টাইম-টেবিলে কিরীটী দেখেছিল, শ্ৰীনগরের আগের স্টেশনটি একটি বড় জংশন স্টেশন। একটি নামকরা ডিস্ট্রিক টাউন।
কোন মকদ্দমার ব্যাপারে বোধ হয়?
হ্যাঁ। তা না হলে আর কেন বলুন? ভদ্রলোক পাইপটা দাঁতে চেপে মৃদু একটু হাসলেন।
ট্রেন দমদম জংশনে এসে থামল।
যাত্রীদের গোলমাল, ওঠামানা। ঘণ্টা বাজল, ট্রেন আবার চলতে শুরু করল।
সান্যাল আবার প্রশ্ন করেন, হঠাৎ শ্ৰীনগরে চলেছেন যে?
এমনিই বেড়াতে যাচ্ছি। দেশ ভ্ৰমণ করাটা আমার একটা নেশা। শুনেছি জায়গাটা নাকি বেশ। পুরনো দিনের অনেক কিছু স্মৃতিচিহ্ন নাকি এখনও সেখানে অবশিষ্ট আছে।
হ্যাঁ, আমিও দু-একবার সেখানে গেছি। শ্ৰীনগরের রাজবাড়িই তো ইতিহাস প্রসিদ্ধ জিনিস একটা। পাল রাজত্বের সময়কার তৈরী সে প্রাসাদ। শুনেছি, সে নাকি এক রহস্যের খাসমহল।
আপনি দেখেছেন সে প্রাসাদ?
বাইরে থেকে যতটা সম্ভব, মানে বহিমহলটা সব ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম। একবার। প্রাসাদের অভ্যন্তরে তো রাজারা কাউকে প্রবেশ করতে দেন না। রাজাদের একটা গেস্ট হাউস আছে, রাজবাড়ি থেকে কিছু দূরে। সেখানে অনেকেই গিয়ে অনেক সময় থাকেন। তা ছাড়া পাল রাজাদের সময়ে কৈবর্ত সর্দার ভীমের উপদ্রবে। রাজার কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামপাল কিছুদিন নাকি ওখানে গিয়ে এক বাড়িতে ছিলেন, সেটাকে রামপালের দুর্গ বলে। হৃতসর্বস্ব রামপাল নাকি সেই বাড়িতে প্রায় দেড় বৎসর লুকিয়ে ছিলেন। ছোটখাটো একটা দুর্গের মত সে বাড়িটা। দুর্গের চারপাশে পরিখা, পরিখার চারপাশে প্রায় দেড় মানুষ সমান উঁচু পাথরের প্রাচীর।
রামপাল নিজেই নাকি সে দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন নিজের লোকজনদের দিয়ে এবং শোনা যায়, সেই দুর্গে বসেই তিনি সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন পরাক্রান্ত কৈবর্ত সর্দার ভীমের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবার জন্য।
কৈবর্ত সর্দার সে কথা জানতে পেরে একদল দুর্ধর্ষ সৈন্য প্রেরণ করে রামপালকে বিধ্বস্ত করবার জন্য। দীর্ঘ আটচল্লিশ ঘণ্টা সেই দুর্গের মধ্যে আত্মগোপন করে রামপাল ভীমের প্রেরিত সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ চালান। শেষটাই কিছুতেই যখন আর দুৰ্গ রক্ষা করা সম্ভব হল না, তখন গোপনে পালিয়ে যান বর্তমান শ্ৰীনগরে যে রাজপ্রাসাদ তারই মধ্যে। আকারে ও চাকচিক্যে তখনকার সে প্রাসাদ বর্তমানের থেকে অনেক ছোটই ছিল, এবং মালিক ছিলেন সৰ্বেশ্বর রায়, সামান্য বিত্তশালী একজন ঐ সময়কার জমিদার মাত্র।
রামপাল সৰ্বেশ্বরের গৃহে পনেরো দিন আত্মগোপন করে থাকেন। পরে সৰ্বেশ্বরের ঢালীরা রাতের অন্ধকারে পালকিতে করে রামপালকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে আসে।
