শেষরাত্রের দিকে কিরীটীর চোখে কেমন একটু তন্দ্রার মত এসেছিল! ঘুম যখন ভাঙলি, চলমান গাড়ির কাচের শার্সির ফাঁকে প্রথম ভোরের ধূসর আলো ওর চোখে পড়ে। চেয়ে দেখল। সহযাত্রী মিঃ সান্যাল গাড়িতে নেই, বোধ হয় নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে গেছেন।
কিরীটী কঁচের শাসিটা নামিয়ে দিল; বিরবির প্রভাতী হাওয়া এসে রাত্রি-জাগরণ ক্লান্ত চোখেমুখে সুস্নিগ্ধ শীতল পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায়।
নির্দিষ্ট সময়ের আধা ঘণ্টারও বেশি পরে গাড়ি শ্ৰীনগরের রেলওয়ে স্টেশনে এসে থামল।
স্টেশনটি ছোট্ট অখ্যাতনামা, ততোধিক অখ্যাতনামা স্টেশনের নামটি। আগে এখানে মেল ট্রেন থামত না। স্টেশন থেকে শ্ৰীনগর প্রায় মাইল আষ্টেক দূরের পথ।
স্টেশন থেকে রাজবংশেরই তৈরী প্রশস্ত কাঁচা সড়ক বরাবর শ্ৰীনগর পর্যন্ত চলে গেছে। মাত্র মাস আষ্টেক হল বর্তমান রাজা ত্ৰিদীপনাথের অনেক চেষ্টার ফলে আজকাল মেল ট্রেনটা এই স্টেশনে থামছে—তাও মাত্র আধ মিনিটের জন্য। আগে আগে রাজবাড়ির লোকেরা বড় জংশন স্টেশনটিতে নেমে সেখান থেকে ব্ৰহ্মপুত্র নদের একটা ছোট শাখানদী বেয়ে ভাউলিয়া করে শ্ৰীনগর যেত, তাতে বর্ষাকাল ও তার পরবর্তী কয়েক মাস নদীপথে যাতায়াত করা চলত। শীতকালে নদীর জল এত বেশি শুকিয়ে যেত যে, নদীপথে কোন বড় বা মাঝারি নৌকেই যাতায়াত করত না। তাই শীতকালটা পরের ছোট স্টেশনে নেমে, হাঁটাপথে গোরুর গাড়িতে চেপে শ্ৰীনগরে যাওয়া ভিন্ন আর অন্য উপায় থাকত না।
উঁচু বাঁধানো প্লাটফরমের ওপরে একতলা ছোট একটি বাড়ি-স্টেশন-ঘর ও গুদাম অফিস।
***
স্টেশন-ইনচার্জ রামসদায়বাবু। প্রায় চল্লিশের উৰ্ব্বে বয়স। মাথায় বাঁকড়া ঝাকড়া চুল। ইতিমধ্যে অর্ধেকের বেশী চুলে বয়সের নোটিশ জারি হয়েছে। চোখে পুরু লেন্সের নিকেল ফ্রেমের চশমা। কিরীটী গাড়ি থেকে নেমে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করতে থাকে।
কে একজন এই দিকেই এগিয়ে আসছে। বয়স ত্রিশ-পয়ত্ৰিশের বেশী নয়। রোগী লম্বাটে গড়ন। অত্যন্ত সুশ্ৰী চেহারা। দীর্ঘ উন্নত নাসা। একজোড়া চোখে বুদ্ধির প্রখর দীপ্তি। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। পরিধানে সাদা ধুতি ও সাদা ভায়লার গরম পাঞ্জাবি, তার ওপরে সাদা শাল জড়ানো! পায়ে সাদা নাগরাই। সঙ্গে সঙ্গে স্টেশনমাস্টার রামসদায়বাবুও এগিয়ে আসেন, টিকেট?
কিরীটী টিকেটটা পকেট থেকে বের করে দেয়।
কোথায় যাবেন? রামসদয় আবার প্রশ্ন করেন।
রাজবাড়ি।
আপনি কি মিঃ রায়? সুশ্ৰী যুবকটি প্রশ্ন করেন?
হ্যাঁ। আপনি?
