- বইয়ের নামঃ বত্রিশ সিংহাসন
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. গল্পের সেই রাজা বিক্ৰমাদিত্য
কথিত আছে, গল্পের সেই রাজা বিক্ৰমাদিত্যের নাকি মণিমাণিক্যখচিত একটি বহু মূল্যবান রত্ন-সিংহাসন ছিল, এবং সেই সিংহাসনটির নির্মাণ-কৌশলও ছিল অদ্ভুত। বত্রিশটি পুতুল চারদিক থেকে সিংহাসনটিকে বেষ্টন করে থাকত।
মহারাজ বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর বহুকাল পরে, ভোজরাজ মৃত্তিকাতল থেকে সেই সিংহাসনটি উদ্ধার করেন। কিন্তু ভােজরাজ বিক্ৰমাদিত্যের সমগুণসম্পন্ন ছিলেন না বলে তাঁর আর সে সিংহাসনে বসা হল না কোন দিনই।
সিংহাসনটি উদ্ধার করবার পর প্রথম যেদিন ভোজরাজ সিংহাসনের ওপরে উপবেশন করতে গেলেন সিংহাসনের প্রথম পুতুলটি তাকে নিষেধ করল; বললে, মহারাজ! এই সিংহাসনে উপবেশনের পূর্বে আমার কিছু বলবার আছে, শ্রবণ করুন।
পুতুলটি বিক্রমাদিত্যের অশেষ গুণরাশির একটি কাহিনী বললে, এবং গল্পটি শেষ হলে বললে, মহারাজ, আপনাকে বিক্রমাদিত্যের সম্পর্কে যে গল্পটি বললাম, আপনার যদি সেরকম কোন গুণ থাকে। তবে সিংহাসনে উপবেশন করুন।
সেদিন আর ভোজরাজের সে সিংহাসনে উপবেশন করা হল না।
পরের দিনও অনুরূপভাবে দ্বিতীয় পুতুলটি ভোজরাজকে সিংহাসনে উপবেশনে বাধা দিয়ে আর একটা গল্প শোনাল বিক্ৰমাদিত্য সম্পর্কে।
এইভাবে বত্ৰিশটা পুতুল একের পর এক—দিনের পর দিন সিংহাসনে বসতে ভোজরাজকে বাধা দিতে লাগল এবং ফলে ভোজরাজের আর কোনদিনও সেই সিংহাসনে বসাই হল না।
গল্পের ভোজরাজের মত শ্ৰীনগর রাজবাড়ির গৃহদেবতাদেরও তাঁরই জন্যই প্রস্তুত সুবর্ণনির্মিত কারুকার্যমণ্ডিত পান্নাচুনিহীরাখচিত বত্রিশ সিংহাসনটিতে বসাই হল না কোনদিন।
শ্ৰীনগর কোথায়, ভারতবর্ষের কোন জায়গায়—পূর্বে, পশ্চিমে, দক্ষিণে না উত্তরে সেটা আমাদের বর্তমান কাহিনীর প্রতিপাদ্য বিষয় নয়।
ধরে নেওয়া যাক বাংলাদেশেরই আশেপাশে কোথাও সেই শ্ৰীনগর, কলকাতা থেকে মাত্র একদিনের পথ।
পূর্ব কাহিনী যার সঙ্গে আমাদের বর্তমান কাহিনীর যোগসূত্র আছে, তা এই? শ্ৰীনগরের বর্তমান তরুণ রাজা ত্ৰিদীপনাথ রায়ের পুরুষানুক্রমে পাওয়া সম্পত্তির মধ্যে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান যে সম্পত্তিটি ছিল সেটি হচ্ছে ছোট একটি স্বর্ণ-নির্মিত রত্নখচিত সিংহাসন। সিংহাসনটিকে বত্রিশটি স্বর্ণনির্মিত পুতুল তাদের চৌষট্টি হাতে ধারণ করে আছে।
প্রায় সাত-আট পুরুষ আগে রাজবংশের সর্বেশ্বর রায় ঐ সিংহাসনটি নির্মাণ করে সোনার গোপাল প্রতিষ্ঠা করেন। সেই হতেই সিংহাসনটিকে বত্রিশ সিংহাসন নামে অভিহিত করা হত। সোনার গোপাল প্রতিষ্ঠা করবার কিছুকাল পরে হঠাৎ অদ্ভুত উপায়ে কোন অদৃশ্য লুণ্ঠনকারী রাজবাড়ির অন্দরমহলে অবস্থিত ঠাকুরঘর থেকে গৃহদেবতা সোনার গোপালটি লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়।
