- বইয়ের নামঃ নীলকুঠি
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১-০৫. রজত আর সুজাতা
দেখা হয়ে গেল দুজনের। রজত আর সুজাতার।
এতদিন পরে এমনি করে দুজনের আবার দেখা হয়ে যাবে কেউ কি ওরা ভেবেছিল! দুজনে দুদিকে যে ভাবে ছিটকে পড়েছিল, তারপর আবার কোন দিন যে দেখা হবে, তাও এক বিচিত্র পরিস্থিতির মধ্যে, ব্যাপারটা দুজনের কাছেই ছিল সত্যি স্বপ্নতীত।
তবু দেখা হল দুজনের। রজত আর সুজাতার।
দুজনের একজন আসছিল লাহোর থেকে। অন্যজন লক্ষ্ণৌ থেকে। এবং দুজনেরই কলকাতায় আগমনের কারণ হচ্ছে একই লোকের কাছ থেকে পাওয়া দুখানা চিঠি।
আরও আশ্চর্য, যখন ওরা জানতে পারল একই দিনে নাকি দুজনে এই চিঠি দুখানা পেয়েছে।
.
একই তারিখে লেখা দুখানা চিঠি। এবং একই কথা অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে দুখানা চিঠিতে লেখা। আর সেই চিঠি পেয়েই লক্ষ্ণৌ থেকে সুজাতা ও লাহোর থেকে রজত একই দিনে রওনা হয়ে এক ঘণ্টা আগে-পিছে হাওড়া স্টেশনে এসে নামল।
পরবর্তী উত্তরপাড়া যাবার লোকাল ট্রেনটা ছিল ঘণ্টা দেড়েক পরে। দুজনের সঙ্গে সাক্ষাত হয়ে গেল তাই হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফরমের উপরেই।
এ কি, সুজাতা না! রজত প্রশ্ন করে বিস্ময়ে।
কে, ছোড়দা! সুজাতাও পাল্টা বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্নটা করে।
কোথায় যাচ্ছিস? লক্ষৌ থেকেই আসছিস নাকি?
হ্যাঁ, উত্তরপাড়া। ছোট্রকার একটা জরুরী চিঠি পেয়ে আসছি।
আশ্চর্য! আমিও তো ছোট্রকার জরুরী চিঠি পেয়েই উত্তরপাড়ায় যাচ্ছি। জবাবে বলে রজত।
রজত ও সুজাতা জ্যেঠতুত ও খুড়তুত ভাই-বোন। একজন থাকে লাহোরে, অন্যজন লক্ষৌতে। প্রায় দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে ভাই-বোনে সাক্ষাৎ।
এদিকে ট্রেন ছাড়বার শেষ ঘণ্টা তখন বাজতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি দুজনে সামনের লোকাল ট্রেনটায় উঠে বসল।
শীতের বেলা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। বেলা সবে সাড়ে চারটে হলেও, বাইরের আলো ইতিমধ্যেই ঝিমিয়ে এসেছে।
ইতিমধ্যেই অফিস-ফেরতা নিত্যকার কেরানী যাত্রীদের ভিড় শুরু হয়ে গেছে ট্রেনে। ট্রেনের কামরায় ঠেলাঠেসি গাদাগাদি। সেকেণ্ড ক্লাস কামরায় ভিড় থাকলেও ততটা ভিড় নেই। একটা বেঞ্চের একধারে ওরা কোনমতে একটু জায়গা করে নিয়ে গায়ে গা দিয়ে বসে পড়ল।
.
দুজনেই ভাবছিল বোধ হয় একই কথা।
ছোটকাকা বিনয়েন্দ্রর জরুরী চিঠি পেয়ে দুজনে, একজন লাহোর থেকে অন্যজন লক্ষৌ থেকে আসছে উত্তরপাড়ায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। জরুরী চিঠি পেয়ে আসছে ওরা কিন্তু তখনো জানে না কী ব্যাপারে জরুরী চিঠি দিয়ে তাদের আসতে বলা হয়েছে। অথচ গত দশ বছর ধরে তাদের ওই কাকা বিনয়েন্দ্র, যদিও আপনার কাকা, তাঁর সঙ্গে ওদের কোন সম্পর্কই ছিল না।
দেখা-সাক্ষাৎ বা মুখের আলাপে কুশল প্রশ্ন পর্যন্ত দূরের কথা, গত দশ বছর পরস্পরের মধ্যে ওদের কোন পত্র বিনিময় পর্যন্ত হয়নি। ওরাও সত্যি কথা বলতে কি ভুলেই গিয়েছিল যে, ওদের একজন আপনার কাকা এ সংসারে কেউ এখনো আছেন!
সেই কাকার কাছ থেকে জরুরী চিঠি। অত্যন্ত জরুরী তাগিদ, পত্র পাওয়ামাত্র যেন চলে আসে ওরা উত্তরপাড়ায়। ইতি অনুতপ্ত ছোট্কা। চিঠির মধ্যে কেবল এতকাল পরে আসবার জন্য এই জরুরী তাগিদটুকু থাকলেই ওরা এভাবে চিঠি পাওয়ামাত্রই চলে আসতে কিনা সন্দেহ। আরও কিছু ছিল সেই সংক্ষিপ্ত চিঠির মধ্যে যেটা গুরুত্বের দিক দিয়ে ওরা অস্বীকার করতে পারেনি। এবং যে কারণে ওরা চিঠি পাওয়ামাত্রই না এসেও পারেনি।
কল্যাণীয়েষু রজত,
আমার আর বেশী দিন নেই। স্পষ্ট বুঝতে পারছি মৃত্যু আমার একেবারে সন্নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাত থেকে আর আমার কোন মতেই নিস্তার নেই। দাদুর প্রেতাত্মার চেষ্টা এতদিনে বোধ হয় সফল হবেই বুঝেতে পারছি। আগে কেবল মধ্যে মধ্যে রাতের বেলা তাকে দেখতাম, এখন যেন তাকে দিনে রাত্রে সব সময়ই দেখতে পাচ্ছি। সেই প্রেত-ছায়া এবারে বোধ হয় আর আমাকে নিস্তার দেবে না। এতকাল যে কেন তোমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখিনি যাবার আগে অন্তত সে কথাটা তোমাকে জানিয়ে যদি না যাই এবং আমার যা কিছু তোমার হাতে তুলে না দিয়ে যেতে পারি তবে মরণের পরেও হয়তো আমার মুক্তি মিলবে না। তাই আমার শেষ অনুরোধ এই চিঠি পাওয়ামাত্রই রওনা হবে।
ইতি আশীবাদক, অনুতপ্ত, ভাগ্যহীন, তোমার ছোকা।
সুজাতার চিঠিতেও অক্ষরে অক্ষরে একই কথা লেখা। কেবল কল্যাণীয়েষু রজতের জায়গায় লেখা, কল্যাণীয়া মা সুজাতা।
তাই যত মন-কষাকষিই থাক, দীর্ঘদিনের সম্পর্কহীন এবং ছাড়াছাড়ি থাকা সত্ত্বেও রজত বা সুজাতা কেউই তাদের ছোট্কা বিনয়েন্দ্রর ওই চিঠি পড়ে রওনা না হয়ে পারেনি।
গত দশ বছরই না হয় ছোট্কার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই কিন্তু এমন একদিন তো ছিল যখন ওই ছোটকাই ছিল ওদের বাড়ির মধ্যে সবার প্রিয়। যত কিছু আদর আবদার ছিল ওদের ঐ ছোট্রকার কাছেই।
সেজন্য রজতের মাও কম তো বলেননি ওদের ছোট্কাকে।
প্রত্যুত্তরে হোটকা হেসেছেন শুধু ওদের দুজনকে পরম স্নেহে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে।
ছোট্রকার ওরা দুজনেই যে ছিল বাড়ির মধ্যে একমাত্র সঙ্গী সাথী। হাসতে হাসতে ছোেটা রজতের মাকে সম্বোধন করে বলেছেন, না না, ওদের তুমি অমন করে বোলো না।
রজতের মা জবাবে বলেছেন, না, বলবে না! আদর দিয়ে দিয়ে ওদের মাথা দুটো যে চিবিয়ে খাচ্ছ। দুটিই সমান ধিঙ্গি হয়েছে, লেখাপড়ার নামে ঘণ্টা। কেবল ছোটকা এটা দাও,ছোট্কা ওটা দাও, এটা করো ছোটকা, ওটা করো।
আহা, অমন করে বোলো না বউদি। একজন এই বয়সে বাপ হারিয়েছে, আর একজন তো বাপ মা দুটো বালাই-ই চুকিয়ে বসে আছে।
সত্যিই তো!
রজতের বাবা অমরেন্দ্রনাথ সেক্রেটারিয়েটে বড় চাকরি করতেন। তিন ভাই অমরেন্দ্র, সুরেন্দ্র ও বিনয়েন্দ্রর মধ্যে তিনিই ছিলেন জ্যেষ্ঠ। অল্প বয়সেই দেখা দিল রক্তচাপাধিক্য, হঠাৎ করোনারী থ্রম্বসিসে একদিন দ্বিপ্রহরে অফিসে কাজ করতে করতেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। জ্ঞানহীন অমরেন্দ্রনাথকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়িতে নিয়ে আসা হল কিন্তু লুপ্ত জ্ঞান আর তাঁর ফিরে এল না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল। রজতের বয়স তখন সবেমাত্র ন বছর। এক বছরও ঘুরল না, সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, একটা ব্রিজ কনস্ট্রাকসনের তদ্বির করে ফিরছিলেন সস্ত্রীক নিজের গাড়িতেই। ড্রাইভার ড্রাইভ করছিল। একটা রেলওয়ে ক্রশিংয়ের বাঁকের মুখে ড্রাইভার স্পীডের মুখে গাড়ি টার্ন নিতে গিয়ে গাড়ি উল্টে গিয়ে একই সঙ্গে ড্রাইভার ও সস্ত্রীক সুরেন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে সঙ্গে সঙ্গেই।
সুজাতার বয়স তখন বছর ছয়েক মাত্র।
অতি অল্প বয়সে মা ও বাপকে একসঙ্গে হারালেও সুজাতার খুব বেশী অসুবিধা হয়নি। কারণ সে প্রকৃতপক্ষে তার জন্মের পর থেকেই আয়ার কোলে ও জ্যেঠাইমার তত্ত্বাবধানে মানুষ হচ্ছিল। বাপ-মার সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব কমই ছিল। সুরেন্দ্রনাথ তাঁর কনট্রাকসনের কাজে বাইরে বাইরেই সর্বদা ঘুরে বেড়াতেন, সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন তাঁর স্ত্রী সুপ্রিয়া। সুজাতার যা কিছু আদর-আবদার ছিল তার ছোট্কা বিনয়েন্দ্রনাথ ও জ্যেঠিমার কাছেই।
একটা বছরের মধ্যেই সাজানো-গোছানো সংসারটার মধ্যে যেন অকস্মাৎ একটা ঝড় বহে গেল। সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল।
সমস্ত ঝক্কি ও দায়িত্ব এসে পড়ল বিনয়েন্দ্রনাথের ঘাড়ে।
বিনয়েন্দ্রনাথ তখন রসায়নে এম. এস. সি. পাস করে এক বে-সরকারি কলেজে সবেমাত্র বছর দুই হল অধ্যাপনার কাজ নিয়েছেন ও ডক্টরেটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।
সংসারের টাকাপয়সার ব্যাপারটা কোন দিনও তাঁকে ভাবতে হয়নি ইতিপূর্বে। যা আয় করতেন তার সবটাই তাঁর ইচ্ছামত রসায়ন শাস্ত্রের বই কিনে ও ভাইপো-ভাইঝিদের আদর-আবদার মেটাতেই ব্যয় হয়ে যেত। কিন্তু হঠাৎ যেন মোটা রকমের উপার্জনক্ষম মাথার উপরে দুই ভায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে সমস্ত ঝক্কি এসে তাঁকে একেবারে বিব্রত করে তুলল।
কিন্তু অত্যুৎসাহী, সদাহাস্যময় আনন্দ ও জ্ঞানপাগল বিনয়েন্দ্রনাথকে দেখে সেটা বোঝবার। উপায় ছিল না।
অমরেন্দ্রনাথ যত্র আয় করতেন তত্র ব্যয় করতেন; কাজেই মৃত্যুর পর সামান্য হাজার দু-তিন টাকা ব্যাঙ্কে ছাড়া আর কিছুই রেখে যেতে পারেননি এবং সময়ও পাননি।
সুরেন্দ্রনাথও তাই, তবে হাজার পনের টাকার জীবনবীমা ছিল তাঁর।
বিনয়েন্দ্রনাথ বউদির শত অনুরোধেও বিবাহ করলেন না, নিজের রিসার্চ ও ভাইপো-ভাইঝিদের নিয়েই দিন কাটাতে লাগলেন।
এমনি করেই দীর্ঘ চোদ্দটা বছর কেটে গেল।
রজত বি. এ. পাস করে এম. এ. ক্লাসে ভর্তি হল ও সুজাতা বি. এ. ক্লাসে সবে নাম লিখিয়েছে এমন সময় অকস্মাৎ একটা ঘটনা ঘটল।
.
অমরেন্দ্র, সুরেন্দ্র ও বিনয়েন্দ্রর মাতামহ অনাদি চক্রবর্তী সেকালের একজন বর্ধিষ্ণু জমিদার, থাকতেন উত্তরপাড়ায়।
একদিন বিয়ে কলেজ থেকেই সেই যে তাঁর দাদুকে দেখতে গেলেন তাঁর উত্তরপাড়ার বাড়িতে, আর ফিরে এলেন না কলকাতার বাসায়।
সন্ধ্যার দিকে উত্তরপাড়া থেকে অবিশ্যি বিনয়েন্দ্রর একটা চিঠি একজন লোকের হাত দিয়ে এসেছিল রজতের মার নামে এবং তাতে লেখা ছিল:
বউদি,
দাদুর হঠাৎ অসুখের সংবাদ পেয়ে উত্তরপাড়ায় এসে দেখি তাঁর মস্তিষ্কবিকৃতিটা কয়েকদিন থেকে একটু বেশী রকমই বাড়াবাড়ি চলেছে। তাঁকে দেখবার কেউ নেই, এ অবস্থায় আঁকে একা একটিমাত্র চাকরের ভরসায় রেখে ফিরতে পারছি না। তবে একটু সুস্থ হলে যাব। রজতই যেন একরকম করে সব চালিয়ে নেয়।
ইতি বিনয়েন্দ্র
ওইটুকু সংবাদ ছাড়া ওদের কলকাতার বাসার ওই লোকগুলোর খরচপত্র কেমন করে কোথা থেকে চলবে তার কোন আভাস মাত্রও সে চিঠিতে ছিল না।
বিনয়েন্দ্রর পক্ষে ওই ধরনের চিঠি দেওয়াটা একটু বিচিত্রই বটে। যাহোক সেই যে বিনয়েন্দ্র উত্তরপাড়ায় চলে গেলেন আর সেখান থেকে ফিরলেন না। এবং দ্বিতীয় আর কোন সংবাদও দিলেন না দীর্ঘ তিন বছরের মধ্যে; এমন কি সকলে কে কেমন আছে এমনি ধরনের কোন একটি কুশল সংবাদ নিয়েও কোন সন্ধান বা পত্র এল না ওই দীর্ঘ তিন বছরে।
রজতের মা বিনয়েন্দ্রর এতাদৃশ ব্যবহারে বেশ কিছুটা মর্মাহত তো হলেনই এবং অভিমানও হল তাঁর সেই সঙ্গে।
আশ্চর্য! বিনয়েন্দ্র অকস্মাৎ সকলকে কেমন করে ভুলে গেল আর ভুলতে পারলই বা কী করে? যাহোক অভিমানের বশেই রজতকে পর্যন্ত তাঁর অনুরোধ সত্ত্বেও একদিনের জন্যও তিনি বিনয়েন্দ্রর সন্ধানে যেতে দিলেন না।
যাক সে যদি ভুলে থাকতে পারে, তাঁরাই বা কেন তাকে ভুলে থাকতে পারবেন না!
.
০২.
উত্তরপাড়ায় বিনয়েন্দ্রর যে মাতামহ ছিলেন অনাদি চক্রবর্তী, তাঁর বয়স প্রায় তখন সত্তরের কাছাকাছি।
এমন একদিন ছিল যে সময় উত্তরপাড়ায় চক্রবর্তীদের ধনসম্পদের প্রবাদটা কিংবদন্তীর মতই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে হচ্ছে রামানন্দ চক্রবর্তীর যুগ। অথচ খুব বেশী দিনের কথাও তো সেটা নয়। কলকাতায় সে সময় ইংরাজ কুঠিয়ালদের প্রতিপত্তি সবে শুরু হয়েছে। রামানন্দ ছিলেন ওইরূপ এক কুঠিরই মুছুদ্দি। রামানন্দ বিয়ে করেছিলেন ভাটপাড়ার বিখ্যাত গাঙ্গুলী পরিবারে। বউ লক্ষ্মীরাণী ছিলেন অপরূপা সুন্দরী। কিন্তু সুখে বা আনন্দে সংসার তিনি করতে পারেননি।
হঠাৎ এক নিষুতি রাত্রে রামানন্দের ঘরে ডাকাত পড়ল। ডাকাতদের হাতে ছিল গাদা। বন্দুক আর জ্বলন্ত মশাল।
ডাকাতের দল কেবল যে রামানন্দর ধনদৌলতই লুঠ করল তাই নয়, লুঠ করে নিয়ে গেল ওই সঙ্গে তাঁর পরমাসুন্দরী যুবতী স্ত্রী লক্ষ্মীরাণীকেও।
সত্য কথাটা কিন্তু রামানন্দ কাউকেই জানতে দিলেন না। তিনি রটনা করে দিলেন ডাকাতদের হাতে লক্ষ্মীরাণীর মৃত্যু ঘটেছে।
দু-চারজন আত্মীয়স্বজন কথাটা বিশ্বাস না করলেও উচ্চবাক্ত করতে সাহস করল না বা রামানন্দর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও সাহস পেল না, রামানন্দের প্রতিপত্তি ও ধনৈশ্বর্যের জন্যই বোধ হয়।
রামানন্দের একটিমাত্র ছেলে যোগেন্দ্র চক্রবর্তী। যোগেন্দ্রকে বুকে নিয়ে রামানন্দ স্ত্রী-বিচ্ছেদের দুঃখটা ভুলবার চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু কিছুতেই যেন ভুলতে পারেন না লক্ষ্মীরাণীকে।
সুরার আশ্রয় নিলেন। এবং শুধু সুরাই নয়, সেই সঙ্গে এসে জুটল বাগানবাড়িতে বাঈজী চন্দনাবাঈ। হু-হু করে সঞ্চিত অর্থ বের হয়ে যেতে লাগল।
তারপর একদিন যখন তাঁর মৃত্যুর পর তরুণ যুবা যোগেন্দ্রর হাতে বিষয়-সম্পত্তি এসে পড়ল, রামানন্দর অর্জিত বিপুল ঐশ্বর্যের অনেকখানিই তখন শুড়ীর দোকান দিয়ে সাগরপারে চালান হয়ে গেছে।
এদিকে উজ্জ্বলতার যে বিষ রামানন্দের রক্ত থেকে তাঁর সন্তানের রক্তের মধ্যেও ধীরে ধীরে সংক্রামিত হচ্ছিল, রামানন্দ কিন্তু সেটা জানতে পারলেন না এবং বাপের মৃত্যুর পর থেকেই তাঁর এতদিনকার জানা উচ্ছঙ্খলত স্বমূর্তিতে যেন প্রকাশ পেল। এবং যোগেন্দ্র তাঁর উচ্ছলতায় বাপকেও ডিঙিয়ে গেলেন যেন। ফলে তাঁর মৃত্যু হল আরও অল্প বয়সে। তাঁর পুত্র অনাদির বয়ঃক্রম তখন মাত্র আঠারো বছর। সম্পত্তিও তখন অনেকটা বেহাত হয়ে গেছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও অনাদি ছিলেন যাকে বলে সত্যিকারের উদ্যোগী পুরুষসিংহ। তিনি তাঁর চেষ্টায় ও অধ্যবসায়ের দ্বারা ক্রমশ সেই জীর্ণ দেউলকে সংস্কার করে ভাগ্যের চাকাটা আবার ফিরিয়ে দিলেন।
অনাদির কোন পুত্রসন্তান জন্মায়নি। জন্মেছিল মাত্র একটি কন্যা সুরধনী।
লক্ষ্মীরাণী চক্রবর্তী পরিবার থেকে লুষ্ঠিত হলেও তার রূপের যে ছাপ চক্রবর্তী পরিবারে রেখে গিয়েছিল সেটা পরিপূর্ণভাবে যেন ফুটে উঠেছিল সুরধনীর দেহে।
অপরূপা সুন্দরী ছিলেন সুরধনী। এবং চক্রবর্তীদের ঘরে লক্ষ্মীরাণীর যে অয়েলপেনটিংটা ছিল তার মুখের গঠন ও চেহারার নিখুত মিল যেন ছিল ওই সুরধনীর চেহারায়।
অনাদি চক্রবর্তী অল্প বয়সেই সুরধনীর বিবাহ দেন গরীবের ঘরের এক অসাধারণ মেধাবী ছাত্র মৃগেন্দ্রনাথের সঙ্গে।
অমরেন্দ্র ও সুরেন্দ্রের জন্মের পর তৃতীয়বার যখন সুরধনীর সন্তানসম্ভাবনা হল তিনি উত্তরপাড়ার পিতৃগৃহে আসেন কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে।
মৃগেন্দ্রনাথ অসাধারণ মেধাবী ছাত্র হলেও জীবনে তেমন উন্নতি করতে পারেননি। অথচ নিজে অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ও আত্মাভিমানী ছিলেন বলে শ্বশুর অনাদি চক্রবর্তীর বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও তাঁর কোনরূপ সাহায্যও কখনো গ্রহণ করেননি। এবং স্ত্রীকেও সহজে পিতৃগৃহে যেতে দিতেন না।
এজন্য জামাই মৃগেন্দ্রর উপরে অনাদি চক্রবর্তী কোনদিন সন্তুষ্ট ছিলেন না। ঠাট্টা করে বলতেন, সাপ নয় তার কৃপানা চক্র।
ধনী পিতার আদরিণী ও সুন্দরী কন্যা সুরধনীও স্বামীর প্রতি কোন দিন খুব বেশী আকৃষ্ট হননি। কারণ তাঁর রূপের মত ধনেরও একটা অহঙ্কার ছিল।
সেবারে যখন অনেক অনুনয় বিনয় করবার পর দিন সাতেকের কড়ারে সুরধনী পিতৃগৃহে এলেন এবং সাতদিন পরেই ঠিক মৃগেন্দ্র স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এলেন, সুরধনী বললেন, আর কটা দিন তিনি থাকতে চান।
মৃগেন্দ্র রাজী হলেন না। বললেন, না, চল।
কেন, থাকি না আর কটা দিন?
না সুরো। গরীব আমি, আমার স্ত্রী বেশী দিন ধনী শ্বশুরের ঘরে থাকলে লোকে নানা কথা বলবে।
তা কেন বলতে যাবে। বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকব।
না, চল। মানুষকে তুমি চেন না, তারা বাঁকাভাবেই নেবে।
সবারই তো তোমার মত বাঁকা মন নয়।
কী বললে, আমার মন বাঁকা?
তা নয় তো কী। অন্য কোথাও নয়, এ আমার নিজের বাপের বাড়ি। থাকিই না কটা দিন আর। গিয়েই তো আবার সেই হাঁড়ি ঠেলা শুরু।
ও, সোনার পালঙ্কে দুদিন শুয়েই বুঝি আরাম ধরে গেছে!
কোথা থেকে কী হয়ে গেল।
সমান বক্রভাবে সুরধনী জবাব দিলেন, সোনার পালঙ্কে ছোটবেলা থেকেই শোওয়া আমার। অভ্যাস। তোমরাই বরং চিরদিন কুঁড়েঘরে থেকেছ, তোমাদেরই চোখে ধাঁধা লাগা সম্ভব দুদিনের সোনার পালঙ্কে শুয়ে, আমাদের নয়।
হুঁ। আচ্ছা বেশ, থাক তবে তুমি এখানেই।
মৃগেন্দ্র চলে গেলেন।
.
সত্যি সত্যি মৃগেন্দ্রর দিক থেকে পরে আর কোন ডাকই এল না।
সুরধনী এবং অনাদি চক্রবর্তী ভেবেছিলেন দু-একদিন পরেই হয়তো মৃগেন্দ্রর রাগ পড়বে কিন্তু দেখা গেল দু-একদিন বা দু-এক সপ্তাহ তো দূরের কথা দশ বছরেও মৃগেন্দ্র চক্রবর্তী বাড়ির ছায়াপর্যন্ত আর মাড়ালেন না। এমন কি সুরধনীর মৃত্যুসবাদ পেয়েও তিনি এলেন। কেবল জ্যেষ্ঠ পুত্র অমরেন্দ্রকে ও সঙ্গে একটি ভৃত্য পাঠিয়ে দিলেন তাদের হাতে এক নীলকুঠী চিঠি দিয়ে অবিলম্বে বিনয়েন্দ্রকে তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেবার জন্যে।
বিনয়েন্দ্র চক্রবর্তী মামার বাড়িতেই জন্মেছিল এবং দাদুর আদরে মানুষ হচ্ছিল।
অনাদি ফেরত পাঠিয়ে দিলেন নাতিকে।
সেই থেকেই অনাদি চক্রবর্তীর সঙ্গে মৃগেন্দ্রদের আর কোন সম্পর্ক ছিল না। কোন পক্ষই কেউ কারোর সন্ধান করতেন না বা কোনরূপ খোঁজখবরও নিতেন না।
.
০৩.
আরও অনেকগুলো বছর গড়িয়ে গেল।
মৃগেন্দ্রও মারা গেলেন একদিন।
অমরেন্দ্র, সুরেন্দ্র লেখাপড়া শিখে উপার্জন শুরু করল, সংসার করল, তাদের ছেলেমেয়ে হল। কিন্তু চক্রবর্তী-বাড়ির সঙ্গে এ-বাড়ির আর যোগাযোগ ঘটে উঠল না। যক্ষের মত বৃদ্ধ অনাদি চক্রবর্তী একা একা তাঁর উত্তরপাড়ার বিরাট প্রাসাদোপম অট্টালিকা নীলকুঠিতে দিন কাটাতে লাগলেন।
অল্প বয়সে বিনয়েন্দ্র মাতামহের স্নেহের নীড় ছেড়ে এসে ক্রমে তাঁর দাদুকে ভুলতে পেরেছিলেন কিন্তু ভুলতে পারেননি অনাদি চক্রবর্তী। একটি বালকের স্মৃতি সর্বদা তাঁর মনের পদায় ভেসে বেড়াত।
তথাপি প্রচণ্ড অভিমানবশে কোন্দিনের জন্য বিনয়েন্দ্রর খোঁজখবর নেননি বা তাকে ডাকেননি অনাদি চক্রবর্তী।
চক্রবর্তী-বাড়ির পুরাতন ভৃত্য রামচরণ কিন্তু বুঝতে পারত বৃদ্ধ অনাদি চক্রবর্তীর মনের কোথায় ব্যথাটা। কিন্তু সে দু-একবার মুখ ফুটে অনাদি চক্রবর্তীকে কথাটা বলতে গিয়ে ধমক খেয়ে চুপ করে গিয়েছিল বলে আর উচ্চবাচ্য করেনি কোনদিন।
শেষের দিকে বৃদ্ধ অনাদি চক্রবর্তীর মাথায় কেমন একটু গোলমাল দেখা দিল।
প্রথম প্রথম সেটা তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য মনে হয়নি বলেই রামচরণ ততটা মাথা ঘামায়নি কিন্তু শেষটায় যখন একটু বাড়াবাড়ি শুরু হল, তখন সে অনন্যোপায় হয়ে বিনয়েন্দ্রনাথকেই তার কলেজে, সরকার মশাইকে দিয়ে তার নিজের জবানীতেই একটা চিঠি লিখে পাঠাল।
খোকাবাবু,
কর্তাবাবু, আপনার দাদুর অবস্থা খুবই খারাপ। আপনি হয়তো জানেন না আপনার চলে। যাওয়ার পর থেকেই বাবুর মাথার একটু একটু গোলমাল দেখা দেয়। এবং সেটা আপনারই। জন্য, আপনাকে হারিয়ে এবারে হয়তো আর বাঁচবেন না। তাই আপনাকে জানাচ্ছি একটিবার এ সময়ে যদি আসেন তো ভাল হয়।
ইতি রামুদা
চিঠিটা পেয়ে বিনয়েন্দ্র কলেজের লাইব্রেরী ঘরে গিয়ে বসলেন।
একবার দুবার তিনবার চিঠিটা পড়লেন।
শৈশবের আনন্দ কলহাসি মুখরিত জীবনের অনেকগুলো পৃষ্ঠা যেন তাঁর মনের মধ্যে পর পর উল্টে যেতে লাগল। বহুকাল পরে আবার মনে পড়ল সেই বৃদ্ধ স্নেহময় দাদুর কথা। বিশেষ করে মধ্যে মধ্যে একটা কথা যা তাঁর দাদু তাঁকে প্রায়ই বলতেন, তোর বাবা যদি তোকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চায় দাদুভাই, চলে যাবি না তো?
বিনয়েন্দ্র জবাবে বলেছেন, ইস, অমনি নিয়ে গেলেই হল কিনা, যাচ্ছে কে? তোমাকে কোনদিনও আমি ছেড়ে যাব না দাদু, দেখে নিও তুমি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাদু তাঁকে আটকে রাখতে পারেননি। ছেড়ে দিতেই হয়েছে। পরের জিনিসের উপর তাঁর জোর কোথায়।
বিনয়েন্দ্রর মনটা ছটফট করে ওঠে। তিনি তখুনি বের হয়ে পড়েন দাদুর ওখানে যাবার জন্যে।
.
দীর্ঘ একুশ বছর বাদে সেই পরিচিত বাড়িতে এসে প্রবেশ করলেন বিনয়েন্দ্র।
বিরাট প্রাসাদ শূন্য—যেন খাঁ খাঁ করছে। সিঁড়ির মুখেই বাড়ির পুরাতন ভৃত্য রামচরণের সঙ্গে দেখা হয়েগেল, রামচরণ প্রথমটায় ওঁকে চিনতে পারেনি কিন্তু বিয়ে ঠিকই চিনেছিলেন।
মাথার চুল সাদা হয়ে গেলেও মুখের চেহারা তার বিশেষ একটা পরিবর্তিত হয়নি।
রামুদা না?
কে?
আমাকে চিনতে পারছ না রামুদা, আমি খোকাবাবু, বিনু।
বিনু! খোকাবাবু, সত্যিসত্যিই তুমি এতদিন পরে এলে! চোখে জল এসে যায় রামচরণের।
দাদু—দাদু কেমন আছেন রামুদা?
চল। ওপরে চল।
রামচরণের পিছু পিছু বিনয়েন্দ্র দোতলায় যে ঘরে অনাদি চক্রবর্তী থাকতেন সেই ঘরে এসে প্রবেশ করলেন।
বিকৃত-মস্তিষ্ক অনাদি চক্রবর্তী তখন ঘরের মধ্যে একা একা পায়চারি করছিলেন আপন মনে ভূতের মত।
পদশব্দে ফিরে তাকালেন। দৃষ্টি ক্ষীণ—স্পষ্ট কিছুই দেখতে পান না।
রামচরণ বললে, এই জ্বর নিয়ে আবার বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছেন?
বেশ করছি। আমার খুশি। তোর বাবার কী!
এখুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন যে!
পড়ি পড়ব মাথা ঘুরে, তোর বাবার কী!
এমন সময় বিনয়েন্দ্র ডাকেন, দাদু!
কে?
চকিতে ঘুরে দাঁড়ালেন অনাদি চক্রবর্তী।
দাদু, আমি বিনু।
বিনু! বিনু!
হঠাৎ অনাদি চক্রবর্তীর সমস্ত দেহটা থরথর করে কেঁপে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যাচ্ছিলেন উলে; কিন্তু চকিতে এগিয়ে গিয়ে বলিষ্ঠ দুহাতে বিনয়েন্দ্র ততক্ষণে পতনোম্মুখ বৃদ্ধকে ধরে ফেলেছেন।
আর ফেরা হল না বিনয়েন্দ্রর। চক্রবর্তীদের নীলকুঠিতেই রয়ে গেলেন। এবং মাস চারেক বাদে অনাদি চক্রবর্তী মারা গেলেন।
অনাদি চক্রবর্তী মারা যাবার পর দেখা গেল তিনি তাঁর স্থাবর-অস্থাবর যা কিছু সম্পত্তি ছিল সব এবং মায় চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স সব কিছু দিয়ে গিয়েছেন বিনয়েন্দ্রকেই।
কিন্তু তার মধ্যে দুটি শর্ত আছে।
বিনয়েন্দ্র জীবিতকালে তাঁর ঐ নীলকুঠি ছাড়া অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারবেন। তাহলেই তাঁর সমস্ত সম্পত্তি চলে যাবে ট্রাস্টির হাতে এবং তখন একটি কর্পদকও আর পাবেন না। দ্বিতীয়ত অমরেন্দ্র সুরেন্দ্রর সন্তানসন্ততিদের সঙ্গেও কোন সম্পর্ক রাখতে পারবেন না।
মৃগেন্দ্রর প্রথম দুই সন্তান অমরেন্দ্র ও সুরেন্দ্র তাদের বাপের মতই হয়েছিল। কখনও তারা দাদুর ওখানে আসেনি এবং দাদুর কথা কোনক্রমে উঠলে কখনও প্রীতিকর কথা বলত না।
সেই সব অনাদি চক্রবর্তীর কানে যাওয়ায় তিনি তাদের কোনদিনই ভাল চোখে দেখতে পারেননি। এবং সেই কারণেই হয়তো তিনি তাদের বঞ্চিত করে যাবতীয় সম্পত্তি একা বিনয়েন্দ্রকেই দিয়ে গিয়েছিলেন।
উইলটা অনাদি চক্রবর্তী মৃত্যুর পাঁচ বছর আগেই করেছিলেন।
বিনয়েন্দ্র উত্তরপাড়ার নীলকুঠি থেকে আর ফিরলেন না। সবাই আত্মীয়-অনাত্মীয়রা বুঝল এবং বললে, বিষয়-সম্পত্তি উইল অনুযায়ী সেখান থেকে এলে হাতছাড়া হয়ে যাবে বলেই তিনি সেখান থেকে আর এলেন না।
কিন্তু আসলে বিনয়েন্দ্র যে আর নীলকুঠি থেকে ফিরে আসেননি তার একমাত্র কারণ তার মধ্যে ঐ বিরাট সম্পত্তির ব্যাপারটা থাকলেও একমাত্র কারণ কিন্তু তা নয়। অন্য মুখ্য একটা কারণ ছিল।
বহুদিনের ইচ্ছা ছিল তাঁর একটি নিজস্ব ল্যাবরেটারী তৈরী করে নিজের ইচ্ছেমত গবেষণা নিয়ে থাকেন। কিন্তু তার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন সেই অর্থ তো তাঁর ছিল না। এখন দাদুর মৃত্যুতে সেই সুযোেগ হাতের মুঠোর মধ্যে আসায় বহুদিনের তাঁর অতৃপ্ত আকাঙ্খটি পূরণ করবার পক্ষে আর কোন বাধাই এখন অবশ্য রইল না। এবং দীর্ঘ তিন বছর পরে আবার সব কথা খুলে বলে তিনি রজতের মাকে একটা দীর্ঘ পত্র দিয়েছিলেন।
কিন্তু রজতের মা সে চিঠি পড়লেন না পর্যন্ত, খাম সমেত ছিড়ে টুকরো টুকরো করে জানলা গলিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন।
দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও বিনয়েন্দ্র চিঠির কোন জবাব পেলেন না।
আবার চিঠি দিলেন। দ্বিতীয় চিঠিও প্রথম চিঠিটার মতই অপঠিত অবস্থায় শতছিন্ন হয়ে জানলাপথে নিক্ষিপ্ত হল।
দীর্ঘ দুমাস অপেক্ষা করবার পরও যখন সেই দ্বিতীয় চিঠির কোন জবাব এল না, প্রচণ্ড অভিমানে বিনয়েন্দ্র আর ওপথ মাড়ালেন না।
তারপর আরও পাঁচটা বছর কালের বুকে মিলিয়ে গেল।
হঠাৎ একদিন বিনয়েন্দ্র সংবাদ পেলেন, রজত লাহোরে চাকরি নিয়ে তার মাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানেই বৌদির মৃত্যু হয়েছে। এবং সুজাতাও তার পরের বছর বি. এ. পাস করে লক্ষ্ণৌয়ে চাকরি নিয়ে চলে গেছে।
একজন লাহোরে, অন্যজন লক্ষ্ণৌতে।
.
০৪.
সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে রজত আর সুজাতা গঙ্গার ধারে নীলকুঠির লোহার ফটকটার সামনে এসে সাইকেল-রিকশা থেকে নেমে এবং রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গেট দিয়ে ঢুকতে যাবে এমন সময় হঠাৎ বাধা পেয়ে তাদের দাঁড়াতে হল।
দাঁড়ান।
গেটের সামনে বাধা দিয়েছিল একজন লাল-পাগড়ি-পরিহিত কনস্টেবল।
কে আপনারা, কী ব্যাপার! দুজনেই থমকে দাঁড়ায়।
কোথা থেকে আসছেন?
রজত বললে, আমার নাম রজত সান্যাল আর ইনি আমার বোন সুজাতা সান্যাল। আমি আসছি লাহোর থেকে আর আমার বোন লক্ষ্ণৌ থেকে।
ও, তা এ বাড়ির মালিক—বিনয়েন্দ্র সান্যাল।
রজত আবার বললে, আমাদের কাকা।
বিনয়েন্দ্রবাবু তাহলে—
বললাম তো আমাদের কাকা।
আপনারা তাহলে কি কিছুই জানেন না?
কিছু জানি না মানে! কি জানি না?
গেটের সামনেই ঢোকার মুখে পুলিস কর্তৃক বাধা পেয়েই মনের মধ্যে উভয়েরই একটা অজানিত আশঙ্কা জাগছিল। এখন পুলিস প্রহরীদের কথায় সে আশঙ্কাটা যেন আরও ঘনীভূত হয়।
এ বাড়ির কত কাল রাতে খুন হয়েছেন।
অ্যাঁ! কি বললে? যুগপৎ একটা অস্ফুট আর্ত চিৎকারের মতই যেন একই মুহূর্তে দুজনের কণ্ঠ হতে কথাটা উচ্চারিত হল।
সংবাদটা শুধু আকস্মিকই নয়, অভাবনীয়।
হ্যাঁ বাবু, বড় দুঃখের বিষয়। এ বাড়ির কর্তাকে কাল রাত্রে কে যেন খুন করেছে।
রজত বা সুজাতা দুজনের একজনের ওষ্ঠ দিয়েও কথা সরে না। দুজনেই বাক্যহারা, বিস্মিত, স্তম্ভিত।
ভিতরে যান, ইন্সপেক্টারবাবু আছেন।
কিন্তু কি বলছ তুমি, আমি যে কিছুই মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না। এ বাড়ির কর্তা নিহত হয়েছেন মানে? রজত কোনমতে প্রশ্নটা করে।
পুলিস প্রহরীটি মৃদু কণ্ঠে বললে, সেই জন্যই তো বাড়িটা পুলিসের প্রহরায় আছে। যান, ভিতরে যান, ভিতরে দারোগাবাবু আছেন, তাঁর কাছেই সব জানতে পারবেন।
কিন্তু পা যেন আর চলে না।
অতর্কিত একটা বৈদ্যুতিক আঘাতে যেন সমস্ত চলচ্ছক্তি ওদের লোপ পেয়ে গেছে! এই চরম দুঃসংবাদের জন্যেই কি তারা এই দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এল পত্র পাওয়া মাত্রই!
গেট পার হবার পর পায়ে-চলা একটা লাল সুরকি-ঢালা রাস্তা। শেষ হয়েছে গিয়ে সেটা প্রশস্ত একটা গাড়িবারান্দার নীচে।
গাড়িবারান্দায় উঠলেই সামনে যে হলঘরটা সেটাই বাইরের ঘর।
হলঘরের দরজাটা খোলা এবং সেই খোলা দরজা-পথে একটা আলোর ছটা বাইরের গাড়িবারান্দায় এসে পড়েছে। যন্ত্রচালিতের মতই দুজনে হলঘরটার মধ্যে খোলা দরজা-পথে গিয়ে প্রবেশ করল।
তাদের কাকা বিনয়েন্দ্রর আকস্মিক নিহত হবার সংবাদটা যেন দুজনেরই মনকে অতর্কিত আঘাতে একেবারে অবশ করে দিয়েছে। সত্যি কথা বটে দীর্ঘদিন ঐ কাকার সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্কই ছিল না। এমন কি দীর্ঘ গত দশ বছরে পরস্পরের মধ্যে কোন পত্রযোগে সংবাদের আদান-প্রদান পর্যন্ত ছিল না।
তথাপি সংবাদটা তাদের বিহ্বল করে দিয়েছে। ব্যাপারটা সঠিক কি হল, এখনও যেন তারা বুঝে উঠতে পারছে না।
হলঘরের মধ্যে প্রবেশ করে তাই তারা দুজনেই যেন থমকে দাঁড়াল।
এ বাড়িতে ইতিপূর্বে ওরা কখনও আসেনি। এই প্রথম এল। বিরাট হলঘরটি। এক পাশে চৌকির উপরে বিস্তৃত ফরাস। তার উপর এদিক-ওদিক কয়েকটা মলিন তাকিয়া পড়ে আছে।
অন্য দিকে কয়েকটা পুরাতন আমলের রচটা, ভেলভেটের গদীমোড়া মলিন ভারি কারুকার্য করা সেগুন কাঠের তৈরী কাউচ।
দেওয়ালে বড় বড় কয়েকটি অয়েল-পেন্টিং।
চোগাচাপকান পরিহিত ও মাথায় পাগড়ি-আঁটা পুরুষের প্রতিকৃতি এগুলিচক্রবর্তীদের স্বনামধন্য সব পূর্বপুরুষদেরই প্রতিকৃতি বলেই মনে হচ্ছে।
মাথার উপরে সিলিং থেকে দোদুল্যমান বেলোয়ারী কাঁচের সেকেলে ঝাড়বাতি। তবে আগে হয়তো এককালে সেই সব বাতিদানের মধ্যে জ্বলত মোমবাতি, এখন জ্বলছে মাত্র দুটি অল্পশক্তির বিদ্যুৎবাতি। যাতে করে অত বড় হলঘরটায় আলোর খাঁকতি ঘটেছে।
স্বল্প আলোয় সর্বত্র যেন একটা ছমছমে ভাব। ঘরের মধ্যে কেউ নেই।
শুধু ঘরের মধ্যে কেন, এত বড় বিরাট নীলকুঠিটার মধ্যে কেউ আছে বলেই মনে হয়। কোন পরিত্যক্ত কবরখানার মতই একটা যেন মৃত্যুশীতল স্তব্ধতা সমস্ত বাড়িটার মধ্যে চেপে বসেছে।
এ বাড়িতে রজত বা সুজাতা ইতিপূর্বে একবারও আসেনি। অপরিচিত সব কিছু। দুজনে কিছুক্ষণ হলঘরটার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আবার একসময় সামনের ভেজানো দরজাটা খুলে অন্দরের দিকে পা বাড়ায়!