আজ্ঞে, ইনি আমাদের রাজাবাহাদুর, রামসদয়বাবু বলে ওঠেন, মহাশয় ব্যক্তি প্রাতঃস্মরণীয়।
ওঃ! কিরীটী হাত তুলে নমস্কার জানায়।
প্রতিনমস্কার জানিয়ে ত্ৰিদীপনাথ সাদর আহ্বান জানান, বাইরে টমটম দাঁড়িয়ে আছে।
দুজনে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ান। অপ্রশস্ত কঁচামাটির সড়ক। ছোট একটি টমটম, গাড়ি। একটা তেজী সাদা ঘোড়া। কোন সহিস বা কোচম্যান নেই।
উঠুন।
কিরীটী গাড়ির পদানিতে পা দিয়ে উঠে বসে! দুলকি চালে ঘোড়াটা ছুটে চলে। দু পাশের ক্ষেতে সরিষার অজস্র হলুদ ফুল, ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় যেন খুশির ঢেউ জাগিয়েছে। চারিদিকে একটা শুচিস্নিগ্ধ আবহাওয়া।
কিরীটী বেশ একটু আশ্চর্যই হয়েছিল, রাজাবাহাদুর নিজেই তাকে নিতে এসেছেন। এতটা সে আশা করেনি। বিশেষ করে তার মত একজন সামান্য অপরিচিত ব্যক্তি!
রাজাবাহাদুরই প্রথমে কথা বললেন, মিঃ রায়, আপনার চিঠি পড়ে আমি যতটা না আশান্বিত হয়েছিলাম, তার চাইতে বেশী আনন্দিত হয়েছি আপনাকে দেখে এবং আশা করছি পরিচয় হলে আরো সুখী হব।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, হতাশও তো হতে পারেন!
বোধ হয় না, কারণ মানুষ চেনবার একটা অসাধারণ ‘ন্যাক’ আমার আছে। রাজাবাহাদুরের ওষ্ঠ্যপ্রান্তে হাসির রেখা দেখা দেয়।
আপনি বোধ হয় একটু আশ্চর্যই হচ্ছেন, রাজাবাহাদুর বলতে লাগলেন, এভাবে একা আমার শুমাপনাকে এগিয়ে অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে; কিন্তু শ্ৰীনগরের রাজবাড়ির এইটাই চিরন্তন নীতি। অতিথি নারায়ণ, তাকে স্বয়ং গিয়ে অভ্যর্থনা না জানালে অতিথির প্রতি অসম্মান দেখানো হয়, তা ছাড়া…
রাজাবাহাদুর থামলেন। কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে রাজাবাহাদুরের মুখের দিকে তাকায়।
তা ছাড়া আপনার চিঠি পড়ে আমি এতখানি বিস্মিত হয়েছিলাম যে আপনাকে চোখে দেখবার একটা দুৰ্দমনীয় লিন্সা মনে আমার জেগেছিল। এই দেখুন আমি সঙ্গে করে টাকা ঃ এনেছিলাম। রাজাবাহাদুর ডান হাতে ঘোড়ার লাগমটা ধরে বা হাত দিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে গোটা পাঁচেক নোট বের করে দেখালেন। তার পর বললেন, আপনার কথাবার্তা ও চেহারায় আমাকে না। যদি ইমপ্রেস করতে পারতেন, তবে স্টেশন থেকেই ধূলোপায়ে আপনাকে বিদায় করে ফিরে আসতাম।
কিরীটী আবার একটু হ্যাঁসলে, কোন জবাবই দিলে না বা একটি প্রশ্নও করলে না।
আপনাকে তো বলেছিই, আপনাকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমার আশা হচ্ছে এখন, আপনি হয়তো আমার হারানো সম্পত্তির একটা কিনারা করলেও করতে পারবেন। সরকারী বে-সরকারী অনেক গোয়েন্দার কাছ থেকেই আমি চিঠি পেয়েছি। সকলের চিঠির মধ্যেই যেন ফুটে উঠেছে একটা জঘন্য লালসার ছবি পাঁচ হাজার টাকার প্রতি।
এতক্ষণ পরে প্রথম কিরীটী সহসা একটা প্রশ্ন করল, রাজাসাহেব, আপনার বহুমূল্য রত্নসিংহাসনটি যে অপহৃত হয়েছে, এ সংবাদ কে কে জানে?