অদ্ভুত বিজ্ঞাপন।
পাঁচ হাজার টাকাটা কিরীটীর কাছে এমন কিছু একটা মূল্যবান সংবাদ নয়। কিন্তু তার মধ্যে যে রহস্যটি ঘনীভূত হয়ে আছে কিরীটী তাতেই চঞ্চল হয়ে ওঠে। পর্যাপ্ত সময়ের এমন চমৎকার সদ্ব্যবহার আর কিছুতেই হতে পারে না।
প্রিয় রাজা বাহাদুর,
…………তারিখের দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত আপনার বিজ্ঞাপনটি পড়লাম। আমার পরিচয় আপনি জানেন না। কারণ আমি সরকারী বা বেসরকারী গোয়েন্দা নাই, সাধারণ একজন ছাত্র মাত্র, বর্তমানে বেকার। হাতে কোন কাজকর্ম নেই। আপনি আপনার বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে যে রহস্যের অনুসন্ধান দিয়েছেন সেটা আমার রহস্যপ্রিয় মনকে একান্তভাবে আকর্ষণ করেছে। পারিশ্রমিকের কথা ছেড়ে দিন, অর্থের আমার অভাব নেই, তাই হয়তো লালসাও নেই। আমার একান্ত ইচ্ছা আপনার অপহৃত বত্রিশ সিংহাসনটির অনুসন্ধান একটিবার আমি করে দেখি। তবে আমার একটা শর্ত আছে ঃ আমি অনুসন্ধানভার গ্রহণ করলে কাউকেই আপনি সে কথা ঘৃণাক্ষরেও বলতে পারবেন না; বিশেষভাবে আমার ও আপনার মধ্যে গোপন থাকবে। আপনি যদি আমার প্রস্তাবে রাজী থাকেন, আমি নিজ ব্যয়ে গিয়ে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি। আর একটা কথা মানুষের পক্ষে যদি সম্ভব হয় তবে আপনার অপহৃত বত্ৰিশ সিংহাসনটি নিশ্চয়ই আমি উদ্ধার করে দিতে পারব। মনে করবেন না এটা আমার আত্মম্ভরিতা, এটা আমার সংস্কার বলতে পারেন, কারণ অনুসন্ধানের ব্যাপারটা আমি মনে করি সম্পূর্ণ অঙ্কশাস্ত্রের মতই একটা জটিল সমস্যা মাত্র। বুদ্ধি থাকলেই যে কোন কঠিন সমস্যার সমাধান করা যায়; অবিশ্যি সে সমস্যা যদি উদ্ভাবিত হয়ে থাকে। আমাদের মত কোন এক মানুষের দ্বারা। অধিক বলবার কিছু নেই, সাক্ষাতেই বিশদ আলোচনা হতে পারবে। নমস্কার জানবেন।
ভবদীয়—কিরীটী রায়
নাম ঠিকানা খামে লিখে তখুনি কিরীটী চিঠিখনি ডাকবাক্সে ফেলে দেওয়ার জন্য মেসের ভৃত্যকে ডেকে পাঠিয়ে দিল।
দিন তিনেক বাদেই অপ্রত্যাশিত ভাবে জবাব এল :
আপনার চিঠিখানা পেলাম। আপনি এলে আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিশ্চয়ই আনন্দ পাব আশা করছি, সাক্ষাতে সব কথাবার্তা হবে।
শিয়ালদহ থেকে রাত্রি আটটায় একটা ট্রেন ছাড়ে, সেটা এখানে পরের দিন সকালবেলা সাতটায় এসে পৌঁছয়। স্টেশন থেকে আমাদের বাড়ি ঘণ্টাখানেকের পথ। আগে সংবাদ পেলে টমটম পাঠাব। নমস্কার রইল।
নিবেদক—ত্ৰিদীপনাথ রায়