লম্বা একটা দীর্ঘ টানা বারান্দা। নির্জন খাঁ-খাঁ করছে।
এখানেও একটি স্বল্প শক্তির বিদ্যুবাতির জন্য রহস্যময় একটা আলোছায়ার থমথমে ভাব। বারান্দায় প্রবেশ করে রজত একবার চারিদিকে তার চোখের দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিল। ঘরের মত সেই বারান্দাটাও শূন্য। এবং হঠাৎ তার নজরে পড়ল বারান্দার মাঝামাঝি জায়গায় অর্ধেক ভেজানো একটা দ্বারপথে ঘরের মধ্যকার একটা ক্ষীণ আলোর আভাস আসছে।
সেই ঘরের দিকেই এগুবে কিনা রজত ভাবছে, এমন সময় অল্প দূরে সামনেই দোতলায় উঠবার সিঁড়িতে ভারী জুতোর মচমচ শব্দ শোনা যেতেই উভয়েরই দৃষ্টি সেই দিকে গিয়ে নিবদ্ধ হল।
প্রশস্ত সিঁড়ি।
০৫.
সিঁড়ির খানিকটা দেখা যাচ্ছে, তারপরেই বাঁয়ে বাঁক নিয়ে উপরে উঠে গেছে বোঝা যায় সিঁড়িটা। মচমচ ভারি জুতোের শব্দটা আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নীচেই নেমে আসছে মনে হল।
আপাততঃ ওরা দুজনেই উদগ্রীব হয়ে শব্দটাকে লক্ষ্য করে ঐদিকেই তাকিয়ে থাকে। ক্রমে বারান্দায় অল্প আলোয় ওদের নজরে পড়ল দীর্ঘকায় এক পুরুষ মূর্তি।
পুরুষ মূর্তিটিই জুতোর শব্দ জাগিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন।
.
আগন্তুক দৈর্ঘ্যে প্রায় ছ ফুট হবেন।
পরিধানে মুসলমানী চোস্ত পায়জামা, গায়ে কালো সার্জের গলাবন্ধ স্কুল সরওয়ানী। পায়ে কালো ডার্বী জুতো। মুখখানি লম্বাটে ধরনের। কালো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সরু গোঁফ। মাথার চুল ঘন কুঞ্চিত, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। হাতে একটি মোটা লাঠি। লাঠিটা ডান হাতে ধরে উঁচু করে নামছিলেন ভদ্রলোক।
হঠাৎ সিঁড়ির নীচে অল্প দূরেই দণ্ডায়মান ওদের দুজনের দিকে নজর পড়তেই নামতে নামতে সিঁড়ির মাঝখানেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। এক হাতে লাঠিটা ধরে ওদের দিকে তাকালেন। চশমার লেন্সের ভিতর দিয়ে চোখের দৃষ্টিজোড়া যেন ওদের সর্বাঙ্গ লেহন করতে লাগল।
ওরাও নিঃশব্দে দণ্ডায়মান আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কোন পক্ষ থেকেই কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল এমনি। হঠাৎ এমন সময় সেই স্তব্ধটার মধ্যে একটা পুরুষের কণ্ঠস্বর পশ্চাৎ দিক থেকে শুনতে পেয়েই রজত ঘুরে ফিরে তাকাল পশ্চাতের দিকে।
এ কি! পুরন্দরবাবু, কোথায় বের হচ্ছেন?
দ্বিতীয় আগন্তুককে দেখা মাত্রই রজতের বুঝতে কষ্ট হয় না তিনি কোন পুলিসের লোক। পরিধানে চিরন্তন পুলিসের পোশাক। লংস ও হাফসাট, কাঁধে পুলিসের ব্যাজ।
হ্যাঁ। একটু বাইরে থেকে ঘুরে না এলে মারা পড়ব, মিঃ বসাক।
পুরন্দরবাবুর প্রত্যুত্তরে পুলিস অফিসার মিঃ বসাক বললেন, কিন্তু আপনাকে তো সকালবেলাতেই বলে দিয়েছিলাম, আপাততঃ investigationশেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের কারোরই কোথাও এ বাড়ি থেকে বের হওয়া চলবে না মিঃ চৌধুরী।
বেশ রুক্ষ ও কর্কশ কঠেই এবারে পুরন্দর চৌধুরী প্রত্যুত্তর দিলেন, কিন্তু কেন বলুন তো? এ আপনাদের অন্যায় জুলুম নয় কী?
অন্যায় জুলুম বলছেন?
নিশ্চয়ই। আপনাদের কি ধারণা তাহলে আমিই বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করেছি?
সে কথা তো আপনাকে আমি বলিনি।
তবে? তবে এভাবে আমাকে বাড়ির মধ্যে নজরবন্দী করে রাখবার মানেটা কী? কী উদ্দেশ্য বলতে পারেন?
উদ্দেশ্য যাই হোক, আপনাকে যেমন বলা হয়েছে তেমনি চলবেন।
আর যদি না চলি?
পুরন্দরবাবু, আপনি ছেলেমানুষ নন, জেনেশুনে আইন অমান্য করবার অপরাধে যে আপনাকে পড়তে হবে সেটা ভুলে যাবেন না।
বলেই যেন সম্পূর্ণ পুরন্দর চৌধুরীকে উপেক্ষা করে এবারে মিঃ বসাক দণ্ডায়মান রজত ও সুজাতার দিকে ফিরে তাকালেন।
বারান্দায় প্রবেশ করা মাত্রই ওদের প্রতি নজর পড়েছিল মিঃ বসাকের, কিন্তু পুরন্দর চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলবার জন্যে ওদের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলেননি বোধ হয়।
এবারে ওদের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললেন, আপনারা?
রজত সংক্ষেপে নিজের ও সুজাতার পরিচয় দিল, আমি আর সুজাতা এই এখুনি আসছি।
কিন্তু আপনারা এত তাড়াতাড়ি এলেন কি করে?
কি বলছেন আপনি মিঃ বসাক? রজত প্রশ্ন করে।
মানে আমি বলছিলাম, আজই তো বেলা দশটা নাগাদ আপনাদের দুজনকে আসবার জন্য তার করেছি।
তার করেছেন?
হ্যাঁ। এ বাড়িতে গত রাত্রে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
আমরা শুনেছি।
আপনারা শুনেছেন! শুনেছেন যে বিনয়েন্দ্রবাবু–
হ্যাঁ শুনেছি। বাইরে গেটের সামনে যে পুলিস প্রহরীটি আছে তার মুখেই শুনেছি। কিন্তু আমরা তো কাকার জরুরী চিঠি পেয়েই আসছি।
জরুরী চিঠি পেয়ে—মানে বিনয়েন্দ্রবাবুর চিঠি পেয়ে?
হ্যাঁ।
আশ্চর্য! আপনারাও কি তাহলে ওঁরই মত বিনয়েন্দ্রবাবুর চিঠি পেয়েই আসছেন নাকি? সত্যিই বিচিত্র ব্যাপার দেখছি! মিঃ বসাক বললেন।
হ্যাঁ।
যাক। তাহলে আমি একাই নয়। আপনারাও আমার দলে আছেন। কথাটা বললেন এবার পুরন্দর চৌধুরী।
সকলে আবার পুরন্দর চৌধুরীর দিকে ফিরে তাকালেন!
কই, কী চিঠি পেয়েছেন দেখি, আছে আপনাদের কাছে সে চিঠি?
হ্যাঁ।
রজতই প্রথমে তার পকেট থেকে চিঠিটা বের করে দিতে দিতে সুজাতার দিকে তাকিয়ে বললে, তোর চিঠিটা আছে তো?
হুঁ, এই যে। বলতে বলতে সুজাতাও তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা মুখছেড়া খামসমেত চিঠি বের করে মিঃ বসাকের হাতে তুলে দিল।
বারান্দার অল্প আলোতেই দুখানা চিঠি পর পর পড়লেন মিঃ বসাক। তারপর আবার মৃদু কণ্ঠে বললেন, আশ্চর্য! একই ধরনের চিঠি, একেবারে হুবহু এক।
নিন, থাকুন এবারে এখানে আমার মতই নজরবন্দী হয়ে। পুরন্দর চৌধুরী আবার কথা বললেন।
মিঃ বসাক কিন্তু পুরন্দর চৌধুরীর ওই ধরনের কথায় মুখে কোনরূপ মন্তব্য না করলেও একবার তীব্র দৃষ্টিতে পুরন্দর চৌধুরীর দিকে তাকালেন, তারপর আবার ওদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আপনাদের সঙ্গে কোন জিনিসপত্র আনেননি রজতবাবু?
বিশেষ কিছু তো সঙ্গে আনিনি, ওর একটা আর আমার একটা বেডিং ও দুজনের দুটো সুটকেস।
সেগুলো কোথায়?
বাইরে দারোয়ানের ছোট ঘরটাতেই রেখে এসেছি।
ঠিক আছে। আসুন, আপাততঃ আমার ঐ ঘরেই।
মিঃ বসাক ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন, রজত ও সুজাতা তাঁকে অনুসরণ করল এবং পুরন্দরবাবুকে কিছু না বলা সত্ত্বেও তিনিও ওদের সঙ্গে সঙ্গেই অগ্রসর হলেন।
দরজার কাছাকাছি যেতেই একজন প্রৌঢ় ব্যক্তিকে বারান্দার অপর প্রান্ত থেকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।
এই যে রামচরণ! শোন, এদিকে এস।
ঐ প্রৌঢ়ই এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য রামচরণ।
০৬-১০. রামচরণ মাত্র আঠারো বছর বয়সে
রামচরণ মাত্র আঠারো বছর বয়সে এ বাড়িতে এসে চাকরি নিয়েছিল অনাদি চক্রবর্তীর কাছে। বাড়ি তার মেদিনীপুরে। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর তার এ বাড়িতে কেটে গেছে। ষাটের উদ্ধে বর্তমানে তার বয়স হলেও একমাত্র কেশে পাক ধরা ছাড়া দেহের কোথাও বার্ধক্যের দাঁত বসেনি। বেঁটেখাটো বেশ বলিষ্ঠ গঠনের লোক। পরিধানে একটা পরিষ্কার সাদা ধুতি ও সাদা মেজাই। কাঁধে একটা পরিষ্কার ভোয়ালে।
রামচরণ মিঃ বসাকের ডাকে এগিয়ে এসে বললে, আমাকে ডাকছিলেন ইন্সপেক্টারবাবু?
হ্যাঁ। তোমার চা হল?
জল ফুটে গেছে, এখুনি নিয়ে আসছি।
এঁদের জন্যেও চা নিয়ে এস, এঁদের বোধ হয় তুমি চিনতে পারছ না?
আজ্ঞে না তো।
এঁরা তোমার কাবাবুর ভাইপো ও ভাইঝি। উপরে এঁদের থাকবার ব্যবস্থা করে দাও। আর হ্যাঁ, দেখ, বাইরে দারোয়ানের ঘরে এঁদের জিনিসপত্র আছে, সেগুলো মালীকে দিয়ে ভিতরে আনাবার ব্যবস্থা কর।
যে আজ্ঞে—
রামচরণ বোধ হয় আজ্ঞা পালনের জন্যই চলে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ সুজাতার কথায় থমকে দাঁড়াল।
সুজাতা বলছিল, কিন্তু আমি তো এখানে থাকতে পারব না ছোড়দা, আমি কলকাতায় যাব।
মিঃ বসাক ফিরে তাকালেন সুজাতার দিকে তার কথায়, কেন বলুন তো সুজাতাদেবী?
না না—আমি এখানে থাকতে পারব না, আমার যেন কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে। ছোড়া, আমি কলকাতায় যাব।
কেমন যেন ভীত শুষ্ক কণ্ঠে কথাগুলো বলে সুজাতা।
মিঃ বসাক হাসলেন, বুঝতে পারছি সুজাতাদেবী, আপনি একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই, আমিও আজকের রাত এখানেই থাকব, কলকাতায় ফিরে যাব না। তাছাড়া এই রাত্রে কলকাতায় গিয়ে সেই হোটেলেই তো উঠবেন। তার চাইতে আজকের রাতটা এখানেই কাটান না, কাল সকালে যা হয় করবেন।
হ্যাঁ। সেই ভাল সুজাতা। রজত বোঝাবার চেষ্টা করে।
না ছোড়দা, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। থাকতে হয় তুমি থাক, আমি কলকাতায় ফিরেই যাব। সুজাতা আবার প্রতিবাদ জানায়।
তা যেতে হয় যাবেনখন। আবার বললেন মিঃ বসাক।
এবার সুজাতা চুপ করেই থাকে।
কিন্তু আজকের রাতটা সত্যিই থেকে গেলে হত না সুজাতা? রজত বোঝাবার চেষ্টা করে।
না–
শোন্ একটা কথা বলে রজত সুজাতাকে একপাশে নিয়ে যায়।
কী?
তোর যাওয়াটা বোধ হয় এক্ষুনি উচিত হবে না।
কেন?
কাকার কি করে মৃত্যু হল সেটাও তো আমাদের জানা প্রয়োজন। তাছাড়া আমি রয়েছি, আরও এত পুলিসের লোক রয়েছে–ভয়টাই বা কি?
না ছোড়দা—
যেতে হয় কাল সকালেই না হয় যাস। চল–
ঐ সময় মিঃ বসাকও আবার বললেন, চলুন, ঘরে চলুন। শুধু আমরাই নয় মিস রয়, এ বাড়ি ঘিরে আট-দশজন পুলিস প্রহরীও আছে এবং সারা রাতই তারা থাকবে।
.
সকলে এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
এ ঘরের সাইজটাও নেহাত ছেট নয়। বেশ প্রশস্তই। চারিদিকে চেয়ে মনে হল ঘরটা ইদানীং খালিই পড়ে থাকত। একটা টেবিল ও এদিক-ওদিক খানকতক চেয়ার ও একটা আরাম-কেদারা ছাড়া ঘরের মধ্যে অন্য কোন আসবাবপত্রই আর নেই।
ঘরের আলোটা কম শক্তির নয়। বেশ উজ্জ্বলই। টেবিলের উপরে একটা সিগারেটের টিন, একটা দেশলাই ও একটা ফ্ল্যাট ফাইল পড়ে ছিল। মিঃ বসাক রজতের দিকে তাকিয়ে বললেন, বসুন রজতবাবু, বসুন সুজাতাদেবী। পুরন্দরবাবু বসুন।
সকলে এক-একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।
রজতই প্রথমে কথা বললে।
মিঃ বসাক তাঁর ডায়েরীতে রজতবাবু সম্পর্কে যা লিখেছিলেন তা হচ্ছে রজতবাবুর বয়স ত্রিশ-বত্রিশের মধ্যে। বেশ বলিষ্ঠ দোহারা গঠন। গায়ের রং কালো। চোখে মুখে একটা বুদ্ধির দীপ্তি আছে। এম. এ পড়তে পড়তে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে লাহোরের একটা মার্চেন্ট অফিসে তাঁর মামার সুপারিসেই চাকরি পেয়ে বছর পাঁচ আগে লাহোরে চলে যান। রজতবাবুর মামা লাহোরের সেই অফিসেই উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারী ছিলেন।
কিন্তু গত বছর দুয়েক হল রজতবাবু সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে লাহোরে আনারকলি অঞ্চলে একটা ওষুধ ও পারফিউমারীর দোকান নেন এক পাঞ্জাবী মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে আধাআধি বখরায়।
মধ্যে মধ্যে প্রায়ই ব্যবসার প্রয়োজনে কলকাতায় আসতেন বটেতবে কখনও কাকা বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেননি বা উত্তরপাড়ায় ইতিপূর্বে কখনও আসেননি।
***
আর সুজাতাদেবী! রজতবাবুর চাইতে বছর চার-পাঁচেক বয়সে ছোটই হবে। দেখতে অপরূপ সুন্দরী। সে বোধ হয় তার অপরূপ সুন্দরী পিতামহী সুরধনী দেবীর চোখ-ঝলসানো রূপের ধারাটাকে বহন করে এনেছিল। চোখে মুখে অদ্ভুত একটা শান্ত নিরীহ সরলতা যেন। সুজাতা লক্ষৌতে চাকরি করছে। বি. এ. পাস। বিবাহ করেনি।
.
০৭.
রজতই প্রথমে কথা বললে, কিন্তু কি করে কি হল কিছুই যে আমি বুঝে উঠতে পারছি না মিঃ বসাক। ছোট্রকার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কোন যোগাযোগ ছিল না সত্যি বটে, তবে তাঁকে তো ভাল করেই জানতাম। তাঁর মত অমন ধীর স্থির শান্ত চরিত্রের লোককে কেউ হত্যা করতে পারে এ যে কখনও কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না।
মিঃ বসাক মৃদু কণ্ঠে বললেন, বিশ্বাস না করতে পারলেও ব্যাপারটা যে ঘটেছে তা তো অস্বীকার করতে পারবেন না রজতবাবু। তাছাড়া দীর্ঘদিন বিনয়েন্দ্রবাবুর সঙ্গে আপনাদের কোন যোগাযোগ পর্যন্ত ছিল না। তাঁর সম্পর্কে কোন কথাও আপনারা শোনেননি।
তা অবশ্য ঠিক।
এই সময়ের মধ্যে তাঁর কোন পরিবর্তন হয়েছিল কিনা এবং এমন কোন কিছু ঘটেছিল কিনা যেজন্য এই দুর্ঘটনা ঘটল তাও তো আপনি বলতে পারেন না।
তা অবশ্য পারি না।
আচ্ছা পুরন্দরবাবু,–হঠাৎ মিঃ বসাক পাশ্বেই উপবিষ্ট পুরন্দর চৌধুরীর দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনিই তো তাঁর বিশেষ বন্ধু ছিলেন, তাঁর সম্পর্কে কোন কিছু আপনি জেনেছিলেন?
না। He was a perfect gentleman। গম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিলেন পুরন্দর চৌধুরী।
এবারে আবার মিঃ বসাক রজতের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আমি লালবাজার থেকে এসে পৌঁছবার আগেই এখানকার থানা-ইনচার্জ রামানন্দবাবু যতটা সম্ভব তদন্ত করেছিলেন। তাঁর রিপোর্ট থেকে যতটা জানতে পেরেছি, বিনয়েন্দ্রবাবু নাকি ইদানীং সাত আট বছর অত্যন্ত secluded life lead করতেন। দিবারাত্র তাঁর ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যেই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। পাড়ার কারোর সঙ্গেই তাঁর বড় একটা মেলামেশা ছিল না। আশপাশের ভদ্রলোকেরা কেউ তাঁর সম্পর্কে কোন কথা বলতে পারেননি। একজন ভদ্রলোক তো বললে, লোকটা যে বাড়িতে থাকে তাই জানবার উপায় ছিল না।
ঐ সময় রামচরণ চায়ের ট্রে হাতে ঘরে এসে প্রবেশ করল।
রজত রামচরণের দিকে তাকিয়ে মিঃ বসাককে সম্বোধন করে বললে, রামচরণ তো এ বাড়ির অনেকদিনকার পুরনো চাকর। ওকে জিজ্ঞাসা করেননি? ও হয়তো অনেক কথা বলতে পারবে।
হ্যাঁ, রামচরণের কাছে কিছু কিছু information পেয়েছি বটে তবে সেও অত্যন্ত এলোমেলো।
রামচরণ একবার রজতের মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু কোন কথা না বলে চায়ের কাপগুলো একটার পর একটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে ঘর থেকে যেমন এসেছিল তেমনি বের হয়ে গেল।
চা পান করতে করতে মিঃ বসাক আবার বলতে লাগলেন।
.
প্রথম ভোরের লোকাল ট্রেনে পুরন্দর চৌধুরী বিনয়েন্দ্রবাবুর একটা জরুরী চিঠি পেয়ে এখানে এসে পৌঁছান। পুরন্দর চৌধুরী আসছেন সিঙ্গাপুর থেকে। ভোরবেলায় তিনি প্লেনে করে কলকাতা এসে পৌঁছান এবং সোজা একেবারে ট্যাক্সিতে করে অন্য কোথায়ও না গিয়ে উত্তরপাড়ায় চলে আসেন।
ইতিপূর্বে অবশ্য পুরন্দর চৌধুরী বার তিন-চার এ বাড়িতে এসেছেন, তিনি নিজেও তা স্বীকার করেছেন এবং রামচরণও বলেছে।
পুরন্দর চৌধুরী এককালে কলেজ লাইফে বিনয়েন্দ্রর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তারপর বি.এস-সি পরীক্ষায় ফেল করে কাউকে কিছু না জানিয়ে জাহাজে খালাসীর চাকরি নিয়ে সিঙ্গাপুরে চলেযানভাগ্যান্বেষণে। এখনও সেখানেই আছেন। পুরন্দরচৌধুরী এখানে এসে নিচেরামচরণের দেখা পান। রামচরণকেই জিজ্ঞাসা করেন তার বাবু কোথায়।
রামচরণ ঐ সময় প্রভাতী চা নিয়ে বাবুর ল্যাবরেটরীর দিকেই চলেছিল। সে বলে, গত রাত থেকে বাবু ল্যাবরেটরীতেই কাজ করছেন। এখনও বের হননি।
এ রকম প্রায়ই নাকি মধ্যে মধ্যে সারাটা রাত বিনয়েন্দ্র ল্যাবরেটরীতেই কাটিয়ে দিতেন।
সকলের উপরে কঠোর নির্দেশ ছিল বিনয়েন্দ্র যতক্ষণ ল্যাবরেটরীতে থাকবেন কেউ যেন তাঁকে কোন কারণেই না বিরক্ত করে। সেইজন্যই রামচরণ সেরাত্রে তাঁকে বিরক্ত করেনি।
রামচরণের জবানবন্দি থেকেই জানা যায়, গত রাত্রে এগারোটা নাগাদ একবার নাকি ল্যাবরেটরী থেকে বের হয়েছিলেন বিনয়েন্দ্র।
সেই সময় খাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করায় বিনয়েন্দ্র বলেছিলেন, রাত্রে আর তিনি কিছু খাবেন না। এক গ্লাস দুধ যেন কেবল গরম করে আঁর শোবার ঘরে রামচরণ রেখে দেয়। প্রয়োজন হলে তাই তিনি খাবেন।
রামচরণ প্রভুর নির্দেশমত এক গ্লাস দুধ গরম করে ল্যাবরেটরী-সংলগ্ন তাঁর শয়নঘরে রেখে শুতে যায়, রাত তখন প্রায় পৌনে বারোটা।
তারপর সে নীচে এসে তার নিজের ঘরে শুতে যায়।
কেন জানি না সেদিন রাত্রি দশটার সময় রাত্রের আহার শেষ করবার পর থেকেই অত্যন্ত ঘুম পাচ্ছিল রামচরণের। অন্যান্য রাত্রে তার চোখে ঘুম আসতে আসতে সেই রাত বারোটা বেজে যায়। অত ঘুম পাচ্ছিল বলেই রামচরণ বোধ হয় বিছানায় গিয়ে শোবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে।
অন্যান্য দিন খুব সকালেই তার ঘুম ভাঙ্গে, কিন্তু গতকাল ঘুম ভাঙ্গে তার প্রায় সাড়ে সাতটায়। তাও লছমনের ডাকাডাকিতে।
লছমন এ বাড়িতে পাচকের কাজ করে। ঘুম ভেঙ্গে অত বেলা হয়ে গেছে দেখে সে একটু ভীতই হয়ে পড়ে। কেন না বাবুর খুব ভোরে চা-পানের অভ্যাস। এবং সময়মত প্রভাতী চা না পেলে গালাগালি দিয়ে তিনি ভূত ছাড়াবেন।
লছমনকে জিজ্ঞাসা করে, বাবু তাঁকে ডেকেছেন কিনা চায়ের জন্য।
লছমন বলে, না।
যা হোক তাড়াতাড়ি চা নিয়ে যখন সে উপরে চলেছে, পুরন্দর চৌধুরীর সঙ্গে সিঁড়ির সামনে তার দেখা।
সাহেব, আপনি কখন এলেন? রামচরণ জিজ্ঞাসা করে।
এই আসছি। তোমার বাবু কেমন আছেন?
ভালই। চলুন, বাবু বোধ হয় কাল রাত থেকে ল্যাবরেটরী ঘরেই আছেন।
উভয়ে উপরে এসে দেখে ল্যাবরেটরী ঘরের দরজা ঈষৎ খোলা; যেটা ইতিপূর্বে খোলা থাকতে কেউ দেখেনি। রামচরণ বেশ একটু আশ্চর্যই হয়।
রামচরণ চায়ের কাপ হাতে ল্যাবরেটরী ঘরে প্রবেশ করে, পুরন্দর চৌধুরী বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন।
রামচরণকে শুধু বলে দেন তাঁর আসার সংবাদটা বাবুকে দিতে।
সরাসরি ঢোকেন না তিনি ল্যাবরেটরীতে, কেননা সংবাদ না দিয়ে ও অনুমতি না নিয়ে যে ল্যাবরেটরী ঘরে একমাত্র রামচরণ ব্যতীত এ বাড়ির কারুর প্রবেশ করবার হুকুম ছিল না সেটা পুরন্দরের অজানা ছিল না।
বারান্দার ঘরের সামনে দোতলায় পুরন্দর চৌধুরী দাঁড়িয়েছিলেন; হঠাৎ একটা কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ ও আর্তকণ্ঠের চিৎকার তাঁর কানে এল।
কী হল?
ল্যাবরেটরীর ভিতর থেকে আবার রামচরণের চাপা আর্তস্বর শোনা গেল। এবং পুরন্দর চৌধুরী কিছু বুঝে উঠবার আগেই খোলা দরজাপথে একপ্রকার ছুটতে ছুটতেই বের হয়ে এল রামচরণ। তার সর্বাঙ্গ তখন থরথর করে কাঁপছে।
কী! কী হয়েছে রামচরণ? পুরন্দর চৌধুরী প্রশ্ন করেন।
বাবু–বাবু বোধ হয় মরে গেছেন!
.
০৮.
কি বলছ রামচরণ! বাবু মরে গেছেন কি! .
হ্যাঁ। আসুন, দেখবেন চলুন।
পুরন্দর চৌধুরী সোজা ঘরের মধ্যে ছুটে যান। প্রথমটায় তাঁর কিছুই চোখে পড়ে না। ল্যাবরেটরী ঘরের সব কটা জানলাই বন্ধ। এবং জানলার উপর সব ভারি কালো পর্দা ফেলা। সাধারণতঃ ল্যাবরেটরী ঘরে যে উজ্জ্বল হাজার পাওয়ারের বিদ্যুৎবাতি জ্বলে, তখনও ঘরে সে আলোটা জ্বলছে। আর কাজ করবার লম্বা টেবিলটা, যার উপরে নানা ধরনের বিচিত্র সব কাঁচের যন্ত্রপাতি—মাইক্রোসকোপ, বুনসেন বানার প্রভৃতি সাজানো—সেই লম্বা টেবিলটারই সামনে একটা বসবার উঁচু টুলটার পাশেই চিৎ হয়ে পড়ে আছেন বৈজ্ঞানিক বিনয়েন্দ্র সান্ন্যালের নিথর নিস্পন্দ দেহটা।
পরিধানে তখনও তাঁর পায়জামা ও গবেষণাগারের সাদা অ্যাপ্রন। ভূপতিত নিষ্কম্প দেহটা এবং তাঁর মুখের দিকে দৃষ্টিমাত্রেই বুঝতে কষ্ট হয় না যে, সে দেহে প্রাণের লেশমাত্রও আর নেই।
বহুক্ষণ পূর্বেই তাঁর দেহান্ত ঘটেছে। এবং সমস্ত মুখখানা হয়ে গেছে নীলাভ। আতঙ্কিত, বিস্ফারিত দুটি চক্ষুতারকা। ঈষৎ বিভক্ত ও প্রসারিত নীলাভ দুটি ওষ্ঠের প্রান্ত দিয়ে ক্ষীণ একটা রক্তাক্ত ফেনার ধারা গড়িয়ে নেমেছে।
দুটি হাত মুষ্টিবদ্ধ।
মৃতদেহের পাশেই তখনও পড়ে রয়েছে একটি গ্লাস-বিকার। সেই গ্লাস-বিকারের তলদেশে তখনও সাদা মত কী সামান্য খানিকটা তরল পদার্থ অবশিষ্ট পড়ে আছে।
প্রথম দর্শনেই ব্যাপারটা মনে হবে বিনয়েন্দ্র যেন কিছু খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
পুরন্দর চৌধুরীই দারোয়ান ধনবাহাদুরের হাতে চিঠি দিয়ে স্থানীয় থানায় সংবাদ প্রেরণ করেন। সংবাদ পাওয়ামাত্রই থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন চলে আসেন। নীলকুঠিতে এসে ব্যাপারটা তদন্ত করে এবং মৃতদেহ পরীক্ষা করে থানা-ইনচার্জের মনে যেন কেমন একটা খটকা লাগে। তিনি তাড়াতাড়ি থানার এ.এস.আই-কে একটা সংবাদ পাঠান, লালবাজার স্পেশাল ব্রাঞ্চে ফোন করে তখুনি ব্যাপারটা জানাবার জন্য।
মৃত্যুর ব্যাপারটা যে ঠিক সোজাসুজি আত্মহত্যা নয়, তিনটি কারণে থানা-ইনচার্জের সন্দেহ হয়েছিল। প্রথমত ঘাড়ের ঠিক নীচেই ১—১২x পরিমাণ একটি কালসিটার চিহ্ন ছিল। দ্বিতীয়ত সুদৃশ্য টেবিল-টাইম-পিষ্ট ভগ্ন অবস্থায় ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিল এবং তৃতীয়ত ল্যাবরেটারীর ঘরের দরজাটা ছিল খোলা।
ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে বেলা দশটা নাগাদ ইন্সপেক্টার মিঃ বসাক লালবাজার থেকে চলে আসেন।
থানা-ইনচার্জ তখন নীলকুঠির সমস্ত লোকদের নীচের একটা ঘরে জড়ো করে পুলিস-প্রহরায় একজন একজন করে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে জেরা করছেন।
নীলকুঠীতে লোকজনের মধ্যে এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য প্রৌঢ় রামচরণ, পাচক লছমন, বয়স তার ত্রিশ-বত্রিশের মধ্যে বছর দুই হল এখানে চাকরিতে লেগেছে। আর একজন ভৃত্য বাইরের যাবতীয় বাজার ও ফাইফরমাস খাটবার জন্য, নাম রেবতী। পূর্ববঙ্গে বাড়ি। বয়েস ত্রিশ-বত্রিশইহবে। বছর পাঁচেক হল এ বাড়িতে কাজ করছে। দারোয়ান নেপালী ধনবাহাদুর থাপা। সেও এ বাড়িতে প্রায় বছর ছয়েক আছে। আর সোফার ও ক্লীনার করালী। করালী এ বাড়িতে কাজে লেগেছে বছরখানেক মাত্র। তার আগে যে ড্রাইভার ছিল গাড়িতে অ্যাক্সিডেন্ট করে এখন হাজতবাস করছে বছর দেড়েক ধরে।
বিরাট নীলকুঠী। ত্রিতল। তিনতলায় দুখানা ঘর, দোতলায় সাতখানা ও একতলায় ছখানা ঘর। এছাড়া বাড়ির সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান। একধারে গ্যারেজ ও দারোয়ানদের থাকার ঘর।
গ্যারেজটা মস্ত বড়। এককালে সেখানে তিনটি জুড়ি গাড়ি ও চারটে ওয়েলার ঘোড়া থাকত।
অনাদি চক্রবর্তীর মৃত্যুর বছরখানেক বাদেই শেষ গাড়িখানা ও শেষ দুটি ঘোড়া বিক্রয় করে দিয়ে, সহিস ও কোচওয়ানকে তুলে দিয়ে মস্ত একটা ফোর্ড গাড়ি কিনেছিলেন বিনয়েন্দ্র।
মোটরগাড়িটা অবিশ্যি কেনা পর্যন্তই।
কারণ বেশীর ভাগ সময়েই গ্যারেজে পড়ে থাকত, কচিৎ কখনও বিনয়েন্দ্র গাড়িতে চেপে বের হতেন। ড্রাইভার বসে বসেই মোটা মাইনে পেত। বাড়ির পশ্চাৎ দিকেও মস্ত বড় বাগান, চারিদিকে তার একমানুষ সমান উঁচু লোহার রেলিং দেওয়া প্রাচীর। তারই ঠিক নীচে প্রবহমাণ জাহ্নবী। একটা বাঁধানো প্রশস্ত ঘাটও আছে চক্রবর্তীদেরই তৈরী তাদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য।
ঘাটের গায়েই একটা লোহার গেট। তবে গেটটা সদাসর্বদা বন্ধই থাকে। একদা ঐ পশ্চাৎ দিককার বাগানে অত্যন্ত সমারোহ ছিল, এখন অযত্নে ও অবহেলায় ঘন আগাছায় ভরে গেছে।
রামচরণ, রেবতী, লছমন ও করালী সকলেই খানতিনেক ঘর নিয়ে বাড়ির নীচের তলাতেই থাকে।
নীলকুঠীতে ঐ চারজন লোক থাকলেও বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল একমাত্র রামচরণেরই। অন্যান্য সকলের সঙ্গে বাবুর দেখাসাক্ষাৎ কচিৎ কখনও হত। তবে মাইনেপত্র নিয়মিত সকলে মাসের প্রথমেই বাড়ির পুরাতন সরকার প্রতুলবাবুর হাত দিয়েই পেত।
প্রতুলবাবু নীলকুঠীতে থাকতেন না। ঐ অঞ্চলেই কাছাকাছি একটা বাসা নিয়ে গত তের বৎসর ধরে পরিবার নিয়ে আছেন। অনাদি চক্রবর্তীর আমল থেকেই নাকি ঐ ব্যবস্থা বহাল ছিল। বিনয়েন্দ্র তার কোন অদলবদল করেননি তাঁর আমলেও।
প্রত্যহ সকালবেলা একবার প্রতুলবাবু নীলকুঠীতে আসতেন। বেলা দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ চলে যেতেন, তারপর আবার আসতেন গোটা পাঁচেকের সময়, যেতেন সেই রাত নটায়।
অনাদি চক্রবর্তীর আমলে অনেক কাজই প্রতুলবাবুকে করতে হত, অনেক কিছুরই দেখাশোনা করতে হত, কিন্তু বিনয়েন্দ্র আসার পর ক্রমে ক্রমে তার দায়িত্ব ও কাজগুলো নিজেই তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
গতকাল প্রতুলবাবু উত্তরপাড়ায় ছিলেন না, তাঁর এক ভাইঝির বিবাহে দিনচারেকের জন্য শ্যামনগর গিয়েছেন।
ভৃত্য, পাচক, সোফার ও দারোয়ান কাউকেই জিজ্ঞাসা করে এমন কোন কিছু জানতে : পারা যায়নি, যা বিনয়েন্দ্রর মৃত্যু-ব্যাপারে আলোকসম্পাৎ করতে পারে।
মিঃ বসাক শুধু একাই আসেন নি, তিনি আসবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন পুলিস সার্জেন ডাঃ বক্সিকেও।
থানা-ইনচার্জ রামানন্দবাবুও ওঁদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন।
চলুন। কোন্ ঘরে মৃতদেহ আছে, একবার দেখে আসা যাক।
.
০৯.
মিঃ বসাক সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, ব্যাপারটা আপনার তাহলে সুইসাইড নয়, হোমিসাইড বলেই মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ স্যার।
মাথার নীচে ঘাড়ে abbression ছাড়া অন্য কিছু কি দেখতে পেয়েছেন, যাতে করে আপনার মনে হয়েছে ব্যাপারটা হোমিসাইড?
হ্যাঁ, আরও একটা কারণ আছে স্যার।
কি?
মৃতদেহ দেখেই অবশ্য বোঝা যায়, যে, বিষই মৃত্যুর কারণ এবং মৃতদেহের পাশে যে গ্লাস-বিকারটি পাওয়া গেছে, সেটার যে অবশিষ্টাংশ তরল পদার্থ এখনও বর্তমান আছে, সেটার chemical analysis হলে হয়তো সেটাও বিষই প্রমাণিত হবে, রামানন্দবাবুবললেন।
বসাক বললেন, কিন্তু বিষই যদি তিনি খেয়ে আত্মহত্যা করবেন, তাহলে মেঝেতে শুয়ে খেলেন কেন? তারপর ঘড়িটা ভাঙা অবস্থায় বা পাওয়া গেল কেন? বরং আমার যেন সব শুনে মনে হচ্ছে তাঁকে কেউ অতর্কিতে প্রথমে পিছন দিক থেকে কোন ভারি বস্তু দিয়ে আঘাত করে, তারপর হয়তো বিষ প্রয়োগ করেছে অজ্ঞান অবস্থায়। আরও একটা কথা, ভেবে দেখেছেন কি ঘরের দরজা খোলাই ছিল! অথচ দেখা যায় আত্মহত্যার সময় সাধারণ লোক দরজা বন্ধ করেই রাখে।
থানা-অফিসার রামানন্দ সেনের কথার জবাবে মিঃ বসাক কোন সাড়া দিলেন না বা। কোনরূপ মন্তব্য করলেন না।
ল্যাবরেটরী ঘরের দরজায় থানা-অফিসার ইতিমধ্যে তালা লাগিয়ে রেখেছিলেন। চাবি তাঁর কাছেই ছিল।
ঘরের তালা খুলে সকলে গিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন।
মিঃ প্রশান্ত বসাক মাত্র বছর কয়েক পুলিস লাইনে প্রবেশ করলেও ইতিমধ্যেই তাঁর কর্মদক্ষতায় স্পেশাল ব্রাঞ্চেরইন্সপেক্টরের পদে উন্নীত হয়েছিলেন। বয়স তাঁর বত্রিশ-তেত্রিশের মধ্যে হলেও ঐ ধরনের জটিল সব কেসে অদ্ভুত ও আশ্চর্য রকমের ঘটনা বিশ্লেষণের ন্যাক ছিল তাঁর।
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সর্বাগ্রে তিনি ঘরের চতুর্দিকে একবার তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিলেন।
বসাক ভাবছিলেন তখন থানা-অফিসারের অনুমান যদি সত্যিই হয়, সত্যিই যদি ব্যাপারটা একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডই হয় তো এই ঘরের মধ্যেই সেটা গতরাত্রেই সঘটিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে হত্যাকারী কি তার কোন দুর্বল মুহূর্তে কোন চিহ্নই আর দুষ্কৃতি রেখে যায়নি! নিশ্চয়ই গিয়েছে। আজ পর্যন্ত জগতের কোথাও এমন কোন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় নি যার কিছু-না-কিছু চিহ্ন অকুস্থানে হত্যাকারীকে অনিচ্ছায় হোক বা অজ্ঞাতেই হোক ফেলে যেতে হয়েছে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে মিঃ বসাক লম্বা গবেষণার টেবিলটার সামনেই। যেখানে তখনও মৃতদেহটা ভূপতিত ছিল তার অতি নিকটে এসে দাঁড়ালেন।
মৃত্যু! তবে আত্মহত্যা, না হত্যাই সেইটাই ভাববার কথা।
মৃতের দুটি বিস্ফারিত চক্ষু–প্রাণহীন হলেও বোঝা যায় তার মধ্যে রয়েছে একট ভয়ার্ত : বিস্ময়। যেন একটা আকস্মিক জিজ্ঞাসায় সন্ত্রস্ত হয়েই সেই অবস্থাতেই থেমে গিয়েছে।
কিসের প্রশ্ন! কিসের আশঙ্কা মৃতের ঐ চোখের তারায়!
দুটি মুষ্টিবদ্ধ হাত। শেষ মুহূর্তটিতে কিছু কি আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন!
কোন আশ্রয়ের সন্ধানে বা কোন অবলম্বনের শেষ প্রচেষ্টায়! এখনও তাই হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ হয়েই আছে।
একেবারে সোজা লম্বালম্বিভাবে দেহটা চিৎ হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে।
কিন্তু কই! দেহের মধ্যে আত্মহত্যা করবার পরের শেষ ও প্রচণ্ড আক্ষেপ কোথায়! বিষ-প্রক্রিয়ায় সাধারণত যা হয়ে থাকে।
যে বিষ আচমকা দেহান্ত ঘটায়, সে বিষ আক্ষেপও দেয় পেশীতে পেশীতে প্রচণ্ড একটা।
নীচু হয়ে মৃতদেহের পাশে বসলেন মিঃ বসাক।
ঈষৎ বিস্ফারিত নীলাভ ওষ্ঠের প্রান্ত বেয়ে ক্ষীণ একটা লালা-মিশ্রিত রক্তের ধারা কালচে হয়ে জমাট বেঁধে আছে।
দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন মৃতের মুখখানি মিঃ বসাক।
দেখতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল নিচের ওষ্ঠটা যেন একটু ফোলা; ডান দিক এবং শুধু তাই নয় সেখানে একটা ক্ষতচিহ্নও আছে। যে ক্ষতচিহ্নে রক্ত একটু জমাট বেঁধে আছে এখনও।
কিসের ক্ষতচিহ্ন ঐ ওষ্ঠে? আর কেনই বা ক্ষতচিহ্ন? তবে কি? চিন্তা ও বিশ্লেষণ অতি দ্রুত মস্তিষ্কের কোষগুলির মধ্যে যেন বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মত বহে যেতে থাকে।
সঙ্গে সঙ্গে একটা সম্ভাবনা মনের মধ্যে ক্রমে ক্রমে দানা বেঁধে উঠতে থাকে বসাকের।
একবারমুখ তুলেপার্শেই দণ্ডায়মান থানা-অফিসারের দিকে তাকালেন মিঃ বসাক, ওষ্ঠপ্রান্তে তাঁর জেগে ওঠে নিঃশব্দ স্মিত হাসির একটা ক্ষীণ রেখা।
পুলিস সার্জেন ডাঃ বক্সীও ইতিমধ্যে পাশে দাঁড়িয়ে দেহটা লক্ষ্য করছিলেন। মৃতের হাতের শক্ত আঙুলগুলো এবার টেনে দেখলেন ডাঃ বক্সী।
কতক্ষণ মারা গেছে বলে আপনার মনে হয় ডাঃ বক্সী? বসাক প্রশ্ন করলেন ডাক্তারকে।
তা ঘণ্টা নয়-দশ তো হবেই। মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলেন ডাঃ বক্সী।
তাহলে রাত একটা দেড়টা নাগাদ মৃত্যু হয়েছে, এই তো?
হ্যাঁ। ঐ রকমই মনে হচ্ছে।
মৃত্যুর কারণ কী বলে মনে হচ্ছে?