সমগ্র রাজবাড়িতে বিষাদের কালো ছায়া ঘনিয়ে এল অবশ্যম্ভাবী এক অমঙ্গলের দুশ্চিন্তয়! চারিদিকে অনুসন্ধান শুরু হল, কিন্তু বৃথা।
এখান সময় রাজমাতা কাত্যায়নী দেবী স্বপ্নে অপহৃত গৃহদেবতা সোনার গোপালের প্রত্যাদেশ পেলেন ঃ ভয়ের কিছু নেই। অপহৃত হয়েছি আমি, আবার তোদের গৃহে সময় হলেই আসব। যতদিন না তোদের ঘরে আবার আমি প্রত্যাবর্তন করি, ততদিন শূন্য সিংহাসন সিন্দুকে তালা বন্ধ করে রাখিস। ঐ বত্রিশ সিংহাসন যতদিন তোদের ঘরে থাকবে, কোন অমঙ্গলই তোদের স্পর্শ করতে পারবে না।
সেই থেকে এতদিন রত্নমণ্ডিত স্বর্ণনির্মিত বত্রিশ সিংহাসনটি রাজবাড়ির লোহার সিন্দুকেই তালাবন্ধ ছিল। গৃহদেবতাও আর প্রত্যাবর্তন করেননি, বত্রিশ সিংহাসনও আর কোন কাজে লাগেনি। রাজবাড়ির কোথাও কোন অমঙ্গলের চিহ্নও দেখা দেয়নি।
সেই সিংহাসনটিই অকস্মাৎ কেমন করে অভাবনীয়রূপে রাজবাড়ির অন্দরমহলে অবস্থিত লৌহ-সিন্দুক থেকে লুষ্ঠিত হয়েছে।
সিন্দুক থেকে সোনার বত্রিশ সিংহাসনটি বের করে আবার নতুন সোনার গোপাল নির্মাণ করে দেবতার প্রতিষ্ঠা করবেন।
স্বর্ণকারকে ডেকে মূর্তি গড়াবার আদেশও দেওয়া হয়েছিল এবং সোনার গোপালের নির্মাণকাৰ্যও প্রায় সুসম্পন্ন হয়ে এসেছে।
আসন্ন উৎসবের আয়োজন চলেছে। আত্মীয়স্বজনে রাজবাড়ি গমগম করছে, এমন সময় এই আকস্মিক বিভ্ৰাট। রাজা ত্ৰিদীপনাথ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। লোহার সিন্দুক থেকে বত্রিশ সিংহাসন চুরি গেছে। নির্মেঘ নীলকাশ থেকে যেন সহসা বজাপাত হয়েছে।
মাত্র কয়েক দিন হল কিরীটী এম. এস.সি.র শেষ পরীক্ষণ দিয়েছে। এখন অখণ্ড অবসর। কিরীটী শিয়ালদহের এক খ্যাতনামা অন্ধকার গলির মধ্যে অবস্থিত বাণীভবন মেসে থাকে।
শরৎ ঋতুর অবসানে শীতের প্রথম আবির্ভাবের রং লেগেছে। প্রকৃতির অঞ্চলে। ঝরা পাতার উৎসব দিকে দিকে শেষ হল; শুষ্ক ডালে সবুজের ইশারা।
মেসের তেতলার ঘরে একটা লোহার চেয়ারে বসে কিরীটী সেইদিনকার দৈনিকখানা আনমনে ওল্টাচ্ছে। হঠাৎ এক জায়গায় দৃষ্টি পড়তেই কিরীটী সচকিত হয়ে ওঠে। একটা বিজ্ঞাপন–
এতদ্বারা সর্বসাধারণকে জ্ঞাত করা হইতেছে যে শ্ৰীনগরের রাজবাটির অন্দরমহলে অবস্থিত লৌহসিন্দুক হইতে রাজাদের পুরুষানুক্রমে রক্ষিত ইতিহাস-বিখ্যাত বহুমূল্য রত্নখচিত সুবর্ণনির্মিত বত্রিশ সিংহাসনটি কে বা কাহারা অত্যাশ্চর্য উপায়ে লুণ্ঠন করিয়াছে। যদি কোথাও এমন কেহ থাকেন, যিনি সেই সিংহাসনটি উদ্ধার করিয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে তঁহাকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা পুরুস্কার দেওয়া হইবে; অনুসন্ধানেচ্ছ অবিলম্বে নিজ ব্যয়ে শ্ৰীনগরের রাজবাটিতে আসিয়া শ্ৰীনগরের রাজা ত্ৰিদীপনাথ রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন। রাজবাটী ঃ শ্ৰীনগর।