কিরীটী তন্ময় হয়ে মিঃ সান্যালের বর্ণিত কাহিনী শুনছিল। রূপকথার চমকপ্রদ, রহস্যঘন রোমাঞ্চকর।
মিঃ সান্যাল একজন শক্তিশালী কথক বটে। ভাষা ও বলবার টেকনিকও তার অপূর্ব।
অন্ধকারের নির্জন প্রকৃতির বুকখানাকে শব্দমুখর করে মেল ট্রেনখানা একটানা ছুটে চলেছে। থামবে গিয়ে একেবারে সেই রাণাঘাট জংশনে।
মাঝে মাঝে ট্রেনের তীব্র গতিবেগের দু পাশে ছোট ছোট স্টেশনের আলোগুলো চমক দিয়ে যায়, মসীকৃষ্ণ রাতের বুকে হঠাৎ জেগেই মিলিয়ে যাওয়া বিদ্যুৎচমকের মত। রেল, লাইনের দু পাশে অন্ধকারে আবছা আগাছার ঝোপ-ঝাড়গুলো জোনাকির ফুলঝুরি জ্বলিয়ে যেন অভিসারে বের হয়েছে।
তারপর? কিরীটী প্রশ্ন করে।
তারপর ঐ ঘটনার অনেক দিন পরে রামপাল যখন হৃতরাজ্য পুনরায় ফিরে পেলেন, সৰ্বেশ্বরের কাজের জন্য তাকে ইনাম দিলেন রাজা উপাধি ও অনেক নিষ্কর জমিজমা। সৰ্বেশ্বর তখন রামপালের সনদের জোরে রাজা উপাধি নিয়ে ঐ জায়গার নাম বদল করে শ্ৰীনগর’ নতুন নামকরণ করলেন। সর্বেশ্বরের ভাগ্যলক্ষ্মী তখন সুপ্ৰসন্ন, দিনে দিনে দেবতার আশীর্বাদে তার যশ, মান, প্রতিপ্রাত্তি ও অর্থ বাড়তে লাগল। বর্তমানের প্রকাণ্ড রাজপ্রাসাদ তৈরী হল অতীতের ক্ষুদ্র জমিদার ভবনের ভিতের উপরে। বর্তমান শ্ৰীনগর ও সেই সঙ্গে শ্ৰীনগরের রাজাদের উৎপত্তির এই হল মোটামুটি ইতিহাস।
গল্প বলতে বলতে পাইপটা নিভে গিয়েছিল। মিঃ সান্যাল পাইপটায় আবার অগ্নিসংযোগ করে একটা টান দিয়ে পীতাভ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, প্রায় বছর পাঁচেক আগে একবার শ্ৰীনগরে বেড়াতে গিয়ে ওখানকার এক বৃদ্ধের মুখে শ্ৰীনগরের এই ইতিহাস আমি শুনি।
উপন্যাসের মতই চমকপ্রদ এ কাহিনী। অতীত বাংলার যে কত শত কাহিনী আজও এমনি করে সুপ্ত রয়ে গেছে, কেই বা তার খোঁজ রাখে। পরদেশী ভাষায় পরের দেশের ইতিহাস মুখস্থ করে আমরা ডিগ্রীর নম্বর বজায় রাখি এবং সেই ডিগ্রীই হয় আমাদের শিক্ষার শীল-মোহর। অথচ ঘরের খবর আমরা রাখি না—কিরীটী মৃদুস্বরে খেদোক্তি করলে।
সত্যি যা বলেছেন! বাংলার ইতিহাসকারেরা যেন চোখ বুজেই ইতিহাস রচনা করেছেন।
নানা ধরনের কথাবাতাঁর মধ্য দিয়ে দুজনের ভিতর ক্রমশঃ বেশ গভীর আলাপ জমে ওঠে। কিরীটিার বেশ লাগে ক্ষণপরিচিত মিঃ সান্যালকে।
মিঃ সান্যালের ব্যারিষ্টারি ব্যবসা হলেও তার বেশী ঝোক ইতিহাস পড়ায়। কাজকর্মের বাইরে যতটুকু সময় তিনি পান, নানা ধরনের ইতিহাস পড়েই তিনি কাটান বেশির ভাগ সময়। এ ছাড়াও তার আর একটি নেশা আছে, সেটা হচ্ছে। যন্ত্র-সঙ্গীতের সাধনা। কাজেই যেখানেই তিনি যান, একটি সুটকেস-ভর্তি বই ও বীণা যন্ত্রখানি তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ফেরে।