মনে তো হচ্ছে a case of poisoning-ই।
অতঃপর ডাঃ বক্সী মৃতদেহটাকে উল্টে দিলেন মেঝের উপরই।
Occipital protuberence-এর ঠিক নীচেই একটি ১ X ১ ইঞ্চি পরিমাণ একিমোসিসের চিহ্ন। হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন ডাঃ বক্সী। তারপর মৃদু অনুচ্চারিত কণ্ঠে মিঃ বসাককে সম্বোধন করে বললেন, শুধু একিমোসিসই নয় মিঃ বসাক, ল্যাসারেসনও আছে। আর মনে হচ্ছে base of the skull-এর ফ্র্যাকচারও সম্ভবত আছে! আমার তো মনে হচ্ছে বেশ ভারি ও শক্ত কিছু যেমন ধরুন কোন লোহার রড জাতীয় জিনিস দিয়েই ঘাড়ে আঘাত করা হয়েছিল। এখন কথা হচ্ছে—
কী? মিঃ বসাক ডাঃ বক্সীর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।
ঐ আঘাতটাই primary cause of death, না poison-ই primary এবং আঘাতটা secondary—এইটাই এখন ভাববার বিষয়।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে থানা-অফিসার রামানন্দবাবুর অনুমানই ঠিক। পরিষ্কার এটা একটা হত্যাকাণ্ড। এবং আঘাতটা primary, আর secondary হচ্ছে poison। এখন কথা হচ্ছে হত্যাকারী প্রথমে মারাত্মক আঘাত হেনে পরে আরও sure হবার জন্য poison-এর ব্যবহার করেছিল, না হত্যা করে পরে poison দিয়েছিল ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ একটা অন্য light দেবার জন্য
মানে, বলতে চাইছেন অন্যের চোখে ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা বোঝাবার জন্য, তাই তো?
ঠিক তাই।
কিন্তু কেন আপনার সে কথা মনে হচ্ছে বলুন তো মিঃ বসাক। ডাঃ বক্সী প্রশ্ন করলেন।
চেয়ে দেখুন ভাল করে, মৃতের নীচের ওষ্ঠে ক্ষতচিহ্ন রয়েছে, এবং শুধু ক্ষতচিহ্নই নয়, জায়গাটা একটু ফুলেও আছে। তাতে করে কি মনে করতে পারি না আমরা যে, হয়তো কোন আঘাত দিয়ে অজ্ঞান করবার পর ব্যাপারটাকে আত্মহত্যার light দেবার জন্যই metal tube বা ঐ জাতীয় কোন কিছুর সাহায্য মুখের মধ্যে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যার দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে এটা pure simple case of homicide নৃশংস হত্যা, আত্মহত্যা আদৌ নয়।
এবারে ডাঃ বক্সী একটু বিশেষ দৃষ্টি দিয়েই মৃতের ওষ্ঠটা আবার পরীক্ষা করলেন, তারপর বললেন, সত্যিই তো, আপনার অনুমান হয়তো মিথ্যা নাও হতে পারে মিঃ বসাক। আমার মনে হচ্ছে, you are right। হ্যাঁ, আপনিই হয়তো ঠিক।
ভাঙা জামান টাইমপিসটা লম্বা টেবিলটার উপরেই রাখা ছিল। মিঃ বসাক ঘড়িটা হাতে তুলে নিলেন এবারে দেখবার জন্য।
ঘড়ির কাচটা ভেঙে শত চিড় খেয়ে গেলেও কাঁচের টুকরোগুলো খুলে পড়ে যায় নি। ঘড়িটা ঠিক একটা বেজে বন্ধ হয়ে আছে।
ঘড়িটা বার দুই নাড়াচাড়া করে মিঃ বসাক পুনরায় সেটা টেবিলের উপরেই রেখে দিলেন।
খুব সম্ভবত ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে রাত একটায়।
যে কোন কারণেই হোক ঘড়িটা নিশ্চয়ই ছিটকে পড়েছিল এবং যার ফলে ঘড়ির কাচটা ভেঙেছে ও ঘড়িটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
ঘড়িটা কোথায় পেয়েছেন? মিঃ বসাক থানা-অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলেন।
মেঝেতে পড়েছিল।
ভৃত্য রামচরণকে পরে জিজ্ঞাসা করে জানা গিয়েছিল ঘড়িটা ওই টেবিলটার উপরেই নাকি সর্বদা থাকত।
.
১০.
যদিচ থানা-অফিসার সকলেরই জবানবন্দি নিয়েছিলেন, তথাপি মিঃ বসাক প্রত্যেককেই আবার পৃথক পৃথকভাবে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন। বিশেষ করে একটা প্রশ্ন সকলকেই করলেন, রাত সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে কোনরূপ শব্দ বা চিৎকার শুনতে কেউ পেয়েছিল কিনা।
কিন্তু সকলেই জবাব দেয়, না। তারা কোনরূপ শব্দই শোনেনি। কারও কোন চিৎকারও শোনেনি।
সমস্ত গবেষণা-ঘরটা মিঃ বসাক চারদিক খুব ভাল করে দেখলেন অন্য কোন সূত্র অথাৎ clue পাওয়া যায় কিনা।
.
গবেষণা-ঘরটি প্রশস্ত একটি হলঘরের মতই বললে অত্যুক্তি হয় না। দরজা মাত্র দুটি; একটি বাইরের বারান্দার দিকে ও অন্যটি পাশের ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে। অতএব এই দুটি দরজা ভিন্ন ওই ঘরে যাতায়াতের আর দ্বিতীয় কোন রাস্তাই নেই।
বারান্দার দিকে তিনটি জানলা। সেগুলো বোধ হয় দীর্ঘদিন পূর্বেই একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভিতর থেকে স্কু এঁটে। অন্যদিকে যে জানলাগুলো সেগুলোতে পূর্বে খড়খড়ির পাল্লা ছিল। বিনয়েন্দ্রনাথ ঘরটিকে ল্যাবরেটরী করবার সময় সেগুলো ফেলে দিয়ে বড় বড় কাঁচের পাল্লা সেট করিয়ে নিয়েছিলেন। পাল্লাগুলো ফ্রেমের মধ্যে বসানো। তার দুটি অংশ। নীচের অংশটি ফিক্সড়, উপরের অংশটি কার উপরে ওঠানো-নামানোর ব্যবস্থা আছে কর্ডের সাহায্যে।
ঘরের ভিতর থেকে জানলার সামনে আবার ভারী কালো পর্দা টাঙানো। সেই পর্দাও কর্ডের সাহায্যে ইচ্ছামত টেনে দেওয়া বা সরিয়ে দেওয়া যায়।
মধ্যে মধ্যে গবেষণার কাজের জন্য ডার্করুমের প্রয়োজন হত বলেই হয়তো জানলায় পর্দা দিয়ে বিনয়েন্দ্রন্দ্ৰ ঐরূপ ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন।
ঘরের তিন দিকেই দেওয়াল ঘেঁষে সব লোহার র্যাক, আলমারি, রেফ্রিজ, কোল্ড স্টোরেজ। নীল কুঠী আলমারি ও র্যাকে নানাজাতীয় শিশি বোতল রং-বেরংয়ের ওষুধে সব ভর্তি। কোন কোন র্যাকে ভর্তি সব মোটা মোটা রসায়ন বিজ্ঞানের বই।
গবেষণা-ঘর নয় তো, জ্ঞানী কোন তপস্বীর জ্ঞানচর্চার পাদপীঠ।
হত্যাকারী এই মন্দিরের মধ্যেও তার মৃত্যু-বীজ ছড়িয়ে যেন এর পবিত্রতাকে কলঙ্কিত করে গেছে।
কাঁচের জানলার ওদিকে বাড়ির পশ্চাৎ দিক। জানলার সামনে এসে দাঁড়ালে পশ্চাতের বাগান ও প্রবহমান গঙ্গার গৈরিক জলরাশি চোখে পড়ে।
ঘরের দুটি দরজা। দুটিই খোলা ছিল। অতএব হত্যাকারী যে কোন একটি দরজাপথেই ঘরে প্রবেশ করতে পারে। তবে বারান্দার দরজাটা সাধারণত যখন সর্বদা বন্ধই থাকত তখন মনে হয়, বিনয়েন্দ্রর শয়নঘর ও গবেষণাঘরের মধ্যবর্তী দরজাপথেই সম্ভবত হত্যাকারী ঐ ঘরে প্রবেশ করেছিল এবং হত্যা করে যাবার সময় দ্বিতীয় দরজাটা খুলে সেই পথে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছে।
গবেষণাঘরের মেঝেটি সাদা ইটালীয়ান মার্বেল পাথরে তৈরী। মসৃণ চকচকে।
মৃতদেহের আশেপাশে মেঝেটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে করতে মিঃ বসাকের সহসা নজর পড়ে এক জায়গায়।
মেঝের উপরে খানিকটা অংশে যেন একটা হলদে ছোপ পড়ে আছে। মনে হয় যেন কিছু তরল জাতীয় রঙিন পদার্থ মেঝেতে পড়েছিল, পরে মুছে নেওয়া হয়েছে।
মেঝেটা দেখতে দেখতে হঠাৎ মিঃ বসাকের দৃষ্টি একটা ব্যাপারে আকর্ষিত হয়। মৃতের পা একেবারে খালি। বিনয়েন্দ্র কি খালিপায়েই গবেষণা করতেন।
রামচরণ একটি পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে মিঃ বসাক প্রশ্ন করলেন, রামচরণ, তোমার বাবু কোন স্যাণ্ডেল বা স্লিপার ব্যবহার করতেন না বাড়িতে?
হ্যাঁ, বাবুর পায়ে সর্বদা একটা সাদা রবারের স্লিপার তো থাকত।
কিন্তু তাহলে গেল কোথায় স্লিপার জোড়া?
সমস্ত ঘর তন্ন তন্ন করে ও পাশের শয়নঘরটি অনুসন্ধান করেও বিনয়েন্দ্রর নিত্যব্যবহৃত, রামচরণ-কথিত সাদা রবারের স্লিপার জোড়ার কোন পাত্তাই পাওয়া গেল না।
রামচরণ বিস্মিত কণ্ঠে বললে, আশ্চর্য! গেল কোথায় বাবুর স্লিপার জোড়া? বাবু তো এক মুহূর্তের জন্যও কখনও খালিপায়ে থাকতেন না।
সত্যি মৃত বিনয়েন্দ্রর পায়ের পাতা দেখে সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না।
তবে স্লিপার জোড়া দেখা গেল না। এবং বাথরুম থেকে বের হয়ে আসবার মুখে আর একটি ব্যাপারে মিঃ বসাকের দৃষ্টি পড়ল, গবেষণাগারের একটি জলের সিঙ্ক।
সিঙ্কের কলটি খোলা। কলের ভোলা মুখ দিয়ে জল ঝরে চলেছে তখনও। এবং সেই জল সিঙ্কের নির্গম পাইপ দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে।
ভাঙা টাইমপিস, ভোলা কল ও অপহৃত নিত্যব্যবহার্য স্লিপার, ঘরের দুটি দ্বারই খোলা এবং মেঝেতে কিসের একটা দাগ; এ ভিন্ন অন্য কোন কিছু দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মত মিঃ বসাকের মনে লাগল না।
মনের মধ্যে কেবলই ঐ তিনটি ব্যাপার চক্রাকারে আবর্ত রচনা করে ফিরতে লাগল মিঃ বসাকের।
ঘড়িটা ভাঙল কি করে?
স্লিপার জোড়া কোথায় গেল?
সিঙ্কের কলটা ভোলা ছিল কেন?
আর সর্বশেষে মেঝেতে ঐ দাগটা কিসের?
হত্যাকারী সম্ভবত পশ্চাৎ দিক থেকে অতর্কিতে বিনয়েন্দ্রকে আক্রমণ করেছিল। তার সঙ্গে বিনয়েন্দ্রর কোন struggle-এর সুযোগ মেলেনি।
আপাততঃমৃতদেহটা ময়নাঘরে পাঠাবার ব্যবস্থা করে মিঃ বসাক সকলকে নিয়ে নীচে নেমে এলেন।
থানা-অফিসার আবার ঘরে তালা দিয়ে দিলেন।
নীচে এসে ডাঃ বক্সী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
সমস্ত বাড়িটার চারপাশ থেকে পাহারার ব্যবস্থা করবার জন্য মিঃ বসাক থানা-অফিসারকে নির্দেশ দিলেন।
থানা-অফিসারও তখনকার মত বিদায় নিলেন।
রামচরণের নিকট হতে রজত ও সুজাতার ঠিকানা নিয়ে মিঃ বসাকই জরুরী তার করে দিলেন তাদের, তার পেয়েই চলে আসবার জন্য নির্দেশ দিয়ে।
১১-১৫. সমস্ত ঘটনাটা সংক্ষেপে বর্ণনা
সমস্ত ঘটনাটা সংক্ষেপে বর্ণনা করে গেলেন মিঃ বসাক রজত ও সুজাতার জ্ঞাতার্থে।
চা পান করতে করতেই মিঃ বসাক সমগ্র দুর্ঘটনাটা বর্ণনা করছিলেন।
উপস্থিত সকলেই চা পান করছিলেন একমাত্র সুজাতা বাদে।
সুজাতা নীলকুঠিতে পা দিয়েই তার ছোটকার মৃত্যু-সংবাদটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই যে কেমন নিচুপ হয়ে গিয়েছিল এবং মাঝখানে একবার ঐ রাত্রেই কলকাতায় ফিরে যাবার কথা ছাড়া দ্বিতীয় কোন কথাই বলেনি।
তার মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না যে, অকস্মাৎ যেন সে কেমন বিহ্বল হয়ে গিয়েছে ঘটনা-বিপর্যয়ে।
মিঃ বসাকের বর্ণনা প্রসঙ্গে রজত মধ্যে মধ্যে দু-একটা কথা বললেও সুজাতা একবারের জন্যও তার মুখ খোলেনি! চায়ের কাপটা সে মিঃ বসাকের অনুরোধে হাতে তুলে নিয়েছিল মাত্র, ওষ্ঠে কাপটা স্পর্শও করেনি।
ধূমায়িত চায়ের কাপটা ক্রমে ক্রমে একসময় ঠাণ্ডা হয়ে জুড়িয়ে গেল, সেদিকেও যেন তার লক্ষ্য ছিল না।
রামচরণ এসে ঘরে আবার প্রবেশ করল।
ট্রের উপরে শূন্য চায়ের কাপগুলো তুলে নিতে নিতে বললে, আপনারা তাহলে রাত্রে এখানেই থাকবেন তো দাদাবাবু?
প্রশ্নটা রামচরণ রজতকে করলেও তার দৃষ্টি ছিল সুজাতার মখের উপরেই নিবদ্ধ।
হ্যাঁ হ্যাঁ—এখানেই থাকবো বৈকি। তুমি সব ব্যবস্থা করে রেখো। রজত সুজাতার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে কথাগুলো বললে।
সুজাতা কোন জবাব দিল না।
উপরের তলার ঘরগুলো অনেকদিন তো ব্যবহার হয় না—
রামচরণকে বাধা দিয়ে রজত বললে, ওরই মধ্যে একটা যাহোক ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করে দাও—আজকের রাতের মত। তারপর কাল সকালে দেখা যাবে।
সেই ভাল রামচরণ। আমারে শোবার ব্যবস্থা যে ঘরে করেছ, তারই পাশের ঘর দুটোয় ওদের ভাই-বোনের থাকবার ব্যবস্থা করে দাও, মিঃ বসাক বললেন।
রামচরণ ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুজাতা ছাড়াও ঘরের মধ্যে উপস্থিত আর একজন প্রায় বলতে গেলে চুপচাপ বসেছিলেন, পুরন্দর চৌধুরী।
একটা বিচিত্র লম্বা বাঁকানো কালো পাইপে উগ্র কটুগন্ধী টোব্যাকো ভরে পুরন্দর চৌধুরী চেয়ারটার উপরে হেলান দিয়ে বসে নিঃশব্দে ধূমপান করছিলেন।
ঘরের বাতাসে টোব্যাকোর উগ্র কটু গন্ধটা ভেসে বেড়াচ্ছিল।
রামচরণ ঘর থেকে চলে যাবার পর সকলেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।
ঘরের আবহাওয়াটা যেন কেমন বিশ্রী থমথমে হয়ে উঠেছে।
ইন্সপেক্টার বসাকই আবার ঘরের স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন।
আজ দুপুরে অনেকক্ষণ ধরে ঐ রামচরণের সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলে ও নানা প্রশ্ন করে বিনয়েন্দ্রবাবুর সম্পর্কে যা জানতে পেরেছি, তার মধ্যে একটি বিশেষ ঘটনা হচ্ছে, মাস চার-পাঁচ আগে একটি তরুণী একদিন সকালবেলা নাকি বিনয়েন্দ্রবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
তরুণী! বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল রজত মিঃ বসাকের মুখের দিকে।
হ্যাঁ, তরুণীটি দেখতে নাকি বেশ সুশ্রীই ছিলেন। সাধারণ বাঙালী মেয়েদের মত দেহের গঠন নয়। বরং বেশ উঁচু লম্বাই। বয়স ছাব্বিশ-আটাশের মধ্যেই নাকি হবে।
কিন্তু কেন এসেছিলেন তিনি জানতে পেরেছেন? প্রশ্ন করে আবার রজতই।
হ্যাঁ, শুনলাম তরুণীটি এসেছিলেন দেখা করতে, বিনয়েন্দ্রবাবু কাগজে তাঁর একজন ল্যাবরেটরী-অ্যাসিস্টেস্টের প্রয়োজন বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, সেই বিজ্ঞাপন দেখে।
তারপর?
তরুণীটি এসে বিনয়েন্দ্রবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ায় রামচরণ তার বাবুকে সংবাদ দেয়।
মিঃ বসাক বলতে লাগলেন, বিনয়েন্দ্র তাঁর ল্যাবরেটরীর মধ্যে ওই সময় কাজ করছিলেন। সংবাদ পেয়ে রামচরণকে তিনি বলেন, আগন্তুক তরুণীকে তাঁর ল্যাবরেটরী ঘরেই পাঠিয়ে দিতে। তরুণী ল্যাবরেটরী ঘরে গিয়ে ঢোকেন।
ঘণ্টা দুই বাদে আবার তরুণী চলে যান। এবং সেই দিনই সন্ধ্যার সময় বিনয়েন্দ্র রামচরণকে ডেকে বলেন, যে তরুণীটি ওই দিন সকালবেলা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, আগামী পরশু সকালে আবার সে আসবে। তরুণীটির জন্য রামচরণ যেন দোতলার একটি ঘর ঠিক করে রাখে, কারণ এবার থেকে সে এ বাড়িতেই থাকবে।
তারপর রজত আবার প্রশ্ন করল, নির্দিষ্ট দিনে তরুণীটি এলেন এবং এখানে থাকতে লাগলেন? কি নাম তাঁর?
জানতে পারা যায়নি। রামচরণও তাঁর নাম বলতে পারেনি, মেমসাহেব বলেই রামচরণ তাঁকে ডাকত। তরুণী অত্যন্ত নির্বিরোধী ও স্বল্পবাক ছিলেন। অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে নাকি কারও সঙ্গেই বড় একটা কথা বলতেন না। দিনেরাত্রে বেশির ভাগ সময়ই তাঁর কাটত বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গবেষণাগারের মধ্যে। যে চার মাস এখানে তিনি ছিলেন, মাসের মধ্যে একবার কি দুবার ছাড়া তিনি কখনও একটা বাড়ির বাইরেই যেতেন না।
আর একজন নতুন লোক যে এ বাড়িতে এসেছে বাইরে থেকে কারও পক্ষে তা বোঝবারও উপায় ছিল না।
সারাটা দিন এবং প্রায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত দুজনেই যে যাঁর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এবং সে সময়টা বিশেষ কাজের এবং প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া দুজনের মধ্যে কোন কথাই নাকি হত না।
একমাত্র দুজনের মধ্যে সামান্য যা কথাবার্তা মধ্যে মধ্যে হত—সেটা ওই খাবার টেবিলে বসে।
বিনয়েন্দ্রকে নিয়ে এক টেবিলে বসেই তিনি খেতেন।
সেই সময় বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে তাঁকে কথা বলতে শুনেছে রামচরণ, কিন্তু তাও সে-সব কথাবার্তার কিছুই প্রায় সে বুঝতে পারেনি, কারণ খাওয়ার টেবিলে বসে যা কিছু আলাপ তাঁর বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে চলত তা সাধারণত ইংরেজীতেই হত।
এমনি করে চলছিল, তারপর হঠাৎ একদিন আবার যেমন তরুণীর ঐ গৃহে আবির্ভাব ঘটেছিল তেমনি হঠাৎই একদিন আবার তরুণী যেন কোথায় চলে গেলেন।
নিয়মিত খুব ভোরে গিয়ে রামচরণ তরুণীকে তাঁর প্রভাতী চা দিয়ে আসত, একদিন সকালবেলা তাঁর প্রাত্যহিক প্রভাতী চা দিতে গিয়ে রামচরণ তাঁর ঘরে আর তাঁকে দেখতে পেল না।
একটি মাত্র বড় সুটকেস কেবল যা সঙ্গে এনেছিলেন তিনি, সেইটিই ডালা-খোলা অবস্থায় ঘরের একপাশে পড়ে ছিল।
রামচরণ প্রথমে ভেবেছিল, তিনি বোধ হয় ল্যাবরেটরী ঘরেই গেছেন কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে বিনয়েন্দ্র অ্যাপ্রন গায়ে একা-একাই কাজ করছেন।
সকালবেলার পরে দ্বিপ্রহরেও খাওয়ার টেবিলে তাঁকে না দেখে রামচরণ বিনয়েন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করে, মেমসাহেবকে দেখছি না বাবু? তিনি খাবেন না?
না।
আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে রামচরণেরও যেমন সাহস হয়নি, বিনয়েন্দ্রও আর তাকে সেই তরুণী সম্পর্কে দ্বিতীয় কোন কথা বলেননি নিজে থেকে।
তবে তরুণীকে আর তারপর এ বাড়িতে রামচরণ দেখেনি।
চার মাস আগে অকস্মাৎ একদিন যেমন তিনি এসেছিলেন, চার মাস বাদে অকস্মাৎই তেমনি আবার যেন উধাও হয়ে গেলেন।
কোথা থেকেই বা এসেছিলেন আর কোথায়ই বা চলে গেলেন কে জানে!
রামচরণ তাঁকে আবার দেখলে হয়তো চিনতে পারবে, তবে তাঁর নাম-ধাম কিছুই জানে না।
তরুণী চলে যান আজ থেকে ঠিক দশ দিন আগে।
এই একটি সংবাদ। এবং দ্বিতীয় সংবাদটি ওই তরুণী ছাড়াও আর একজন পুরুষ আগন্তুক বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে গত এক বছরের মধ্যে বার দুই দেখা করেছেন।
আগন্তুক সম্ভবত একজন ইউ.পি.বাসী।
লম্বা-চওড়া চেহারা, মুখে নূর দাড়ি, চোখে কালো কাঁচের চশমা ছিল আগন্তুকের। এবং পরিধানে ছিল কেনা পায়জামা, সেরওয়ানী ও মাথায় গান্ধী-টুপি।
তিনি নাকি প্রথমবার এসে বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে তাঁর ল্যাবরেটরী ঘরে বসে আধঘণ্টাটাক আলাপ করে চলে যান।
দ্বিতীয়বার তিনি আসেন দুর্ঘটনার মাস চারেকের কিছু আগে।
তৃতীয় সংবাদ যা ইন্সপেক্টার সংগ্রহ করেছেন রামচরণের কাছ থেকে তা এই: পুরন্দর চৌধুরী গত দু-বছর থেকে মধ্যে মধ্যে চার-পাঁচ মাস অন্তর অন্তর বার পাঁচেক নাকি এবাড়িতে এসেছেন। এবং রামচরণ তাঁকে চেনেন। পুরন্দর চৌধুরী এখানে এলে নাকি দু-পাঁচদিন থাকতেন।
চতুর্থ সংবাদটি হচ্ছে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এবং শুধু উল্লেখযোগ্যই নয়, একটু রহস্যপূর্ণও।
গত দেড় বছর ধরে ঠিক দু মাস অন্তর অন্তর সিঙ্গাপুর থেকে বিনয়েন্দ্রর নামে একটি করে নাকি রেজিস্টার্ড পার্শেল আসত।
পার্সেলের মধ্যে কি যে আসত তা রামচরণ বলতে পারে না। কারণ পার্সেলটি আসবার সঙ্গে সঙ্গেই রসিদে সই করেই বিনয়েন্দ্র পার্সেলটি নিয়েই ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করতেন। কখনও তিনি রামচরণের সামনে পার্সেলটি খোলেন নি।
এবং একটা ব্যাপার রামচরণ লক্ষ্য করেছিল, পার্সেলটি আসবার সময় হয়ে এলেই বিনয়েন্দ্র যেন কেমন বিশেষ রকম একটু চঞ্চল ও অস্থির হয়ে উঠতেন। বার বার সকালবেলা পিওন আসবার সময়টিতে একবার ঘর একবার বারান্দা করতেন।
যদি কখনও দু-একদিন পার্সেলটি আসতে দেরি হত, বিনয়েন্দ্রর মেজাজ ও ব্যবহার যেন কেমন খিটখিটে হয়ে উঠত। আবার পার্সেলটি এসে গেলেই ঠাণ্ডা হয়ে যেতেন।
শান্ত ধীর যেমন তাঁর স্বভাব।
ছোট একটি চৌকো বাক্সে পার্সেলটি আসত।
সিঙ্গাপুর থেকে যে পার্সেলটি আসত রামচরণ তা জেনেছিল একদিন বাবুর কথাতেই, কিন্তু জানত না কে পাঠাত পার্সেলটি এবং পার্সেলটির মধ্যে কি থাকতই বা।
.
১২.
দরজার বাইরে এমন সময় জুতোর আওয়াজ পাওয়া গেল।
কেউ আসছে এ ঘরের দিকে। ইন্সপেক্টার বসাক চোখ তুলে খোলা দরজাটার দিকে তাকালেন।
ভিতরে আসতে পারি স্যার? বাইরে থেকে ভারী পুরুষ-কণ্ঠে প্রশ্ন এল।
কে, সীতেশ? এস এস—
চব্বিশ-পঁচিশ বৎসর বয়স্ক একটি যুবক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। পরিধানে তার ক্যালকাটা পুলিশের সাদা ইউনিফর্ম।
কি খবর সীতেশ?
জামার পকেট থেকে একটি মুখ আঁটা অন হিজ ম্যাজেস্টিস সার্ভিস ছাপ দেওয়া লম্বা খাম বের করে এগিয়ে দিতে দিতে বললে, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট স্যার।
আগ্রহের সঙ্গে খামটা হাতে নিয়ে ইন্সপেক্টার বসাক বললেন, থ্যাঙ্কস্। আচ্ছা তুমি যেতে পার সীতেশ।
সার্জেন্ট সীতেশ ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ইন্সপেক্টার বসাক খামটা ছিড়ে রিপোর্টটা বের করলেন।
.
বিনয়েন্দ্রর মৃতদেহের ময়না তদন্তের রিপোর্ট।
ডাঃ বক্সীই ময়না তদন্ত করেছেন নিজে।
দেখলেন মৃতদেহে বিষই পাওয়া গেছে, তবে সে সাধারণ কোন কেমিকেল বিষ নয়, মেক-ভেন। সর্প-বিষ!
বিষপ্রয়োগেও যে বিনয়েন্দ্রকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল সেটা ইন্সপেক্টার বসাক সকালে মৃতদেহ পরীক্ষা করতে গিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন।
কিন্তু বুঝতে পারেননি সেটা সর্প-বিষ হতে পারে। ঘাড়ের নিচে যেরক্ত জমার (একিমোসি) চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল মৃতদেহে, সেটাও কোন ভারি বস্তুর দ্বারা আঘাতই প্রমাণ করছে। এবং শুধু রক্ত জমাই নয়, base of the skull-এ ফ্র্যাকচারও পাওয়া গিয়েছে। সে আঘাতে মৃত্যুও ঘটতে পারত।
এদিকে দেহে সর্প-বিষ প্রয়োগের চিহ্নও যথেষ্ট পাওয়া গিয়েছে।
মৃত্যুর কারণ তাই ওই সর্প-বিষ বা আঘাতের যে কোন একটিই হতে পারে।
অথবা একসঙ্গে দুটিই হতে পারে। ডাঃ বক্সীর অন্তত তাই ধারণা। কাজেই বলা শক্ত, এক্ষেত্রে উক্ত দুটি কারণের কোটি প্রথম এবং কোনটি দ্বিতীয়।
তবে এ থেকে আরও একটি সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, ব্যাপারটি আদৌ আত্মহত্যা নয়, নিষ্ঠুর হত্যা।
ময়না তদন্তে কি পাওয়া গেল মিঃ বসাক? প্রশ্ন করে রজতই।
ইন্সপেক্টার ময়না তদন্তের রিপোর্টটা সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললেন।
সে কি! স্নেক-ভেন! সর্প-বিষ! বিস্মিত কণ্ঠে রজত বলে।
হ্যাঁ।
কিন্তু সর্প-বিষ কাকার শরীরে এল কি করে? তবে কি সর্পদংশনেই তাঁর মৃত্যু হল?
সম্ভবত না, গম্ভীর শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন ইন্সপেক্টার।
সর্প-দংশন নয়?
না।
তবে সর্প-বিষ তাঁর দেহে এল কোথা থেকে?
সেটাই তো বর্তমান রহস্য।
কিন্তু সর্প-দংশন যে নয় বুঝলেন কি করে?
কারণ সর্প-দংশনে মৃত্যু হলে প্রথমত বিনয়েন্দ্রবাবুর শরীরের কোথাও না কোথাও সর্পদংশনের চিহ্ন নিশ্চয়ই পাওয়া যেত, এবং দ্বিতীয়ত কাউকে আচমকা সর্প-দংশন করলে তার পক্ষে নিঃশব্দে ওইভাবে মরে থাকা সম্ভবপর হত না। শুধু তাই নয়, সর্পদংশনেই যদি মৃত্যু হবে তবে মৃতের ঘাড়ের নীচে সেই কালসিটার দাগ অর্থাৎ একটা শক্ত আঘাতের চিহ্ন এল কোথা থেকে? নিজে নিজে তিনি নিশ্চয়ই ঘাড়ে আঘাত করেননি বা পড়ে গিয়েও ওইভাবে আঘাত পাননি! পেতে পারেন না।
তবে?
মৃতের ঘাড়ের ও ঠোঁটের ক্ষতচিহ্ন দেখে আমার যতদূর মনে হচ্ছে রজতবাবু, হত্যাকারী হয়তো তাঁকে অতর্কিতে আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলে, পরে মুখ দিয়ে সর্পবিষ কোন নল বা ওই জাতীয় কিছুর সাহায্যে তাঁর শরীরের মধ্যে প্রয়োগ করেছিল।
তাহলে আপনি স্থিরনিশ্চিত যে ব্যাপারটা হত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়?
হ্যাঁ। Clean murder। নৃশংস হত্যা।
Clean murder তাই বা অমন জোর গলায় আপনি বলছেন কি করে ইন্সপেক্টার?
এতক্ষণে এই প্রথম পুরন্দর চৌধুরী পাইপটা মুখ থেকে সরিয়ে কথা বললেন।
সকলে যুগপৎ পুরন্দর চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল।
কি বলছেন মিঃ চৌধুরী? ইন্সপেক্টার বসাক প্রশ্ন করলেন।
বলছিলাম আপনার পোেস্ট মর্টে রিপোর্টের ওই findings টুকুই কি আপনার ওই ধরনের উক্তির অবিসংবাদী প্রফ? ব্যাপারটা তত আগাগোড়া pure and simple একটা accidentও হতে পারে?
পুরন্দর চৌধুরীর দ্বিতীয়বারের কথাগুলো শুনেই সঙ্গে সঙ্গে ইন্সপেক্টার বসাক জবাব দিতে পারলেন না, তাঁর মুখের দিকে কিছুক্ষণের জন্য তাকিয়ে রইলেন।
পুরন্দর চৌধুরীও ইন্সপেক্টার বসাকের দিকেই তাকিয়েছিলেন। পুরন্দর চৌধুরীর চোখের উপরের ও নীচের পাতা দুটো যেন একটু কুঁচকে আছে, তথাপি সেই কোঁচকানো চোখের ফাঁক দিয়ে যে দৃষ্টিটা তাঁর প্রতি স্থিরনিবদ্ধ তার মধ্যে যেন সুস্পষ্ট একটা চ্যালেঞ্জের আহ্বান আছে বলে বসাকের মনে হয় ঐ মুহূর্তে।
কয়েকটা মুহূর্ত একটা গুমোট স্তব্ধতার মধ্যে কেটে গেল।
হঠাৎ ইন্সপেক্টারের ওষ্ঠপ্রান্তে ক্ষীণ একটা বঙ্কিম হাসির রেখা জেগে উঠল। এবং তিনি মৃদুকণ্ঠে বললেন, না মিঃ চৌধুরী, আপনার সঙ্গে আমি ঠিক একমত হতে পারছি না। ঘাড়ের নীচে একটা বেশ জোরালো আঘাত ও সেই সঙ্গে সর্পবিষ ব্যাপারটাকে ঠিক আকস্মিক একটা দুর্ঘটনার পর্যায়ে ফেলতে পারছি না।
কেন বলুন তো?
আমার position-এ আপনি থাকলেও কি তাই বলতেন না মিঃ চৌধুরী? ধরুন না যদি ব্যাপারটা আপনি যেমন বলছেন simple একটা accident-ই হয়, আঘাতটা ঠিক ঘাড়ের নীচেই লাগল—শরীরের আর কোথায়ও আঘাত এতটুকু লাগল না, তা কেমন করে হবে বলুন? তারপর সর্পবিষের ব্যাপারটা-সেটাই বা accident-এর সঙ্গে খাপ খাওয়াচ্ছেন কি করে?
সেটা সর্প-দংশনও হতে পারে। সর্পদংশনের জায়গাটা হয়তো আপনাদের ময়না তদন্তে এড়িয়ে গিয়েছে। তদন্তের সময় ডাক্তারের চোখে পড়েনি।
তারপর একটু থেমে বলেন, এবং সেটা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। সাপ দংশন করলেও তো এমন একটা বড় রকমের কিছু তার দন্ত-দংশন চিহ্ন রেখে যাবে না যেটা সহজেই নজরে পড়তে পারে!
মৃদু হেসে ইন্সপেক্টার বসাক আবার বললেন, আপনার কথাটা হয়তো ঠিক, এবং যুক্তি যে একবারেই নেই তাও বলছি না। কিন্তু কথা হচ্ছে একটা লোককে সাপে দংশন করল অথচ বাড়ির কেউ তা জানতেও পারলে না তাই বা কেমন করে সম্ভব বলুন?
রামচরণ এমন সময় আবার এসে ঘরে প্রবেশ করল, রান্না হয়ে গেছে। টেবিলে কি খাবার দেওয়া হবে?
ইন্সপেক্টার বসাক বললেন, হ্যাঁ, দিতে বল।
.
দোতলার একটি ঘরই বিনয়েন্দ্র ডাইনিং রুম হিসাবে ব্যবহার করতেন।
রামচরণ সকলকে সেই ঘরে নিয়ে এল।
মাঝারি গোছের ঘরটি।
ঘরের মাঝখানে লম্বা একটি ডাইনিং টেবিল; তার উপরে ধবধবে একটি চাদর পেতে দেওয়া হয়েছে। মাথার উপরে সিলিং থেকে ঝুলন্ত সুদৃশ্য ডিম্বাকৃতি সাদা ডোমের মধ্যে উজ্জ্বল বিদ্যুৎবাতি জ্বলছে। ঘরের একধারে একটি ফ্রিজ, তার উপরে বসানোে একটা সুদৃশ্য টাইমপিস। ঘড়িটা দশটা বেজে বন্ধ হয়ে আছে।
টেবিলের দু পাশে গদি-মোড়া সুদৃশ্য সব আরামদায়ক চেয়ার।
টেবিলের একদিকে বসলেন ইন্সপেক্টার বসাক ও পুরন্দর স্টেধুরী, অন্যদিকে বসল রজত ও সুজাতা।
পাচক কাঁচের প্লেটে করে পরিবেশন করে গেল আহার্য।
কিন্তু আহারে বসে দেখা গেল, কারোরই আহারে যেন তেমন একটা উৎসাহ বা রুচি নেই। খেতে হবে তাই যেন সব খেয়ে চলেছে।
বিশেষ করে সুজাতা যেন একেবারেই কোন খাওয়ার স্পৃহা বোধ করছিল না।
ঘটনার আকস্মিকতায় সে যেন কেমন বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। বার বার তার কাকা বিনয়েন্দ্রর কথাটা ও তাঁর মুখখানাই যেন মনের পাতায় ভেসে উঠছিল।
বছর দশেক হবে তার কাকার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। তাদের ছেড়ে কাকার অকস্মাৎ এখানে চলে আসাটা তার জেঠিমা ও দাদা রজত কাকার কর্তব্যের মস্ত বড় একটা ক্ৰটি বলেই কোনদিন যেন ক্ষমা করতে পারেননি।
কিন্তু সুজাতা কাকার চলে আসা ও এখানে থেকে যাওয়াটা তত বড় একটা ক্রটি বলে মনে করতে পারেনি কোনদিনই।
কারণ কাকা বিনয়েন্দ্রর সে ছিল অশেষ স্নেহের পাত্রী।
অনেক সময় কাকার সঙ্গে তার অনেক মনের কথা হত। কাকা ও ভাইঝিতে পরস্পরের ভবিষ্যৎ ও কর্মজীবন নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনা হত। কাকার মনের মধ্যে ছিল সত্যিকারের জ্ঞানলিষ্ণু বিজ্ঞানী মানুষ। সে মানুষটা ছিল যেমনি সহজ তেমনি শিশুর মত সরল।
কোনপ্রকার ঘোরপ্যাঁচই তাঁর মনের কোথাও ছিল না।
এ কথা সাদা কাগজের পৃষ্ঠার মত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
কাকা ভাইঝিতে কতদিন আলোচনা হয়েছে, যদি বিনয়েন্দ্রর প্রচুর টাকা থাকত তবে সে কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে তৈরী করত একটি মনের মত ল্যাবরেটরী-গবেষণাগার। দিনরাত সেই গবেষণাগারের মধ্যে বসে সে তার আপন ইচ্ছা ও খুশিমত গবেষণা করে যেত। কোন ঝামেলা নেই, সংসারের কোন দুশ্চিন্তা নেই। নেই কোন দায়িত্ব।
কাকার কথায় হাসতে হাসতে সুজাতা বলত, এক কাজ কর না কেন ছোটকা, লটারির টিকিট একটা একটা করে কিনতে থাক। হঠাৎ যদি ভাগ্যে একটা মোটা টাকা পেয়ে যাও তো আর কোন অভাবই থাকবে না। দিব্যি মনের খুশিতে মনোমত এক গবেষণাগার তৈরী করে দিনরাত বসে বসে গবেষণা চালাতে পারবে তখন।
হেসে বিনয়েন্দ্র জবাব দিয়েছেন, ঠাট্টা নয় রে সুজাতা, এক মস্ত বড় জ্যোতিষী আমার হস্তরেখা বিচার করে বলেছে হঠাৎই আমার নাকি ধনপ্রাপ্তি হবে একদিন।
তবে আর কি! তবে তো নির্ভাবনায় লটারির টিকিট কিনতে শুরু করতে পার ছোটকা।
না। লটারিতে আমার বিশ্বাস নেই।
তবে আর হঠাৎ ধনপ্রাপ্তি হবে কি করে?
কেন, অন্য ভাবেও তো হতে পারে।
হ্যাঁ–হতে পারে যদি তোমার দাদামশাই তোমাকে তার বিষয়সম্পত্তি মরবার আগে দিয়ে যান।
সে গুড়ে বালি।
কেন?
আমাদের ওপরে দাদামশাইয়ের যে কি প্রচণ্ড আক্রোশ আর ঘৃণা তা তো তুই জানিস না।
সে আর সকলের যার ওপরেই থাক তোমার ওপরে তো ছোটবেলায় বুড়ো খুব খুশিই ছিল।
সে তো অতীত কাহিনী। সেখান থেকে চলে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই সে স্নেহ সব উবে গেছে কবে, তার কি আর কিছু অবশিষ্ট আছে রে?
তাহলে তো কটা বছর তোমার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায়ই দেখছি না ছোটকা।
কী রকম?
চাকরিবাকরি করি আমি, তারপর মাসে মাসে তোমাকে টাকা দিতে শুরু করব, তুমি সেই টাকা জমিয়ে ল্যাবরেটরী তৈরী করবে।
তা হলেই হয়েছে। ততদিনে চুলে পাক ধরবে, মাথার ঘিলু আসবে শুকিয়ে; তাছাড়া তোকে চাকরি করতে আমি দেবই বা কেন? চমৎকার একটা ছেলে দেখে তোর বিয়ে দেব, তারপর বুড়ো বয়েসে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তোর বাড়িতে তোর ছেলেমেয়েদের নিয়ে—
খিলখিল করে হেসে উঠেছে সুজাতা।
হাসছিস যে?
তা কি করব বল? বিয়েই আমি করব না ঠিক করেছি।
মেয়েছেলে বিয়ে করবি না কি রে?
কেন, ছেলে হয়ে তুমি যদি বিয়ে না করে থাকতে পার তো মেয়ে হয়ে আমিই বা বিয়ে না করে কেন থাকতে পারব না?
দূর পাগলী! বিয়ে তোকে করতে হবে বৈকি।
না ছোটকা, বিয়ে আমি কিছুতেই করতে পারব না।
কেন রে?
বিয়ে করলে তোমার বুড়ো বয়সে তোমাকে দেখবে কে?
