বলেন কি!
আরও-ওই যে নরহরি সরকার—
সেও? নরহরিও?
হ্যাঁ।
ওরও কি বৌ নেই?
না। বছরচারেক হল বৌ গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। একটা ছেলে ও একটা মেয়ে আছে। আর এক ভাগ্নে ছিল, তাকে দূর করে দিয়েছে বাড়ি থেকে।
হুঁ। আর কেউ?
আরও একজন দিদিকে বিয়ে করতে চেয়েছিল জানি, কিন্তু দিদি তাকে প্রত্যাখ্যান করায় আর সে কখনও উচ্চবাচ্চ্য করেনি।
কে সে?
সুবোধদা।
মানে আপনাদের পাশের বাড়ির সুবোধ মিত্র?
হ্যাঁ।
আচ্ছা একটা কথা, আপনার দিদির কারও ওপর দুর্বলতা ছিল, জানেন? মানে কাউকে লাইক করতেন? বুঝতেই পারছেন, আমি কি বলতে চাই! ..
ওদের কারও প্রতি দিদির কোন দুর্বলতা ছিল বলে অন্তত আমি জানি না, তবে–
কি, তবে?
সুবোধদার প্রতি হয়ত তার মনটা—ওদের প্রতি যেমন, তেমন বিরূপ ছিল না। হয়ত সুবোধদার প্রতি দিদির কিছুটা দুর্বলতা বা প্রশ্রয় ছিল।
কীসে বুঝলেন?
বুঝতে পেরেছিলাম।
.
১০.
আচ্ছা আপনাদের পল্লীর বাইরের এমন কেউ কি ছিল যার প্রতি হয়ত তার—আপনার দিদির কোন দুর্বলতা বা ভালোবাসা ছিল। এবারে সুদর্শন জিজ্ঞাসা করে।
মনে হয়নি কখনও সেরকম কিছু।
কি করে বুঝলেন?
হলে অন্তত আমি জানতে বোধ হয় পারতাম।
হুঁ। আচ্ছা আপনার দিদির কাছে কেউ আসত না? আর কারোর সঙ্গে তাঁর আলাপ ছিল না?
না।
কিন্তু আমি শুনেছি কে একজন সুট-পরা ভদ্রলোক নাকি মধ্যে মধ্যে মাধবী দেবীকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যেতেন।
কে—অমরবাবুর কথা বলছেন?
তা জানি না। অমরবাবু কে?
উনি এক অফিসে কাজ করেন। ওঁদের অফিসে থিয়েটার করতে গিয়ে দিদির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।
লোকটির বয়স কত হবে?
ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে বলে মনে হয়।
অমরবাবুর সঙ্গে আপনার দিদির কি রকম ঘনিষ্ঠতা ছিল?
আলাপ-পরিচয় ছিল জানি, তবে সেরকমের কিছু ঘনিষ্ঠতা হলে আমি জানতে পারতাম নিশ্চয়ই।
দিদি বুঝি সব কথাই আপনাকে বলতেন?
সবই বলত। রাত্রে আমরা এক বিছানায় শুতাম তো। শুয়ে শুয়ে গল্প হত।
অমরবাবুর কথা কখনও বলেননি?
না।
আপনার দিদি তাহলে কাউকে ভালবাসতেন বলে আপনার মনে হয় না?
মনে হয়নি কখনও।
আচ্ছা আপনার দিদি তো অনেক টাকা উপায় করতেন, তাই না?
তা বোধ হয় করত।
কেন, উপার্জনের কথা আপনাকে কখনও বলেননি?
না, আমিও জিজ্ঞাসা করিনি কখনও।
সব টাকা তো আর খরচ হত না, নিশ্চয়ই কিছু কিছু জমাতেন?
বোধ হয়।
জানেন না কিছু সে সম্পর্কে?
না, সঠিক কিছু জানি না। আমিও কখনও জিজ্ঞাসা করিনি, সেও বলেনি।
কোথায় টাকা রাখতেন—ব্যাঙ্কে?
