এখনও বাড়ির কেউই জানে না বলতে গেলে; কারণ এ সংবাদটা আমি সকলের কাছেই গোপন রেখেছি; এমন কি আমার স্ত্রী পর্যন্ত জানেন না এবং একটি ইংরাজী দৈনিক ছাড়া অন্য কোথাও আমি বিজ্ঞাপন দিইনি। ইংরাজী দৈনিকে ইংরাজীতে বিজ্ঞাপন দেওয়ারও দুটো কারণ আমার আছে। এক কারণ, চোরকে আমি জানিয়ে দিতে চাই যে ব্যাপারটা আমি টের পেয়েও বিচলিত হইনি এবং ফিরে পাবার আশা রাখি। দ্বিতীয় কারণ, ব্যাপারটা বাড়িতে ঢাকঢোল না পিটিয়ে যথাসাধ্য গোপন করে অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়েছি।
আশ্চর্য! আচ্ছা আপনার কাউকে কি সন্দেহ হয়। এই চুরির ব্যাপারে?
কাউকে বলতে আপনি ঠিক কি mean করছেন?
মানে বাড়ির মধ্যে কোন বিশেষ লোককে বা বাইরে জানাশোনার মধ্যে কাউকে।
বাড়ির মধ্যে কাউকেই আমি সন্দেহ করতে পারছি না; কারণ আয়রন সেফটা আমার নিজের শয়নকক্ষে ছিল। তা ছাড়া তার চাবি সর্বদাই আমার নিজের শয়নকক্ষের ড্রয়ারে থাকে।
আপনার শয়নকক্ষ তো পুরাকালে নবাবী আমলের বেগমদের মহল নয় যে কারও পক্ষেই সেখানে প্রবেশ দুঃসাধ্য।
তা নয় বটে, তবে সে কক্ষে দু-চারজন ছাড়া অপরের যাওয়া নিষেধ আছে।
যেমন?
আমার স্ত্রী, আমার বৃদ্ধা মা ও বাড়ির বহুদিনের পুরাতন ভৃত্য ভজু। এরা ছাড়া সে ঘরে কেউই আর বড় একটা ঢোকে না বলেই আমি জানি! তবে যদি বলেন এ কাজ আমার স্ত্রী বা বিশ্বাসী বৃদ্ধ ভূত্য ভজুর তা হলে আমি নাচার।
কিরীটী হো হো করে হেসে ওঠে।
হাসছেন যে?
কতদিন আপনি বিয়ে করেছেন?
বছর সাতেক।
আপনার সন্তান?
এখনও পর্যন্ত হয়নি।
আপনার স্ত্রী? মাপ করবেন, অবশ্য যদি কিছু না মনে করেন।
না, না, অসঙ্কোচে আপনি যা জানতে চান বলুন! রাজবাড়ির অন্দরমহলে আপনাকে আমি নিয়ে চলেছি। রাজবাড়ির রীতিবিরুদ্ধ কাজ। আজ পর্যন্ত খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়া রাজঅন্তঃপুরে বড় একটা কেউই প্রবেশ করতে পারেনি। অথচ পাল রাজত্বের সময় থেকে ইতিহাসবিখ্যাত বলে অনেকবার অনেক পর্যটক রাজবাড়ির অন্দরমহল দেখবার জন্য অনেক ইচ্ছা ও অনুরোধ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু নিয়ম নেই বলে কাউকেই আজ পর্যন্ত সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। বলতে গেলে আপনিই সর্বপ্রথম সেখানে প্রবেশ করতে চলেছেন, এক্ষেত্রেই..
বলছিলাম আপনি কি রকম ঘরে বিয়ে করেছেন?