কেন, বিয়ে হলেও তো আমাকে দেখাশুনা করতে পারবি।
না কাকামণি, তা হয় না। বিয়ে হয়ে গেলে স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা আর থাকে না।
সেই ছোট্রকা যখন হঠাৎ একদিন কলেজ থেকেই সেই যে তাদের কাউকে কোন কিছু না জানিয়ে চলে গেল তার দাদামশাইয়ের ওখানে এবং আর ফিরে এল না, সুজাতার অভিমানই হয়েছিল খুব বেশি তার ছোট্কার উপরে।
তার জেঠিমার মত অভিমানমিশ্রিত আক্রোশ বা দাদার মত শুধু আক্রোশই হয়নি।
সে তার ছোটকার মনের কথা জানত বলেই ভেবেছিল, ছোটকার এতদিনকার মনের সাধটা বোধ হয় মিটতে চলেছে, তাই আপাতত ছোট্কা কটা দিন দূরে থাকতে বাধ্য হয়েছেন মাত্র।
তাদের পরস্পরের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়নি। হবেও না কোনদিন।
ফলত সুজাতা যেমন তার জেঠিমাকে লেখা বিনয়েন্দ্রর দুখানা চিঠির কথা ঘুণাক্ষরেও জানত না তেমনি এও জানতে পারেনি যে, কী কঠোর শর্তে বিনয়েন্দ্রর দাদামশাই তার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি বিনয়েন্দ্রকে একা দান করে গেছেন।
তারপর পাস করার পরেই লক্ষ্ণৌয়ে চাকরি পেয়ে সুজাতা চলে গেল। ছোট্কার সঙ্গে তার দেখাসাক্ষাৎ বা পত্র মারফৎ কোনরূপ যোগাযোগ না থাকলেও ছোট্রকাকে সে একটি দিনের জন্যও ভুলতে পারেনি বা তাঁর কথা না মনে করে থাকতে পারেনি।
এমনকি ইদানীং কিছুদিন থেকেই সে ভাবছিল, এবারে ছোট্রকাকে ও একটা চিঠি দেবে। কিন্তু নানা কাজের ঝাটে সময় করে উঠতে পারছিল না। ঠিক এমনি সময়ে বিনয়েন্দ্রর জরুরী চিঠিটা হাতে এল। একটা মুহূর্তও আর সুজাতা দেরি করল না। চিঠি পাওয়া মাত্রই ছুটি নিয়ে সে রওনা হয়ে পড়ল।
এখানে পৌঁছেই অকস্মাৎ ছোট্কার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তাই বোধ হয় সব চাইতে বেশী আঘাত পেল সুজাতা।
নেই! তার ছোট্কা আর নেই!
অতদূর থেকে এতদিন অদর্শনের পর তীব্র একটা দর্শনাকাঙ্খা নিয়ে এসেও ছোটকার সঙ্গে তার দেখা হল না। শুধু যে দেখাই হল না তাই নয়, এ জীবনে আর কখনো তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে না।
মৃত্যু! নিষ্ঠুর মৃত্যু চিরদিনের মতই তার ছোট্রকাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে তাদের নাগালের বাইরে।
নিরুপায় কান্নায় বুকের ভিতরটা সুজাতার গুমরে গুমরে উঠছিল অথচ চোখে তার এক ফোঁটা জলও নেই।
সে কাঁদতে চাইছে, অথচ কাঁদতে পারছে না।
সমস্ত ব্যাপারটা যেন এখনো কেমন অবিশ্বাস্য বলেই মনে হচ্ছে। তার ছোট্কাকে কেউ নাকি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। অমন শান্ত সরল স্নেহময় লোকটিকে কে হত্যা করল! আর কেনই বা হত্যা করল! কেউ তো ছোটকার এমন শত্রু ছিল না!
কি নিষ্ঠুর হত্যা! সর্পবিষ প্রয়োগে হত্যা! রামচরণের নিকট হতে সংগৃহীত ইন্সপেক্টার বসাকের মুখে শোনা ক্ষণপূর্বের সেই কাহিনীটাই মনে মনে সুজাতা বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করছিল।
কে সেই রহস্যময় তরুণী!
কোথা থেকে এসেছিল সে বিনয়েন্দ্রর কাছে! আর হঠাৎই বা কেন সে কাকামণির মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে অমন করে চলে গেল!
ছোট্কার এই নিষ্ঠুর হত্যা-ব্যাপারের মধ্যে তার কোন হাত নেই তো!
.
১৩.
হঠাৎ ইন্সপেক্টার বসাকের প্রশ্নে সুজাতার চমক ভাঙল, সুজাতাদেবী, আপনি তো কিছুই খেলেন না?
একেবারেই ক্ষিধে নেই।
ইন্সপেক্টার বসাক বুঝতে পারেন, একে দীর্ঘ ট্রেন-জানি, তার উপর এই আকস্মিক দুঃসংবাদ, নারীর মন স্বভাবতই হয়তো মুষড়ে পড়েছে।
কিছু আর বললেন না ইন্সপেক্টার।
আহারপর্ব সমাপ্ত হয়েছিল। সকলে উঠে পড়লেন।
রামচরণ ইতিমধ্যেই সকলের শয়নের ব্যবস্থা করে রেখেছিল।
দোতলায় চারটি ঘরের একটি ঘরে পুরন্দর চৌধুরীর, একটি ঘরে রজতের, একটি ঘরে সুজাতার ও অন্য একটি ঘরে ইন্সপেক্টার বসাকের।
সকলেই শ্রান্ত। তাছাড়া রাত অনেক হয়েছিল। একে একে তাই সকলেই আহারের পর যে যার নির্দিষ্ট শয়নঘরে গিয়ে প্রবেশ করল।
নীলকুঠীর আশেপাশে একমাত্র, বামপাশে প্রায় লাগোয়া দোতলা একটি বাড়ি ছাড়া অন্য কোন বাড়ি নেই।
ডানদিকে অপ্রশস্ত একটি গলিপথ, তারপর একটা চুন-সুরকির আড়ৎ। তার ওদিকে আবার বাড়ি।
নিজের নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে বাগানের দিককার জানলাটা খুলে বসাক জানলার সামনে এসে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে সিগারেট-কেসটা বের করে, কেস থেকে একটা সিগারেট নিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করলেন।
মিঃ বসাক খুব বেশি ধূমপান করেন না। রাত্রে দিনে হয়তো চার-পাঁচটার বেশি সিগারেট নয়।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা হবে।
ক্ষীণ একফালি চাঁদ আকাশে উঠেছে। তারই ক্ষীণ আলো বাগানের গাছপালায় যেন একটা ধূসর চাদর টেনে দিয়েছে। গঙ্গায় বোধ হয় এখন জোয়ার। বাগানের সামনে ঘাটের সিঁড়ির শেষ ধাপ পর্যন্ত নিশ্চয়ই স্ফীত জলরাশি উঠে এসেছে।
কলকল ছলছল শব্দ কানে আসে।
গঙ্গার ওপারে মিলের আলোকমালা অন্ধকার আকাশপটে যেন সাতনরী হারের মত দোলে।
বিনয়েন্দ্রর হত্যার ব্যাপারটাই মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল তখন বসাকের। আসলে মৃত্যুর কারণ কোন্টা। ঘাড়ের নীচে আঘাত, না সর্পবিষ! দুটি কারণের যে কোন একটিই পৃথক পৃথকভাবে মৃত্যু ঘটিয়ে থাকতে পারে। আবার দুটি একত্রেও মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আর চোখে যা দেখা গেছে ও হাতের কাছে যে-সব প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে তাতে মনে হয় ঘাড়ে কোন ভারি শক্ত বস্তু দিয়ে আঘাত করাতেই বিনয়েন্দ্র অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল, তারপর সেই অবস্থাতেই সম্ভবত বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে তাকে।
আরও কতকগুলো ব্যাপার যার কোন সঠিক উত্তর যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিনয়েন্দ্রর সর্বদা ব্যবহৃত সাদা রবারের চপ্পলজোড়া কোথায় গেল? ঘড়িটা ভাঙা অবস্থাতেই ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিল কেন?
ল্যাবরেটরী ঘরের দরজাটি খোলা ছিল কেন?
যে তরুণী মহিলাটি বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে কাজ করতে এসেছিল, মাস চারেক কাজ করবার পর হঠাৎই বা সে কাউকে কোন কিছু না জানিয়ে বিনয়েন্দ্রর নিহত হবার দিন দশেক আগে চলে গেল কেন?
যে নূর দাড়ি, চোখে চশমা—সম্ভবত ইউ.পি. হতে আগত ভদ্রলোকটি দুবার বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, তিনিই বা কে?
কি তাঁর পরিচয়?
সিঙ্গাপুর থেকে যে পার্সেলটি নিয়মিত বিনয়েন্দ্রর কাছে আসত তার মধ্যেই বা কি থাকত? আর কে-ই বা পাঠাত পার্সেলটি?
হঠাৎ চকিতে একটা কথা মনের মধ্যে উদয় হয়।
পুরন্দর চৌধুরী!
পুরন্দর চৌধুরী সিঙ্গাপুরেই থাকেন। এবং সেখান থেকেই বিনয়েন্দ্রর চিঠি পেয়ে এসেছেন। পুরন্দর চৌধুরী বিনয়েন্দ্রর বিশেষ বন্ধু ছিলেন। সিঙ্গাপুর হতে প্রেরিত সেই রহস্যময় পার্সেলের সঙ্গে ওই পুরন্দর চৌধুরীর কোন সম্পর্ক নেই তো!
কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিন্তাটা যেন পুরন্দর চৌধুরীকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খেতে শুরু করে বসাকের মাথার মধ্যে।
.
পুরন্দর চৌধুরী।
লোকটির চেহারাটা আর একবার বসাকের মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কি করেন ভদ্রলোক সিঙ্গাপুরে তাও জিজ্ঞাসা করা হয়নি। ঘনিষ্ঠতা ছিল পুরন্দর চৌধুরীর সঙ্গে বিনয়েন্দ্রর অনেক কাল, কিন্তু সে ঘনিষ্ঠতা সত্যিকারের কতখানি ছিল তা এখনও জানা যায়নি।
তারপর ওই চিঠি।
পুরন্দর চৌধুরী, সুজাতাদেবী ও রজতবাবু প্রত্যেকেই চিঠি পেয়ে এখানে আসছেন।
চিঠির তারিখ কবেকার?
তিনখানি চিঠিই মিঃ বসাকের পকেটে ছিল। ঘরের আলো জ্বেলে তিনখানি চিঠিই পকেট থেকে টেনে বের করলেন মিঃ বসাক।
আজ মাসের সতের তারিখ। ১৬ই তারিখে রাত্রি একটা থেকে সোয়া একটার মধ্যে নিহত হয়েছেন বিনয়েন্দ্র। এবং চিঠি লেখার তারিখ দেখা যাচ্ছে ১২ই।
হঠাৎ মনে হয় সুজাতাদেক বা রজতবাবুর হয়তো চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রওনা হয়ে এখানে আজ এসে পৌঁছানো সম্ভবপর হয়েছে, কিন্তু পুরন্দর চৌধুরীর পক্ষে সিঙ্গাপুরে চিঠি পেয়ে আজ সকালেই এসে পৌঁছানো সম্ভব হল কি করে?
হঠাৎ এমন সময় খুট করে একটা অস্পষ্ট শব্দ মিঃ বসাকের কানে এল। চকিতে শ্রবণেন্দ্রিয় তাঁর সজাগ হয়ে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে ঘরের আলোটা নিবিয়ে, দিলেন মিঃ বসাক।
ঘর অন্ধকার হয়ে গেল মুহূর্তে।
সেই অন্ধকার ঘরের মধ্যে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকেন মিঃ বসাক।
স্পষ্ট শুনেছেন তিনি খুট করে একটা শব্দ–মৃদু কিন্তু স্পষ্ট।
মুহূর্ত-পরে আবার সেই মৃদু অথচ স্পষ্ট শব্দটা শোনা গেল।
মুহূর্তকাল অতঃপর বসাক কি যেন ভাবলেন, তারপরই এগিয়ে গিয়ে নিঃশব্দে হাত দিয়ে চেপে ধরে ধীরে ধীরে ঘরের খিলটা খুলে দরজাটা ফাঁক করে বারান্দায় দৃষ্টিপাত করলেন।
লম্বা টানা বারান্দাটা ক্ষীণ চাঁদের আলোয় স্পষ্ট না হলেও বেশ আবছা আবছা দেখা যাচ্ছিল।
আবার সেই শব্দটা শোনা গেল।
তাকিয়ে রইলেন মিঃ বসাক।
হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল, তৃতীয় ঘর থেকে সর্বাঙ্গ একটা সাদা চাদরে আবৃত দীর্ঘকায় একটি মূর্তি যেন পা টিপে টিপে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
রুদ্ধশ্বাসে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকেন মিঃ বসাক সেই দিকে।
.
১৪.
আপাদমস্তক শ্বেতবস্ত্রে আবৃত দীর্ঘ মূর্তিটি ঘর থেকে বের হয়ে ক্ষণেকের জন্য মনে হল যেন বসাকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বারান্দাটার এক প্রান্ত হতে অন্য এক প্রান্ত পর্যন্ত দেখে নিল সতর্কভাবে।
তারপর ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে তাঁরই ঘরের দিকে যেন এগিয়ে আসতে লাগল সেই মূর্তি।
বারান্দায় যেটুকু ক্ষীণ চাঁদের আলো আসছিল তাও হঠাৎ যেন অন্তর্হিত হয়। বোধ হয় মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়েছে।
মিঃ বসাক তাকিয়ে রইলেন সেই দিকে।
মূর্তিটা খুব অস্পষ্ট দেখা যায়, এগিয়ে আসছে।
অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টিতে মিঃ বসাক অগ্রবর্তী মূর্তির দিকে নজর রাখলেন। ক্রমশ পায়ে পায়ে মূর্তি দাঁড়াল ঠিক গিয়ে ল্যাবরেটরী ঘরের বদ্ধ দরজার সামনে।
মিঃ বসাকের মনে পড়ল বাড়িতে আর বড় মজবুত তালা না খুঁজে পাওয়ায় একতলা ও দোতলার সংযোজিত সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল গেটটাতে ওই ল্যাবরেটরী ঘরের দরজার তালাটাই রাত্রে খুলিয়েই লাগিয়েছিলেন রামচরণকে দিয়ে।
ল্যাবরেটরীটা এখন খোলাই রয়েছে।
দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল অত্যন্ত মৃদু হলেও স্পষ্ট। মূর্তি ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে অদৃশ্য হল।
কয়েকটা মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন রুদ্ধশ্বাসে ইন্সপেক্টার বসাক।
তারপর ঘর থেকে বের হয়ে এগিয়ে গেলেন ল্যাবরেটরী ঘরের দরজাটার দিকে পা টিপে অতি সন্তর্পণে।
দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে।
এক মুহূর্ত কি ভাবলেন, তারপর পকেট থেকে রুমালটা বের করে দরজার কড়া দুটো সেই রুমাল দিয়ে বেশ শক্ত করে গিট দিয়ে বাঁধলেন।
এবং সোজা নিজের ঘরে ফিরে এসে তাঁর ঘর ও বিনয়েন্দ্রর শয়নঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা খুলে সেই শয়নঘরে প্রবেশ করলেন। পকেটে পিস্তল ও শক্তিশালী একটা টর্চ নিতে ভুললেন না।
এ বাড়ির সমস্ত ঘর ও ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই তিনি ভাল করে সব পরীক্ষা করে জেনে নিয়েছিলেন।
বিনয়েন্দ্রর শয়নঘর ও ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা এবারে খুলে ফেলে ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে দৃষ্টিপাত করলেন।
একটা আলোর সন্ধানী রশ্মি অন্ধকার ল্যাবরেটরী ঘরটার মধ্যে ইতস্তত সঞ্চারিত হচ্ছে। বুঝতে কষ্ট হল না বসাকের, ক্ষণপূর্বে যে বস্ত্রাবৃত মূর্তি ঐ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে তারই হাতের সন্ধানী আলোর সঞ্চরণশীল রশ্মি ওটা।
পা টিপে টিপে নিঃশব্দে দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে এগিয়ে চললেন মিঃ বসাক ঘরের দেওয়ালের সুইচ বোর্ডটার দিকে। খুট করে সুইচ টেপার একটা শব্দ হল এবং সঙ্গে সঙ্গে অত্যুজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় ঘরের অন্ধকার অপসারিত হল।
অস্ফুট একটা শব্দ শোনা গেল।
নড়বেন না। দাঁড়ান–যেমন আছেন। কঠিন নির্দেশ যেন উচ্চারিত হল ইন্সপেক্টার বসাকের কণ্ঠ থেকে।
দিনের আলোর মতই সমস্ত ঘরটা চোখের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মাত্র হাত পাঁচেক ব্যবধানেনিঃশব্দে দাঁড়িয়েসেইশ্বেতবস্ত্রাবৃতমূৰ্তিতখন। শ্বেতবস্ত্রে আবৃতযেন একটি প্রস্তরমূর্তি।
কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত কেটে গেল।
ইন্সপেক্টারই আবার কথা বললেন, পুরন্দরবাবু, ঘুরে দাঁড়ান।
পুরন্দর চৌধুরী ঘুরে দাঁড়ালেন। নিজেই গায়ের চাদরটা খুলে ফেললেন।
বসুন পুরন্দরবাবু, কথা আছে আপনার সঙ্গে। বসুন ওই টুলটায়।
পুরন্দর চৌধুরী যেন যন্ত্রচালিতের মতই সামনের টুলটার উপরে গিয়ে বসলেন।
ঘরে একটা আরামকেদারা একপাশে ছিল, সেটা টেনে এনে সামনাসামৰিউপবেশন করলেন ইন্সপেক্টার প্রশান্ত বসাক, তারপর প্রশ্ন শুরু করলেন।
এবারে বলুন শুনি, কেন এই মাঝরাত্রে চোরের মত লুকিয়ে এ ঘরে এসেছেন?
ইন্সপেক্টার বসাক প্রশ্ন করা সত্ত্বেও পুরন্দর চৌধুরী চুপ করে রইলেন। কোন জবাব দিলেন না।
পুরন্দরবাবু? আবার ডাকলেন মিঃ বসাক।
পুরন্দর চৌধুরী মুখ তুলে তাকালেন ইন্সপেক্টারের মুখের দিকে। তারপর যেন মনে হল একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস তাঁর বুকখানা কাঁপিয়ে বের হয়ে এল।
কথা বললেন পুরন্দর চৌধুরী অতঃপর অত্যন্ত মৃদু শান্তকঠে, আপনি কি ভাবছেন জানি না ইন্সপেক্টার, কিন্তু বিশ্বাস করুন বিনয়েন্দ্রকে আমি হত্যা করিনি। সে আমার বন্ধু ছিল। সেই কলেজের সেকেন্ড ইয়ার থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয়।
আমি তো বলিনি মিঃ চৌধুরী যে আপনিই তাঁকে হত্যা করেছেন। জবাব দিলেন ইন্সপেক্টার শান্ত মৃদু কণ্ঠে।
বিশ্বাস করুন মিঃ বসাক, আমি নিজেও কম বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে যাইনি তার এই আকস্মিক মৃত্যুতে। পুরন্দর চৌধুরী আবার বলতে লাগলেন, চিঠিটা তার পাওয়া মাত্রই এরোপ্লেনে আমি রওনা হই–
কথার মাঝখানে হঠাৎ বাধা দিলেন ইন্সপেক্টার, কিন্তু সিঙ্গাপুরের প্লেন তো রাত দশটায় কলকাতায় পৌঁছায়। সে ক্ষেত্রে চিঠিটা জরুরী মনে করে চিঠিটা পাওয়া মাত্রই যদি রওনা হয়ে এসে থাকেন তো সেই রাত্রেই সোজা এখানে আপনার বন্ধুর কাছে চলে না এসে পরের দিন সকালে এলেন কেন মিঃ চৌধুরী?
ইন্সপেক্টারের আকস্মিক প্রশ্নে পুরন্দর চৌধুরী সত্যিই মনে হল কেমন যেন একটু বিব্রত বোধ করেন, কিন্তু পরক্ষণেই সে বিব্রত ভাবটা সামলে নিয়ে বললেন, অত রাত্রে আর এসে কি হবে, তাই রাতটা হোটেলে কাটিয়ে পরের দিন সকালেই চলে আসি।
যদি কিছু না মনে করেন তো কোন্ হোটেলে রাত্রে উঠেছিলেন?
হোটেল স্যাভয়ে।
হুঁ। আচ্ছা মিঃ চৌধুরী?
বলুন।
একটা কথা আপনি শুনেছেন বিনয়েন্দ্রবাবুর নামে নিয়মিতভাবে সিঙ্গাপুর থেকে কিসের একটা পার্সেল আসত?
হ্যাঁ।
আপনি বলতে পারেন সে পার্সেল সম্পর্কে কিছু? সিঙ্গাপুরের কার কাছ থেকে পার্সেলটা আসত? আপনিও তো সিঙ্গাপুরেই থাকেন।
পুরন্দর চৌধুরী চুপ করে থাকেন।
কি, জবাব দিচ্ছেন না যে? পার্সেলটা সম্পর্কে আপনি তাহলে কিছু জানেন না বোধ হয়?
পার্সেলটা আমিই পাঠাতাম তাকে। মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলেন পুরন্দর চৌধুরী এবারে।
আপনি! আপনিই তাহলে পার্সেলটা পাঠাতেন!
হ্যাঁ।
ও, তা কি পাঠাতেন পার্সেলের মধ্যে করে, জানতে পারি কি?
একটা tonic।
টনিক! কিসের tonic পাঠাতেন মিঃ চৌধুরী আপনার বন্ধুকে?
পুরন্দর চৌধুরী আবার চুপ করে থাকেন।
মিথ্যে আর সব কথা গোপন করবার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই পুরন্দরবাবু। আপনি না বললেও সব কথা আমরা সিঙ্গাপুর পুলিসকে তার করলে তারা খোঁজ নিয়ে আমাদের জানাবে।
একপ্রকার মাদক দ্রব্য তার মধ্যে থাকত।
মাদক দ্রব্য! হুঁ, আমি ওই রকমই কিছু অনুমান করেছিলাম রামচরণের মুখে সব কথা শুনে। কিন্তু কি ধরনের মাদক দ্রব্য তার মধ্যে থাকত বলবেন কি?
দু-তিন রকমের বুনো গাছের শিকড়, বাকল আর—
আর—আর কি থাকত তার মধ্যে?
সর্প-বিষ।
কি? কি বললেন?
সর্প-বিষ। মেক-ভেনম্।
আপনি! আপনি পাঠাতেন সেই বস্তুটি! তাহলে আপনিই বোধ হয় আপনার বন্ধুটিকে ওই বিষের সঙ্গে পরিচিতি করিয়েছিলেন?
কতকটা হাঁও বটে, আবার নাও বলতে পারেন।
মানে?
তাহলে আপনাকে সব কথা খুলে বলতে হয়।
বলুন।
ইন্সপেক্টার বসাকের নির্দেশে পুরন্দর অতঃপর যে কাহিনী বিবৃত করলেন তা যেমন বিস্ময়কর তেমনি চমকপ্রদ।
.
১৫.
আই. এস-সি ও বি. এস-সি-তে এক বছর কলকাতার কলেজে পুরন্দর চৌধুরী ও বিনয়েন্দ্র সহপাঠী ছিলেন।
সেই সময়েই উভয়ের মধ্যে নাকি প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়।
উভয়েরই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে ধৈর্য বা একনিষ্ঠতা যা বিনয়েন্দ্রর চরিত্রে সব চাইতে বড় গুণ ছিল, সে দুটির একটিও ছিল না পুরন্দরের চরিত্রে।
শুধু তাই নয়, পুরন্দরের চিরদিনই প্রচণ্ড একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল যেমন করেই হোক, যে কোন উপায়ে বড়লোক বা ধনী হবার। ছোটবেলায় মা-বাপকে হারিয়ে পুরন্দর মানুষ হয়েছিলেন এক গরীব কেরানী মাতুলের আশ্রয়ে।
থার্ড ইয়ারে পড়তে পড়তেই হঠাৎ সেই মাতুল মারা গেলেন। সংসার হল অচল। পুরন্দরের পড়াশুনাও বন্ধ হল।
কলেজ ছেড়ে পুরন্দর এদিক-ওদিক কিছুদিন চাকরির চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোথাও বিশেষ কিছু সুবিধা হল না।
এমন সময় হঠাৎ ডকে এক জাহাজের মেটের সঙ্গে ঘটনাচক্রে পুরন্দরের আলাপ হয়। ইদ্রিস মিঞা।
বম মুলুকে গিয়ে অনেকের বরাতের চাকা নাকি ঘুরে গেছে। এ ধরনের দু-চারটে সরস গল্প এ-ওর কাছে পুরন্দর চৌধুরী শোনা অবধি ওই সময় প্রায়ই তিনি ডক অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন, যদি কাউকে ধরে কোনমতে জাহাজে চেপে বিনা পয়সায় সেই সব জায়গায় যাওয়া যায় একবার।
কোনক্রমে একবার সেখানে গিয়ে সে পৌঁছতে পারলে সে ঠিক তার ভাগ্যের চাকাটা ঘুরিয়ে দেবে।
ইদ্রিস মিঞা জাহাজে বয়লারের খালাসীর চাকরি দিয়ে বময় নিয়ে যাবার নাম করে পুরন্দরকে। পুরন্দর সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যান এবং নির্দিষ্ট দিনে জাহাজে উঠে পড়েন। সেবার জাহাজটা চায়নায় যাচ্ছিল মাল নিয়ে। জাহাজটা ছিল মাল-টানা জাহাজ। কাগো জাহাজ। জাহাজটা সিঙ্গাপুর ঘুরে যাচ্ছিল, সিঙ্গাপুরে থামতেই পুরন্দর কিন্তু বন্দরে নেমে গেলেন আর উঠলেন না জাহাজে, কেন না, দিন দশেক বয়লার ঘরের প্রচণ্ড তাপের মধ্যে কয়লা ঠেলে ঠেলে হাতে ফোস্কা তো পড়েছিলই, শরীরও প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল গরমে আর পরিশ্রমে। হাতে মাত্র পাঁচটি টাকা, গায়ে খালাসীর নীল পোশাক। পুরন্দর পথে পথে ঘুরতে লাগলেন যা হোক কোন একটা চাকরির সন্ধানে।
কিন্তু একজন বিদেশীর পক্ষে চাকরি পাওয়া অত সহজ নয়।
ঘুরতে ঘুরতে একদিন হোটেলে এক বাঙালী প্রৌঢ়ের সঙ্গে আলাপ হয়। শোনা গেল, সেও নাকি একটা এসেছিল ভাগ্যান্বেষণে সিঙ্গাপুরে। সে-ইতাকে একরবার গুডসেরফ্যাক্টরীতে চাকরি করে দেয়। এবং সেখানেই আলাপ হয় বছর দেড়েক বাদে এক চীনা ভদ্রলোকের সঙ্গে। নাম তার লিং সিং।
লিং সিংয়ের দেহে পুরোপুরি চীনের রক্ত ছিল না। তার মা ছিল চীনা, আর বাপ ছিল অ্যাংলো মালয়ী। শহরের মধ্যেই লিং সিংয়ের ছিল একটা কিউরিও শপ। লোকজনের মধ্যে লিং সিং ও তার স্ত্রী–কু-সি। দুজনেরই বয়স হয়েছে।
শহরের একটা হোটেলে সাধারণতঃ যেখানে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরাই যাতায়াত করত, লিং সিং-ও সেখানে যেত। পুরন্দর চৌধুরীও সেই হোটেলে মধ্যে মধ্যে যেতেন। সেইখানেই আলাপ হয় দুজনের।
লিং সিংকে মধ্যে মধ্যে পুরন্দর চৌধুরী কোথাও একটা ভাল চাকরি করে দেবার জন্য বলতেন।
লিং সিং আশ্বাস দিত সে চেষ্টা করবে।
শেষে একদিন লিং সিং তাঁকে বললে, সত্যিই যদি সে চাকরি করতে চায় তো যেন সে আজ সন্ধ্যার পর তার কিউরিও শপে যায়। ঠিকানা দিয়ে দিল লিং সিং পুরন্দরকে তার দোকানের।
সেই দিনই সন্ধ্যার পর পুরন্দর লিং সিংয়ের কিউরিও শপে গেলেন তার সঙ্গে দেখা করতে।
এ-কথা সে-কথার পর লিং সিং এক সময় বললে, সে এবং তার স্ত্রী দুজনেরই বয়স হয়েছে। তাদের কোন ছেলেমেয়ে বা আত্মীয়স্বজনও কেউ নেই। তারা একজন পুরন্দরের মতই বিশ্বাসী ও কর্মঠ লোক খুঁজছে, তাদের দোকানে থাকবে, দোকান দেখাশোনা করবে, খাওয়া থাকা ছাড়াও একশ ডলার করে মাসে মাইনে পাবে।
মাত্র পঞ্চাশ ডলার করে মাইনে পাচ্ছিলেন পুরন্দর ফ্যাক্টরীতে; সানন্দে তিনি রাজী হয়ে গেলেন। এবং পরের দিন থেকেই লিং সিংয়ের কিউরিও শপে কাজে লেগে গেলেন।
তারপর? মিঃ বসাক শুধালেন।
তারপর?
হ্যাঁ।
১৬-২০. পুরন্দর চৌধুরী আবার বলতে লাগলেন
মাসখানেকের মধ্যেই পুরন্দর চৌধুরী দেখলেন এবং বুঝতেও পারলেন, লিং সিংয়ের দোকানটা বাইরে থেকে একটা কিউরিও শপ মনে হলেও এবং সেখানে বহু বিচিত্র খরিদ্দারদের নিত্য আনাগোনা থাকলেও, আসলে সেটা একটা দুষ্প্রাপ্য অথচ রহস্যপূর্ণ চোরাই মাদক দ্রব্য কারবারেরই আড্ডা।
লিং সিংয়ের কিউরিওর বেচা-কেনাটা একটা আসলে বাইরের ঠাট মাত্র। এবং চোরাই মাদক দ্রব্যের কারবারটাই ছিল লিং সিংয়ের আসল কারবার। কিন্তু সদা সতর্ক ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেও পুরন্দর কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত জানতেই পারেননি যে, লিং সিংয়ের সেই মাদক দ্রব্যটি আসলে কি? এবং কোথায় তা রাখা হয় বা কি ভাবে বিক্রি করা হয়।
মধ্যে মধ্যে পুরন্দর কেবল শুনতেন, এক-আধজন খরিদ্দার এসে বলত আসল সিঙ্গাপুরী মুক্তা চায়।…
লিং সিং তখন তাঁকে দোতলায় তার শয়নঘরের সংলগ্ন ছোট্ট একটি কামরার মধ্যে, ডেকে নিয়ে গিয়ে কামরার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিত। মিনিট পনের-কুড়ি পরে খরিদ্দার ও লিং সিং কামরা থেকে বের হয়ে আসত।
অবশেষে পুরন্দরের কেমন যেন সন্দেহ হয় ঐ সিঙ্গাপুরী মুক্তার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন রহস্য রয়েছে। নচেৎ ঐ মুক্তার ব্যাপারে লিং সিংয়ের অত সতর্কতা কেন।
ফলে পুরন্দর কাজ করতেন, কিন্তু তাঁর সজাগ সতর্ক দৃষ্টি সর্বদা মেলে রাখতেন যেমন করেই হোক আসল সিঙ্গাপুরী মুক্তা রহস্যটা জানবার জন্য।
আরও একটা ব্যাপার পুরন্দর লক্ষ্য করেছিলেন, লিং সিংয়ের কিউরিও শপে বেচাকেনা যা হত, সেটা এমন বিশেষ কিছুই নয় যার দ্বারা লিং সিংয়ের একটা মোটা রকমের আয় হতে পারে। এবং লিং সিংয়ের অবস্থা যে বেশ সচ্ছল, সেটা বুঝতে অন্ধেরও কষ্ট হত না।
পুরন্দর চৌধুরী লক্ষ্য করেছিলেন, মুক্তা সন্ধানী যারা সাধারণত কিউরিও শপে লিং সিংয়ের কাছে আসত তারা সাধারণত স্থানীয় লোক নয়।
চীন-মালয়, জাভা, সুমাত্রা, ভারতবর্ষ প্রভৃতি জায়গা থেকেই সব খরিদ্দারেরা আসত।
তারা আসত জাহাজে চেপে, কিন্তু সিঙ্গাপুরে থাকত না তারা।
পুরন্দর চৌধুরী চাকরি করতেন বটে লিং সিংয়ের ওখানে, কিন্তু একতলা ছেড়ে দোতলায় ওঠবার তাঁর কোন অধিকার ছিল না। লিং সিংয়ের বউই সাধারণত নীচে পুরন্দরের খাবার পৌঁছে দিয়ে যেত প্রত্যহ।
যেদিন তিনি আসতেন না, যে ছোরা মালয়ী চাকরটা ওখানে কাজ করত সে-ই নিয়ে আসত তাঁর খাবার।
এমনি করে দীর্ঘ আট মাস কেটে গেল।
এমন সময় হঠাৎ লিং সিং অসুস্থ হয়ে পড়ল কদিন। লিং সিং আর নীচে নামে না। পুরন্দর একা-একাই লিং সিংয়ের কিউরিও শপ দেখাশোনা করেন।
সকাল থেকেই সেদিন আকাশটা ছিল মেঘলা, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। পুরন্দর একা কাউন্টারের ওপাশে বসে একটা ইংরেজী নভেল পড়ছেন। এমন সময় দীর্ঘকায় এক সাহেবী পোশাক পরিহিত, মাথায় ফেল্টক্যাপ, গায়ে বর্ষাতি এক আগন্তুক এসে দোকানে প্রবেশ করল।
গুড মর্ণিং!
পুরন্দর বই থেকে মুখ তুলে তাকালেন। আগন্তুকের তামাটে মুখের রঙ সাক্ষ্য দিচ্ছে। বহু রৌদ্র-জলের ইতিহাসের মুখে তামাটে রঙের চাপদাড়ি।
ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে আগন্তুক জিজ্ঞাসা করল, লিং সিং কোথায়?
পুরন্দর বললেন, যা বলবার তিনি তাঁর কাছেই বলতে পারেন, কারণ লিং সিং অসুস্থ।
আগন্তুক বললে, তার কিছু সিঙ্গাপুরী মুক্তার প্রয়োজন।
সিঙ্গাপুরী মুক্তা! সঙ্গে সঙ্গে একটা মতলব পুরন্দরের মনের মধ্যে স্থান পায়।
আগন্তুককে অপেক্ষা করতে বলেপুরন্দর এগিয়ে গিয়ে দরজার পাশেকলিং বেলটা টিপলেন।
একটু পরেই লিং সিংয়ের স্ত্রীর মুখ সিঁড়ির উপরে দেখা গেল।
পুরন্দর বললেন, তোমার স্বামীকে বল সিঙ্গাপুরী মুক্তার একজন খরিদ্দার এসেছে।
খানিক পরে লিং সিংয়ের স্ত্রী এসে আগন্তুক ও পুরন্দর দুজনকেই উপরে ডেকে নিয়ে গেল লিং সিংয়ের শয়ন ঘরে। এই সর্বপ্রথম লিং সিংয়ের বাড়ির দোতলায় উঠলেন পুরন্দর এখানে আসবার পর। শয্যার উপরে লি সিং শুয়েছিল।
পুরন্দরের সামনেই লি সিং তার শয্যার তলা থেকে একটা চৌকো কাঠের বাক্স বের করে ডালাটা খুলতেই পুরন্দর দেখলেন সত্যিই বাক্সে ভর্তি ছোট ছোট সব সাদা মুক্তা। একটা প্যাকেটে করে কিছু মুক্তা নিয়ে পরিবর্তে একগোছা নোট গুণে দিয়ে আগন্তুক চলে গেল।
সেই রাত্রেই আবার পুরন্দরের ডাক এল লিং সিংয়ের শয়নঘরে দোতলায়।
আমাকে ডেকেছ?
হ্যাঁ, বসো। শয্যার পাশেই লিং সিং একটা খালি চেয়ার দেখিয়ে দিল পুরন্দরকে বসবার জন্য।
পুরন্দর বসলেন।
ঘরের মধ্যে একটা টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। বাইরে শুরু হয়েছে ঝোড়ো হাওয়া। ঘরের বন্ধ কাঁচের জানলা সেই হাওয়ায় থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
লিং সিংয়ের পায়ের কাছে তার প্রৌঢ়া স্ত্রী নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঈষৎ হলদে চ্যাপ্টা মুখে বাতির আলো কেমন ম্লান দেখায়।
দেখ পুরন্দর, লিং সিং বলতে লাগল, তোমাকে আমি এনেছিলাম সামান্য ঐ একশো ডলার মাইনের চাকরির জন্যে নয়। আমার এবং আমার স্ত্রীর বয়স হয়েছে, ক্রমশ দেহের শক্তিও আমাদের কমে আসছে। আমাদের কোন ছেলেপিলে নেই। তাই আমি এমন একজন লোক কিছুদিন থেকে খুঁজছিলাম যাকে পুরোপুরি আমরা বিশ্বাস করতে পারি। হোটেলে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়ার পর থেকেই তোমার উপরে আমার নজর পড়েছিল। তোমাকে আমি যাচাই করছিলাম। দেখলাম, তোমার মধ্যে একটা সং অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কষ্টসহিষ্ণু মানুষ আছে। আমাদেরও একজন দেখাশোনা করবার মত সৎ ও বিশ্বাসী লোক চাই। মনে হল, তোমাকে দিয়ে হয়তো আমাদের সে আশা যেন মিটতে পারে। চাকরি দিয়ে তোমাকে তাই নিয়ে এলাম। দীর্ঘ আটমাস তোমাকে দিনের পর দিন আমি পরীক্ষা করেছি। বুঝেছি, লোক নির্বাচনে আমি ঠকি নি।
এই পর্যন্ত একটানা কথাগুলো বলে লিং সিং পরিশ্রমে যেন হাঁপাতে লাগল। পুরন্দর বললেন, লিং সিং, তুমি এখন অসুস্থ। পরে এসব কথা হবে। আজ থাক।
না। আমার যা বলবার আজই আগাগোড়া সব তোমাকে আমি বলব বলেই ডেকে এনেছি এখানে। শোন পুরন্দর। কিওরিও শপটাই আমার আসল ব্যবসা নয়াআমার আসল ব্যবসাটি হচ্ছে বিচিত্র এক প্রকার মিশ্র মাদক দ্রব্য বৈচা। বিশেষ সেই দ্রব্যটি এমনই প্রক্রিয়ায় তৈরী যে, একবার তাতে মানুষ অভ্যস্থ হলে পরবর্তী জীবনে আর তাকে ছাড়তে পারবে না। এবং তখন যে কোন মূল্যের বিনিময়েও তাকে সেই মাদক দ্রব্যটি সংগ্রহ করতেই হবে। বিশেষ ঐ বিচিত্র মাদক দ্রব্যটির তৈরীর প্রক্রিয়া আমি শিখেছিলাম আমার ঐ স্ত্রীর বাপের কাছ থেকে। মরবার আগে সে আমাকে প্রক্রিয়াটি শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। সেইটি তোমাকে আমি শিখিয়ে দিয়ে যাব, কিন্তু তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যতদিন আমরা বেঁচে থাকব আমাদের দেখাশোনা তুমি করবে। আমাদের মৃত্যুর পর অবশ্য তুমি হবে সব কিছুর মালিক।
পুরন্দর জবাবে বললেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের দেখব। তুমি আমাকে বিশেষ ওই মাদক দ্রব্য তৈরীর প্রক্রিয়া শিখিয়ে না দিলেও তোমাদের আমি দেখতাম এবং দেখবও।
আমি জানি পুরন্দর। তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি বলেই তোমাকে আমার ঘরে এনে আমি স্থান দিয়েছি, হ্যাঁ শোন, যে মাদক দ্রব্যটির কথা বলছিলাম তারই নাম সিঙ্গাপুরী মুক্তা। কয়েক প্রকার বুনন গাছের ছাল, শিকড়, আফিং ও সর্পবিষ দিয়ে তৈরী করতে হয় সেই বিশেষ আশ্চর্য মাদক দ্রব্যটি। এবং পরে জিলাটিন দিয়ে কোটিং দিয়ে তাকে মুক্তার আকার দিই।
.
১৭.
পুরন্দর চৌধুরী বলতে লাগলেন, লিং সিংয়ের মৃত্যুর পর সেই মাদক দ্রব্য বেচে আমি অথোপার্জন করতে লাগলাম।
ঐভাবে ব্যবসা করতে করতে একদিন আমার মনে হল, শুধু ঐভাবে সিঙ্গাপুরে বসে কেন, আমি তো মধ্যে মধ্যে কলকাতা এসেও ঐ মাদক দ্রব্যের ব্যবসা করতে পারি। তাতে করে আমার আয় আরও বেড়ে যাবে। এলাম কলকাতা। কলকাতায় এসেই কয়েকটি শাঁসালো পুরাতন বন্ধুকে খুঁজে খুঁজে বের করলাম। যাদের অর্থ আছে, শখ আছে। ঠিক সেই সময় একদিন মার্কেটে বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে বহুকাল পরে আমার দেখা হল।
বহুদিন পরে দুই পুরোন দিনের বন্ধুর দেখা। সে আমায় তার এই বাড়িতে টেনে নিয়ে এলো। দেখলাম বিনয়েন্দ্র প্রভূত অর্থের মালিক হয়েছে তার মাতামহের দৌলতে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হল, এই বিনয়েন্দ্রকে যদি আমি গাঁথতে পারি তো বেশ মোটা টাকা উপার্জন করতে পারব। বিনয়েন্দ্র দিবারাত্রই বলতে গেলে তার গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত। এবং প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় বলে রাত্রে শয়নের পূর্বে সে সামান্য একটু ড্রিঙ্ক করত। তাকে বোঝালাম, নেশাই যদি করতে হয় তো লিকার কেন। লিকার বড় বদ নেশা। ক্রমে ক্রমে লিভারটি একেবারে নষ্ট করে ফেলবে। বিনয়েন্দ্র তাতে জবাব দিল, কি করি ভাই বল। শুধু যে পরিশ্রমের জন্যই আমি ড্রিঙ্ক করি তা নয়। যতক্ষণ নিজের গবেষণা ও পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি, বেশ থাকি। কিন্তু নির্জন অবসর মুহূর্তগুলি যেন কাটতেই চায় না। নিজের এমন একাকীত্ব যেন জগদ্দল পাথরের মত আমাকে চেপে ধরে। আপন জন থেকেও আমার কেউ নেই। জীবনে বিয়ে-থা করি নি, একদিন যারা ছিল আমার আপনার, যাদের ভালবেসে যাদের নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম, যাদের আঁকড়ে ধরে ভেবেছিলাম এ জীবনটা কাটিয়ে দের, তারাও, আজ আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে গিয়েছে। দেখা করা তত দূরে থাক, একটা খোঁজ পর্যন্ত তারা আমার নেয় না, বেঁচে আছি কি মরে গেছি। এওঁ একপক্ষে আমার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। না হলে দাদামশাই বা তাঁর উইলটা বিচিত্র করে যাবেন কেন! আর করেই যদি গেলেন তো তারাই বা আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে যাবে কেন! আমাকে অনাত্মীয়ের মত ত্যাগ করবে কেন! অথচ তারা ছাড়া তো আমার এ সংসারে আপনার জনও আর কেউ নেই। আমার মৃত্যুর পর তারাই তো সব কিছু পাবে। সবই হবে, অথচ আমি যতদিন বেঁচে থাকব তারা আমার কাছেও আসবে না। এই সব নানা কারণেই ড্রিঙ্ক করে আমি ভুলে থাকি অবসর সময়টা। আমি তখন তাকে বললাম, বেশ তো, ঐ লিকার ছাড়া ভুলে থাকবার আরও পথ আছে। তখন আমিই নিজের তাগিদে তাকে সিঙ্গাপুরী মুক্তার সঙ্গে পরিচয় করালাম। প্রথমটায় অনিচ্ছার সঙ্গেই সে আমার প্রস্তাবে ঠিক রাজী নয়, তবে নিমরাজী হয়েছিল। পরে হল সে ক্রমে ক্রমে আমার ক্রীতদাস। সম্পূর্ণ আমার মুঠোর মধ্যে সে এল। ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে শুরু করলাম। কলকাতায় তিনখানা বাড়ি তো গেলই–নগদ টাকাতেও টান পড়ল তার।
.