চিঠিখানি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তার মধ্যেই অপরিচিত ত্ৰিদীপনাথ রায়ের সুস্পষ্ট একটা ছবি যেন ফুটে উঠেছে। বার দুই আদ্যোপােন্ত পড়ে কিরীটীর মনে হয়—লোকটি স্বল্পভাষী। কোন কােজই বেশ চিন্তা না করে করেন না। পূর্বপুরুষের বত্রিশ সিংহাসনটি চুরি যাওয়ায় ভদ্রলোক নিশ্চয়ই বিশেষ রকম বিচলিত হয়ে উঠেছেন। এবং বিচলিত হয়েই ক্ষান্ত হননি, সেটি পুনরুদ্ধার করবার জন্যও দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন ও সংক্ষিপ্ত চিঠির মধ্যে দিয়ে সেটা যেন সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হচ্ছে কিরীটীর কাছে! আর দেরি করা নয়, শুভস্য শীঘ্রম।
কিরীটী জামাটা গায়ে দিয়ে শিয়ালদহের দিকে বেরিয়ে পড়ল। সেখানে খোঁজ করে পরের দিনের গাড়িতে একটা সেকেণ্ড ক্লাস বার্থ রিজার্ভ করে, কিরীটী ডাকঘরে গিয়ে ত্ৰিদীপনাথকে তার করে দিল।
শীত এখনও ভাল করে মোটেই পড়েনি, সামান্য একটু শীতের আমেজ দেখা দিয়েছে মাত্র। স্টেশনে এসে কিরীটী দেখল, ছোট একটা সেকেণ্ড ক্লাস কুপেতে লোয়ার বার্থ সে পেয়েছে। উপরের বার্থে যিনি যাচ্ছেন তাঁর নাম বিনায়ক সান্যাল, বার অ্যাট-ল। কিরীটী গাড়িতে উঠে হোন্ড-অলটা খুলে বার্থের ওপরে বিছানাটা বিছিয়ে নিল। সঙ্গে করে কয়েকটা রহস্যোপন্যাস এনেছে, রাত্রের খোরাক। রাত্রের ট্রেনে সে কোনদিনই ঘুমোতে পারে না। ট্রেনের ঝাকুনি ও চাকার শব্দে ঘুম আসে না।
কিরীটী ব্লিপিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে বালিশের ওপরে আড় হয়ে শুয়ে একটা বই খুলে বসল। ট্রেন ছাড়তে বোধ করি আর মিনিট দু-তিন দেরী আছে।
সাহেবী পোশাক পরা একজন নধরদেহ পুরুষ, হাতে একটা অ্যাটাচি কেস, বগলে প্রকাণ্ড একটা খাপে ভর্তি বীণা জাতীয় তারের বাদ্যযন্ত্র ও কুলীর মাথায় বেডিং ও একটা মাঝারি গোছের সুটকেশ চাপিয়ে কামরার মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
কিরীটী একবার বই থেকে চোখ তুলে আগন্তুকের দিকে তাকাল।
আগস্তুকের বয়স তিরিশের উর্ধের্ব। মাথার ঘন চুল ব্যাক-ব্রাশ করা। নাকটা ভোঁতা। ফ্রেঞ্চকটি দাড়ি, বাটারফ্লাই গোঁফ। চোখে রিমালেস চশমা। চশমার লেন্সের অন্তরালে গোল গোল চোখের তীক্ষ অনুসন্ধানী দৃষ্টি। পরিধানে নেভি ব্ল কালারের দামী সার্জের সুট। জিনিসপত্র গোছগাছ করে বিছানাটা বার্থে পেতে আগন্তুক কুলীকে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে, কিরীটীর বার্থের পাশে বসবার যে বেতের চেয়ারটা আছে, তাতে বসে পড়ে পকেট থেকে দামী টোবাকো পাইপ ও পাউচ বের করে ধূমপানের যোগাড় করতে লাগলেন। পাইপে টোবাকো ভরে লাইটার দিয়ে অগ্নিসংযোগ করে তীব্র এক টান দিয়ে একগাল পীতাভ ধোঁয়া ছেড়ে কিরীটীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।
ট্রেন ছাড়বার ঘণ্টা পড়ে গেছে; ট্রেন প্ল্যাটফরম ছেড়ে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে।
কতদূর যাবেন? ব্যারিস্টার সাহেব কিরীটীকে প্রশ্ন করলেন।
বেশী দূর নয়, শ্ৰীনগর। আপনি?
আমি শ্ৰীনগর না হলেও কাছাকাছি—শ্ৰীনগরের আগের স্টেশনে।