মৃদু হেসে রাজাবাহাদুর কিরীটীর সামনে এসে বসলেন, তাকালেন কিরীটীর চোখের দিতে।
ভালো করে আনন্যমনা হয়ে একদৃষ্টি তাকান। দেখতে পাবেন। শুধু ভাবুন আমার চোখ দুটি।-ভুলে যান জগৎ সংসার সব কিছু। ভুলে যান। আপনি কে, কোথায়, কেন? শুধু আমার চোখ-হ্যাঁ, আমার চোখ…
এক মিনিট, দু মিনিট করে মিনিট দশেক কেটে গেল। রাজাবাহাদুর ও কিরীটী পরস্পর চোখের দিকে তাকিয়ে। ঘরের সব কটি প্রাণী বাক্যাহারা।
সহসা কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। এ যেন সে কিরীটীর একটু আগে শোনা কণ্ঠস্বর নয়। বৰ্জগভীর নির্দেশ বের হয়ে আসে কিরীটীর কণ্ঠস্বরে, রাজাবাহাদুর।
মন্ত্ৰমুগ্ধ রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরে শোনা গেল, বলুন! যেন বহু বহু দূর হতে ভেসে আসছে।
আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
হ্যাঁ। ক্ষীণ উত্তর।
আপনাদের পূর্বপুরুষের বত্রিশ সিংহাসনটি চুরি গেছে না?
হ্যাঁ ঘরের একমাত্র জ্ঞানদাশঙ্কর চমকে উঠলেন, কিরীটীর ইঙ্গিতে চুপ করে রইলেন।
আপনি জানেন সেটা কোথায় আছে?
না তো।
নিশ্চয়ই জানেন। আজ থেকে ঠিক তেরো দিন আগে এমনি একটি রাত্রির কথা মনে করুন। মনে করে দেখুন। নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন। সে রাতের কথা মনে পড়ছে এখন?
হ্যাঁ, পড়ছে। সহসা এমন সময় অতর্কিতে দপ করে ঘরের মধ্যের একটিমাত্র মোমবাতি নিভে গিয়ে নিশ্চিদ্র আঁধারে সমগ্র ঘরখানি যেন দৃষ্টি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল! মালতী দেবী অর্ধস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন। আলো জ্বালাতেও বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল।
রাজাবাহাদুর তেমনি ভাবেই স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে আছেন, মাথাটা নীচের দিকে ঝুলে পড়েছে, চোখ দুটি অর্ধনিমীলিত, যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমুচ্ছেন।
অখণ্ড নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কিরাটাই আবার সর্বপ্রথম বললে রাজাবাহাদুরকে সম্বোধন করে, আপনিই রুপোর ঝাঁপিটা আপনার শয়নঘরের আয়রন সেফ থেকে সে রাত্রে বের করে নিয়ে আসেন, কেমন তাই না? বলুন, কোথায় রেখেছেন সেটা?
হ্যাঁ—কিন্তু আমার মনে পড়ছে না কোথায় রেখেছি সেটা! না, মনে পড়ছে না।
এরপর ধীরে ধীরে কিরীটী রাজাবাহাদুরের মোহনিদ্রা ভাঙিয়ে দিল। ঘরের সব কয়টি প্রাণীই নির্বাক। কারো মুখে কোন কথা নেই। যাদুমন্ত্ৰে যেন সকলেই বাক্যহীন হয়েছে।
০৪. ঘুম আসছে না
ঘুম আসছে না। মাথার মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে। দু পাশের শিরাগুলো দপদপ করছে। মোমবাতিটা পিটপিট করে জ্বলছে। খসখস একটা শব্দ।
কিরীটী সতর্ক হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, দেওয়ালের সেই গুপ্তদ্বার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই গুপ্তদ্বারপথে যার মূর্তি ভেসে উঠল, তাকে দেখে কিরীটী যেন ভূত দেখার মতই চমকে ওঠে।
মাথার ওপরে স্বল্প ঘোমটা, রাণীসাহেবা এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।
কিরীটী শয্যার ওপরে উঠে বসে বললে, আসুন রাণীসাহেবা।
কিরীটীবাবু!