মিঃ বসাক পুরন্দর চৌধুরী বর্ণিত কাহিনী শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান। লোকটা শুধু শয়তানই নয়, পিশাচ। অবলীলাক্রমে সে তার দুষ্কৃতির নোংরা কাহিনী বর্ণনা করে গেল।
পুরন্দর চৌধুরী তাঁর কাহিনী শেষ করে নিঃশব্দে বসেছিলেন।
ধীরে ধীরে আবার একসময় মাথাটা তুললেন, অর্থের নেশায় বুদ হয়ে অন্যায় ও পাপের মধ্যে বুঝতে পারে নি এতদিন যে, আমার সমস্ত অন্যায়, সমস্ত দুস্কৃতি একজনের অদৃশ্য জমাখরচের খাতায় সব জমা হয়ে চলেছে। সকল কিছুর হিসাবনিকাশের দিন আমার আসন্ন হয়ে উঠেছে। কড়ায় গণ্ডায় সব—সব আমাকে শোধ দিতে হবে।
কথাগুলো বলতে বলতে শেষের দিকে পুরন্দর চৌধুরীর গলাটা ধরে এল। কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে যেন তিনি বুকের মধ্যে উদ্বেলিত ঝড়টাকে একটু প্রশমিত করবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
আরও কিছুক্ষণ পরে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, জন্মের পর জ্ঞান হবার সঙ্গে সঙ্গেই দুঃখ ও দারিদ্র্য আমার পদে পদে পথ রোধ করেছে। তাই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ছলে-বলে-কৌশলে যেমন করে থোক অর্থ উপার্জন করতেই হবে। আশ্রয়দাতা লিং সিংয়ের দয়ায় সেই অর্থ যখন আমার হাতে এল, বাংলাদেশে এসে বেলাকে আমি বিবাহ করে সঙ্গে করে সিঙ্গাপুরে নিয়েগেলাম।
বেলা আমার প্রতিবেশী গাঁয়ের এক অত্যন্ত গরীব ব্রাহ্মণের মেয়ে। বেলাকে আমি ভালবাসতাম এবং বেলাও আমাকে ভালবাসত। চিরদিনের মত শেষবার গ্রামে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে যখন চলে আসি, তাকে বলে এসেছিলাম, যদি কোনদিন ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে ফেলতে পারি এবং তখনও সে যদি আমার জন্য অপেক্ষা করে তো ফিরে এসে তাকে আমি তখন বিয়ে করব।
কলকাতা ছাড়বার চার বছর পরে ভাগ্য যখন ফিরল বেলার বাবাকে একটি চিঠি দিলাম। চিঠির জবাবে জানলাম, বেলার বাপ মারা গেছে, বেলা তখন তার এক দূর-সম্পকীয় কার সংসারে দাসীবৃত্তি করে দিন কাটাচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে এলাম কলকাতায় ও গ্রামে গিয়ে বেলাকে বিবাহ করলাম।
জীবন আমার আনন্দে ভরে উঠল। দুবছর বাদে আমাদের খোকা হল। সুখের পেয়ালা কানায় কানায় ভরে উঠল। ভেবেছিলাম, এমনি করেই বুঝি আনন্দ আর সৌভাগ্যের মধ্যে বাকি জীবনটা আমার কেটে যাবে।
বেলা কিন্তু মধ্যে মধ্যে আমাকে বলতো, ওই মাদক দ্রব্যের ব্যবসা ছেড়ে দিতে। কিন্তু দুস্কৃতির নেশা তখন মদের নেশার মতই আমার দেহের কোষে কোষে ছড়িয়ে গিয়েছে। তা থেকে তখন আর মুক্তি কোথায়! তাছাড়া পাপের দণ্ড। কতজনকে হৃতসর্বস্বকরেছি, কতজনকে জোঁকের মত শুষে শুষে রক্তশূন্য করে তিলে তিলে চরম সর্বনাশের মধ্যে ঠেলে দিয়েছি, তার ফল ভোগ করতে হবে না!
আবার একটু থেমে যেন নিজেকে একটু সামলে নিয়ে পুরন্দর বলতে লাগলেন, পূর্বেই আপনাকে বলেছি ইনসপেক্টার, ওই সিঙ্গাপুরী মুক্তা তৈরীকরবার জন্য সর্পবিষ বাস্নেক-ভেনমের প্রয়োজন হতো। সেই কারণে জ্যান্ত সাপই খাঁচায় রেখে দিতাম।
সাপের বিষ-থলি থেকে বিষ সংগ্রহ করতাম। সিঙ্গাপুরে ভাল বিষাক্ত সাপ তেমন মিলত বলে জাভা, সুমাত্রা ও বোর্ণিয়োর জঙ্গল থেকে বিষধর সব সাপ একজন চীনা মধ্যে মধ্যে ধরে এনে আমার কাছে বিক্রি করে যেত। সেবারে সে একটা প্রকাণ্ড গোখরো সাপ দিয়ে গেল। অত বড় জাতের গোখররা ইতিপূর্বে আমি বড় একটা দেখি নি। খাঁচার মধ্যে সাখটার সে কি গর্জন। মনে হচ্ছিল ছোবল দিয়ে খাঁচাটা বুঝি ভেঙেই ফেলবে।
চীনাটা বারবার আমাকে সতর্ক করে গিয়েছিল যে সাপটা একটু নিস্তেজ না হওয়ার আগে যেন তার বিষ সংগ্রহের আমি চেষ্টা না করি।
উপরের তলার একটা ছোট ঘরে সিগাপুরীমুক্তা তৈরীর সবমালমশলা ও সাপের খাঁচাগুলো থাকত। সাধারণত সে ঘরটা সর্বদা তালা দেওয়াই থাকতো।
যে দিনকার কথা বলছি সে দিন কি কাজে সেই ঘরে ঢুকছি এমন সময় একজন খরিদ্দার। আসায় তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেছি এবং তাড়াহুড়ায় সেই ঘরের তালাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি। খরিদ্দারটি আমার অনেক দিনকার জানাশোনা। সে মধ্যে মধ্যে এসে অনেক টাকার মুক্তা নিয়ে যেত। সে বললে, এখুনি তার সঙ্গে যেতে হবে একটা হোটেলে। একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দেবে, যে লোকটি আমার সঙ্গে মুক্তার কারবার করতে চায়। গাড়ি নিয়েই এসেছিল খরিদ্দারটি। আমার স্ত্রী রান্নাঘরে ছিল, তাকে বলে খরিদ্দারটির সঙ্গে বের হয়ে গেলাম।
বের হবার সময়ই ভুলে গেলাম যে সেই ঘরটা তালা দিতে হবে। ফিরতে প্রায় ঘণ্টা দুই দেরী হয়ে গেল। যে কাজে গিয়েছিলাম তাতে সফল হয়ে পকেট ভর্তি নোট নিয়ে বাড়ি ফেরবার পথে ভাবতে ভাবতে আসছিলাম এবারে আর মাসকয়েক কারবার করে স্ত্রীপুত্রকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসব এবং কারবার একেবারে গুটিয়ে ফেলব। কিছুদিন থেকেই বেলা বলছিল কলকাতায় ফিরে যাবার জন্য। এখানে তার কোন সঙ্গী সাথী ছিল না একা একা। তার দিন যে খুব কষ্টে কাটে তা বুঝতে পেরেছিলাম।
বাড়িতে ঢুকেই উচ্চকণ্ঠে ডাকলাম, বেলা! বেলা!
কিন্তু বেলার কোন সাড়া পাওয়া গেল না। বাচ্চা চাকরটা আমার ডাক শুনে উপর থেকে ছুটতে ছুটতে এসে বললে, সর্বনাশ হয়ে গেছে। দেখবেন চলুন।
সে বেচারীও কিছু জানত না। বেলা তাকে কি কিনতে যেন বাজারে পাঠিয়েছিল, সে আমার মিনিট পনের আগে মাত্র ফিরেছে।
চারটার সঙ্গে ছুটতে ছুটতে উপরে গেলাম।
কি থেকে কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছিল সে-ও জানে না আমিও আজ পর্যন্ত জানি না। তবে যে ঘরে সাপগুলো থাকত সে ঘরে ঢুকে দেখি, বেলা আর থোকন মেঝেতে মরে পড়ে আছে।
সর্বাঙ্গ তাদের নীল হয়ে গেছে। আর নতুন কেনা গোখরো সাপটা যে খাঁচার মধ্যে ছিল, সেটা মেঝেতে উন্টে পড়ে আছে এবং সেই সাপটা ঘরের মধ্যে কোথাও নেই।
কয়েকটা মুহূর্ত আমার কণ্ঠ দিয়ে কোন শব্দ বের হল না।
ঘটনার আকস্মিকতায় ও আতঙ্কে আমি যেন একদম বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।
কাঁদবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কাঁদতে পারলাম না।
সমস্ত জীবনটাই এক মুহূর্তে আমার কাছে মিথ্যে হয়ে গেল। সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার যেন একেবারে শেষ হয়ে গেল। গত সাত বছর ধরে এই যে তিলে তিলে অর্থ সংগ্রহ করে ভাগ্যকে জয় করবার দুস্তর প্রচেষ্টা সব—সব যেন মনে হল শেষ হয়ে গেছে।
বেলাকে স্ত্রীরূপে পেয়ে জীবন আমার ভরে গিয়েছিল। জীবনে থোকন এনেছিল এক অনাস্বাদিত আনন্দ, এক মুহূর্তে ঈশ্বর যেন তাদের দুজনকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে জগতের সর্বাপেক্ষা নিঃস্ব ও রিক্ত করে ভিক্ষুকেরও অধম করে দিয়ে গেলেন। সমস্ত দিন সেই দুটি বিষজর্জরিত নীল মৃতদেহকে সামনে নিয়ে হতবাক, মুহ্যমানের মত বসে রইলাম।
ক্ৰমে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল।
ছোকরা চাকরটাও বোধ হয় কেমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। উপরের সিঁড়িতে রেলিংয়ের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ধীরে ধীরে মৃতদেহের পাশ থেকে এক সময় উঠে দাঁড়ালাম। অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে বেলা ও খোকনের। পুলিস জানতে পারলে ময়না ঘরে টেনে নিয়ে যাবে। নিষ্ঠুরের মত ডাক্তার বেলার ঐ দেহে এবং আমার সাধের খোকনের নবনীত ঐ দেহে ছুরি চালাবে। সহ্য করতে পারব না।
তারপর শুধু তাই নয়, ক্রিমেশন গ্রাউন্ডে নিয়ে গিয়ে তাদের শেষ কাজ করতে হবে। তার জন্যও তো কোন ডাক্তারের সার্টিফিকেট চাই। এবং আরও আছে, জানাজানি হলে। ব্যাপারটা পুলিস আসবে। তখন নানা গোেলমালও শুরু হবে। তার চাইতে এই বাড়ির উঠানেই, মা ও ছেলেকে মাটির নিচে শুইয়ে রেখে দিই।
আমার জীবনের সবচাইতে দুটি প্রিয়জন আমার বাড়ির মধ্যেই মাটির নিচে শুয়ে থাক। ঘুমিয়ে থাক।
চাকরটাকে জাগিয়ে নীচে নেমে এলাম।
কখন এক সময় বৃষ্টি থেমে গেছে। বর্ষণক্লান্ত আকাশে এখনও এদিক-ওদিক টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। তারই ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি তারা উঁকি দিচ্ছে।
চাকরটার সাহায্যে দুজনে মিলে উঠানের এক কোণে যে বড় ইউক্যালিপটাস গাছটা ছিল তার নীচে পাশাপাশি দুটি গর্ত খুঁড়লাম। তারপর সেই গর্তের মধ্যে শুইয়ে দিলাম বেলা আর খোনকে।
মাটি চাপা দিয়ে গর্ত দুটো যখন ভরাট হয়ে গেল, তখন রাত্রি-শেষের আকাশ ফিকে আলোয় আসন্ন প্রভাতের ইঙ্গিত জানাচ্ছে।
তারপর সাতটা দিন সাতটা রাত কোথা দিয়ে কেমন করে যে কেটে গেল বুঝতেও পারলাম না। সমস্ত জীবনটাই যেন মিথ্যা হয়ে গেছে। কিছুই আর ভাল লাগে না। আর কি হবে এই দূর দেশে একা পড়ে থেকে। ব্যবসা-পত্র সব বন্ধ করে দিয়েছি।
মাঝে মাঝে খরিদ্দার এলে তাদের ফিরিয়ে দিই।
দোকান সর্বদা বন্ধই থাকে।
মনের যখন এই রকম অবস্থা, উত্তরপাড়া থেকে বিনয়েন্দ্রর চিঠি পেলাম। জরুরী চিঠি, চলে আসবার জন্য।
পরের দিনই প্লেনে একটা সীট পেয়ে গেলাম। রওনা হয়ে পড়লাম। মনে মনে ঠিক করলাম, এখানে এসে একটা ব্যবস্থা করে দু-চারদিনের মধ্যেই আবার সিঙ্গাপুর ফিরে সেখানকার সব কাজ-কারবার বন্ধ করে চিরদিনের মত এখানে চলে আসব।
কিন্তু হায়! তখন কি জানতাম যে, এখানে এসে এ বাড়িতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই এই দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাব।
এই পর্যন্ত বলে পুরন্দর চৌধুরী যেন একটা বড় রকমের দীর্ঘশ্বাস কোনমতে রোধ করলেন।
.
১৮.
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার এক সময় পুরন্দর চৌধুরী বললেন, কিন্তু এখনও পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারছি না ইন্সপেক্টার, সত্যি কথা বলতে কি, এ দুর্ঘটনা কি করে ঘটল। আপনি বলছেন, বিনয়েন্দ্রকে কেউ হত্যা করেছে। কিন্তু আমি তো বুঝে উঠতে পারছি না বিনয়েন্দ্রকে কেউ হত্যা করতে পারে।এ যেন কেমন অবিশ্বাস্য বলে এখনও আমার মনে হচ্ছে।
কেন বলুন তো? ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করলেন।
প্রথমত বিয়েকে আমি খুব ভাল করেই জানতাম। ইদানীং বিনয়েন্দ্র আমার প্ররোচনায় মুক্তার নেশায় জড়িয়ে পড়েছিল সত্য, কিন্তু ওই একটি মাত্র নেশার বদ অভ্যাস ছাড়া তার চরিত্রে আর কোন দোষই তো ছিল না। মিতভাষী, সংযমী, স্নেহপ্রবণ, সমঝদার এবং যথেষ্ট বুদ্ধিমান লোক ছিল সে। এবং যতদূর জানি, তার কোন শত্রুও এ দুনিয়ায় কেউ ছিল বলে তো মনে হয় না। তার জীবনের অনেক গোপন কথাও আমার অজানা নয়তবু বলব, তাকে কেউ হত্যা করতে পারে এ যেন সম্পূর্ণই অবিশ্বাস্য।
আচ্ছা পুরন্দরবাবু, ইন্সপেক্টার প্রশ্ন করলেন, এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য রামচরণের মুখে যে বিশেষ একটি মহিলার কথা শুনলাম, তার সম্পর্কে কোন কিছু আপনি বলতে পারেন?
কি আপনি ঠিক জানতে চাইছে ইন্সপেক্টার?
কথাটা আমার কি খুব অস্পষ্ট বলে বোধ হচ্ছে পুরন্দরবাবু?
মিঃ বসাকের কথায় কিছুক্ষণ পুরন্দর চৌধুরী তাঁর মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, না ইন্সপেক্টার।
আপনি যা সন্দেহ করছেন বিনয়েন্দ্রর সে রকম কোন দুর্বলতাই ছিল না।
প্রত্যুত্তরে এবারে ইন্সপেক্টার আর কোন কথা বললেন না, কেবল মৃদু একটা হাসি তাঁর ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে উঠল।
পুরন্দর চৌধুরীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নাইন্সপেক্টারের ওষ্ঠপ্রান্তেরক্ষীণ হাসির আভাসটা।
তিনি বললেন, আপনি বোধ হয় আমার কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারলেন নাইন্সপেক্টার। কিন্তু সত্যিই আমি বলছি দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব আমাদের। তাকে আমি খুব ভালভাবেই জানতাম। স্ত্রীলোকের ব্যাপারে তার, সত্যি বলছি,কোন প্রকার দুর্বলতাই ছিল না।
এবারে মৃদুকণ্ঠে বসাক বললেন, বু আপনার কথা আমি পুরোখুরি বিশ্বাস করতে পারলাম পুরন্দরবাবু।
কেন বলুন তো?
নেশার কাছে যে মানুষ নিজেকে বিক্রি করতে পারে তার মধ্যে আর যে গুণই থাক কেন, নারীর প্রতি তার দুবর্লতা কখনও জাগবে না, এ যেন বিশ্বাস করতেই মন চায় না। কিন্তু যাক সে কথা। আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, সেই মিস্টিরিয়াস স্ত্রীলোকটি সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন কিনা।
খুববেশী জানবার অবকাশও আমার হয়নি। কারণবেশীক্ষণ তাকে দেখবার আমার অবকাশও হয়নি এবং তার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগও আমি পাইনি।
আপনি তাকে এ বাড়িতে দেখেছিলেন তা হলে?
হ্যাঁ।
কবে?
মাসদেড়েক আগে বিশেষ একটা কাজে কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাকে কলকাতায় আসতে হয় সেই সময়।
তাহলে মাসদেড়েক আগে আপনি আর একবার কলকাতায় এসেছিলেন এর আগে?
হ্যাঁ।
তারপর?
সেই সময় রাত, বোধ করি, তখন দশটা হবে। বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে এখানে দেখা করতে আসি।
অত রাত্রে এসেছিলেন যে?
পরের দিনই ভোরের প্লেনে চলে যাব, তাছাড়া সমস্ত দিনটাই কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তাই রাত্রে ছাড়া সময় করে উঠতে পারিনি।
আচ্ছা, আপনি যে সে দিন রাত্রে এসেছিলেন এ বাড়িতে রামচরণ জানত?
হ্যাঁ। জানে বৈকি। সে-ই তো আমার আসার সংবাদ বিনয়েন্দ্রকে দেয় রাত্রে।
যাক। তারপর বলুন।
বিনয়েন্দ্র আমাকে এই ঘরেই ডেকে পাঠায়। ইদানীং বৎসর খানেক ধরে বিনয়েন্দ্র একটা বিশেষ কি গবেষণা নিয়ে সর্বদাই ব্যস্ত থাকত, কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখলাম—
এই পর্যন্ত বলে পুরন্দর চৌধুরী যেন একটু ইতস্তত করতে লাগলেন।
বলুন। থামলেন কেন?
এই ঘরে ঢুকে দেখলাম ঘরের এক কোণে একটা আরাম-কেদারার উপর বিনয়েন্দ্র গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে। আর একটি তেইশ-চব্বিশ বছরের তরুণী অ্যাপ্রন গায়ে ঐ টেবিলটার সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন একটা এক্সপেরিমেন্ট করছেন-হাতে একটা তরল পদার্থপূর্ণ টেস্ট টিউব নিয়ে। আমার প্রবেশ ও পদশব্দ পেয়েও বিনয়েন্দ্র কোন সাড়া না দেওয়ায় আমিই তার সামনে এগিয়ে গেলাম। ডাকলাম, বিনু।
কে? ও, পুরন্দর। এস। তারপর কী সংবাদ? বলে অদূরে কার্যরত তরুণীকে সম্বোধন করে বললে, লতা, সল্যুশনটা হল?
সম্বোধিতা তরুণী বিনয়েন্দ্রর ডাকে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, না। এখনও সেডিমেন্ট পড়ছে।
কথাটা বলে তরুণী আবার নিজের কাজে মনঃসংযোগ করলেন।
বস পুরন্দর। দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বিনয়েন্দ্র বললে।
ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। সেই আলোয় বিনয়েন্দ্রর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।
চোখ দুটো বোজা। সমস্ত মুখখানিতে যেন একটা ক্লান্ত অবসন্নতা। চোখ খুলে যেন তাকাতেও তার কষ্ট হচ্ছে।
বুঝতে আমার দেরি হল না, আমারই যোগান দেওয়া সিংহলী মুক্তার নেশায় আপাতত বিনয়েন্দ্রন্দ্ৰ কুঁদ হয়ে আছে।
শুধু তাই নয়, মাসচারেক আগে শেষবার যে বিনয়েন্দ্রকে আমি দেখেছিলাম এ যেন সে বিনয়েন্দ্র নয়। তার সঙ্গে এর প্রচুর প্রভেদ আছে।
আরো একটু কৃশ, আরো একটু কালো হয়েছে সে। চোখের কোলে একটা কালো দাগ গভীর হয়ে বসেছে। কপালের দুপাশে শিরাগুলো একটু যেন শীত। নাকটা যেন আরও একটু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কেন জানি না ঠিক ঐ মুহূর্তে বিয়েকে দেখে আনন্দ হওয়ার চাইতে মনে আমার একটু যেন দুঃখই হল।
বুঝলাম, পুরোপুরিভাবেই আজ বিনয়েন্দ্র নেশায় কবলিত। এর আগে দেখেছি, সে রাত বারটা সাড়ে বারটার পর শুতে যাবার পূর্বে সাধারণত নেশা করত কিন্তু এখন দেখছি সে সময়ের নিয়ম-পালন বা মর্যাদা আর অক্ষুন্ন নেই। এতদিন নেশা ছিল তার সময়বাঁধা, ইচ্ছাধীন। এখন সেই হয়েছে নেশার ইচ্ছাধীন। নেশার গ্রাসে সে আজ কবলিত।
বিনয়েন্দ্র আমাকে বসতে বললে বটে, কিন্তু তার তখন আলোচনা কিছু করবার বা কথা বলবার মত অবস্থা নয়।
কিছুক্ষণ বসে থেকে আবার ডাকলাম, বিনু!
অ্যাঁ? অতি কষ্টে যেন চোখ মেলে তাকাল বিনয়েন্দ্র। তারপর বললে, তুমি তো রাতটা আছ। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নাও। কাল সকালে শুনব তোমার কথা।
বললাম, রাত্রে আমি থাকব না। এখুনি চলে যাব।
ও, চলে যাবে। যাও এবারে কিছু বেশী করে পার্লস পাঠিয়ে দিও তো, একটা দুটোয় আজকাল আর শানাচ্ছে না হে।
বিনয়েন্দ্রর কথায় চমকে উঠলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ফিরে তাকালাম অদূরে দণ্ডায়মান সেই তরুণীর দিকে।
তরুণীর দিকে তাকাতেই স্পষ্ট দেখলাম, সে যেন আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল, অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। সে যে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল বুঝতে আমার কষ্ট হল না।
নেশার ঘোরে আবার হয়ত বেফাঁস কি বলে বসবে বিনয়েন্দ্র, তাই আর দেরি না করে ফিরে আসবার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই বিনয়েন্দ্র আবার চোখ মেলে তাকিয়ে বললে, চললে নাকি পুরন্দর?
হ্যাঁ। ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। তাছাড়া কাল খুব ভোরে আমার প্লেন ছাড়ছে।
তা যাও। তবে বলছিলাম—
কী?
দামটা কিছু কমাও না। একেবারে যে চীনে জোঁকের মত শুষে নিচ্ছ। এমন বেকায়দায় তুমি ফেলবে জানলে কোন্ আহাম্মক তোমার ঐ ফাঁদে পা দিত!
ছেড়ে দিলেই তো পার। কথাটা কেমন যেন আমার আপনা থেকেই মুখ দিয়ে হঠাৎ বের হয়ে গেল।
কি বললে! ছেড়ে দেব? হ্যাঁ, এইবার খাঁটি ব্যবসাদারী কথা বলছ। কি করব, অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই নেশাটা ছাড়তে পারলাম না। নইলে দেখিয়ে দিতাম তোমায়।
বিনয়েন্দ্রর কথায় দুঃখও হল, হাসিও পেল।
কিন্তু বুঝতে পারছিলাম ঘরের মধ্যে উপস্থিত ঐ মুহূর্তে তৃতীয় ব্যক্তিটি আর যাই করুক, কাজের ভান করলেও তার সমস্ত শ্রবণেন্দ্রিয় প্রখর করে আমাদের উভয়ের কথাগুলো শুনছে।
তাড়াতাড়ি তাই কথা আর না বাড়তে দিয়ে দরজার দিকে অগ্রসর হলাম।
দরজা বরাবর এসে কি জানি কেন নিজের কৌতূহলকে আর দাবিয়ে রাখতে পারলাম না। ফিরে তাকালাম।
সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম একজোড়া শাণিত ছুরির ফলার মত দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ। দরজা খুলে বের হয়ে এলাম, কিন্তু মনে হতে লাগল সেই শাণিত ছুরির ফলার মতো চোখের দৃষ্টিটা যেন আমার পিছনে পিছনে আসছে।
কথাগুলো একটানা বলে পুরন্দর চৌধুরী থামলেন।
তারপর?
তারপর? আবার বলতে শুরু করলেন, সেই কয়েক মুহূর্তের জন্য তাকে দেখেছিলাম। আর দেখিনি। এবং ঐ কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখাই। পরিচয় হয়নি। এবং পরিচয়ের অবকাশও ঘটেনি। তারপর তো এবারে এসে শুনলাম, কিছুদিন আগে হঠাৎ তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছেন।
এবারে ইন্সপেক্টার কথা বললেন, যাক। তবু সেই মিস্টিরিয়াস ভদ্রমহিলাটির নামের একটা হদিস পাওয়া গেল। আর একটা কথা মিঃ চৌধুরী?
বলুন।
এত রাত্রে আপনি এ ঘরে এসেছিলেন কেন চোরের মত গোপমে, সন্তর্পণে?
সবই যখন আপনাকে বলেছি সেটুকু বলবারও আমার আর আপত্তি থাবার কি থাকতে পারে ইন্সপেক্টার। বুঝতে হয়তো পারছেন, আমি এসেছিলাম সেই সিংহলী মুক্তা যদি এখনও অবশিষ্ট পড়ে থাকে তো সেগুলো গোপনে সরিয়ে ফেলবার জন্য। কারণ মাত্র দিন কুড়ি আগে একটা পার্সেল ডাকযোগে আমি পাঠিয়েছিলাম। ঠিক আমার স্ত্রী ও পুত্র যেদিন সপাঘাতে মারা যায় তারই আগের দিন সকালবেলা।
পুরন্দর চৌধুরীর কথা শুনে ইন্সপেক্টার কয়েক মুহূর্ত আবার ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, কিন্তু আপনার মুখেই একটু আগে শুনেছি মিঃ চৌধুরী, সেগুলো এমনি হঠাৎ দেখলে কারও পক্ষেই সাধারণ বড় আকারের মুক্তা ছাড়া অন্য কিছুই। ভাবা সম্ভব নয়; তবে আপনি সেগুলো সরাবার জন্য এত ব্যস্ত হয়েছিলেন কেন। আর এ ঘরেই যে সেগুলো পাবেন তাই বা আপনি ভাবলেন কি করে?
এ তো খুব স্বাভাবিক ইন্সপেক্টার। এই ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যেই তার বেশীর ভাগ সময় দিন ও রাত্রি কাটত। তাছাড়া এই ঘরে আলমারিতে তার গবেষণার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নানাপ্রকার ওষুধপত্র থাকতো, সেদিক দিয়ে সেগুলো এখানে রাখাই তো স্বাভাবিক।
হুঁ। একেবারে অসম্ভব নয়।
আর তাছাড়া হঠাৎ ওষুধপত্রের মধ্যে ঐ মুক্তা জাতীয় বস্তুগুলো কেউ দেখতে পেলে পুলিসের পক্ষে সন্দেহ জাগাও কি স্বাভাবিক নয়?
পুরন্দর চৌধুরীর যুক্তিটা খুব ধারালো না হলেও ইন্সপেক্টার আর কোন তর্কের মধ্যে গেলেন না। ইতিমধ্যে রাত্রিও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল।
খোলা জানালাপথে অন্ধকারমুক্ত আকাশের গায়ে আলো একটু একটু করে তখন ফুটে উঠছে। ঘরের আলোটা নিবিয়ে দিয়ে দুজনে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই ঝিরঝিরে প্রথম ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া জাগরণক্লান্ত চোখে-মুখে যেন স্নিগ্ধ চন্দনস্পর্শের মত মনে হল ইন্সপেক্টারের।
ক্ষণপূর্বে শোনা পুরন্দর চৌধুরীর বিচিত্র কাহিনীটা তখনও তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে ফিরছে। সত্য হোক বা মিথ্যা হোক, সত্যিই পুরন্দর চৌধুরীর কাহিনী বিচিত্র।
বাড়ির কেউ হয়তো এখনও জাগে নি। সকলেই যে যার শয্যায় ঘুমিয়ে।
পুরন্দর চৌধুরীকে সত্যিই বড় ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। তিনি ইন্সপেক্টারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধীর মন্থর পদে তাঁর নির্দিষ্ট ঘরের দিকে চলে গেলেন।
.
রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি মাথার মধ্যে তখনও যেন কেমন দপ দপ করছে। একাকী দোতলার বারান্দায় পায়চারী করতে করতে ইন্সপেক্টার আগাগোড়া সমগ্র ঘটনাটা যেন পুনরায় ভাববার চেষ্টা করতে লাগলেন। এবং তখনও সেই চিন্তার সবটুকু জুড়েই যেন পুরন্দর চৌধুরীর বর্ণিত কাহিনীটাই আনাগোনা করতে থাকে।
বিনয়েন্দ্র রায়ের হত্যার ব্যাপারটা মিঃ বসাক যতটা সহজ ভেবেছিলেন, এখন যেন ক্রমেই মনে হচ্ছে ততটা সহজ নয়। রীতিমত জটিল।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে কেটে যাচ্ছিল দিন, অবিবাহিত বিনয়েন্দ্রর এবং একটিমাত্র রহস্যময়ী নারীর মাস দুয়েকের সংস্পর্শ ব্যতীত অন্য কোন নারীঘটিত ব্যাপারের কোন হদিসই আপাতত পাওয়া যাচ্ছে না। এবং সেই রহস্যময়ী নারীটির সঙ্গে তার কতখানি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল এবং আগে কোন ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল কিনা তারও কোন সঠিক সংবাদ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
বিনয়েন্দ্রর অর্থের অভাব ছিল না। এবং বিশেষ করে ব্যাচিলর অবস্থায় প্রচুর অর্থ হাতে থাকায় সাধারণত যে দুটি দোষ সংক্রামক ব্যাধির মতই সঙ্গে দেখা দেয় প্রায় সর্বক্ষেত্রেই নারী ও নেশা, তার প্রথমটি সম্পর্কে কোনও কিছু এখন পর্যন্ত সঠিক না জানা গেলেও শেষোক্তটি সম্পর্কে জানা যাচ্ছে সে-ব্যাধিটির কবলিত বেশ রীতিমতভাবেই হয়েছিলেন বিনয়েন্দ্র। এবং সে ব্যাপারের জন্য মূলত দায়ী তারই অন্যতম কলেজ-জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঐ পুরন্দর চৌধুরী।
পুরন্দর চৌধুরী!
সঙ্গে সঙ্গেই যেন নতুন করে আবার পুরন্দর চৌধুরীর চিন্তাটা মনের মধ্যে জেগে ওঠে ইন্সপেক্টারের। লোকটার বুদ্ধি তী, ধূর্ত, সতর্ক এবং প্রচণ্ড সুবিধাবাদী ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ।
প্রথম দিকে ভদ্রলোক একেবারেই মুখ খোলেননি বা খুলতে চাননি।
অতর্কিতে ল্যাবরেটরী ঘরে রাত্রির অভিসারে ধরা পড়ে গিয়েই তবে মুখ খুলেছেন। এবং শুধু মুখ খোলাই নয়, বিচিত্র এক কাহিনীও শুনিয়েছেন।
লোকটা কিন্তু তথাপি এত সহজ বা সরল মনে হচ্ছে না ইন্সপেক্টারের।
সহসা এমন সময় ইন্সপেক্টারের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল সিঁড়িতে একটা দ্রুত স্খলিত পদশব্দ শুনে। কে যেন সিঁড়িপথে উঠে আসছে।
ফিরে তাকালেন ইন্সপেক্টার সিঁড়ির দিকে।
.
১৯.
যে ব্যক্তিটি সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভোরের আলোয় তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল সে আর কেউ নয় ঐ বাড়ির একজন ভৃত্য রেবতী।
রেবতীর চোখে মুখে একটা স্পষ্ট ব্যস্ততা ও আতঙ্ক।
রেবতীই কথা বললে প্রথমে উত্তেজিত কণ্ঠে, ইন্সপেক্টার সাহেব, রামচরণ বোধ হয় মারা গেছে।
কথাটা শুনেই মিঃ বসাক রীতিমত যেন চমকে ওঠেন। তাঁর বিস্মিত কষ্ঠ হতে আপনা হতেই যে কথাগুলো বের হয়ে এল, মারা গেছে রামচরণ! সে কি!
হ্যাঁ। আপনি একবার শীগগিরই নীচে চলুন।
চল্ তো দেখি।
কোনরূপ সময়ক্ষেপ না করে রেবতীর পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন ইন্সপেক্টার। একতলার একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের শেষ ঘরটির দরজাটা তখনও খোলাই ছিল।
রেবতীই প্রথমে গিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল খোলা দরজাপথে।
মিঃ বসাক তার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকলেন।
ঘরের আলোটা তখনও জ্বলছে। যদিও পশ্চাতের বাগানের দিককার খোলা জানলাপথে ভোরের পর্যাপ্ত আলো ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে।
ভোরের সেই স্পষ্ট আলোয় যে দৃশ্যটি ইন্সপেক্টারের চোখে পড়ল ঘরে প্রবেশ করেই, তা যেমন বীভৎস তেমনি করুণ।
জানলার প্রায় লাগোয়া একটা চৌকির উপরে রামচরণের দেহটা চিত হয়ে পড়ে আছে।
মুখটা দরজার দিকেও একটু কাত হয়ে আছে।
চোখের পাতা খোলা, চোখের মণি দুটো যেন ঠেলে বের হয়ে এসেছে।
মুখটা ঈষৎ হাঁ হয়ে আছে। এবং সেই দ্বিধাবিভক্ত, হাঁ করা ওষ্ঠের প্রান্ত বেয়ে নেমে এসেছে লালামিশ্রিত ক্ষীণ একটা রক্তের ধারা।
সমস্ত মুখখানা যেন নীল হয়ে আছে। খালি গা, পরিধানে একটি পরিষ্কার ধুতি, প্রসারিত দুটি বাহুশয্যার উপরে মুষ্টিবদ্ধ।
প্রথম দর্শনেই বোঝা যায় সে দেহে প্রাণ নেই।
কয়েকটা মুহূর্ত সেই বীভৎস দৃশ্যের সামনে নির্বাক স্থাণুর মতই দাঁড়িয়ে রইলেন মিঃ বসাক।
এ যেন সেই গতকাল সকালের বীভৎস করুণ দৃশ্যেরই হুবহু পুনরাবৃত্তি।
আশ্চর্য, চবিবশ ঘণ্টাও গেল না প্রথম বাড়ির মালিক তারপর বাড়ির পুরাতন ভৃত্য সম্ভবতঃ একইভাবে নিষ্ঠুর হত্যার কবলিত হল।
কে জানত গতকাল রাত্রে এগারোটার সময় সকলকে খাইয়ে দাইয়ে যে লোকটা সকলের শয়নের ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দিয়ে বিদায় নিয়ে এসেছিল তার মৃত্যু এত নিকটে ঘনিয়ে এসেছে!
কে জানত মৃত্যু তার একেবারে ঠিক পশ্চাতে এসে মুখব্যাদন করে দাঁড়িয়েছে। প্রসারিত করেছে তার করাল বাহ!
আকস্মিক ঘটনা পরিস্থিতির বিহ্বলতাটা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টার তাঁর প্রায় পাশেই দণ্ডায়মান রেবতীর দিকে।
রেবতী, কখন তুমি জানতে পেরেছ এই ব্যাপারটা?
সকালে উঠেই এ ঘরে ঢুকে।
সকালে উঠেই এ ঘরে এসেছিলে কেন?
উনুনে আগুন দিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করব কিনা জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম।
ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল?
হ্যাঁ। তবে কপাট দুটো ভেজানো ছিল।
রামচরণ কি সাধারণত ঘরের দরজা খুলেই শুত রেবতী?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তুমি কোন্ ঘরে থাক?
ঠিক এর পাশের ঘরটাতেই।
কাল রাত্রে শেষ কখন তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল রামচরণের, রেবতী।
কত রাত তখন ঠিক আমি বলতে পারব না, আপনাদের খাওয়াদাওয়ার পরই রামচরণ রান্নাঘরে আসে, আমি তখন রান্নাঘর পরিষ্কার করছিলাম। আমাকে ডেকে বললে, তার শরীরটা নাকি তেমন ভাল নয়, আর ক্ষুধাও নেই, সে শুতে যাচ্ছে।
বলেছিল তার শরীরটা ভাল নয়?
হ্যাঁ। অবিশ্যি কথাটা শুনে আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম সাহেব।
কেন বল তো?
তা আজ্ঞে আজ পাঁচ বছর হল এ বাড়িতে আমি আছি, কখনও তো রামচরণকে অসুস্থ হতে দেখিনি। তবে কাল রাত্রে বোধ হয়—
কথাটা সম্পূর্ণ শেষ না করে যেন একটু ইতস্তত করেই থেমে গেল রেবতী।
কাল রাত্রে বোধ হয় কী রেবতী? চুপ করলে কেন?
আজ্ঞে, রামচরণ নেশা করত।
নেশা করত? কতকটা যেন চমকিতভাবেই ইন্সপেক্টার প্রশ্নটা করলেন রেবতীকে। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল সিংহলী মুক্তার কথা।
প্রভু ভৃত্য দুজনেই কি তবে মুক্তার নেশায় অভ্যস্ত ছিল নাকি!
কি নেশা করত রামচরণ?
আজ্ঞে, রামচরণ আফিং খেত।
আফিং! কথাটা বলে মিঃ বসাক তাকালেন রেবতীর মুখের দিকে।
আজ্ঞে হ্যাঁ। সন্ধ্যার দিকে তাকে রোজ একটা মটরের দানার মত আফিং খেতে দেখতাম। তবে কাল রাত্রে বোধ হয় তার আফিংয়ের মাত্রাটা একটু বেশীই হয়েছিল আমার মনে হয়।
কি করে বুঝলে?
কাল যেন রামচরণের একটু ঝিমঝিম ভাব দেখেছি।
ইন্সপেক্টর কিছুক্ষণ অতঃপর চুপ করে কি যেন ভাবলেন।
তারপর আবার প্রশ্ন করলেন, তুমি তো পাশের ঘরেই ছিলে রেবতী, রাত্রে কোনরকম শব্দ বা গোলমাল কিছু শুনেছ?
আজ্ঞে না!
কোন কিছুই শোননি?
না।
কাল কত রাত্রে শুতে গিয়েছিলে ঘরে?
রামচরণ কথা বলে চলে আসবার পরই খাওয়াদাওয়া সেরে এসে শুয়ে পড়ি।
.
২০.
একটা চাদর দিয়ে রামচরণের মৃতদেহটা ঢেকে রেবতীকে নিয়ে ইন্সপেক্টার বসাক ঘর থেকে বের হয়ে এলেন।
দরজাটা বন্ধ করে রেবতীতে বললেন, ঠাকুর আর করালীকে ডেকে নিয়ে তুমি ওপরে এস রেবতী।
দোতলায় এসে ইন্সপেক্টার দেখলেন মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। উভয়ের চোখাচোখি হল। দোহারা চেহারা হলেও বেশ বলিষ্ঠ গঠন ভদ্রলোকের!
মাথার এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে বেশ মসৃণ চকচকে একখানি টাক।
মাথার বাকি অংশে যে কেশ তাও বিরল হয়ে এসেছে।
উঁচু খাঁড়ার মত নাক। প্রশস্ত কপাল। ভাঙা গাল, গালের হনু দুটো যেন বয়ের আকারে ঠেলে উঠেছে। গোল গোল চোখ। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের সেলুলয়েডের চশমা। পুরু লেন্সের ওধার হতে তাকিয়ে আছেন ভদ্রলোক। উপরের ওষ্ঠ পুরু একজোড়া গোঁফে প্রায় ঢাকা বললেও অত্যুক্তি হয় না। নীচের পুরু কালচে বর্ণের ওষ্ঠটা যেন একটু উটে আছে। পুরুষ্টু গোঁফের অন্তরাল হতেও দেখা যায় উপরের দাঁত্রে সারি। উঁচু দাঁত। পরিধানে ধুতি ও গলাবন্ধ মুগার চায়না কোট। পায়ে চকচকে কালো রংয়ের ডার্বি শু।
আপনি? প্রথমেই প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টার।
আমার নাম প্রতুল বোস। এ বাড়ির সরকার। আপনি বোধ হয় পুলিসের কেউ হবেন?
হ্যাঁ। পুলিস ইন্সপেক্টার প্রশান্ত বসাক।
গেটেই পুলিস প্রহরী মোতায়েন দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। তার মুখেই একটু আগে সব শুনে এলাম, কিন্তু ব্যাপারটা যে কিছুতেই এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছিনা ইন্সপেক্টর। সত্যিই কি বিনয়েন্দ্রবাবুকে কেউ মাডার করেছে?
হাঁ। ব্যাপারটা যতই অবিশ্বাস্য হোক, সত্যি। আর শুধু তাই নয় প্রতুলবাবু, গত রাত্রে ইতিমধ্যেই আরও একটি হত্যাকাণ্ড এ বাড়িতে সংঘটিত হয়েছে।
তার মানে! কী আপনি বলছেন ইন্সপেক্টার? আবার কাকে কে হত্যা করল কাল রাত্রে এ বাড়িতে!
কে হত্যা করেছে তা জানি না। তবে হত্যা করেছে এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্যকে।
কে! রামচরণ!
হ্যাঁ। সে-ই নিহত হয়েছে।
এ সব আপনি কি বলছেন ইন্সপেক্টার! বাড়ির চার পাশে পুলিস প্রহরী, আপনি নিজে উপস্থিত ছিলেন এখানে; এমন দুঃসাহস?
দুঃসাহস বটে প্রতুলবাবু।
ইন্সপেক্টার বসাকের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দরজা খুলে প্রথমে রজত ও তারপরই সুজাতা যে-যার নির্দিষ্ট ঘর থেকে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
বসাকের শেষের কথাটা রজতের কানে গিয়েছিল, সে এগিয়ে আসতে আসতে প্রশ্ন করল, কি দুঃসাহসের কথা বলছিলেন ইন্সপেক্টার?
এই যে রজতবাবু! আসুন কাল রাত্রেও আবার একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এ বাড়িতে।
সে কি! অস্ফুট আর্ত চিৎকারে কথাটা বলে রজত, আবার! আবার কে নিহত হল?
