ এমন সময় সেই অস্পষ্ট খসখস শব্দ। ঘরের মধ্যে সুদৃশ্য বাতিদানে তেলের বাতি জুলছে। সমগ্র ঘরখানি তারই আলোয় আলোকিত।
সেই গুপ্ত দ্বার আবার ফুটে ওঠে চোখের সামনে এবং একটু পরেই সেই দ্বারপথে রাজাবাহাদুরকে দেখা গেল, হাতে তার শক্তিশালী পাঁচ সেলের টর্চ।
দেরি হয়ে গেল। এইবারে সব ঘুমিয়েছে, আপনাকে এবারে অন্দরমহলে নিয়ে যাব। বাড়িতে উৎসব আসন্ন। আর মাত্ৰ সাতদিন বাদেই সোনার গোপাল প্রতিষ্ঠিত হবে, আত্মীয়স্বজন ও বাড়ির প্রত্যেকেই জানে। মাত্ৰ সাতটা দিন। আপনার হাতে সময় মিঃ রায়, যা কিছু করবার এই সময়ের মধ্যেই আপনাকে করতে হবে। মূর্তি প্রতিষ্ঠার যে এতবড় বিঘ্ন উপস্থিত হয়েছে এখনও পর্যন্ত কেউ তা জানে না, কাউকে জানতে দিইনি। রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরা যেন কি এক অদ্ভুত উত্তেজনায় কাঁপিতে থাকে। সহসা এগিয়ে এসে কিরীটীর ডান হাতখানি আগ্রহের সঙ্গে চেপে ধরে ব্যাকুল উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলেন, বলুন মিঃ রায়, পারবেন তো আমার সিংহাসনটি উদ্ধার করে দিতে?
কিরীটী অবাক হয়ে রাজাবাহাদুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, এ যে স্টেশনে সকালের পরিচিত সে রাজা ত্ৰিদীপনাথ নয়; সেই দুৰ্জয় সকল্প ও মনোবল, কিছুই যেন অবশিষ্ট নেই, ছোট একটি ভীরু শিশু!
চলুন রাজাবাহাদুর, আপনাদের শয়নকক্ষটা একবার দেখব।
আসুন।
সাঙ্কেতিক গোপন দরজা-পথে দুজনে—আগে রাজা ত্ৰিদীপনাথ, পশ্চাতে কিরীটী একটা অপ্রশস্ত অলিন্দে এসে প্রবেশ করল। অনেক দিনের বদ্ধ বায়ুতে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অলিন্দপথে অনেকটা চলাবার পর সামনেই সিঁড়ি অতিক্রম করে আবার দুজনে এসে একটা বন্ধ দেওয়ালের সামনে দাঁড়াল। সেই দেওয়াল সরে গিয়ে দ্বারপথ প্রকাশিত হল এবং সেই দ্বারপথ দিয়ে দুজনে এসে যে প্রশস্ত সুসজ্জিত কক্ষে প্রবেশ করল, সেটাই রাজা ত্ৰিদীপনাথের শয়নকক্ষ।
রৌপ্যনির্মিত সুদৃশ্য বাতিদানে মোমবাতি জ্বলছে। প্রকাণ্ড পালঙ্কে নিৰ্ভাজ শয্যা বিছানো।
আমার স্ত্রী এখানে নেই। তিনি দিন দশেক হল তার ভাইয়ের সঙ্গে বাপের বাড়ি গেছেন, দিন তিনেকের মধ্যেই ফিরে আসবার কথা। উৎসবের বাড়ি, কিন্তু হঠাৎ তার মাষ্ট্রর শরীর অসুস্থ হওয়ায় তাকে যেতে হয়েছে।–
কিরীটি ঘরের চতুষ্পার্শ্বে তীক্ষ চোখে তাকাচ্ছিল।
পালঙ্ক থেকে হাত পাঁচেক দূরে দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো মস্ত একটি আয়রন সেফ।
ঐ আয়রন সেফেই বুঝি আপনার সিংহাসনটি ছিল?
হ্যাঁ।
সিন্দূকটা একবার দেখতে পারি কি? নিশ্চয়, রাজাবাহাদুর এগিয়ে গিয়ে কটিদেশ থেকে একটা চাবির গোছা বের করে সিন্দুকের গা-ডালায় একটা চাবি লাগালেন।
কোন শব্দমাত্র হল না, নিঃশব্দে সিন্দুকটি খুলে গেল।
কিরীটী মৃদুস্বরে বললে, আশ্চর্য তো।
কি আশ্চর্য মিঃ রায়?
কিছু না, ঐ সিন্দুকটা।
হ্যাঁ, মূল্যবান জার্মান সিন্দুক ওটি, আমার প্রপিতামহেরও আগেকার।
সিন্দুকে পর পর তিনটি সেলফ। ছোট বড় অনেক প্রকার কৌটো ও কাগজপত্রের বাণ্ডিল সেই তিনটি সেলফে সাজানো।
কোথায় ছিল সিংহাসনটি?
ঐ যে দেখছেন সুন্দর ঝাপিটি, ওর মধ্যেই ছিল।
সিংহাসনটি কত বড় ছিল?
তা ছ’ ইঞ্চি খাড়ায় হবে বৈকি। এক-একটা পুতুলই তো প্রায় আড়াই ইঞ্চি করে হবে।
কিরীটি রাজাবাহাদুরের হাত থেকে টৰ্চটা নিয়ে, তার আলোয় আয়রন সেফটি ভাল করে পরীক্ষা করতে লাগল।
সিংহাসনটি চুরি যাওয়ার পর আপনি সিন্দুকের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করেন নি তো?
না, কেবলমাত্র ঝাঁপিটা একবার সিন্দুক থেকে বাইরে বের করেছিলাম।
কিরীটী সিন্দুকটার ভিতর থেকে ঝাঁপিটা বাইরে এনে, সেটাকে ভাল করে দেখতে লাগল। ঝাঁপিটার গঠনকৌশল সত্যই অপূর্ব। সাধারণ বেতের তৈরী নয়, সূক্ষ্ম রুপোর তারে তৈরী। যথেষ্ট মজবুত। ঝাঁপির ভিতরে অনেক কিছু এক সঙ্গে রাখা যেতে পারে।
ঝাঁপিটি আমি দিনের আলোয় একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে চাই। এটা আমি নীচে আমার ঘরে নিয়ে যাব, আপনার কোন আপত্তি নেই তো রাজাবাহাদুর?
না, আপত্তি কি! নিয়ে যান।
এবার কিরীটী ঘরটা ভাল করে দেখতে লাগল।
বেশ প্রকাণ্ড ঘর। মেঝে সুদৃশ্য চৌকো মার্বেল পাথরে গাঁথা, গুপ্তদ্বারটি ভিন্ন প্রকোষ্ঠে প্রবেশের একটি মাত্রই দ্বার। তা ছাড়া ঘরে চারটি জানলা। দুটি অন্দরের দিকে, অন্য দুটি পূর্বে ও দক্ষিণে।