বসুন রাণীসাহেবা। আপনি কেন এত রাত্রে এসেছেন তা আমি জানি।
আমাকে এ কলঙ্ক থেকে বাঁচান। কিরীটীবাবু! অসহ্য কান্নার দুর্দমনীয় বেগে রাণী যেন ভেঙে পড়লেন।
কিরীটি ঘরের মধ্যে ধীরভাবে পায়চারি করছিল, সহসা রাণীসাহেবার সামনে এসে দাঁড়াল, তারপর তীক্ষ্ণ অথচ চাপা কণ্ঠে বললে, আপনি যা বলছেন, তা কি সত্যি আপনার মনের কথা রাণীসাহেব? সত্যিই কি এই কলঙ্ক থেকে আপনি মুক্ত হতে চান?
হ্যাঁ।
কিন্তু দুদিন আগেও তো আপনার এ সদিচ্ছা ছিল না রাণীসাহেবা?
বিস্মিত দৃষ্টি তুলে রাণীসাহেবা কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
তার মানে?
তা হলে সে রাত্রে এমনি করে আপনি আমার কাছে সত্যকে গোপন করতেন না।
আপনি কি বলছেন কিরীটীবাবু!
রাণীসাহেবা! এখনও আপনার মনে কিন্তু আছে। আমার কাছে আগাগোড়াই আপনি নিজেকে গোপনতার আড়ালে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু বৃথা আপনার সে প্রয়াস। আপনি-আপনি বুঝতে পারছেন না। রাণীসাহেবা, কত বড় কলঙ্ক আপনার মাথার ওপরে ঝুলছে! দেবতুল্য আপনার স্বামী। আপনার প্রতি অশেষ শ্ৰদ্ধা ও ভালবাসা। একবার যখন সমস্ত কথা প্রকাশ পাবে, বুঝতে পারছেন কি, আপনার প্রতি তাঁর এই শ্রদ্ধা ধুলোয় লুটিয়ে পড়বে, আপনার সকল অহঙ্কার চুর্ণ হবে! সারাটা জীবন আপনাকে চোখের জলে ভাসতে হবে। এখনও ভেবে দেখুন রাণীসাহেবা, আমার কথা এখনও ভেবে দেখুন-এ কলঙ্ক হতে মুক্তি চান, না। সারা জীবন ধরে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান? সোনার সিংহাসনে আপনি আজ সমারাঢ়। মুহুর্তে আপনি ধুলোর ওপরে লুটিয়ে পড়বেন। শেষের দিকে কিরীটীর কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে।
রাণীসাহেবা দু হাতের মধ্যে মুখ গুজে ফুলে ফুলে কাঁদিতে লাগলেন।
কিরীটি রোরুদ্যমানা রাণীসাহেবার দিকে তাকিয়ে রইল নিশ্চল হয়ে।
অনেকক্ষণ কেঁদে রাণীসাহেবা কিছুটা শান্ত হলেন, অশুধৌত মুখখানি তুলে বললেন, বলুন, আমাকে কি করতে হবে কিরীটীবাবু? আমি প্রস্তুত।
আমার ওপরে যদি বিশ্বাস রাখেন, তবে সব কথা আমায় খুলে বলতে হবে।
জিজ্ঞাসা করুন।
সে রাত্রে, মানে যেদিন আপনার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেদিন দ্বিপ্রহরে আপনার স্বামীকে মেসমেরাইজড করা হয়েছিল, কেমন, সত্যি কিনা?
হ্যাঁ।
কিন্তু মোসমেরাইজ তাঁর সেদিন ভাঙানো হয়নি।
না, না, তাকে আবার ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল।
না, আপনি জানেন না, তা হয়নি। মোসমেরাইজের ঝোকেই আপনার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার সেই অবস্থাতেই আপনারা তাকে নিয়ে গিয়ে শয্যায় শুইয়ে দেন। বুঝতে পারছেন কি, কত বড় নিষ্ঠুরতা আপনার স্বামীর প্রতি সেদিন করা হয়েছিল! আপনার জেগে থাকা অবস্থাতেই আপনার স্বামী আপনার চোখের সামনে আয়রন সেফ খুলে ঝাপিসমেত সিংহাসনটি বের করে নিয়ে গুপ্তদ্বারপথে নীচে চলে যান, তাই না?