রামচরণ। রামচরণ!
হ্যাঁ।
সুজাতার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হয় না। সে ফ্যাল ফ্যাল করে সদ্য-ঘুমভাঙা চোখে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এবং হঠাৎ যেন কেমন তার মাথাটা ঘুরে ওঠে। ঢুলে পড়ে যাচ্ছিল সুজাতা, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই ইন্সপেক্টার বসাক চকিতে এগিয়ে এসে দুহাত বাড়িয়ে সুজাতার পতনোম্মুখ দেহটা সযত্নে ধরে ফেললেন।
কী হল! কী হল সুজাতা! সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসে রজতও। সুজাতার দু চোখের পাতা যেন নিমীলিত। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিথিল। ইতিমধ্যে ইন্সপেক্টারবাকপাঁজা-কোলে সুজাতার শিথিল দেহটা প্রায় বুকের উপর তুলে নিয়ে এগিয়ে যান সামনের খোলা দরজাপথে ঘরের মধ্যে।
ঘরের মধ্যে খাটের উপর পাতা শয্যাটার উপরে এসে সযত্নে ইন্সপেক্টার সুজাতার দেহটা শুইয়ে দিলেন।
রজত পাশেই এসে দাঁড়িয়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে ইন্সপেক্টার বললেন, দেখুন তো ঘরের কোণে ঐ কুঁজোতে বোধ হয় জল আছে।
কুঁজোর পাশেই একটা কাঁচের গ্লাস ছিল, প্রতুলবাবুই গ্লাসে করে তাড়াতাড়ি কুঁজো থেকে জল ঢেলে এনে দিলেন।
কী হল! একজন ডাক্তার কাউকে ডাকলে হত না? রজত ব্যগ্র কণ্ঠে বলে।
গ্লাস থেকে জল নিয়ে শায়িত সুজাতার চোখে-মুখে জলের মৃদু ঝাপটা দিতে দিতে সুজাতার নিমীলিত চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ইন্সপেক্টার বসাক বললেন, না। ব্যস্ত হবেন না রজতবাবু। একেগতকালের ব্যাপার থেকে হয়অেস্ট্রেনযাচ্ছিল, তার উপর আজকের নিউজটা একটা শক্ দিয়েছে। তাই হয়তো জ্ঞান হারিয়েছে। আপনি বরং পাখার সুইচটা অনুগ্রহ করে অন্ করে দিন।
রজত এগিয়ে পাখার সুইচটা অন করে দিল।
মৃদু মিষ্টি একটা ল্যাভেণ্ডারের গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে প্রবেশ করছে। জলবিন্দুশোভিত কোমল চার কপালটি, তার আশেপাশে চুর্ণকুন্তলের দু-এক গাছি স্থানভ্রষ্ট হয়ে জলের সঙ্গে কপালে জড়িয়ে গিয়েছে। নিমীলিত আঁখির জলসিক্ত পাতা দুটি মৃদু কাঁপছে। বাম গণ্ডের উপরে কালো ছোট্ট তিলটি।
অনিমেষে চেয়ে থাকেন ইন্সপেক্টার বসাক মুখখানির দিকে। শুধু কি মুখখানিই! নিটোল চিবুক, ঠিক তার নীচে শঙ্খের মত সুন্দর গ্রীবা। গ্রীবাকে বেষ্টন করে চিকচিক করছে সরু সোনার একটি বিছে হার। গলাকাটা ব্লাউজের সীমানা ভেদ করে থেকে থেকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলিত হচ্ছে যেন সুধাভরা দুটি স্বর্ণকুম্ভ।
চোখের দৃষ্টি যেন ঘুরিয়ে নিতে পারেন না ইন্সপেক্টার বসাক। সত্যিই আজ বুঝি সুপ্রভাত।
সব কিছু ভুলে গিয়ে যেন ইন্সপেক্টার চেয়ে রইলেন বসে সেই মুখখানির দিকে।
এবং বেশ কিছুক্ষণ পরে কম্পিত ভীরু চোখের পাতা দুটি খুলে তাকাল সুজাতা।
সুজাতাদেবী! স্নিগ্ধ কণ্ঠে ডাকেন ইন্সপেক্টার বসাক।
বিস্রস্ত বেশ ঠিক করে উঠে বসবার চেষ্টা করে সুজাতা, কিন্তু বাধা দেন ইন্সপেক্টার বসাক, উঠবেন না, আর একটু শুয়ে থাকুন। চলুন রজতবাবু, আমরা বাইরে যাই। উনি একটু বিশ্রাম নিন।
ইন্সপেক্টার বসাকের ইঙ্গিতে সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
দরজাটা নিঃশব্দে ভেজিয়ে দিলেন বসাক।
২১-২৫. গত রাত্রে নীচের তলায়
গত রাত্রে নীচের তলায় যে ঘরে বসে সকলের কথাবার্তা হয়েছিল ইন্সপেক্টার বসাক সেই ঘরেই এসে প্রতুল বোস ও রজতকে নিয়ে প্রবেশ করলেন।
রেবতীর মুখেই ইতিমধ্যে সংবাদটা ড্রাইভার করালী, পাচক লছমন ও দারোয়ান ধনবাহাদুর জানতে পেরেছিল।
তারাও এসে দরজার বাইরে ভিড় করে দাঁড়ায় ইতিমধ্যে। ঐ সঙ্গে প্রহরারত একজন বাঙালী কনেস্টবল মহেশও দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়।
সর্বাগ্রে মহেশকে ডেকে মিঃ বসাক থানায় রামানন্দ সেনকে তখুনি একটা সংবাদ দিতে বললেন, সংবাদ পাওয়া মাত্রই নীলকুঠীতে চলে আসবার জন্য। মৃতদেহটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
রেবতীকে যা জিজ্ঞাসাবাদ করবার করা হয়ে গিয়েছিল বলে ইন্সপেক্টর বসাক প্রথমে ডাকলেন লছমনকে। লছমন সাধারণত একটু ভীতু প্রকৃতির লোক। তার উপরে রেবতীর মুখে রামচরণেরখুন হবার সংবাদ পাওয়া অবধি সে যেন আর তার মধ্যেই ছিল না। ইন্সপেক্টারের আহ্বানে সে যখন তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল তার গলা দিয়ে স্বর বেরুবার মত অবস্থাও তখন আর তার নেই।
নাম কি তোর?
গোটা দুই ঢোঁক গিলে কোনমতে লছমন নামটা তার উচ্চারণ করে।
কাল রাত্রে কখন শুতে গিয়েছিলি?
লছমণের যদিও মুঙ্গের জিলায় বাড়ি, দশ বছর বাংলাদেশে থেকে বেশ ভালই বাংলা ভাষাতে কথাবার্তা বলতে পারে।
সে আবার কোনমতে একটা ঢোঁক গিলে বললে, রাত এগারোটার পরই হবে সাহেব।
শুনলাম, কাল রাত্রে নাকি রামচরণ কিছু খায়নি, সত্যি?
হ্যাঁ সাহেব। রামচরণ কাল রাত্রে কিছুই খায়নি।
কেন খায়নি জানিস কিছু?
না। বলতে পারি না সাহেব।
রামচরণ বোজ আফিং খেত, জানিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ, দেখেছি তাকে খেতে।
তুই দেখেছিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
হুঁ, কাল রাত্রে তুই একটানাই ঘুমিয়েছিলি না এক-আধবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল?
একবার মাঝখানে উঠেছিলাম বাইরে যাবার জন্য।
সেই সময় কিছু শব্দ বা কিছু শুনেছিস?
আজ্ঞে–
লছমন যেন কেমন একটু ইতস্তত করতে থাকে।
এবারে একটু চড়া সুরে মিঃ বসাক বললেন, চুপ করে রইলি কেন? যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দে।
আজ্ঞে আমি যখন বাইরে থেকে ঘুরে আবার ঘরে ঢুকতে যাব—
কী? আবার থামল দেখ। বল্–
তখন যেন মনে হল কে একজন সাদা চাদরে গা ঢেকে রামচরণের ঘর থেকে বের হয়ে রান্না-ঘরের সামনে যে সরু ফালি বারান্দাটা সেই দিকে চট্ করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ভয়ে বাবু তখন আমার গলা শুকিয়ে এসেছে, অড়াতাড়ি উঠি কি পড়ি কোনমতে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে খিল তুলে দিই।
কেন, ভেবেছিলি বুঝি ভূত?
আজ্ঞে সাহেব। গত মাসখানেক ধরে রামচরণের মুখে শুনেছি—
কি শুনেছিস?
বুড়োকতাবাবু নাকি ভূত হয়ে এ বাড়িতে রাত্রে ঘুরে বেড়ায় মধ্যে মধ্যে।
কি বললি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমাদের বাবুও নাকি তাকে–ঐ বুড়োকতাবাবুর ভূতকে অনেক রাত্রে উপরের বারান্দায় ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন।
রামচরণ তোকে ঐ কথা বলেছিল?
হ্যাঁ।
শুধু তোদের কর্তাবাবুই বুড়োকতার ভূত দেখেছিলেন না তোরাও কেউ কেউ এর আগে দেখেছিস?
আমি বা রামচরণ কখনও দেখিনি তবে করালী নাকি বার দু-তিন দেখেছিল।
ভূত তুই বিশ্বাস করিস?
কি যে বলেন বাবু! সিয়ারাম! সিয়ারাম। ভূত প্রেত তেনারা আছে বৈকি!
রেবতী, করালী ওদের তোর কেমন লোক বলে মনে হয়?
রেবতীও আমারই মত ভীতু বাবু, তবে করালীর খুব সাহস।
মৃদু হেসে ইন্সপেক্টার এবারে বললেন, আচ্ছা হ্যাঁ। করালীকে এ ঘরে পাঠিয়ে দে।
নমস্কার জানিয়ে লছমন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
তার মুখ দেখে মনে হল সে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
ইন্সপেক্টার বসাক লছমনকে প্রশ্ন করতে করতে তাঁর ডাইরীতে মধ্যে মধ্যে নোট করে নিচ্ছিলেন।
রজত স্তব্ধ হয়ে পাশেই একটা চেয়ারে বসেছিল।
এমন সময় আবার ঘরের বাইরে জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই বলতে গেলে স্থানীয় থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
.
২২.
আবার কি হল স্যার? রামানন্দ সেন প্রশ্ন করলেন।
এই যে মিঃ সেন, আসুন। বসুন—
মুখ তুলে আহ্বান জানালেন ইন্সপেক্টার রামানন্দ সেনকে।
রামানন্দ সেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।
This time poor রামচরণ।
বলেন কি, মানে সেই বৃদ্ধ পুরাতন ভৃত্য–সত্যি—
হ্যাঁ। তারপর একটু থেমে আবার বললেন, কিছুটা এখন অবশ্য বুঝতে পারছি আমারই অসাবধানতার জন্যে বেচারীকে প্রাণ দিতে হল।
কি বলছেন স্যার।
ঠিকই বলছি মিঃ সেন। রামচরণের কথাবার্তা শুনেই কলি মনে হয়েছিল স্বেচ্ছায় আমার প্রশ্নের জেরায় পড়ে যতটুকু সে স্বীকার করেছে, সেটাই সব নয়। যে কোন কারণেই হোক অনেক কথাই সে গোপন করে গিয়েছে। তাই কাল মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম একদিনেই আর বেশি চাপ দেব না। আজ রইয়ে সইয়ে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করব। এবং আমার অনুমান যে এক্কেরে মিথ্যা নয়, তার মৃত্যুই সেটা প্রমাণ করে দিয়ে গেল। তাই বলছিলাম কাল যদি একটু রামচরণ সম্পর্কে সতর্ক থাকতাম এবং তার উপরে আরো একটু নজর রাখতাম, তবে হয়তো এমনি করে তাকে নিহত হতে হত না।
আপনি কি বলতে চান স্যার বিনয়েন্দ্রবাবুর হত্যাকারীই তবে রামচরণকেও হত্যা করেছে!
নিশ্চয়ই। একই কালো হাতের কাজ। এবং এ বিষয়ও আমি স্থির নিশ্চয়ই যে বিনয়েন্দ্রর হত্যার ব্যাপারে অনেক কিছু জানত বলেই সে বেচারীকে হত্যাকারীর হাতে এইভাবে এত তাড়াতাড়ি প্রাণ দিতে হল। অনেক কথাই বিনয়েন্দ্রবাবু সম্পর্কে আমাকে সেগতকাল বলেছিল, আরও বেশী কিছু না প্রকাশ করে বসে যাতে করে হত্যাকারীর বিপদ ঘটতে পারে, সেই আশঙ্কাতেই হয়তো হত্যাকারী এত তাড়াতাড়ি তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলল। এবং—
কথাটা ইন্সপেক্টার শেষ করতে পারলেন না হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন। বললেন, কে?
একটা মুখ দরজাপথে উঁকি দিয়েছিল।
ইন্সপেক্টরের প্রশ্নে ঘরের অন্যান্য সকলেরই দৃষ্টি সেইদিকে আকর্ষিত হয়।
একটা ভাঙা কর্কশ গলায় প্রশ্নোত্তর এল, আজ্ঞে, আমি করালী।
এস, ভেতরে এস।
করালী ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।
লোকটা দেখতে রোগা লম্বা। কালো পালিশ করা গায়ের রং। মুখভর্তি বসন্তের বিশ্রী ক্ষতচিহ্ন। নাকটা একটু চাপা। পুরু ঠোঁট অত্যাধিক ধূমপানে একেবারে কালচে হয়ে গেছে। মাথার চুল পর্যাপ্ত, তেল চকচক করছে। এলবার্ট তেড়ি। পরিধানে সাধারণ একটা ধোপ-দুরন্ত ধুতি ও গায়ে একটা সাদা অনুরূপ সিবু টুইলের হাফসার্ট।
আমাকে ডেকেছিলেন স্যার?
হ্যাঁ। কিন্তু ঘরে না ঢুকে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে উঁকি মারছিলে কেন?
আজ্ঞে উঁকি তত মারিনি, ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম আপনারা কথা বলছেন, তাই ঢুকতে একটু ইতস্তত করছিলাম।
হুঁ, তুমি তো এই নীচের তলাতেই লছমনের ঘরের পাশের ঘরটাতেই থাক?
আজ্ঞে।
কাল রাত্রে কখন ঘুমিয়েছিলে?
আজ্ঞে, শরীরটা আমার কয়দিন থেকেই ভাল যাচ্ছিল না বলে কাল রাতে আর কিছু খাইনি, সাড়ে নটার মধ্যেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।
শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
আজ্ঞে একরকম তাই, আমার তো বিছানায় শোওয়া আর ঘুমোনো।
রাত্রে আর ঘুম ভাঙেনি?
না।
কিন্তু ওই একটি মাত্র উচ্চারিত শব্দও যেন ইন্সপেক্টারের মনে হল, করালী একটু ইতস্তত করেই উচ্চারণ করল।
কাল রাত্রে তাহলে কোন রকম শব্দ বা চিৎকার শোননি?
শব্দ? চিৎকার? কই না।
হুঁ। ইন্সপেক্টার কি যেন ভাবতে লাগলেন।
তারপর হঠাৎ আবার প্রশ্ন শুরু করলেন, করালী, তুমি তো বছরখানেক মাত্র এখানে চাকরি নিয়েছ, তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এর আগে কোথায় কাজ করতে?
কোথাও দুচার দিনের বেশি একটা ঠিকে কাজ ছাড়া করিনি, একমাত্র এই বাড়িতেই এই একবর একটানা কাজ করছি।
তোমার ড্রাইভিং লাইসেন্স কত দিনের?
চার বছরের।
চার বছর লাইসেন্স পেয়েছ, অথচ কোথাও এর আগে বড় একটা কাজ করোনি। কি করে তাহলে দিন চালাতে?
তা আর চলত কই স্যার। আজকাল ভাল সুপারিশপত্র না হলে প্রাইভেট গাড়ি চালাবার কাজ কি বিশ্বাস করে কেউ দিতে চায় স্যার? কাজের সন্ধান নিয়ে কারও কাছে গেলেই। অমনি সকলে প্রশ্ন করবেন, আগে কোথায় কাজ করেছ, কেমন কাজ করতে তার সাটিফিকেট দেখাও।
হুঁ। তা বিনয়েন্দ্রবাবু সে রকম কিছু দেখতে চাননি তোমার কাছে?
আজ্ঞে না। আজ্ঞে তিনি ছিলেন সত্যিকারের গুণী। বললেন, ড্রাইভ কর দেখি, কাজ দেখে তবে কাজে বহাল করব। বললাম, এই তো বাবু কথার মত কথা। নিয়ে গেলাম গাড়িতে চাপিয়ে। আপনাদের আশীবাদে স্যার যে কোন মে বা মডেলের গাড়ি দিন না, জলের মত চালিয়ে নিয়ে যাব। আমার গাড়ি চালানো দেখে বাবুও খুশী হয়ে গেলেন। তিনি সেই দিনই কাজে বহাল করে নিলেন আমাকে।
ইন্সপেক্টার বুঝতে পারেন, লোকটা একটু বেশীই কথা বলে।
বাবু তাহলে গাড়ি চালানোয় খুশি ছিলেন বল?
আজ্ঞে, নিজমুখে আমি কি বলব স্যার, বলবেন অহঙ্কার, দেমাক। তবে হ্যাঁ, বাবু বেঁচে থাকলে তাঁরই মুখে শুনতে পারতেন। তবে তিনি বলতেন, করালী, তোমার হাতে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমানো যায়।
হুঁ। ভাল কথা। দেখ করালী, কাল তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি।
বলুন স্যার।
তোমার আপনার জন আর কে কে আছে?
আজ্ঞে স্যার, সে কথা আর বলবেন না। ভাল করে জ্ঞান হবার আগেই মা বাপকে হারিয়েছি; তারপর লালন-পালন করলে এক পিসি; তা সেও বছর দশেক আগে মারা গেছে। সব ধুয়ে মুছে গেছে। একা স্যার—একেবারে একা।
বিয়ে করনি?
বিয়ে-থা আর কে দেবে বলুন স্যার। এতদিন তো ক্যাঁ কাঁ করে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়িয়েছি—এই তো সবে যাহোক একটা কাজ জুটেছিল। দেখুন না, তাও বরাতে সইল না। এবারে আবার সেই রাস্তা আর কলের জল।
কেন হে, এখানে তো শুনলাম দেড়শো টাকা মাইনে পেতে, থাকা খাওয়া লাগত না, এ ক বছরে কিছুই জমাতে পারনি?:
আজ্ঞে না স্যার। জমল আর কোথায়! আগের কিছু ধার-দেনা ছিল, তাই শোধ দিতে দিতেই সব বেরিয়ে যেত মাসে মাসে-জমাব কি করে আর।
আচ্ছা করালী, তুমি যেতে পার। হ্যাঁ, ভাল কথা, না বলে কোথাও বেরিও না যেন।
আজ্ঞে না স্যার, কোথাও বড় একটা আমি বের হই না।
করালী ঘর ছেড়ে চলে গেল।
.
২৩.
ইন্সপেক্টার বসাক থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু বুঝতে পারলেন সেন?
একেবারেই যে কিছু বুঝিনি তা নয় স্যার। বেশ গভীর জলের মাছ বলেই মনে হল।
হঠাৎ রজত কথা বললে, ঠিকই বলেছেন মিঃ সেন। লোকটার চোখ দুটো যেন ঠিক সাপের চোখের মত। একেবারে পলক পড়ে না। তা ছাড়া লোকটার মুখের দিকে তাকালেই যেন কেমন গা ঘিনঘিন করে। আশ্চর্য! লোকটাকে ছোেটা যে কি করে টলারেট করতেন তাই ভাবছি।
ইন্সপেক্টার রজতের কথায় মৃদু হাসলেন মাত্র, কোন জবাব দিলেন না।
হাসিটা রজতের দৃষ্টি এড়ায় না। সে বলে, হাসছেন আপনি ইন্সপেক্টার, কিন্তু লোকটার মুখের দিকে তাকালেই কি মনে হয় না—ঠিক যেন একটা snake!
ইন্সপেক্টার রজতের প্রশ্নের এবারেও কোন জবাব দিলেন না, কেবল রামানন্দ সেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, মৃতদেহটা একবার দেখবেন নাকি?
হ্যাঁ। একবার যাই, দেখে আসি। একটা ডাইরী আবার পাঠাতে হবে তো!
যান।
রামানন্দ সেন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
ইন্সপেক্টার এবারে রজতের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আপনারা যখন এসে গেছেন রজতবাবু, মৃতদেহের মানে আপনাদের কাকার সৎকার করবেন তো?
তা করতে হবে বৈকি।
তাহলে আর দেরি করবেন না। রামানন্দরাবুর কাছ থেকে একটা Order নিয়ে কলকাতায় চলে যান।
.
রামচরণের মৃতদেহটা মর্গে পাঠাবার একটা ব্যবস্থা করে রামানন্দ সেন থানায় ফিরে গেলেন। চা পান করে রজতও বিনয়েন্দ্রবাবুর মৃতদেহ কলকাতার মর্গ থেকে নিয়ে সৎকারের একটা ব্যবস্থা করবার জন্য বের হয়ে গেল।
একজন কনস্টেবলকে নিচের তলায় প্রহরায় রেখে ইন্সপেক্টার বসাক উপরে চললেন।
প্রথমেই পুরন্দর চৌধুরীর সংবাদ দেবার জন্য তাঁর ঘরে গিয়ে প্রবেশ করলেন। পুরন্দর চৌধুরী শয্যার উপরে শুয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন তখনও।
ধীরে ধীরে ঘরের দরজাটা টেনে দিয়ে, ঘর থেকে বের হয়ে এলেন ইন্সপেক্টার।
হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, বেলা প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। সুজাতাদেবীর একটা সংবাদ নেওয়া প্রয়োজন।
এগিয়ে চললেন ইন্সপেক্টার সুজাতার ঘরের দিকে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা ইতস্তত করলেন, তারপর আঙুল দিয়ে টুকটুক করে ভেজানো দরজার গায়ে মৃদু ‘নক’ করলেন।
কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। প্রথমে ভাবলেন সুজাতা ঘুমচ্ছে হয়তো তারপরেই আবার কি ভেবে মৃদু একটু ঠেলা দিয়ে ভেজালে দরজাটা ঈষৎ একটু ফাঁক করে ঘরের ভিতরে দৃষ্টিপাত করলেন।
দেখতে পেলেন, সুজাতা নিঃশব্দে খোলা জানলার সামনে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।
বিস্রস্ত চুলের রাশ সারা পিঠ ব্যেপে ছড়িয়ে আছে। হাওয়ায় চুর্ণ কুন্তল উড়ছে। বেশেও কেমন একটা শিথিল এলোমেলো ভাব।
আবার দরজার গায়ে নক করলেন টুকটুক করে।
কে? ভিতর থেকে সুজাতার গলার প্রশ্ন ভেসে এল।
ভিতরে আসতে পারি কি?
আসুন।
দরজা ঠেলে ইন্সপেক্টার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
সুজাতা ঘুরে দাঁড়াল: আসুন।
এখন একটু সুস্থ বোধ করছেন তো মিস রয়?
হ্যাঁ।
একটু চা বা গরম দুধ এক গ্লাস খেলে পারতেন। বলি না দিতে রেবতীকে ডেকে?
বলতে হবে না। রেবতী কিছুক্ষণ আগে নিজেই এসে আমাকে চা দিয়ে গিয়েছে। চা খেয়েছি। কিন্তু আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন নে মিঃ বসাক? বসুন না ঐ চেয়ারটার ওপরে।
হ্যাঁ, বসি। পাশেই একটা চেয়ার ছিল, টেনে নিয়ে ইন্সপেক্টার উপবেশন করলেন: আপনিও বসুন মিস রয়।
সুজাতা খাটের উপরেই শয্যায় উপবেশন করে।
কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কোন কথা বলে না স্তব্ধতার মধ্যেই কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল। এবং স্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রথমেই কথা বললেন ইন্সপেক্টার, আপনি কি তাহলে কলকাতায়ই ফিরে যাবেন ঠিক করলেন, মিস রয়?
সুজাতা নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকাল ইন্সপেক্টারের মুখের দিকে।
রজতদা কোথায়? সুজাতা প্রশ্ন করে।
রজতবাবু তো এই কিছুক্ষণ আগে কলকাতায় গেলেন।
কলকাতায় কেন?
বিনয়েন্দ্রবাবুর মৃতদেহের সৎকারের একটা ব্যবস্থা করতে হবে তো, তাই।
সুজাতা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, আমি যদি লক্ষ্ণৌয়ে ফিরে যাই আপনার কোন আপত্তি আছে কি?
না। আপত্তি আর কি, তবে আপনার কাকার সলিসিটারকে একটা সংবাদ পাঠাতে বলেছি প্রতুলবাবুকে, আজই সন্ধ্যার সময় এখানে এসে একবার দেখা করবার জন্য।
সলিসিটারকে কেন?
আপনার কাকার উইল-টুইল যদি কিছু থাকে, তা সেটা তো আপনাদের জানা প্রয়োজন।
থাকলেও আমার সে বিষয়ে কোন interestই নেই জানবেন, মিঃ বসাক। সুজাতা যেন মৃদু ও নিরাসক্ত কণ্ঠে কথাটা বললে।
বিস্মিত ইন্সপেক্টার সুজাতার মুখের দিকেতাকালেন।
হ্যাঁ। তাঁর সম্পত্তি যার ইচ্ছা সে নিক। আমার তাতে কোন প্রয়োজনই নেই। চাই না আমি সেই অর্থের এক কপর্দকও, এবং নেবও না। পূর্ববৎ নিরাসক্ত কণ্ঠেই কথাগুলো বলে গেল সুজাতা।
সে তো পরের কথা পরে। আগে দেখুন তাঁর কোন উইল আছে কিনা। উইলে যদি আপনাদেরই সব দিয়ে গিয়ে থাকেন তো ভালই, নচেৎ উইল না থাকলেও তাঁর সব কিছুর একমাত্র ওয়ারিশন তো আপনারাই, আর কিছু যদি আপনি না নেনইযাকে খুশি সব দানও করতে পারবেন।
না। তাঁর হোপার্জিত অর্থ তো নয়, সবই তো সেই বাবার দাদামশাইয়ের অর্থ। যে লোক মরবার সময় পর্যন্ত তাঁর নাতি-নাতিনীদের মুখ দেখেননি, তাঁর সম্পত্তি লাখ টাকা হলেও আর যেই নিক আমি একটি কপর্দকও স্পর্শ করব না তা জানবেন।
কি বলছেন আপনি মিস রয়?
ঠিক বলছি। আপনি তো জানেন না আমার পিতামহকে। অনাদি চক্রবর্তী তাঁর একমাত্র জামাই হওয়া সত্ত্বেও সব কিছু থেকে তাঁকে তিনি বঞ্চিত করে গিয়েছিলেন। আর শুধু কি তিনিই, শুনেছি আমার পিতামহীরও এমন অহমিকা ছিল ধনী-কন্যা বলে যে, আমার পিতামহকে যাচ্ছেতাই করে অপমান করতেও একদিন দ্বিধাবোেধ করেননি। বাবা বলেছিলেন একদিন, সুজাতা, যদি কখনও ভিক্ষা করেও খেতে হয় তবু যেন অনাদি চক্রবর্তীর এক কপর্দকও গ্রহণ কোরো না। এমন কি তিনি যেচে দিতে এলেও জেনো যে অর্থ বিবাহিতা স্ত্রীকে পর্যন্ত স্বামীর কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয়, সে অর্থ মানুষের জীবনে আর যাই দিক মঙ্গল আনতে পারে না। আমি এখানে এসেছিলাম শুধু তাকে একটিবার দেখব বলে, অন্যথায় আসতামই না।
.
২৪.
একটানা সুজাতা কথাগুলো বলে গেল।
মিঃ বসাকের বুঝতে কষ্ট হয় না, সুজাতাদেবী সত্যি সত্যিই তার মৃত ছোটাকে গভীর শ্রদ্ধা ও স্নেহ করত। এবং তাই ছোটকার মৃত্যু-সংবাদটা তার বুকে শেলের মতই আঘাত হেনেছে।
একটু থেমে সুজাতা আবার বলতে লাগল, আমার ও ছোট্কার মধ্যে ঠিক যে কি সম্পর্ক ছিল, আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না মিঃ বসাক। তাছাড়া আপনি হয়তো বুঝবেনও না। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছি। মানুষ হয়েছি রজতদার মা-জেঠাইমার স্নেহ ও ভালবাসাতেই। কিন্তু সেদিনকার আমার বালিকা মনের খুব নিকটে যাকে আপনার করে পেয়েছিলাম, সে হচ্ছে আমার ছোটুকাই।
বলতে বলতে সুজাতার গলাটা যেন কেমন জড়িয়ে আসে।
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ছোট্কা ছিল আমাদের, বিশেষ করে আমার, জীবনে একাধারে বন্ধু ও সর্ব ব্যাপারে একমাত্র সাথী। তাই যেদিন তিনি তাঁর দাদামশাইয়ের জরুরী একটা চিঠি পেয়ে হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়েই এ বাড়িতে চলে এলেন, এবং তারপর যে কারণেই হক আর তিনি আমাদের কাছে ফিরে গেলেন না, তার পর থেকে রজতদা ও জেঠাইমা তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেও আমি তা পারিনি। তাঁদের সঙ্গে একমত না হতে পারলেও অবিশ্যি তাঁদের বিরুদ্ধেও যেতে পারিনি। তাই মনে মনে ছোট্রকার সঙ্গে দেখা করবার খুব বেশী একটা ইচ্ছা থাকলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি সেদিন।
একটু থেমে সুজাতা আবার বলতে লাগল, তারপর হঠাৎ এমন কতকগুলো কথা ছোটকার নামে আমার কানে গেল যে, পরে আর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতে ইচ্ছাও হয়নি।
কিছু যদি না মনে করেন তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করি সুজাতাদেবী। কী এমন কথা আপনার ছোট্রকার সম্পর্কে, কার মুখে আপনি শুনেছিলেন বলতে আপনার যদি অপত্তি না থাকে–
না। আপত্তি কি। কথাটা শুনেছিলাম রজতদার মুখেই। তার সঙ্গে নাকি হঠাৎ একদিন ছোট্কার রাস্তায় দেখা হয়েছিল, তখন ছোট্কা নাকি রজতদা কথা বলে সত্ত্বেও তাকে চিনতে পারেনি। তাই ভয় হয়েছিল রজতদার মত আমাকেও যদি ছট্কা আর না চিনতে পারেন!
সুজাতার মুখে কথাটা শুনে মিঃ বসাক কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। একটা কথা সুজাতাকে ঐ সম্পর্কে খুবই ইচ্ছা হচ্ছিল বলবার কিন্তু ইচ্ছা করেই শেষ পর্যন্ত বললেন না। এমন সময় রেবতী এসে ঘরে ঢুকল।
কি খবর রেবতী?
বাবু, ঠাকুর বলল খাবার তৈরী।
ঠিক আছে, ঠাকুরকে টেবিলে খাবার দিতে বল। আর অমনি দেখ পুরন্দরবাবু উঠেছেন কিনা।
রেবতী চলে গেল।
উঠুন সুজাতাদেবী। স্নান করবেন তো করে নিন।
হ্যাঁ, আমি স্নান করব।
খাবার টেবিলে বসে সুজাতা কিন্তু এক গ্লাস সরবৎ ছাড়া কিছুই খেতে চাইল না। না খেলেও খাবার টেবিলেই বসে রইল।
মিঃ বসাক ও পুরন্দর চৌধুরী খেতে লাগলেন।
এক সময় মিঃ বসাক বললেন, আপনি কি তাহলে আজই চলে যেতে চান, মিস রয়?
রজতদা ফিরে আসুক। কাল সকালেই যাব।
কালই তাহলে লক্ষ্ণৌ রওনা হচ্ছেন?
না। দু-একদিন পরে রওনা হব।
আহারাদির পর সুজাতা ও পুরন্দর চৌধুরী যে যার ঘরে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। মিঃ বসাক নীচে এলেন।
যে ঘরে রামচরণ নিহত হয়েছিল সেই ঘরে এসে ঢুকলেন।
ঘণ্টাখানেক আগে মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘরটা খালি।
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন। ঘরের জানলাগুলো ভেজানো ছিল, এগিয়ে গিয়ে ঘরের পশ্চাতে বাগানের দিককার দুটো জানলাই খুলে দিলেন। দ্বিপ্রহরের পর্যাপ্ত আলোয় স্বল্পান্ধকার ঘরটা আলোকিত ও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
ঘরের দেওয়ালে পেরেকের সাহায্যে দড়ি টাঙিয়ে তার উপরে খান দুই পরিষ্কার পাট করা ধুতি ঝুলছে। একপাশে একটা ভোয়ালে। একটা শার্ট ও গোটা দুই গেঞ্জিও দড়িতে বোলানো রয়েছে।
এক কোণে একটা কালো মাঝারি আকারের রঙ ওঠা স্টীল ট্রাঙ্ক। দেওয়ালে একটা আরশি ও তার পিছনে গোঁজা একটা চিরুনি। আরশিটার পাশেই দেওয়ালে টাঙানো একটা ফটো। ফটোটার সামনে এগিয়ে গেলেন মিঃ বসাক।
পাঁচ-ছ বছরের একটি শিশুর হোট ফটো। অনেক দিন আগেকার ভোলা ফটো হবে। কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
ফটোটা দেখতে দেখতে হঠাৎ তার পাশেই দেওয়ালে টাঙানো আরশিটার পিছনে গোঁজা চিরুনিটার দিকে নজর পড়তেই একটা জিনিস তাঁর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
চিরুনিটার সরু দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকগাছি কেশ তখনও আটকে আছে।
বিশেষ করে কয়েকগাছি কেশই তাঁর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
.
২৫.
হাত বাড়িয়ে চিরুনিটা হাতে নিলেন মিঃ বসাক।
চার-পাঁচগাছি কেশ আটকে রয়েছে চিরুনির সরু দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে। এবং কেশগুলি লম্বায় হাতখানেকের চাইতে একটু বেশীই হবে। আর সেগুলো সামান্য একটু কোঁকড়ানো এবং রংও তার ঠিক কালো নয়, কেমন একটু কটা কটা।
ধীরে ধীরে কেশগুলি চিরুনির দাঁত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আরও ভাল করে পরীক্ষা করতে লাগলেন মিঃ বসাক।
রামচরণের নিত্যব্যবহৃত এই চিরুনি তাতে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে। এখনও মিঃ বসাকের, রামচরণের কেশের রং কুচকুচে কালোই ছিল; যদিচ অনেক কেশেই তার পাক ধরেছিল। বিশেষ করে, তার কেশ দৈর্ঘ্যে এতখানি হওয়াও অসম্ভব। মোট কথা, চিরুনির এই কেশ আদপেই রামচরণের মাথার নয়। এবং কেশের দৈর্ঘ্য দেখে মনে হয়, এ কোন রমণীর মাথার কেশ হবে। কোন পুরুষের মাথার কেশ এ নয়। এবং কোন নারীরই মাথার কেশ যদি হবে, তবে এই চিরুনিতে এ কে এল কোথা থেকে?
এ বাড়িতে তো কোন নারীর অস্তিত্বই নেই এবং ছিল না বলেই তো তিনি শুনেছেন। একমাত্র লতা, তাও সেদিন যার আগেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। সে ক্ষেত্রে চিরুণির দাঁতে নারীর কে দেখে মনে হচ্ছে, গতকাল দিনে বা রাত্রে, নিশ্চয়ই কেউ এক সময়ে এই চিরুনির সাহায্যে তাঁর কেশ প্রসাধন করেছিলেন যিনি কোন পুরুষই নন, নারীই। এ বাড়িতে একমাত্র বর্তমানে উপস্থিত নারী সুজাতাদেবীই। সুজাতাদেবী নিশ্চয়ই রামচরণের ঘরে এসে তাঁর চিরুনি দিয়ে কেশ প্রসাধন করেননি। আর করলেও সুজাতাদেবীর কেশ এ ধরনের নয়। তাঁর কেশ দের্ঘ্যে আরও বড় ও কালো কুচকুচে। আদপেই কোঁকড়ানো নয়।
তবে কে সেই নারী যার কেশ প্রসাধনের চিহ্ন এখনও এই চিরুনির দাঁতে রয়ে গিয়েছে।
আরও মনে হয়, যেই কেশ প্রসাধন করে থাকুক রামচরণের দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা পড়েনি, নচেৎ রামচরণের মত ছিমছাম প্রকৃতির লোকের চিরুনিতে এগুলো আটকে থাকা সম্ভব হত না, একবার তার দৃষ্টি চিরুনিতে আকৃষ্ট হলে।
তবে কি রামচরণের অজ্ঞাতেই কেউ তার চিরুনির সাহায্যে কেশ প্রসাধন করেছিল! সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথা মনে হয় মিঃ বসাকের, গত রাত্রে রামচরণ যখন তাঁদের আহার্য পরিবেশন করছিল তখনও তো তিনি লক্ষ্য করেছেন, তার মাথার কেশপরিপাটি করে আঁচড়ানো ছিল। যাতে করে তাঁর মনে হয়েছিল, বিকালের পরে কোন এক সময় সে তার কেশ প্রসাধন করেছিল। অতএব কি দাঁড়াচ্ছে তাহলে?
সন্ধ্যার পর রাত্রে কোন এক সময়ে কোন না কোন নারীই এই ঘরে এসে রামচরণের এই চিরুনির সাহায্যে তার কেশ প্রসাধন নিশ্চয়ই করেছিল। যার সুস্পষ্ট ও নিশ্চিত প্রমাণ এখনো এই চিরুনির দাঁতে কয়েকগাছি কেশে বর্তমান। এবং এ থেকে সহজেই অনুমান হয় কোন নারী তাহলে গতরাত্রে এ কক্ষে এসেছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে, রামচরণের জ্ঞাতে না অজ্ঞাতে।
আরও একটা কথা সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, যে নারী গত রাত্রে এই ঘরে এসেছিল সে রামচরণের পরিচিতও হতে পারে, অপরিচিতও হতে পারে। এবং শুধু তাই নয় রামচরণের হত্যার ব্যাপারে সেই নারীর প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ কোন যোগাযোগ ছিল কিনা তাই বা কে জানে!
মোট কথা, কোন এক নারীর এই কক্ষমধ্যে গত রাত্রে পদার্পণ ঘটেছিল। এবং সে বিষয়ে যখন কোন সন্দেহই থাকছে না তখন সেই নারীর এই কক্ষমধ্যে আবির্ভাবের ব্যাপারটাই রামচরণের হত্যার মতই বিস্ময়কর মনে হয়।
বাড়ির চারদিকে কাল সতর্ক পুলিস প্রহরী ছিল, তার মধ্যেই অন্যের দৃষ্টি এড়িয়ে কী করে এক নারীর এ বাড়িতে প্রবেশ সম্ভবপর হয়।
তবে কি সেই নারীই রামচরণের হত্যাকারী!
কথাটা ভাবতে গিয়েও যেন মিঃ বসাকের লজ্জার অবধি থাকে না। তাঁদের এতগুলো পুরুষের জাগ্রত ও সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত কিনা সামান্য এক নারী নিঃশব্দে এসে রামচরণকে হত্যা করে চলে গেল। এতগুলো লোক কেউ কিছু জানতেও পারল না।
কিন্তু এলই বা সে এ বাড়িতে কোন্ পথে, আবার ফিরে গেলই বা কোন্ পথে?
অথচ কিছুক্ষণ পূর্বে পর্যন্ত কেন যেন মিঃ বসাকের ধারণা হয়েছিল, গত রাত্রে রামচরণের হত্যাকারী এ বাড়ির মধ্যে যারা উপস্থিত ছিল গত রাত্রে তাদের মধ্যেই কেউ না কেউ হতে পারে। এখন মনে হচ্ছে তা নাও হয়তো হতে পারে।
ভাবতে ভাবতে চকিতে মিঃ বসাকের মনে আর একটা সম্ভাবনার উদয় হয়। এই কেশ যার সেই নারী ও বিনয়েন্দ্রর জীবনে তার ল্যাবরেটরী অ্যাসিস্টেন্ট হিসাবে যে রহস্যময়ী নারীর অকস্মাৎ আবির্ভাব ঘটেছিল—উভয়েই এক নয় তো!
কিন্তু কথাটার মধ্যে যেন বেশ কোন যুক্তি খুঁজে পান না মিঃ বসাক।
সে না হলেও কোন এক নারী কাল রাত্রে এ ঘরে এসেছিল ঠিকই এবং যে প্রমাণ একমাত্র যার পক্ষে আজ দেওয়া সম্ভব ছিল সে রামচরণ, কিন্তু সে আজ মৃত।
যে রহস্যের উপর আলোকপাত সম্ভব হত আজ আর তার কাছ থেকে পাওয়ার কোন উপায়ই নেই, তার মুখ আজ চিরদিনের জন্যই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আর সে কথা বলবে না।
আবার মনে হয়, তবে কি বিনয়েন্দ্রবাবুর হত্যাকারীও সে-ই! তাই সে এত তাড়াতাড়ি রামচরণের কণ্ঠও চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে গেল, পাছে রামচরণ তার সমস্ত রহস্য ফাঁস করে দেয়!
আবার সেই রহস্যময়ীর কথাই মনের মধ্যে নতুন করে এসে উদয় হয়।
সমস্ত ব্যাপারটাই ক্রমে যেন আরো জটিল হয়ে উঠেছে। সব যেন কেমন বিশ্রীভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে যাই হোক, এই কয়েকগাছি কেশের মধ্যে নিঃসন্দেহে যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।
যত্নসহকারে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করেন মিঃ বসাক। এবং কাগজের মধ্যে কেশ কগাছি রেখে ভাঁজ করে সযত্নে পকেটের মধ্যে রেখে দিলেন।
তারপর রামচরণের স্টীল ট্রাঙ্কটা খুলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তালা দেওয়া। খোলা গেল। চাবিটা কিন্তু বিশেষ খুঁজতে হল না। রামচরণের শয্যার নীচে তোশকের তলাতেই পাওয়া গেল। চাবির সাহায্যে মিঃ বসাক তালা খুলে ফেললেন।
বাক্সটা খুলে ডালাটা তুললেন। ট্রাকের মধ্যে বিশেষ কিছুএমন পাওয়া গেল না। খানকয়েক ধুতি পাট করা, গোটা দুই জামা। একটা ব্যাগের মধ্যে গোটা ত্রিশেক টাকা ও কিছু খুচরো পয়সা। একটা ছোট কৌটোর মধ্যে খানিকটা আফিং এবং খানকয়েক চিঠি ও মনিঅর্ডারের রসিদ।
রসিদগুলো ফেরত আসছে কোন এক শ্যামসুন্দর ঘোষের কাছ থেকে।
চিঠিগুলোও সেই শ্যামসুন্দরেরই লেখা। চিঠি পড়ে বোঝা গেল, সম্পর্কে সেই শ্যামসুন্দর রামচরণেরভাইপোহয়। থাকে মেদিনীপুর। আর পাওয়া গেল একটাপোষ্ট-অফিসের পাস-বই।
পাস-বইটা উলটে-পালটে দেখা গেল, তার মধ্যে প্রায় শ-চারেক টাকা আজ পর্যন্ত জমা দেওয়া আছে। মধ্যে মধ্যে অবিশ্যি পাঁচ-দশ করে তোলার নিদর্শনও আছে। লোকটা দেখা যাহেতাহলে কিছুটা সঞ্চয়ীও ছিল।
বাক্সটা বন্ধ করে পুনব্ৰায় তালায় চাবি দিয়ে মিঃ বসাক রামচরণের ঘর থেকে বের হয়ে এলেন।
দ্বিপ্রহরের রৌদ্রতাপ তখন অনেকটা ঝিমিয়ে এসেছে। প্রশান্ত বসাক নীচের তলায় যে ঘরটায় গত দুদিন ধরে অফিস করেছিলেন সেই ঘরেই এসে প্রবেশ করলেন।
২৬-৩০. ঘরের মধ্যে ঢুকতেই চোখাচোখি
ঘরের মধ্যে ঢুকতেই চোখাচোখি হয়ে গেল প্রতুলবাবুর সঙ্গে।
প্রতুলবাবু বোধ হয় কিছুক্ষণ আগে এসেছেন, ঐ ঘরে ইন্সপেক্টারের অপেক্ষায় বসেছিলেন।
প্রতুলবাবুর পাশেইচেয়ারেস্যুট পরিহিত সুশ্রী আর একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোবসেছিলেন।
এই যে প্রতুলবাবু! কতক্ষণ এসেছেন?