এককালে তারা যথেষ্টই ধনী ছিলেন, কিছুদিন হল অবস্থার একটু হেরফের হয়েছে, তবে পুরাতন বনেদী বংশ।
সহসা কিরীটীর বিস্মিত দৃষ্টির সামনে রাজবাড়ি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। রাজবাড়িই বটে।
আরও বিস্মিত হল সে, যখন গাড়ি এসে রাজবাড়ির ফটকের মধ্যে ঢুকল। বন্ধুকধারী নেপালী দারোয়ান কুর্নিশ করে লাহার বিরাট গেট খুলে দিল। পাথরের নুড়িঢালা চওড়া পথ।
বর্হিমহলে এসে টমটম দাঁড়াতেই বৃদ্ধ নায়ব থাকহরিবাবু নত হয়ে নমস্কার জানিয়ে অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে এলেন। সহিস এসে ঘোড়ার রাশ ধরল। রাজাবাহাদুরের সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীও টমটম থেকে নেমে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল।
কিরীটী বিস্মিত মুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল রাজবাড়ির ইতিহাসপ্রসিদ্ধ কারুকার্য দেখে। বড় বড় পাথরের খিলান, মোটা মোটা থাম। একদা যে এখানে ঐশ্চর্য ও গরিমার প্রাচুর্য ছিল, এখনও যে তার অনেকখানিই অবশিষ্ট আছে তা প্রথম দৃষ্টিতেই বোঝা যায়।
ত্ৰিদীপনাথ শৌখিন ও আধুনিক কেতা-দূরস্ত লোক। পুরাতনের সঙ্গে বহু জায়গায় আধুনিকের অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন!
আসুন মিঃ রায়। রাজাবাহাদুর বলেন কিরীটীকে! সেই আহ্বানে কিরীটী এগিয়ে চলে।
বহির্মহলের অনেকগুলো ঘর পেরিয়ে দুজনে এসে একটা নাতিপ্রশস্ত ঘরে প্রবেশ করেন। আসবাবের বিশেষ কোন বাহুল্য নেই। তবু যা সামান্য আসবাবপত্র আছে, সে সব মূল্যবান। সুন্দর একটি মেহগনি পালঙ্কের ওপরে শুভ্ৰ শয্যা বিছানো, মাথার ধারে শ্বেতপাথরের একটি গোল টেবিল, সাদা পাথরের গ্লাসে বোধ হয় পানীয় জল ঢাকা দেওয়া আছে। পুরনো আমলের দুটি আরামকেদারা। একটি আলমারি বই ভর্তি। জামা কাপড় রাখবার জন্য একটি আলনা। এ ঘরটাই আপনার জন্য ঠিক করে রেখেছি, কোন কষ্ট হবে না তো?
বরং বলুন এত বেশী প্রাচুর্য যে অসুবিধাই ভোগ করতে হবে প্রাচুর্যে।
রাজাবাহাদুর হাসলেন প্রত্যুত্তরে।
আপনি বিশ্রাম করুন, আহারাদির পর আবার সাক্ষাৎ হবে।
রাজাবাহাদুর নমস্কার জানিয়ে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
০২. দ্বিপ্রহরের দিকে
দ্বিপ্রহরের দিকে বোধ হয় কিরীটীর কেমন একটু তন্দ্ৰা মত এসেছিল। একটা অস্পষ্ট খসখস শব্দে তার তন্দ্ৰা টুটে গেল।
খোলা জানলাপথে বৈকালী রৌদ্রের নিস্তেজ আলো ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে।
দরজাটা সে শয়নের পূর্বেই ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল।
ঘুমের ঘোর তখনও চোখের পাতা থেকে ভাল করে মুছে যায়নি।
একটা অস্পষ্ট আওয়াজ ও শুনেছিল, ঘরের ভিতর চারদিকে ও একবার ভাল করে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল, কিন্তু কোথাও কিছু নেই।
কিন্তু ও কি, বইয়ের আলমারিটার পাশে? ভাল করে কিরীটী চোখের পাতা দুটো একবার রগড়ে নিল। দেওয়ালের একটা অংশ ভিতরের দিকে সরে যাচ্ছে না! হ্যাঁ, তাই তো…
বিস্ময়ে যেন ও স্তব্ধ হয়ে গেছে। একদৃষ্টে দেওয়ালের দিকে ও তাকিয়ে থাকে।
আরো ভিতরে—হ্যাঁ, ক্রমে দেওয়ালের একটা চৌকো অংশ ভিতরের দিকে ঢুকে বেশ প্রশস্ত দ্বারপথ প্রকাশ পেল।
আশ্চর্য! এসব কি ভোজবাজি? না, ও জেগে জেগেই দিনের বেলা স্বপ্ন দেখছে? না, স্বপ্ন যে নয়, পরমুহুর্তেই তা প্রকাশ পেল। ঘরে প্রবেশ করলেন রাজাবাহাদুর। কিরীটীর বিস্ফোরিত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রাজাবাহাদুর হেসে বললেন, ও কি, আপনি জেগে নাকি? আমার ঘরের অদৃশ্য দ্বারপথ দিয়ে যে একটু আগে আমি দেখলাম। আপনি গভীর নিদ্রায় মগ্ন!