হতে পারে। কারণ সব সময়ই দিদি আমাকে বলত, কিছু ভাবিস না সাবি, তুই পড়ে যা-যতদূর পড়তে চাস; তারপর খুব ভাল একটা ছেলে দেখে তোর বিয়ে দেব। আমি বলেছি, তুমি বিয়ে কর না। দিদি হেসেছে।
দিদির জামা-কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র কোথায় থাকত?
আমাদের ঘরে একটা সুটকেসের মধ্যে।
তার চাবিটা কোথায়?
আমি জানি না। চাবিটা সব সময় তার হ্যান্ডব্যাগেই বোধ হয় রাখত দিদি।
আগামী কাল আমি একবার আপনাদের বাসায় যাব ভাবছি।
কেন?
যদি কোন ক্লু তার মধ্যে পাওয়া যায়!
কখন যাবেন?
সকাল দশটার মধ্যেই যাব।
আচ্ছা।
আর একটা কথা, আপনার দিদিকে কেউ কখনও কোন চিঠিপত্র লেখেনি?
ইদানীং আর কোন চিঠি আসেনি, তবে বছর দেড়েক আগে পর্যন্ত মধ্যে মধ্যে আকাশ-নীল রঙের খামে দিদির কাছে চিঠি আসত।
কার চিঠি?
বলতে পারি না।
শোনেননি কিছু কখনও আপনার দিদির মুখে?
না।
আপনি জিজ্ঞাসা করেননি?
না, করিনি।
আপনার জানবার কৌতূহল হয়নি?
কোন জবাব দেয় না সাবিত্রী, চুপ করে থাকে।
হুঁ। কতদিন সেরকম চিঠি এসেছে?
প্রায় বছরখানেক ধরে প্রতি মাসেই একখানা দুখানা। তারপর হঠাৎ একদিন আকাশনীল রঙের খামে চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল।
আপনার সে চিঠি সম্পর্কে, সত্যি বলবেন, কখনও কোন কৌতূহল হয়নি?
মিথ্যা বলব না-হয়েছে, জিজ্ঞাসাও করেছিলাম একবার, কে তোকে চিঠি লেখে রে দিদি?
তারপর?
দিদি জবাব দিয়েছিল, ও আমার এক বন্ধু। আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি কখনও তারপর।
আপনার দিদি সে-সব চিঠির নিশ্চয়ই জবাব দিতেন, নচেৎ আবার চিঠি আসবে কেন?
জবাব দিত কিনা জানি না, কখনও দিতে কিন্তু আমি দেখিনি।
থানার ঘড়িতে ওই সময় ঢংঢং করে রাত দশটা ঘোষণা করল।
অনেক রাত হল, এবার আমি যাই। সাবিত্রী উঠে দাঁড়ায়।
আর একটা কথা সাবিত্রী দেবী, আপনার দিদির গিনি জমাবার শখ ছিল, তাই না?
গিনি!
হ্যাঁ, গিনি।
তা—তা তো জানি না।
আপনি দেখেননি বা শোনেননি কখনও?
না।
আচ্ছা এবার আপনি যান—না, চলুন একা যাবেন না—রাত অনেক হয়েছে, থানা থেকে অনেকটা পথ। চলুন আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।
সুদর্শন উঠে দাঁড়াল ড্রয়ার থেকে টর্চটা বের করে পকেটে পুরে।
ইতিমধ্যে চারদিক কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। একে শীতের রাত, তায় প্রায় দশটা বেজে গেছে। অন্যান্য রাতের মত তখনও সে-রাত্রে কুয়াশা নামেনি।
রাতের আকাশ বেশ পরিষ্কার। চতুর্দশীর চাঁদের আলোয় চারদিক বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। বাইরে বেশ শীত। থানা থেকে বের হয়ে আসতেই সেটা উভয়েই টের পায়।
১১-১৫. আপনি আবার কষ্ট করে এলেন
১১.
আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন? সাবিত্রী বলে, একাই অনায়াসে আমি চলে যেতে পারতাম।
তা পারতেন, তবে এত রাত্রে এ পথটা খুব ভাল নয়। মিলের ওয়ার্কাররা এই সময়টা মদ খেয়ে ফেরে অনেকেই।