এই কিছুক্ষণ হল। আলাপ করিয়ে দিই ইন্সপেক্টার সাহেব, ইনি মিঃ চট্টরাজ, বিনয়েন্দ্রবাবুর অ্যাটর্নী। আর ইনি ইন্সপেক্টার মিঃ প্রশান্ত বসাক।
উভয়ে উভয়কে নমস্কার জানান।
কথা বললেন তারপর প্রথমে মিঃ চট্টরাজই, আমাকে আপনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন মিঃ বসাক?
হ্যাঁ। বিনয়েন্দ্রবাবুর কোন উইল আছে কিনা সেইটাই আমি জানবার জন্য আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম মিঃ চট্টরাজ।
না। উইল তিনি কোন কিছু করে যাননি।
কোন উইলই নেই?
না।
উইলের কোন কথাবার্তাও হয়নি কখনও তাঁর সঙ্গে আপনার?
মাস পাঁচ-ছয় আগে একবার তিনি আমাদের অফিসে যান, সেই সময় কথায় কথায় একবার বলেছিলেন উইল একটা তিনি করবেন—
সে উইল কী ভাবে হবে সে সম্পর্কে কোন কথাবার্তা হয়নি?
হ্যাঁ, বলেছিলেন, তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি একমাত্র হাজার দশেক নগদ টাকা ছাড়া তিনি তাঁর ভাইঝি কে এক সুজাতাদেবীকেই নাকি দিয়ে যেতে চান।
একমাত্র দশ হাজার টাকা ব্যতীত সব কিছু সুজাতাদেবীকেই দিয়ে যাবেন বলেছিলেন?
হ্যাঁ।
রজতবাবু তাঁর একমাত্র ভাইপোর সম্পর্কে কোন ব্যবস্থাই করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি?
হ্যাঁ, করেছিলেন, ঐ নগদ দশ হাজার টাকা মাত্র। আর কিছু নয়।
হুঁ। ক্ষণকাল চুপচাপ বসে কি যেন ভাবলেন মিঃ বসাক, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, একটা কথা মিঃ চট্টরাজ, বিনয়েন্দ্রবাবুর প্রপার্টির ভ্যালুয়েশন কত হবে নিশ্চয়ই জানেন?
ইদানীং অনেককিছুইহস্তান্তরিত হয়েছিল। কলকাতার তিনখানা বাড়ি, ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ বাবদ যা পেয়েছেন সবই গিয়েছিল খরচ হয়ে তালেও এখনও যা প্রপার্টি আছে তার ভ্যালুয়েশন তা ধরুন, লাখ দুয়েক তো হবেই। তাছাড়া ব্যাঙ্কেও নগদ হাজার পঞ্চাশ এখনও আছে।
সম্পত্তির পরিমাণ তাহলে নেহাত কম নয়। বেশ লোভনীয়ই যে যে-কোন ব্যক্তির পক্ষে।
মিঃ চট্টরাজ বললেন, এ আর কি, একদিন চক্রবর্তীদের সম্পত্তির পরিমাণ পনের বিশ লাখ টাকা ছিল; যা কাগজপত্রে পাওয়া যায়। নানা ভাবে কমতে কমতে এখন কলকাতার পার্ক স্ট্রীটের বাড়ি, এই নীলকুঠি ও টালিগঞ্জ অঞ্চলে কিছু জমি ও ব্যাঙ্কে যা নগদ আছে।
এখন তাহলে বিনয়েন্দ্রবাবুর সমস্ত সম্পত্তি কে পাচ্ছে মিঃ চট্টরাজ?
উইল যখন কিছু নেই তখন রজতবাবু ও সুজাতাদেবীই সব সমান ভাগে পাবেন; কেন একমাত্র ওঁরাই দুজনে আজ বিনয়েন্দ্রবাবুর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।
রেবতী এসে ঘরে প্রবেশ করল এবং প্রতুলবাবুকে সম্বোধন করে বললে, বাবু চাল ডাল তেল ঘির ব্যবস্থা করে দিয়ে যাবেন।
এতদিন, এমন কি কাল রাত পর্যন্তও রামচরণের ঘাড়েই ঐ সব কিছুর দায়িত্ব গত বিশ বছর ধরে চাপানো ছিল। এখন অন্য কোন রকম ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত রেবতীকেই চালাতে হবে।
প্রতুলবাবু বললেন, যাবার আগে টাকা দিয়ে যাব। এখন যা যা দরকার মতি স্টোর্স থেকে এ বাড়ির অ্যাকাউন্টে গিয়ে নিয়ে আয়।
রেবতী মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
প্রতুলবাবু তখন চট্টরাজকে সম্বোধন করে বললেন, টাকার ব্যবস্থা কিছু আপনাকে শীগগিরই করতে হবে মিঃ চট্টরাজ। আমার ক্যাশেও সামান্যই আছে আর।
সামনের মাসের টাকাটা এ মাসের দশ তারিখেই তুলে রেখেছিলাম ব্যাঙ্ক থেকে। কাল সে টাকাটা পাঠিয়ে দেব। তারপর রেবতীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, এঁদের চা দাও রেবতী।
রেবতী বললে, চা প্রায় হয়ে এসেছে। এখুনি আনছে।
রেবতী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
প্রতি মাসে সাধারণতঃ কত সংসার-খরচ বলে আসত মিঃ চট্টরাজ?
কলকাতার পার্ক স্ট্রীটের ফ্ল্যাট সিস্টেমের বাড়িটা থেকে ভাড়া বাবদ ৬০০ টাকা পাওয়া যায় আর ব্যাঙ্ক থেকে ৬০০ টাকা। এই বারশত করে প্রতি মাসে আসত।
তাছাড়া ৪০০ টাকা/৫০০ টাকা প্রতি মাসেই বেশী চেয়ে পাঠাতেন যেটা আবার তুলে দেওয়া হত ব্যাঙ্ক থেকেই।
ব্যাঙ্ক থেকে অত টাকা তুলতেন প্রতি মাসে? প্রশান্ত বসাক প্রশ্ন করেন চট্টরাজকে।
হ্যাঁ, ইদানীং বছর দেড়েক থেকেই তো অমনি টাকা খরচ হচ্ছিল।
তার আগে?
বাড়িভাড়ার টাকাতেই চলে যেত।
তা ইদানীং বছর দেড়েক ধরে এমন কি খরচ বেড়েছিল মিঃ চট্টরাজ, যে বিনয়েন্দ্রবাবুর অত টাকার প্রয়োজন হত?
তা কেমন করে বলব বলুন। টাকা তিনি চাইতেন, আমরা পাঠিয়ে দিতাম মাত্র। তাঁর অর্থ তিনি ব্যয় করবেন তাতে আমাদের কি বলবার থাকতে পারে বলুন? শুধু ঐ কেন, গত এক বছরের মধ্যেই তো তাঁর কলকাতায় আরও যে দুখানা ছোট বাড়ি ছিল তাও তিনি বিক্রি করেছেন।
এবার মিঃ বসাক ঘুরে তাকালেন প্রতুলবাবুর মুখের দিকে এবং প্রশ্ন করলেন, কেন অত টাকার প্রয়োজন হত ইদানীং তাঁর, সে সম্পর্কে আপনি কিছু বলতে পারেন প্রতুলবাবু?
আজ্ঞে না, তাঁর একান্ত নিজস্ব ব্যাপার কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পেত না। কাউকে তিনি কিছু বলতেনও না।
আচ্ছা মিঃ চট্টরাজ, বিনয়েন্দ্রবাবুর সঙ্গে আপনার কি রকম পরিচয় ছিল?
বিশেষ কিছুই না বলতে গেলে। বেশীর ভাগ তাঁর যা কিছু বলবার তিনি চিঠিতে বা ফোনেই জানাতেন।
এ বাড়িতে ফোন আছে নাকি? কই দেখিনি তো! বললেন প্রশান্ত বসাক।
জবাব দিলেন প্রতুলবাবু, আছে ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে।
বাইরে এমন সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। পুরন্দর চৌধুরী এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।
আসুন পুরন্দরবাবু, বিশ্রাম নেওয়া হল?
হ্যাঁ। আমাকে তাহলে অনুগ্রহ করে এবারে যাবার অনুমতি দিন ইন্সপেক্টার। কথা দিচ্ছি আপনাকে আমি, ডাকামাত্রই আবার আমি এসে হাজির হব।
আমি এখুনি একবার কলকাতায় যাব। ফিরে এসে আপনাকে বলব কখন আপনাকে ছেড়ে দিতে পারব মিঃ চৌধুরী। জবাব দিলেন ইন্সপেক্টার।
রেবতী চায়ের ট্রে হাতে ঘরে এসে প্রবেশ করল।
.
২৭.
লালবাজারে কিছু কাজ ছিল, সে কাজ শেষ করে মিঃ বসাক সোজা সেখান থেকে কিরীটীর টালিগঞ্জ ভবনে এসে হাজির হলেন।
কিরীটী তার দোতলার বসবার ঘরে আলো জ্বেলে বসে একখানা জ্যোতিষ-চর্চার বই নিয়ে পড়ছিল।
জংলী এসে সংবাদ দিল, ইন্সপেক্টার বসাক এসেছেন।
নিয়ে আয় এই ঘরেই। বই থেকে মুখ না তুলেই কিরীটী বললে।
একটু পরে প্রশান্ত বসাকের পদশব্দে পূর্ববং বই হতে মুখ না তুলেই একটা সাদা কাগজের বুকে একটা কুষ্ঠির ছকের পাশে কি সব লিখতে লিখতে আহ্বান জানাল কিরীটী, আসুন মিঃ বসাক, বসুন। সপ্তম স্থানে রাহু, অষ্টমে বুধ।
মিঃ বসাক বসতে বসতে বললেন, জ্যোতিষ চর্চা আবার শুরু করলেন কবে থেকে?
ভারতের বহু পুরাতন ও অবহেলিত অদ্ভুত সায়েন্স এই জ্যোতিষচচার ব্যাপার মিঃ বসাক। এবং সময় ও নক্ষত্র যদি ঠিক ঠিক হয় তো অনেক কিছুই দেখবেন, নির্ভুল পাবেন আপনি গণনায়। অঙ্ক শাস্ত্রের মত ঠিক হলে শুদ্ধ উত্তর ঠিক আপনি পাবেনই।
জ্যোতিষ চচটিাকে সত্যি সত্যিই তাহলে আপনি বিশ্বাস করেন মিঃ রায়?
নিশ্চয়ই, এ একটা অত্যাশ্চর্য সায়েন্স। আর বিশ্বাসের কথা বলছেন, এ তো আপনি বিশ্বাস করেন যে চন্দ্রের কলাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদীর জোয়ার-ভাঁটার পরিবর্তন হয়?
তা অবিশ্যি করি।
তবে কেন আপনার বিশ্বাস করতে বাধে মানুষের দেহের উপরেও গ্রহ-উপগ্রহের প্রভাব আছে? জানেন না আপনি, ভৃগুর কি অসাধারণ ক্ষমতা। আমি এ যতই পড়ছিএবং যতই মনে মনে বিশ্লেষণ করছি ততই বিস্ময় যেন আমার বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কুষ্টির ছকটা আর কিছুই নয়, মানুষের বহু বিচিত্র রহস্যময় অজ্ঞাত জীবনের কতকগুলো সত্য ও অবধারিত সূত্র একত্রে গ্রথিত একটা সংকেত মাত্র। সূত্রগুলির সঠিক পাঠোদ্ধার করতে পারলে আপনি সুনিশ্চিত পৌঁছবেন সেই অজানিত সংকেতের নির্ভুল মীমাংসায়। আজ উত্তরপাড়ার নীলকুঠির যে হত্যা-রহস্য আপনাকে চিন্তিত করে—
বাধা দিলেন ইন্সপেক্টার, আশ্চর্য, কি করে জানলেন যে সেই ব্যাপারেই আপনার কাছে আমি এসেছি।
কিছুটা শুনেছি আজ দুপুরে, আপনাদের হেডকোয়ার্টারে গিয়েছিলাম, সেখানেই। শুনলাম, নীলকুঠির মার্ডারের মোটামুটি কাহিনীটা এবং সেখানেই শুনলাম আপনিই সেই ঘটনাটা তদন্ত করছেন বর্তমানে। তার পরই অকস্মাৎ আপনার আমার কাছে আগমন। ব্যস, একেবারে অঙ্কশাস্ত্রের যোগ-বিয়োগ—উত্তর মিলে গেল।
সত্যি! সেই কারণেই আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি মিঃ রায় এই সময়ে।
না না—এর মধ্যে বিরক্তির কী আছে। বলুন, শোনা যাক।
প্রশান্ত বসাক সেই একেবারে গোড়া থেকেই সব বলে যেতে লাগলেন।
কিরীটী সোফাটার উপর গা এলিয়ে দু চক্ষু বুজে একটা ফুরোট. টানতে টানতে শুনতে লাগল।
কাহিনী যখন শেষ হল, কিরীটী তখনও চোখ বুজে পূর্ববং সোফার উপরে হেলান দিয়েই বসে আছে।
ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা যেন থমথথ করছে।
ওয়াল-ক্লকটা ঢং ঢং করে রাত্রি নটা ঘোষণা করল।
সময় সংকেতের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটী চোখ মেলে তাকাল, এবং মৃদু কণ্ঠে এই সর্বপ্রথম প্রশ্ন করল, আপনি যা বললেন, তার মধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে।
কী বলুন তো?
প্রথমত ধরুন, সিঙ্গাপুরী মুক্তা।
কিন্তু সিঙ্গাপুরী মুক্তার ব্যাপারটা তো–
হ্যাঁ। যতটুকু মুক্তা সম্পর্কে আপনি জেনেছেন, আমার মনে হচ্ছে, সেটাই সব নয়, আংশিক মাত্র। দ্বিতীয়ত সেই রহস্যময়ী নারীলতা। লতা শব্দের আর একটি অর্থ জানেন তো, সাপ, এবং সেই সাপই শুধুনয়, ইউ. পি. থেকে আগত সেই আগন্তুকের কথাটাও আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে। যেমন করে হোক ঐ দুটি ব্যক্তিবিশেষের খুঁটিনাটি কিছু সংবাদ বা পরিচয় আপনাকে জানতে হবে। আর আপনার মুখে সমস্ত কথা শোনবার পর, মনে মনে আমি। যে ছকটি গড়ে তুলেছি তা যদি ভুল না হয়, অর্থাৎ আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে তো জানবেন, এ ক্ষেত্রে হত্যার কারণ বা মোটিভ প্রেমঘটিত।
প্রেমঘটিত!
হ্যাঁ, প্রেমেরই যে সর্বাপেক্ষা বিচিত্র গতি। এবং যে প্রেম ক্ষেত্রবিশেষে নিঃস্ব করে আপনাকে বিলিয়ে দিতে পারে, মনে রাখবেন, সেই প্রেমই আবার ভয়াবহ গরল উদগীরণ করতে পারে।
আচ্ছা মিঃ রায়, আপনার কি মনে হয় হত্যাকারী কোন পুরুষ বা নারী?
পুরুষও হতে পারেন, নারীও হতে পারেন। অথবা উভয়ের একত্রে মিলিত প্রচেষ্টাও থাকতে পারে। কিন্তু সে তো শেষ কথা বর্তমান রহস্যের। তার পূর্বে সে সূত্রগুলি ধরে আপনি অগ্রসর হবেন সেগুলো হচ্ছে, এক নম্বর, প্রত্যেকেরই গত চার-পাঁচ বছরের জীবনের অতীত ইতিহাস। বিনয়েন্দ্র, রজত, সুজাতাদেবী ও পুরন্দর চৌধুরীর। দুনম্বর,সেই ছায়ামূর্তির অন্বেষণ। যে ছায়ামূর্তিকে ইদানীং বিনয়েন্দ্র রাত্রে নীলকুঠিতে ঘন ঘন দেখতেন এবং রামচরণ ও ড্রাইভার করালীও দেখেছে বলে জানা যায়। তিন নম্বর, সেই শ্রীমতী রহস্যময়ী লতা। তাঁকেও খুঁজে বের করতে হবে, এবং সেই সঙ্গে জানতে হবে সেই লতা বিনয়েন্দ্রর কুমার জীবনে কতখানি ঘনিষ্ঠ হয়ে এসেছিল। চার নম্বর, বিনয়েন্দ্রর শয়নকক্ষ ও গবেষণা ঘরটি আর একবার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আপনাকে দেখতে হবে। এই চারটি প্রশ্নের মধ্যেই বিনয়েন্দ্রর হত্যার কারণ বা মোটিভটি জড়িয়ে আছে জানবেন।
প্রশান্ত বসাক গভীর মনোযোগ সহকারে কিরীটীর কথাগুলো শুনতে থাকেন।
কিরীটী একটু থেমে আবার বললে, এবারে হত্যা করা সম্পর্কে যা আমার মনে হচ্ছে, বিনয়েন্দ্রর হত্যার ব্যাপারটি হচ্ছে pre-arranged, premeditative and a well planned murder। খুব ধীরে-সুস্থে, সময় নিয়ে, প্ল্যান করে, এবং ক্ষেত্র তৈরি করে তারপর হত্যা করা হয়েছে বেচারীকে। এবং খুব সম্ভবত, তার কিছুটা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বেচারী রামচরণ জানতে পারায় হত্যাকারী রামচরণকেও সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। অতএব সেটাও ইচ্ছাকৃত হত্যা। দুটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যিনি হোতা, জানবেন, তিনি যেমন ধূর্ত তেমনি সতর্ক, তেমনি শয়তানী বুদ্ধিতে পরিপক। এবং সম্ভবত আজ কাল বা দু-চারদিনের মধ্যেই হোক, হত্যাকারী আবার হানবে তার মৃত্যু-ছোবল।
কিরীটীর কথায় প্রশান্ত বসাক যেন চমকে ওঠেন, বলেন, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়!
ঠিকই বলছি। আমার calculation যদি মিথ্যা না হয় তো শীঘ্রই আবার একটি বা ততোধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে। অতএব সাবধান। খুব সাবধান। কিন্তু যাক সে কথা, এবারে আসা যাক আপনার সূত্রগুলির মধ্যে। ১নং, ভাঙা ঘড়ি। ২নং, অপহৃত বিনয়েন্দ্রর রবারের চপ্পল জোড়া। ৩নং, রামচরণের ঘরে তার নিত্যব্যবহার্য চিরুনিতে প্রাপ্ত কয়েকগাছি নারীর কেশ। ৪নং, তিনখানি চিঠি।
.
২৮.
প্রশান্ত বসাক কিরীটীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, শুভরাত্রি জানিয়ে নিজের গাড়িতে এসে যখন বসলেন, রাত তখন সোয়া দশটা।
ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন উত্তরপাড়া যাবার জন্য।
চলন্ত গাড়ির মধ্যে বসে আর একবার সমস্ত ব্যাপারটা ও কিরীটীর কথাগুলো মনে মনে পর্যালোচনা করতে লাগলেন প্রশান্ত বসাক।
নীলকুঠিতে যখন এসে পৌঁছলেন রাত্রি তখন প্রায় পৌনে এগারটা।
সিঁড়ির মুখেই রেবতীর সঙ্গে প্রশান্ত বসাকের দেখা হয়ে গেল।
এবং রেবতীর কাছেই শুনলেন, এতক্ষণ সকলে ওর জন্য অপেক্ষা করে এই সবে খেতে বসেছেন।
রজতবাবুরাত আটটা নাগাদ ফিরে এসেছেন এবং আরও একটি সংবাদ পেলেন, সুন্দরলাল নামে এক ভদ্রলোক রায়পুর থেকে এসেছেন।
প্রশান্ত বসাক সোজা একেবারে খাবার ঘরেই এসে প্রবেশ করলেন। ঘরের মধ্যে টেবিলের সামনে বসে সবেমাত্র সকলে তখন আহার শুরু করেছেন।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত চারটি প্রাণী-সুজাতা, রজত, পুরন্দর চৌধুরী ওঁদের তো চেনেনই প্রশান্ত বসাক, চেনেন না কেবল চতুর্থ ব্যক্তিকে। পরিধানে তাঁর সুট, মাথায় পাঞ্জাবীদের মত পাগড়ি এবং চোখে কালো লেন্সের চশমা। বুঝলেন, উনিই আগন্তুক সুন্দরলাল।
প্রশান্ত বসাকের পদশব্দে সকলেই মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।
রজত ও সুজাতা পাশাপাশি একদিকে ও অন্যদিকে টেবিলের পাশাপাশি বসে পুরন্দর চৌধুরী ও সুন্দরলাল।
প্রশান্ত বসাক ঘরে প্রবেশের মুখেই লক্ষ্য করেছিলেন, রজত ও সুজাতা নিম্নকণ্ঠে পরস্পরের সঙ্গে কী যেন কথাবার্তা বলছে। আর সুন্দরলাল ও পুরন্দর চৌধুরী দুজনে কথাবার্তা বলছেন। ইন্সপেক্টারকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সর্বাগ্রে রজতই তাঁকে আহ্বান জানাল, আসুন মিঃ বসাক, আপনার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করে থেকে এইমাত্র আমরা সকলে বসলাম।
না না—তাতে কি হয়েছে, বেশ করেছেন। বলতে বলতে এগিয়ে এসে একটা খালি চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন প্রশান্ত বসাক, তারপর বললেন, দাহ হয়ে গেল।
হ্যাঁ। রেবতী এসে ইন্সপেক্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বললে, আপনার খাবার দিতে বলি? হ্যাঁ, বল। ওকে আপনি বোধ হয় চিনতে পারছেন না মিঃ বসাক? সুন্দরলালকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে প্রশ্ন করল রজত।
না। মানে—
সুন্দরলালই জবাব দিলেন ইংরাজীতে, My name is Sundarlal Jha।
সুস্পষ্ট শুদ্ধ উচ্চারণ। কোথাও এতটুকু জড়তা নেই, এবং গলাটা সরু ও মিষ্টি।
হ্যাঁ, রেবতীই বলছিল আপনার এখানে আসবার কথা এইমাত্র। তা আপনি—
বিনয়েন্দ্রবাবু আমার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে পৌঁছে এঁদের মুখে সব শুনে তো একেবারে তাজ্জব বনে গেছি ইন্সপেক্টার, how horrible, how absurd!
ইন্সপেক্টার কিন্তু কোন জবাব দেন না। তাঁর মনে পড়ে ঘণ্টাখানেক আগে কিরীটীর সেই কথাগুলো-pre-arranged, pre-meditative and a well planned murder!
সুন্দরলাল আবার বললেন, এতক্ষণ আমি চলেই যেতাম, কেবল আপনার সঙ্গে দেখা করব বলেই যাইনি। তাছাড়া ওঁরা বিশেষ করে বললেন ডিনারটা খেয়ে যেতে সে তো ভালই করেছেন, মৃদুকণ্ঠে ইন্সপেক্টার বলেন, তা উঠেছেন কোথায়?
কলকাতায়, তাজ হোটেলে।
আপনি যখন বিনয়েন্দ্রবাবুর বিশেষ পরিচিত তখন হয়তো তাঁর সম্পর্কে একটু খোঁজখবরও পাব আপনার কাছে। প্রশান্ত বসাক বললেন।
তাঁর সঙ্গে আলাপ আমার ইদানীং ঘনিষ্ঠ হলেও পরিচয় আমার তাঁর সঙ্গে একপক্ষে তাঁর থার্ড ইয়ারে ছাত্রজীবনে কয়েক মাস সহপাঠী হিসাবেই হয়। তারপর পড়া ছেড়ে দিয়ে আমার এক আত্মীয়ের কাছে নাগপুরে গিয়ে ব্যবসা শুরু করি। দীর্ঘকাল পরে আবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা এই কলকাতায়ই একটা বিজ্ঞান সভায়। তারপর বার দু-তিন নাগপুর থেকে কলকাতায় এলেই আমি এখানে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যেতাম। সেদিক দিয়ে তাঁর পার্সোন্যাল ব্যাপারের বিশেষ তেমন কিছুই আমি জানি না। তাই সেরকম সাহায্য আপনাকে করতে পারব বলে তো আমার মনে হয় না, মিঃ বসাক।
আপনি বিনয়েন্দ্রবাবুর সহপাঠী যখন, তখন পুরন্দরবাবুর সঙ্গেও বোধহয় আপনার সেই সময়েই আলাপ মিঃ ঝা?
প্রশান্ত বসাকের আকস্মিক প্রশ্নে চকিতে সুন্দরলাল তাঁর পার্শ্বে উপবিষ্ট পুরন্দর চৌধুরীর দিকে একবার তাকালেন। তারপর মৃদু স্মিতকণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ, ওঁর সঙ্গেও আমার আলাপ আছে।
মিঃ বসাক সুন্দরলালের সঙ্গে এমনি ঘরোয়া সহজভরে কথাবার্তা বলতে বলতেই তীক্ষ্ণ সতর্ক দৃষ্টিতে সুন্দরলালকে দেখছিলেন।
বয়েস যাই হোক না কেন, সুন্দরলালকে কিন্তু পুরন্দর চৌধুরী ও বিনয়েন্দ্র রায়ের সহপাঠী হিসাবে যথেষ্ঠ কম বয়েসী বলেই মনে হচ্ছিল।
শুধু তাই নয়, মুখে যেন কেমন একটা রমনী-সুলভ কমনীয়তা,দাড়ি নিখুঁতভাবে কামানন, সরু গোঁফ।
দেহের গঠনটাও ভারী সুশ্রী–লম্বা, খুব রোগাও নয়, আবার মোটও নয়।
কাঁটা চামচের সাহায্যে আহার করছিলেন সুন্দরলাল, হাতের আঙুলগুলো লম্বা লম্বা সরু সরু।
ডান হাতের অনামিকায় ও মধ্যাঙ্গুষ্ঠে দুটি পাথর বসানো স্বর্ণ-অঙ্গুরীয়। একটি পাথর, প্রবাল। অন্যটি বোধ হয় হীরা।
ঘরের আলোয় আংটির হীরাটি ঝিলমিল করছিল।
টেবিলে বসে খেতে খেতেই নানাবিধ আলোচনা চলতে লাগল অতঃপর।
.
আহারাদির পর পুনরায় আগামী কাল আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সুন্দরলাল বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
রজত অসুস্থ ছিল, সেও শুতে গেল।
সুজাতার ঘুম আসছিল না বলে তিন তলার ছাতে বেড়াতে গেল।
কেবল একটা টর্চ ও লোডেড পিস্তল পকেটে নিয়ে প্রশান্ত বসাক বাড়ির পশ্চাতের বাগানে গিয়ে প্রবেশ করলেন।
চাঁদ উঠতে আজ অনেক দেরি। অন্ধকার আকাশে এক ঝাঁক তারা জ্বলজ্বল করছে।
দীর্ঘ দিনের অযত্নে বাগানের চারিদিকে প্রচুর আগাছা নির্বিবাদে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকার রাত্রি যেন চারিদিককার আগাছা ও জঙ্গলের মধ্যে লুকোচুরি খেলছে। প্রাচীরের সীমানা ঘেঁষে বড় বড় দুটি কনকচাঁপার গাছ। ডালে ডালে তার অজস্র বিকশিত পুষ্প-গন্ধ বাতাসে যেন ম-ম করছে।
পায়ে-চলা একটা অপ্রশস্ত পথ বাগানের মধ্যে দিয়ে বরাবর চলে গিয়েছে প্রাচীর সীমানার গেট পর্যন্ত, সেই পথটা ধরেই এগিয়ে চললেন প্রশান্ত বসাক।
.
২৯.
সুজাতা একাকী তিনতলার ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আজ যেন কোথায়ও হাওয়া এতটুকুও নেই। অসহ্য একটা গুমোট ভাব।
কালই সকালে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে মনস্থ করেছিল সুজাতা। এবং যাবার জন্য। গতকাল দ্বিপ্রহর পর্যন্ত তার মনের মধ্যে একটা আগ্রহও যেন তাকে তাড়না করছিল। কিন্তু এখন সে তাড়না যেন আর তত তীব্র নেই।
ছোট্রকার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে যে বিহ্বলতা এসেছিল সেটাও যেনকেমন থিতিয়ে এসেছে। নিজেকে কেমন যেন দুর্বল মনে হয়।
বিশেষ একখানি মুখ মনের মধ্যে যেন কেবলই ভেসে ভেসে ওঠে। মনে হয় সত্যিই তো, তাড়াতাড়ি লক্ষ্ণৌ ফিরে গিয়ে কি হবে! সেই তো দৈনন্দিনের রুটিন-বাঁধা একঘেয়ে শিক্ষয়িত্রীর জীবন।
একই বহুবার পঠিত বইয়ের পাতাগুলি একের পর এক উল্টে যাওয়া, একই কথা, একই লেখা, কোন বৈচিত্র্য নেই। কোন নূতনত্ব বা কোন আবিষ্কারের আনন্দ বা উত্তেজনা নেই।
সেই স্কুল, সেই বাসা।
বহু পরিচিত লক্ষ্ণৌ শহরের সেই রাস্তাঘাটগুলো।
সীমাবদ্ধ একটা গণ্ডির মধ্যে কেবলই চোখ-বাঁধা বলদের মত পাক খাওয়া।
এই জীবন তো সুজাতা কোনদিন চায়নি। কল্পনাও তো কখনো করেনি। সারাটা জীবন ধরে এমনি করেই সে রুক্ষ এক মরুভূমির মধ্যে ঘুরে ঘুরেই বেড়াবে!
সেও তো কতদিন স্বপ্ন দেখেছে, জীবনের পাত্রখানি তার একদিন সুধারসে কানায় কানায় ভরে উঠবে। জীবন-মাধুর্য পরিপূর্ণতায় উপচে পড়বে।
জীবনের ত্রিশটা বছর কোথা দিয়ে কেমন করে যে কেটে গেল!
কোথা থেকে এত মিষ্টি চাঁপা ফুলের গন্ধ আসছে! মনে পড়ল আজই সকালে জানলার ভিতর দিয়ে সে দেখেছে বাগানের প্রাচীর সীমানার ধার ঘেঁষে বড় বড় দুটি কনক চাঁপার গাছ অজস্র স্বর্ণ-ফুলে যেন ছেয়ে আছে। এ তারই গন্ধ।
এয়োদশীর ক্ষীণ চাঁদ দেখা দিল আকাশ-দিগন্তে। আবছা মৃদু কোমল আলোর একটি আভাস যেন চারিদিকে ছড়িয়ে গেল।
কত রাত হয়েছে, কে জানে!
সুজাতা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
শেষ সিঁড়িতে পা দিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই আপনার অজ্ঞাতেই যেন থমকে দাঁড়িয়ে যায় সুজাতা।
ও কি! ওটা কি!
চাঁদের আবছা আলোয় বারান্দায় দীর্ঘ শ্বেত বস্ত্রাবৃত ওটা কি!
ভয়ে আতঙ্কে স্থান কাল ভুলে আর্ত একটা চিৎকার করে উঠল সুজাতা এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিঁড়ির শেষ ধাপের উপরে মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল।
.
প্রশান্ত বসাকও তখন সবে মাত্র বাগান থেকে ফিরে দোতলায় ওঠবার প্রথম ধাপে পা দিয়েছেন। সুজাতার কণ্ঠনিঃসৃত আর্ত সেই তীক্ষ্ণ চিৎকারের শব্দটা তাঁর কানে যেতেই তিনি চমকে ওঠেন এবং সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পান যেন একটা দুত পদধ্বনি উপরের বারান্দায় মিলিয়ে গেল। এক মুহূর্তও আর দেরি করলেন না প্রশান্ত বসাক।
প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে দু-তিনটা সিঁড়ি এক একবারে অতিক্রম করে ছুটলেন উপরের দিকে।
বারান্দায় এসে যখন পৌঁছলেন, দেখলেন পুরন্দর চৌধুরীও ইতিমধ্যে তাঁর ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন।
কি! কি ব্যাপার! কে যেন চিৎকার করল! পুরন্দর চৌধুরী সামনেই প্রশান্ত বসাককে দেখে প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, আমিও শুনেছি সে চিৎকার। বলতে বলতেই হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল তিনতলার ছাতে ওঠবার সিঁড়িটার মুখেই কী যেন একটা পড়ে আছে।
ছুটেই একপ্রকার সিঁড়ির কাছে পৌঁছে প্রশান্ত যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সেই ক্ষীণ চন্দ্রালোকেও সুজাতাকে চিনতে তাঁর কষ্ট হয় না।
পুরন্দর চৌধুরীও প্রশান্ত বসাকের পিছনে এসে গিয়েছিলেন এবং তিনিও সুজাতাকে চিনতে পেরেছিলেন। বিস্মিতকণ্ঠে তিনি বললেন, এ কি, সুজাতাদেবী এখানে পড়ে!
প্রশান্ত বসাক ততক্ষণে সুজাতার জ্ঞানহীন দেহটা পরম স্নেহে দু হাতে তুলে নিয়েছেন। সুজাতার ঘরের দিকে এগুতে এগুতে বললেন, ছাতের সিঁড়ির দরজাটায় শিকল তুলে দিন তো মিঃ চৌধুরী।
সুজাতার ঘরে প্রবেশ করে তার শয্যার.ওপরেই ধীরে ধীরে শুইয়ে দিলেন সুজাতাকে।
চোখে মুখে জলের ছিটে দিতেই সুজাতার লুপ্ত জ্ঞান ফিরে এল।
চোখ মেলে তাকল সে।
সুজাতাদেবী!
কে?
আমি প্রশান্ত, সুজাতাদেবী।
আমি—
একটু চুপ করে থাকুন।
কিন্তু সুজাতা চুপ করে থাকে না। বলে, এ বাড়িতে নিশ্চয়ই ভূত আছে প্রশান্তবাবু।
ভূত!
হ্যাঁ। স্পষ্ট বারান্দায় আমি হেঁটে বেড়াতে দেখেছি।
ইতিমধ্যে পুরন্দর চৌধুরী রজতকে ডেকে তুলেছিলেন। রজতও এসে কক্ষে প্রবেশ করে বলে, ব্যাপার কি, কি হয়েছে সুজাতা?
প্রশান্ত বসাক আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কী ঠিক দেখেছেন বলুন তো সুজাতা দেবী?
সাদা চাদরে সর্বাঙ্গ ঢাকা একটা মৃর্তি বারান্দায় হেঁটে বেড়াচ্ছিল। আমাকে দেখেই ছুটে সেই মূর্তিটা যেন ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।
প্রশান্ত বসাককে মনে হল যেন অত্যন্ত চিন্তিত।
রজত আবার কথা বলে, তাহলে রেবতী যে ছায়ামূর্তির কথা এ বাড়িতে মধ্যে মধ্যে রাত্রে দেখা দেয় বলেছিল তা দেখছি মিথ্যা নয়।
ছায়ামূর্তি? সে আবার কি? পুরন্দর চৌধুরী প্রশ্ন করলেন রজতকে।
হ্যাঁ, আপনি শোনেননি?
কই, না তো।
যাকগে সে কথা। রজতবাবু, এ ঘরে আপনি ততক্ষণ একটু বসুন, আমি আসছি।
কথাটা বলে হঠাৎ যেন প্রশান্ত বসাক ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
.
৩০.
প্রশান্ত বসাক সুজাতার ঘর থেকে বের হয়ে সোজা ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালালেন।
কিরীটীর কথাটাই তাঁর ঐ মুহূর্তে নতুন করে মনে পড়েছিল, সে বলেছিল ল্যাবরেটারী ঘরটা আর একবার ভাল করে দেখতে।
শূন্য ঘর। কোথাও কিছু নেই।
তবু সমস্ত ল্যাবরেটারী ঘর ও তৎসংলগ্ন বিনয়েন্দ্রর শূন্য শয়ন ঘরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন।
কিন্তু কোথায়ও কিছু নেই। আবার ল্যাবরেটরী ঘরে ফিরে এলেন।
হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল ল্যাবরেটরীর মধ্যস্থিত বাথরুমের দরজাটা হাঁ হাঁ করছে খোলা।
এগিয়ে গেলেন প্রশান্ত বসাক বাথরুমের দিকে।
কিন্তু বাথরুমের দরজাপথে প্রবেশ করতে গিয়েই যেন দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালেন। দরজার সামনে কতকগুলো অস্পষ্ট জলসিক্ত পায়ের ছাপ। ছাপগুলো বাথরুম থেকে এসে যেন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। খালি পায়ের ছাপ। বাথরুমের খোলা দরজাপথে প্রশান্ত বসাক ভিতরে উঁকি দিলেন, বাথরুমের মেঝেতে জল জমে আছে, বুঝলেন ঐ জল লেগেই পায়ের ছাপ ফেলেছে এ ঘরে।
প্রশান্ত বসাক এবারে বাথরুমের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
বাথরুমে একটি মাত্রই কাঁচের জানালা। ঠিক ল্যাবরেটরী ঘরেরই জানলার অনুরূপ।
লোহার-ফ্রেমে ঘষা কাচ বসানো একটি মাত্রই পাল্লা। এবং সেই পাল্লাটি ঠিক মধ্যস্থলে একটি ফালক্রেমের সাহায্যে দড়ি দিয়ে ওঠা নামা করা যায়।
প্রশান্ত বসাক বাথরুমের মধ্যে ঢুকে দেখলেন, জানলার পাল্লাটি ওঠানো।
হস্তধৃত টর্চের আলোর সাহায্যে বাথরুমের আলোর সুইচটা খুঁজে নিয়ে আলোটা জ্বালালেন মিঃ বসাক।
বাথরুমটা আলোয় ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে প্রশান্তর মনে হল ঘরের সংলগ্ন ঐ বাথরুমটি যেন বরাবর ছিল না। পরে তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। অথবা এমনও হতে পারে ঐ বড় হলঘরটির সংলগ্ন এই ছোট ঘরটি পূর্বে অন্য কোন ব্যাপারে ব্যবহার করা হত, বিনয়েন্দ্র পরে সেটিকে নিজের সুবিধার জন্য বাথরুমে পরিণত করে নিয়েছিলেন।
প্রশান্তর বুঝতে কষ্ট হয় না, বাথরুমের ঐ জানলাপথেই কেউ এ ঘরে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু কি ভাবে এল জানলাপথে!
কাঁচের জানলার পাল্লাটার তলা দিয়ে উঁকি দিলেন। নীলকুঠির পশ্চাতের বাগানের খানিকটা অংশ চোখে পড়ল।
আরও একটু ঝুঁকে পড়ে ভাল করে পরীক্ষা করতে গিয়ে চোখে পড়ল জানলার ঠিক নীচেই চওড়া কার্নিশ।
সেই কার্নিশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় বটে, তবে সেটা বেশ বিপদসঙ্কুল এবং শুধু তাই নয় সাহসেরও প্রয়োজন।
আবার ঘরের মেঝেতে জলসিক্ত সেই অস্পষ্ট পদচিহ্নগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন—যদি কোন বিশেষত্ব থাকে পদচিহ্নগুলোর মধ্যে। কিন্তু তেমন কোন উল্লেখযোেগ্য বিশেষত্বই চোখে পড়ল না প্রশান্ত বসাকের।
বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে একসময় ফিরে এলেন ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে প্রশান্ত বসাক।
পূর্বোক্ত ঘরে প্রশান্ত বসাক যখন ফিরে এলেন, রজত সুজাতার পাশে বসে আছে আর জানলার কাছে দাঁড়িয়ে লম্বা সেই বিচিত্র পাইপটায় নিঃশব্দে ধূমপান করছেন পুরন্দর চৌধুরী। সুজাতার জ্ঞান ফিরে এসেছে।
একটা কটু তীব্র তামাকের গন্ধ ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
প্রশান্তর পদশব্দে ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই যুগপৎ চোখ তুলে দরজার দিকে তাকাল। পুরন্দর চৌধুরীই প্রথমে কথা বললেন, Anything wrong ইন্সপেক্টার?
না কিছুই দেখতে পেলাম না।
আমার মনে হয় হঠাৎ উনি কোনরকম ছায়া-টায়া দেখে হয়তো–
পুরন্দর চৌধুরীর কথাটা শেষ হল না। জবাব দিল সুজাতাই, কোন রকম ছায়া যে সেটা নয় সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত মিঃ চৌধুরী। হঠাৎ দেখে আচমকা আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম বটে সত্যি, তবে সে দেখার মধ্যে কোন রকম আমার ভুল হয়নি।
কিন্তু তাই যদি হবে, তবে এত তাড়াতাড়ি সেটা উধাও হয়ই বা কি করে দোতলা থেকে? কথাটা বললে রজত।
কিন্তু সেটাই তো আমার না দেখার বা কিছু একটা ভুল দেখবার একমাত্র যুক্তি নয় রজতদা। জবাবে বলে সুজাতা।
না। উনি ভুল দেখেননি রজতবাবু। কথাটা বললেন এবারে প্রশান্ত। এবং তাঁর কথায় ও তাঁর গলার স্বরে পুরন্দর চৌধুরী ও রজত দুজনেই যেন যুগপৎ চমকে প্রশান্তর মুখের দিকে তাকাল।
সত্যি বলছেন আপনি মিঃ বসাক? কথাটা বলে রজত।
হ্যাঁ রজতবাবু, আমি সত্যিই বলছি। কিন্তু রাত প্রায় পৌনে দুটো বাজে, বাকি রাতটুকু আপনারা সকলেই ঘুমবার চেষ্টা করুন, আমিও এবারে শুতে যাব, ঘুমে আমার দু চোখ ভেঙে আসছে।
সমস্ত আলোচনাটার উপরে যেন অকস্মাৎ একটা দাঁড়ি টেনে প্রশান্ত বসাক বোধ হয় ঘর ত্যাগ করে নিজের ঘরে শুতে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। এবং কক্ষ ত্যাগের পূর্বে সুজাতাকে লক্ষ্য করে বললেন, ঘরের দরজায় খিল তুলে দিয়ে শোবেন মিস রয়।
কথাটা শেষ করেই আর মুহূর্তমাত্রও দাঁড়ালেন না ইন্সপেক্টার, নিঃশব্দে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।
অতঃপর রজত ও পুরন্দর চৌধুরীও যে যার ঘরে শুতে যাবার জন্য পা বাড়াল।
.
প্রশান্ত নিজের নির্দিষ্ট ঘরে প্রবেশ করে দরজাটা কেবল ভেজিয়ে দিলেন।
ঘুমের কথা বলে আলোচনার সমাপ্তি করে বিদায় নিয়ে এলেও ঘুম কিন্তু প্রশান্ত বসারে দুচোখের কোথাও তখন ছিল না।
তিনি কেবল নিজের মনে মনে সমস্ত ব্যাপারটা আগাগোড়া আর একবার ভাল করে ভেবে দেখতে চান।
বাথরুমের মেঝেতে, জলসিক্ত পদচিহ্নগুলো সত্যিই তাঁকে বিশেষভাবেই যেন বিচলিত করে তুলেছিল। আর কিছুনা হোক পদচিহ্নগুলো সুস্পষ্টভাবে একটা জিনিস প্রমাণিত করছে, ওই রাত্রে কিছুক্ষণ আগে কোন তৃতীয় ব্যক্তিবিশেষের আবির্ভাব ওই নীলকুঠীতে ঘটেছিল নিঃসন্দেহে। কোন ছায়ার মায়া নয়। এবং লছমনের মুখে শোনা সেই ভৌতিক আবির্ভাবের সঙ্গে যে আজকের রাত্রে সুজাতাদেবীর দৈখা ছায়ামূর্তির বিশেষ এক যোগাযোগ আছে সে বিষয়েও তাঁর যেন কোনই আর সন্দেহ বা দ্বিমত থাকছে না।
আর এও বোঝা যাচ্ছে ভৌতিক ব্যাপারটা এ বাড়িতে পূর্বে যারা দেখেছে তাদের সে দেখাটাও যেমন মিথ্যা নয়, তেমনি ব্যাপারটাও সত্যি সত্যিই কিছু আসলে ভৌতিক নয়।
লছমনের মুখ থেকেই তার জবানবন্দিতে শোনা গেছে রামচরণ বিনয়েন্দ্র এবং লছমন নিজেও পূর্বে এ বাড়িতে রাত্রে ওই ছায়ামূর্তি নাকি দেখেছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা চলে আসছে বেশ কিছুদিন ধরে। এবং ছায়ামূর্তির ভৌতিক মুখোসের অন্তরালে যখন সত্যিকারের একটা জলজ্যান্ত মানুষ আছে তখন ওর পশ্চাতে কোন রহস্য যে আছে সেও সুনিশ্চিত।
৩১-৩৫. নীলকুঠির আশেপাশে
নীলকুঠির আশেপাশে একমাত্র বাঁদিকে লাগোয়া একটা দোতলা বাড়ি ভিন্ন আর কোন বাড়ি নেই প্রশান্ত বসাক সেটা পূর্বেই লক্ষ্য করেছিলেন।
জায়গাটার গত কয়েক বৎসরে অনেক কিছু ডেভালপমেন্ট হলেও ঐ অঞ্চলটির বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি।
ভোরের আলো আকাশে ফুটে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশান্ত বসাক নীলকুঠি থেকে বের হয়ে পড়লেন।
কুঠির আশপাশটা একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
বাঁদিককার দোতলা বাড়িটায় একজন প্রফেসার থাকেন, সংসারে তাঁর এক বৃদ্ধা মা ও স্ত্রী। পূর্বেই সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল গত মাসখানেক ধরে প্রফেসার মা ও স্ত্রীকে নিয়ে পুরীতে চেঞ্জে গেছেন। বর্তমানে বাড়ি দেখাশোনা করে একটি ভৃত্য।
ঘুরতে ঘুরতে প্রশান্ত বসাক নীলকুঠির ডান দিকে এবারে এলেন। সংকীর্ণ একটি গলিপথ। গলিপথটি বড় একটা ব্যবহৃত হয় বলে মনে হয় না। এবং পথটি বরাবর গঙ্গার ধার পর্যন্ত চলে গিয়েছে।
এগিয়ে গেলেন সেই গলিপথ ধরে প্রশান্ত বসাক। গঙ্গার একেবারে ধারে গিয়ে যেখানে পথটা শেষ হয়েছে, বিরাট শাখাপ্রশাখাবহুল একটি পুরাতন অশ্বত্থ বৃক্ষ সেখানে।
ঢালু পাড় বরাবর অশ্বথ গাছের তলা থেকে গঙ্গার মধ্যে নেমে গেছে।
অশ্বত্থতলা থেকে নীলকুঠির লাগোয়া পশ্চাতের বাগানটার সবটাই চোখে পড়ে। এবং বাড়ির পশ্চাতের অশটাও সবটাই দেখা যায়। নীলকুঠির দিকে তাকাতেই দোতলার ঐ দিককার একটি ভোলা জানলা প্রশান্ত বসাকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। খোলা জানলার সামনে যেন স্থির একটি চিত্র। চিনতে কষ্ট হয় না কার চিত্র সেটা।
সুজাতা।
দৃষ্টি তাঁর সম্মুখের দিকে বোধ হয় গঙ্গাবক্ষেই প্রসারিত ও স্থির। হাওয়ায় মাথার চুর্ণ কুন্তলগুলি উড়ছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন প্রশান্ত বসাক সেদিকে। চোখ যেন আর ফিরতে চায় না।
ধীরে ধীরে এক সময় চোখ নামিয়ে পূর্বের পথে আবার ফিরে চললেন প্রশান্ত বসাক।
গলির অন্যদিকে যে সীমানাপ্রাচীর বহু স্থানে তা ভেঙে ভেঙে গিয়েছে। সেই রকম ভাঙাই একটা জায়গা দিয়ে প্রাচীরের অন্যদিকে গেলেন প্রশান্ত বসাক। প্রায় দু-তিন কাঠা জায়গা প্রাচীরবেষ্টিত। জীর্ণ একটি একতলা পাকা বাড়ি। গোটা তিনেক দরজা দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে একটি দরজার কড়ার সঙ্গে তালা লাগান।
এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রশান্ত বসাক সেই দরজার সামনে। পাকা ভিতের বহু জায়গায় ফাটল ধরেছে—সিমেন্ট উঠে গিয়ে তলাকার ইটের গাঁথুনি বিশ্রী ক্ষতচিহ্নের মত দেখাচ্ছে।
হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল সেই তালা দেওয়া দরজাটার সামনেই জীর্ণ বারান্দার মেঝেতে অনেকগুলো অস্পষ্ট শ্বেত পদচিহ্ন।
এবারে দিনের স্পষ্ট আলোয় পরীক্ষা করে দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না, সেইশ্বেত পদচিহ্নগুলো পড়েছে পায়ে চুন লেগে থাকার দরুন। এবং এও মনে হয় গত রাত্রে যে পদচিহ্ন অস্পষ্ট জলসিক্ত তিনি বাথরুমে দেখেছেন এগুলো ঠিক তারই অনুরূপ।
ঘরের দরজাটা বন্ধ, তালাটা ধরে টানলেন, কিন্তু ভাল জামান তালা, সহজে সে তালা ভাঙবার উপায় নেই।
এমন সময় হঠাৎ তাঁর কানে এল তুলসীদাসের দোঁহা মৃদু কণ্ঠে কে যেন গাইছে।
সামনের দিকে চোখ তুলে তাকালেন, একজন মধ্যবয়সী হিন্দুস্থানী গঙ্গা থেকে সদ্য স্নান করে বোধ হয় হাতে একটা লোটা ঝুলিয়ে তুলসীদাসের দোঁহা গাইতে গাইতে ঐ গৃহের দিকেই আসছে।
হিন্দুস্থানী ব্যক্তিটি দণ্ডায়মান প্রশান্ত বসাকের কাছ বরাবর এসে মুখ তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, কিকো মাঙতে হে বাবুজী?
এ কোঠিমে আপই রহেতে হে?
হ্যাঁ। লেকেন আপ্ কিকো মাঙতে হে?
আপকো নাম কেয়া জী?
হরিরাম মিশির।
ব্রাহ্মণ?
হ্যাঁ, কনৌজকা ব্রাহ্মণ।
ও। এমনি বেড়াতে বেড়াতে চলে এসেছিলাম মিশিরজী। ভেবেছিলাম পোড়ো বাড়ি।
হঠাৎ এমন সময় পাশের একটি বন্ধ দরজা খুলে গেল এবং একটি হিন্দুস্থানী তরুণী আবক্ষ ঘোমটা টেনে বের হয়ে এল।
মিশিরজী তরুণীকে প্রশ্ন করে, কিধার যাতা হায় বেটি? গঙ্গামে?
তরুণী কোন কথা না বলে কেবল মাথা হেলিয়ে গঙ্গার দিকে চলে গেল।
প্রশান্ত বসাক চেয়ে থাকেন সেই দিকে, বিশেষ করে সেই তরুণীর চলার ভঙ্গিটা যেন প্রশান্ত বসাকের চোখের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
চোখ যেন ফেরাতে পারেন না।
বাবুজী!
মিশিরজীর ডাকে আবার ফিরে তাকালেন প্রশান্ত বসাক।
বাবুজী কি এই উত্তর পাড়াতেই থাকেন?
অ্যাঁ। না—মানে—
এখানে ঢুকলেন কি করে? গেটে আমার তালা দেওয়া।
না না–গেট দিয়ে আমি ঢুকিনি; ঐ যে ভাঙা প্রাচীর—তারই ফাঁক দিয়ে এসেছি। ভেবেছিলাম পোড়ো বাড়ি।
হ্যাঁ, বাবুজী, এতদিন পোড়ো বাড়িই ছিল, মাসখানেকের কিছু কেঁশী হবে মাত্র আমরা এখানে এসে উঠেছি। তা বাবুজী দাঁড়িয়েই রইলেন, ঘর থেকে একটা চৌকি এনে দিই, বসুন—
না না, মিশিরজী, ব্যস্ত হতে হবে না। আমি এমনিই বেড়াতে চলে এসেছি। এবারে যাই।
প্রশান্ত বসাক তাড়াতাড়ি নেমে যাবার জন্য পা বাড়ালেন।
মিশিরজীও এগিয়ে এল, চলুন বাবুজী, আপনাকে গেট খুলে রাস্তায় দিয়ে আসি।
গেট থেকে বের হয়ে প্রশান্ত বসাক কিন্তু নীলকুঠির দিকে গেলেন না, উলটো পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন।
এগিয়ে যেতে যেতে একবার ইচ্ছা হল, পিছন ফিরে তাকান, কিন্তু তাকালেন না। তবে পিছন ফিরে তাকালে দেখতে পেতেন তখনও খোলা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মিশিরজী একদৃষ্টে প্রশান্ত বসারে গমনপথের দিকেই তাকিয়ে আছে।
তার দু চোখের তারায় ঝকঝকে শাণিত দৃষ্টি, বহুপূর্বেই তার সহজ সরল বোকা বোকা চোখের দৃষ্টি শাণিত ছোরার ফলার মত প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছিল।
.
৩২.
অনেকটা পথ ঘুরে প্রশান্ত বসাক যখন নীলকুঠিতে ফিরে এলেন বেলা তখন প্রায় পৌনে আটটা।
দোতলায় চায়ের টেবিলে প্রভাতী চায়ের আসর তখন প্রায় ভাঙার মুখে।
টেবিলের দু পাশে রজত, পুরন্দর চৌধুরী ও সুজাতা বসে এবং শুধু তারাই নয়, গত সন্ধ্যার পরিচিত সেই কালো কাঁচের চশমা চোখে সুটপরিহিত যুবক সুন্দরলালও উপস্থিত।
প্রশান্ত বসাককে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সকলেই একসঙ্গে তাঁর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। এবং কথা বললে পুরন্দর চৌধুরী, এই যে মিঃ বসাক! সক্কাল বেলাতেই উঠে কোথায় গিয়েছিলেন?
এই একটু মর্ণিংওয়াক করতে গিয়েছিলাম। তারপর মিঃ সুন্দরলাল, আপনি কতক্ষণ?
এই আসছি।
সুজাতা ততক্ষণে উঠে চায়ের কেতলিটার গায়ে হাত দিয়ে তার তাপ অনুভব করে বললে, কেতলির চা-টা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, আপনি চা খাননি, রেবতীকে বলে আসি কিছু গরম চা দিতে প্রশান্তবাবু।
কথাগুলো বলে এগিয়ে যেতে উদ্যত হতেই সুজাতাকে বাধা দিলেন মিঃ বসাক, না না—আপনি ব্যস্ত হবেন না মিস রয়। বসুন আপনি।
সুজাতা স্মিতকঠে বললে, ব্যস্ত নয়, আমিও আর একটু চা খাব।
গতরাত্রের মত আজও ঘরে প্রবেশ করার মুখে প্রশান্ত বসাক লক্ষ্য করেছিলেন, মিঃ সুন্দরলাল ও পুরন্দর চৌধুরী পাশাপাশি একটু যেন ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেই নিম্নকণ্ঠে পরস্পরের সঙ্গে পরস্পর কথা বলছিলেন, এবং প্রশান্ত বসাকের কক্ষমধ্যে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা যেন অকস্মাৎ চুপ করে গেলেন।
সুজাতা ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দু-মিনিটে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ কি একটা কথা মনে পড়ায় এখুনি আসছি বলে প্রশান্ত বসাকও বের হয়ে এলেন ঘর থেকে। এবং সোজা নিচে চলে গেলেন।
নিচের তলায় প্রহরারত কনস্টেবল মহেশকে নিয় অথচ দ্রুতকণ্ঠে কি কতকগুলো নির্দেশ দিয়ে বললেন, যাও এখুনি, বাইরে গেটের পাশে হরিসাধন আছে সাধারণ পোশাকে, যা যা বললাম তাকে বলবে। যেমন যেমন প্রয়োজন বুঝবে সে যেন করে।
ঠিক আছে, আমি এখুনি গিয়ে বলে আসছি।
মহেশ বাইরে চলে গেল।
মহেশকে নির্দেশ দিয়ে প্রশান্ত বসাক যেমন ঘুরে সিঁড়ির দিকে দোতলায় ওঠবার জন্য পা বাড়াতে যাবেন, আচমকা তাঁর নজরে পড়ল নীচের একখানি ঘরের ভেজানো দুই বাটের সামান্যতম মধ্যবর্তী ফাঁকের মধ্য দিয়ে একজোড়া শিকারীর চোখের মত জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি যেন চকিতে বাটের অন্তরালে দেখা দিয়েই আত্মগোপন করল।
থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন প্রশান্ত বসাক।
মুহূর্তকাল ভ্রূকুঞ্চিত করে কি যেন ভাবলেন, তারপর সোজা এগিয়ে গেলেন সেই ঈন্মুক্ত দ্বারপথের দিকে।
হাত দিয়ে ঠেলে কবাট দুটো খুলে ফেললেন, খালি ঘর, ঘরে কেউ নেই।
চিনতে পারলেন করালীর ঘর ওটা। পাশেই পাচক লছমনের ঘর। দু-ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটার দিকে এবারে এগিয়ে গেলেন, কিন্তু দরজার কবাট ঠেলতে গিয়ে বুঝলেন ওপাশ থেকে দরজা বন্ধ। বের হয়ে এলেন করাঙ্গীর ঘর থেকে প্রশান্ত বসাক। বারান্দা দিয়ে গিয়ে লছমনের ঘরের সামনের দরজা ঠেলতেই ঘরের দরজাটা খুলে গেল। ভিতরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু দেখলেন পাচক লছমনের ঘরও খালি। সে ঘরেও কেউ নেই। আরো দেখলেন করালী ও লছমনের ঘরের মধ্যবর্তী দরজার গায়ে সেই ঘর থেকেই খিল তোেলা। ঐ ঘরের ঐ মধ্যবর্তী দরজাটি বাদেও আরও দুটি দরজা ছিল। এবং দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটি বাদেও অন্য দুটি দরজাই খোলা ছিল।
যার চোখের ক্ষণিক দৃষ্টি ক্ষণপূর্বে মাত্র তিনি পাশের ঘরের উন্মুক্ত দরজা-পথে দেখেছিলেন, সে অনায়াসেই তাহলে এ দ্বিতীয় দরজাটি দিয়ে চলে যেতে পারে।
হঠাৎ ঐ সময় বারান্দার দিকে দ্বিতীয় যে দ্বারটি সেটি খুলে গেল এবং চায়ের কাপ হাতে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে করালী এসে ঘরে প্রবেশ করেই ঘরের মধ্যে দণ্ডায়মান ইন্সপেক্টারকে দেখে যেন থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল, ইন্সপেক্টার সাহেব।
হ্যাঁ, তোমার ঘরটা আমি দেখছিলাম করালী।
করালী চা-ভর্তি কাপটা একটা টুলের উপর নামিয়ে রেখে সসম্ভমে সরে দাঁড়াল।
কোথায় ছিলে করালী?
রান্নাঘরে চায়ের জন্য গিয়েছিলাম সাহেব।
রান্নাঘরে আর কে কে আছেন?
লছমন আর নতুন দিদিমণি আছেন।
প্রশান্ত বসাক করালীর সঙ্গে দ্বিতীয় আর কোন কথাবার্তা না বলে রাগী যে পথে ঘরে প্রবেশ করেছিল ক্ষণপূর্বে, সেই খোলা দ্বার দিয়েই বের হয়ে গেলেন। এবং সোজা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেন।
ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখলেন সুন্দরলাল তখন ঘরে নেই। রজত আর পুরন্দর চৌধুরী বসে বসে গল্প করছেন, আর কেউ ঘরে নেই।
একটু পরেই সুজাতা এসে ঘরে প্রবেশ করল এবং তার পিছনে পিছনেই চায়ের কেতলী নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল রেবতী।
.
চা পান করতে করতেই সামনাসামনি উপবিষ্ট সুজাতার দিকে তাকিয়ে প্রশান্ত বসাক বলেন, তাহলে আজই আপনি কলকাতায় চলে যাচ্ছেন মিস রয়?
সুজাতা প্রশান্ত বসাকের প্রশ্নে একবার মাত্র তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে মুখটা নামিয়ে মৃদুকণ্ঠে বললে, তাই ভেবেছিলাম যাব, কিন্তু রজতদা বলছে, দু-চারদিনের মধ্যে ও ফিরে যাবে, সেই সঙ্গেই যাবার জন্যে।
হ্যাঁ মিঃ বসাক, আমি তাই বলছিলাম সুজাতাকে। যেতে ওকেও হবে, আমাকেও হবে। এদিককার ব্যবস্থাপত্র যাহোক একটা কিছু করে যেতে হবে তো। এবং সেজন্য ওর ও আমার দুজনেরই থাকা প্রয়োজন। আপনি কি বলেন মিঃ বসাক? রজত কথাগুলো বললে।
হ্যাঁ, আপনারাই যখন বিনয়েন্দ্রবাবুর সমস্ত সম্পত্তির ওয়ারিশান তখন ইন্সপেক্টারকে বাধা দিল সুজাতা, না, ছোট্রকার সম্পত্তির এক কপর্দকও আমি স্পর্শ করব, তা আমি রজতদাকে বলেই দিয়েছি।
হ্যাঁ, সুজাতা তাই বলছিল বটে। কিন্তু মিঃ বসাক, আপনিই বলুন তো তাই কখনও কি হয়। সম্পত্তি ওকেও আমার সঙ্গে সমান ভাগে নিতে হবে বৈকি, কি বলেন?
না রজতদা, ও আমি স্পর্শও করব না। তুমিই সব নাও।
কিন্তু আমিই বা তোর ন্যায্য সম্পত্তি নিতে যাব কেন? বেশ তো, তোর ভাগ তুই না নিস—যে ভাবে খুশী দান করে যা বা যে কোন একটা ব্যবস্থা করে যা।
বেশ, তাই করে যাব।
এমন সময় প্রতুলবাবু এসে ঘরে ঢুকলেন।
এই যে প্রতুলবাবু, আসুন। রজত আহ্বান জানালেন প্রতুলবাবুকে।
প্রতুলবাবু এগিয়ে এসে একটা খালি চেয়ারে উপবেশন করলেন।
অ্যাটর্নী চট্টরাজকে আজ একবার আসবার জন্য আপনাকে খবর দিতে হবে প্রতুলবাবু। রজত বলে।
প্রতুলবাবু ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে রজতের মুখের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালেন। প্রতুলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রজত কথাটার আবার পুনরাবৃত্তি করে, ছোট্রকার অ্যাটর্নী চট্টরাজকে কাল কোন এক সময় আসবার জন্য একটা সংবাদ দেবেন। তাছাড়া, আমিও আর এখানে অনির্দিষ্ট কাল বসে থাকতে পারব না। লাহোরে আমাকে ফিরে যেতে হবে।
প্রতুলবাবু যেন এতক্ষণে ব্যাপারটি কিছু যাহোক বুঝতে পারেন। বললেন, এ বাড়িতে তাহলে আপনারা কেউ থাকবেন না রজতবাবু?
কে থাকবে এই চক্রবর্তীদের ভূতুড়ে নীলকুঠিতে বলুন। শেষকালে কি চক্রবর্তীদের প্রেতাত্মার হাতে বেঘোরে প্রাণটা দেব!
তাহলে এ বাড়িটার কী ব্যবস্থা হবে?
আপনি রইলেন, বেচে দেবার চেষ্টা করবেন।
কিন্তু আমি তো আর চাকরি করবনা রজতবাবু। মৃদু শান্ত কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিলেন প্রতুলবাবু।
তার মানে, চাকরি ছেড়ে দেবেন?
হ্যাঁ। তাছাড়া, এসব বাড়িঘর-দোর সব যখন আপনারা বেচেই দেবেন তখন আর আমার প্রয়োজনই বা কি! চক্রবর্তী মশাইয়ের মৃত্যুর পর থেকেই এক প্রকার আমার কোন কাজকর্ম ছিল না। তবু চক্রবর্তী মশাই মরবার আগে বিশেষ করে অনুরোধ করে গিয়েছিলেন, বিনয়েন্দ্রবাবুকে যেন একলা ফেলে আমি না চলে যাই। তাই ছিলাম। তা এখন সে প্রয়োজনও ফুরিয়েছে।
হঠাৎ এমন সময় সুজাতা কথা বলে, এক কাজ করলে হয় না রজতদা?
কী?
ছোট্কার ঐ ল্যাবরেটারীটা প্রাণের চাইতেও প্রিয় ছিল। সমস্ত নীলকুঠিটাকেই একটা গবেষণাগারে পরিণত করে দুঃস্থ বৈজ্ঞানিকদের এখানে গবেষণার একটা ব্যবস্থা করে দিলে হয় না?
কিন্তু আমার তো মনে হয়—
রজতকে বাধা দিয়ে সুজাতা বলে, অবিশ্যি আমি আমার অংশের ব্যবস্থাটা সেই ভাবেই করতে পারি! তবে তুমি–
না না–কথাটা তুই নেহাত মন্দ বলিসনি সুজাতা। দেখি ভেবে। হ্যাঁ প্রতুলবাবু, আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন, কোথায় কার কি দেনা-পাওনা আছে, চাকরবাকরদের মাইনে পত্র কে কি পাবে না পাবে সব একটা হিসাবপত্র করে ফেলুন। যত তাড়াতাড়ি পারি এদিককার সব মিটিয়ে দিয়ে আমাকে একবার লাহোরে যেতে হবে।
যে আজ্ঞে। তাই হবে। এখন তাহলে আমি উঠলাম।
প্রতুলবাবু বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
.
৩৩.
ল্যাবরেটারী ঘরে এক্সপেরিমেন্ট করবার লম্বা টেবিলের সেফেই ফোন ছিল। প্রশান্ত বসাকের সেটা পূর্বেই নজরে পড়েছিল।
ল্যাবরেটারী ঘরে ঢুকে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে প্রশান্ত বসাকফোনের রিসিভারটা তুলে নিলেন এবং কিরীটীর ফোন-নম্বরটা চাইনে এক্সচেঞ্জে।
একটু পরেই কনেকশন পাওয়া গেল।
হ্যালো! কিরীটী রায় কথা বলছি।
নমস্কার মিঃ রায়। আমি প্রশান্ত বসাক। উত্তরপাড়ার নীলকুঠি থেকে কথা বলছি।
নমস্কার। নীলকুঠিতে ফোন আছে নাকি?
হ্যাঁ।
বেশ। তারপর কি সংবাদ বলুন, any further development?
বসাক তখন ফোনে সংক্ষেপে অথচ কিছু বাদ না দিয়ে, গত রাত্রে এ বাড়িতে ফিরে আসবার পর যা ঘটেছে সব একটু একটু করে বলে গেলেন। তারপর বললেন, কোন সঠিক সিদ্ধান্তেই তো এখনও পৌঁছতে পারছি না মিঃ রায়। অথচ এদেরও আর কেমন করে আটকে রাখি বলুন?
ওপাশ থেকে কিরীটীর মৃদু হাসির শব্দ শোনা গেল। সে বললে, নীলকুঠি-রহস্য শেষ ধাপে পৌঁছতে আমার মনে হয় বেশী দেরি নেই প্রশান্তবাবু।
কি বলছেন আপনি?
হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। হয়তো বা আজ রাত্রেও আবার সেই ছায়ামূর্তির আবির্ভাব ঘটতে পারে। আর একান্তই যদি আজ বা কাল না ঘটে, জানবেন দু-চারদিনের মধ্যেই আবির্ভাব তার ঘটবে। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলছিলাম–
কী?
সুজাতাদেবী নীলকুঠি থেকে চলে গেলেই ভাল করতেন।
কিরীটীর কথায় প্রশান্ত বসাক যেন অতিমাত্রায় চমকে ওঠেন এবং তাঁর সেই চমকানো গলার স্বরে ফুটে ওঠে। বলেন কি মিঃ রায়! তবে কি
হ্যাঁ প্রশান্তবাবু। দিনেরাত্রে সর্বদা সুজাতাদেবীর উপরে তীক্ষ্ণ নজর রাখবেন।
আপনি—আপনি কি তাহলে সত্যি সত্যিই হত্যাকারী কে ধরতে পেরেছেন মিঃ রায়? কিরীটীকে কথাটা আর না জিজ্ঞাসা করে থাকতে পারেন না প্রশান্ত বসাক।
অনুমান করেছি প্রশান্তবাবু।
অনুমান?
হ্যাঁ।
কে? কে তাহলে হত্যাকারী?
মৃদু হাসির একটা শব্দ আবার ভেসে এল এবং সেই সঙ্গে ভেসে এল প্রশ্নোত্তরে দুটি কথা: আপনিই বলুন না?
আমি?
হ্যাঁ, আপনি।
কিন্তু আমি তো—
ঠিক এখনও অনুমান করতে পারছেন না। তাই না?
হ্যাঁ, মানে–
শুনুন প্রশান্তবাবু। আপনি ভোলেননি নিশ্চয়ই, বৈজ্ঞানিক বিনয়েন্দ্রর হত্যা ব্যাপারটা গতকালই আপনাকে বলেছিলাম pre-arranged, pre-meditative and well planned। এবং আমার অনুমান, সেই প্ল্যানের মধ্যে একটি নারী আছে।
নারী?
হ্যাঁ।
You mean তাহলে সেই লতা!
লতা কি পাতা জানি না, তবে একটি নারী এ ব্যাপারের মধ্যে আছে। তাকে খুঁজে বের করুন, তাহলেই হত্যাকারীকেও সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবেন। আর এও জানবেন, সেই নারী বৈজ্ঞানিক বিনয়েন্দ্রবাবুকে বেশ জোরেই আকর্ষণ করেছিল। জানেন তো আকর্ষণ মানেই দুর্বলতা। আর দুর্বলতা মানেই—আত্মসমর্পণ। এবং তার পশ্চাতে এসেছে বিষ। আর এ সব কিছুর মূলে বিনয়েন্দ্রবাবুর বিপুল সম্পত্তিও নিশ্চয়ই আছে জানবেন।
কিন্তু সেই নারী।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখুন। বেশি দূরে নয়, সামনেই হয়তো তিনি আছেন।
সামনেই আছে?
হ্যাঁ। জানেন, আমাদের বাংলাদেশে এক শ্রেণীর সাপ আছে, যাকে গ্রাম্য ভাষায় বলা হয় লাউডগা সাপ। লাউপাতার সবুজ পত্রের মতই তার গায়ের বর্ণ। এবং সেই কারণেই সাপ যখন লাউ গাছে জড়িয়ে থাকে হঠাৎ বড় একটা চোখে পড়ে না। অথচ সাবধান না হলে দংশন করে।
কিরীটীর শেষের কথায় চকিতে একটা সম্ভাবনা যেন বিদ্যুৎস্ফুরণের মতই প্রশান্ত বসাকের মনের মধ্যে ঝিলমিল করে ওঠে। তবে কি সঙ্গে সঙ্গেই তারপর প্রায় প্রশান্ত বসাক বলে ওঠেন, বুঝেছি। বুঝেছি আপনার ইঙ্গিত মিঃ রায়। ধন্যবাদ ধন্যবাদ। আচ্ছা নমস্কার। রিসিভারটা নামিয়ে রেখে প্রশান্ত বসাক কয়েকটা মুহূর্ত মনে মনে কি যেন ভাবলেন। তারপর আবার রিসিভারটা তুলে নিয়ে হেড কোয়ার্টারে কনেশন চাইলেন।
প্রশান্ত বসাক জিজ্ঞাসা করলেন, যে সংবাদগুলো জানবার জন্য ওয়্যার করতে বলেছিলাম তার জবাব এসেছে কি?
না, এখনও আসেনি, জবাব এলে—
এলেই আমাকে জানাবেন, এ বাড়ির ফোন-নম্বরটা টুকে নিন।
প্রশান্ত বসাক নীলকুঠির ফোন-নম্বরটা দিয়ে দিলেন।
ঐদিন সমস্ত দ্বিপ্রহরটা মিঃ বসাক তন্ন তন্ন করে ল্যাবরেটারী ঘরের যাবতীয় সব কিছু নেড়ে-চেড়ে উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগলেন। যদি আর কোন নতুন সূত্র পাওয়া যায়।
ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা ড্রয়ারে আলমারির মধ্যে একটা হাতীর দাঁতের সুদৃশ্য কৌটো পেলেন। এবং পেলেন একটা নোট-বই। কৌটোটার মধ্যে আট-দশটা মুক্তো পাওয়া গেল। বুঝলেন ঐগুলিইসেই সিঙ্গাপুরীমুক্তা। আর কালো মরোক্কো চামড়ায় বাঁধা ডিমাইসাইজেরনোট-বুকটা। নোট-বুকটার প্রায় দুইয়ের তিন অংশ ব্যবহৃত হয়েছে।
নানা ধরনের অঙ্ক, রসায়ন শাস্ত্রের অনধিগম্য অবোধ্য সব ফরমূলা লেখা পাতায় পাতায়।
অন্যমনস্কভাবে নোট-বইয়ের পাতাগুলো উল্টাতে লাগলেন প্রশান্ত বসাক।
হঠাৎ শেষের দিকে একটি পাতায় দেখলেন দুবাধ্য সব অঙ্কের নীচেই স্পষ্ট বাংলা অক্ষরে লেখা—লতা।
সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ যেন তিনি অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠলেন। অকস্মাৎ তাঁর মনের মধ্যে একটা সরীসৃপ যেন শিরশিরিয়ে উঠেছে। এবং শুধু লতা শব্দটিই নয়, তার চারপাশে নানাপ্রকারের বিচিত্র সব কালির আঁকিবুকি কাটা।
আবার পাতা উল্টে চললেন। এবং অন্য আর এক পাতায় দেখলেন লেখা-লতা চলে গেল।
তার নীচে আবার অঙ্ক কষা আছে। আবার পাতা উল্টে চললেন। হঠাৎ আবার শেষের একটা পৃষ্ঠায় নজর আটকে গেল সেখানে লেখা : লতা কি আর ফিরে কোনদিনই আসবে না! তবে সে কেন এল!
একদৃষ্টে লেখাটার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বারে বার লেখাটা পড়তে পড়তে হঠাৎ সম্পূর্ণ অন্য আর একটি কথা মনে পড়ে যায় প্রশান্ত বসাকের।
ভ্রূ দুটো কুঁচকে যায় তাঁর।
যে সম্ভাবনাটা এইমাত্র তাঁর মনে উদয় হয়েছে তার মীমাংসার জন্য তাড়াতাড়ি নোট-বুকটা বন্ধ করে পকেটে পুরে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন প্রশান্ত বসাক।
বাইরে বেলা অনেকখানি গড়িয়ে এসেছে। সূর্যের আলো স্তিমিত হয়ে এসেছে।
নিজের নির্দিষ্ট ঘরটার মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন প্রশান্ত বসাক; এবং ঘরে প্রবেশ করে ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
.
৩৪.
ঐদিনই সন্ধ্যার দিকে ডাইনিং হলে সান্ধ্য চা-পানের পর এক সময় প্রশান্ত বসাক তাঁর পকেট থেকে চারখানা কাগজ বের করলেন। চারখানা কাগজেই কি যেন সব লেখা রয়েছে। লেখা কাগজ চারখানি হাতে করে ঘরের মধ্যে উপস্থিত সুজাতা, রজত, পুরন্দর চৌধুরী ও প্রতুলবাবুকে সম্বোধন করে বললেন, আপনারা প্রত্যেকেই এই কাগজগুলো পড়ে দেখুন। কাগজে আমি বাংলায় আপনাদের প্রত্যেকের জবানবন্দি সংক্ষেপে আলাদা আলাদা করে লিখেছি। পড়ে দেখুন, আপনারা যে যেমন জবানবন্দি দিয়েছেন আমার লেখার সঙ্গে তা মিলছে কিনা।
প্রত্যেকেই যেন একটু বিস্মিত হয়ে যে যার হাতের কাগজখানা চোখের সামনে মেলে ধরে পড়তে শুরু করে।
প্রশান্ত বসাক নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকেন।
খুব সংক্ষিপ্ত জবানবন্দি, পড়তে কারোরই বেশি সময় লাগে না!
পড়লেন? কারও জবানবন্দিতে কোন ভুল নেই তো? প্রত্যেকের দিকেই তাকিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে প্রশ্নটা করলেন প্রশান্ত বসাক।
না। প্রত্যেকেই জবাব দেয়।
বেশ। এবারে আপনারা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাগজের তলায় বাংলায় বেশ পরিষ্কার স্পষ্টাক্ষরে লিখুন। উপরিউক্ত জবানবন্দির মধ্যে কোন ভুল নেই এবং পরে তার নীচে আপনারা যে যার নাম দস্তখত করুন।
প্রথমটায় কয়েকটা মুহূর্ত প্রশান্ত বসাকের প্রস্তাবে কেউ কোন জবাব দেয় না। কেবল পরস্পর পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।
আমার বক্তব্যটা নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পেরেছেন?
জবাব দিল এবারে প্রথমে রজতই, বললে, হ্যাঁ। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি না মিঃ বসাক, এর কি প্রয়োজন ছিল?
সঙ্গে সঙ্গে প্রতুলবাবু জবাব দেন, তাই মিঃ বসাক। আমিও তাই বলতে চাইছিলাম। তাছাড়া আমি তো এখানে আদৌ উপস্থিতই ছিলাম না।
কিন্তু আমার প্রস্তাবে আপনাদের আপত্তি কি থাকতে পারে তাও তো বুঝতে পারছি না প্রতুলবাবু।
আমার ও আমাদের যার যা বলবার ছিল সবই খোলাখুলিভাবে আপনাদের কাছে বলেছি ইন্সপেক্টার। কথাটা বললে রজত।
অস্বীকার করছি না রজতবাবু সে কথা আমি। এবং পড়েই তো দেখলেন, আপনারা যে যেমন জবানবন্দি আমাদের কাছে দিয়েছেন সেইটুকুই কেবল ঐ কাগজে লিখেছি আমি। তবে আপনাদের আপত্তিটাই বা হচ্ছে কেন? অবিশ্যি you are at libertyযদি কিছু অন্যরকম লিখে থাকি সে জায়গাটা বরং কেটে ঠিক করে আপনারাই লিখে দিন।
প্রশান্তবাবু তো ঠিকই বলছেন রজতদা। দিন কলম, আমি লিখে সই করে দিচ্ছি। এতক্ষণে সর্বপ্রথম কথা বললে সুজাতা।
প্রশান্ত বসাক সুজাতার দিকে কলমটা এগিয়ে দিলেন।
সুজাতা কোনরূপ দ্বিধামাত্রও না করে জবানবন্দির নীচে নিজের নামটা সই করে কাগজটা এগিয়ে দিল প্রশান্ত বসাকের দিকে, এই নিন।
পুরন্দর চৌধুরী এবার কথা বললেন, আমি যদি ইংরাজিতে লিখি আপত্তি আছে আপনার মিঃ বসাক?
কেন বলুন তো?
দীর্ঘদিনের অনভ্যাসের ফলে বাংলা আমি বড় একটা আজকাল লিখতে পারি না। তাছাড়া আমার বাংলা হস্তাক্ষরও অত্যন্ত বিশ্রী।
প্রশান্ত বসাক মৃদু হেসে বললেন, তা হোক। বাংলাতেই লিখুন।
অগত্যা পুরন্দর চৌধুরী যেন বেশ একটু অনিচ্ছার সঙ্গেই প্রশান্ত বসাকের নির্দেশ মত কাগজটায় লিখে দিলেন।
এবং রজত ও প্রতুলবাবুও নাম সই করে দিলেন।
প্রত্যেকের লেখা ও সই করা কাগজগুলো অতঃপর আর না দেখেই আঁজ করে প্রশান্ত বসাক নিজের জামার বুকপকেটে রেখে দিলেন।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পূর্বে এ ঘরে চা-পানে বসবার সময় যে আবহাওয়াটা ছিল, প্রশান্ত বসাক প্রদত্ত কাগজে নাম সই করবার পর যেন হঠাৎ সেই আবহাওয়াটা কেমন থমথমে হয়ে গেল। অচিন্ত্যনীয় একটা পরিস্থিতি যেন হঠাৎ একটা ভারী পাথরের মতই সকলের মনের মধ্যে চেপে বসে। কেউ কোন কথা মুখ ফুটে স্পষ্টাস্পষ্টি বলতে পারছে না, অথচ মনের গুমোট ভাবটাও যেন আর গোপন থাকছে না কারো।
বেশ কিছুক্ষণ ঘরের আবহাওয়াটা যেন একটা বিশ্রী অস্বস্তিতে থমথম করতে থাকে।
সকলেই চুপচাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই।
ঘরের অস্বস্তিকর আবহাওয়া যেন প্রত্যেকেরই কেমন শ্বাস রোধ করে আনে। হঠাৎ সেই স্তব্ধতার মধ্যে কথা বলে ওঠেন পুরন্দর চৌধুরী, আপনার যদি আপত্তি না থাকে তো আমি কালই চলে যেতে চাই মিঃ বসাক।
বেশ। যাবেন। তবে কলকাতায় যেখানেই থাকুন ঠিকানাটা দিয়ে যাবেন যাবার আগে।
কিন্তু কলকাতায় তো আমি থাকব না মিঃ বসাক। প্লেন পেলে কালই আমি সিঙ্গাপুরে চলে যাব।
সিঙ্গাপুরে আপনি হেড কোয়ার্টারের পারমিশন ছাড়া যেতে পারবেন না মিঃ চৌধুরী।
কিন্তু সে পারমিশনের জন্য সব কাজকর্ম ফেলে এখনো যদি অনির্দিষ্ট কালের জন্য আমাকে কলকাতায় বসে থাকতে হয়—
পুরন্দর চৌধুরীর কথাটা শেষ হল না। প্রশান্ত বসাক বললেন, না, আর বড়জোর চার-পাঁচদিনের বেশী আপনাকে আটকে রাখা হবে না মিঃ চৌধুরী।
চার-পাঁচদিনের মধ্যেই তাহলে আপনাদের তদন্তের কাজ শেষ হয়ে যাবে বলতে চান মিঃ বসাক? পুরন্দর চৌধুরী প্রশ্ন করলেন।
সেই রকমই তো আশা করা যাচ্ছে। আর শেষ না হলেও আপনাদের কাউকেই আটকে রাখা হবে না।
ভাল।
কথাটা বলে সহসা পুরন্দর চৌধুরী চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।
রজত প্রতুলবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রতুলবাবু, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল, আপনি একবার নীচে আসবেন কি?
চলুন।
প্রতুলবাবু ও রজতবাবু ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
ঘরের মধ্যে কেবল রইলেন প্রশান্ত বসাক ও সুজাতা। টেবিলের দুধারে দুজনে পরস্পরের মুখখামুখি বসে।
হঠাৎ প্রশান্ত বসাকের কণ্ঠস্বরে যেন চমকে মুখ তুলে তাকাল সুজাতা তাঁর দিকে।
একটা কথা বলছিলাম সুজাতাদেবী।
আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ।
বলুন।
যদি কিছু মনে না করেন তো কথাটা বলি। প্রশান্ত বসাক যেন ইতস্তত করেন।
বলুন না।
আপনি আজই কলকাতাতেই চলে যান বরং—
কেন বলুন তো? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল সুজাতা প্রশ্নটা করে প্রশান্ত বসাকের মুখের দিকে।
তাছাড়া প্রথমে আপনি তো যেতেও চাইছিলেন।
কিন্তু তখন তো আপনিই যেতে দিতে চাননি।
না চাইনি। কিন্তু এখন নিজে থেকেই আপনাকে চলে যাবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি মিস রয়।
মৃদু স্মিতকণ্ঠে সুজাতা বলে, কেন বলুন তো?
নাই বা শুনলেন এখন কারণটা।
বেশ। তবে আজ নয়, কাল সকালেই চলে যাব।
কাল?
হ্যাঁ।
কি ভেবে প্রশান্ত বসাক বললেন, বেশ, তাই যাবেন।
তারপর আরো কিছুক্ষণ বসে দুজনে কথা বলেন।
.
৩৫.
ঐদিন রাত্রে।
কিরীটী ফোনে যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিল, চব্বিশ ঘণ্টাও উত্তীর্ণ হল না, তা সত্যি হয়ে গেল।
সে রাত্রে সকলের খাওয়াদাওয়া করতে প্রায় এগারোটা হয়ে গেল। এবং খাওয়াদাওয়ার পর রাত সোয়া এগারোটা নাগাদ যে যার নির্দিষ্ট ঘরে শুতে গেল।
প্রশান্ত বসাক তাঁর নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে ঘরের দরজার ভিতর থেকে খিল তুলে দিয়ে বাগানের দিককার খোলা জানলাটার সামনে দাঁড়িয়ে নিশব্দে ধূমপান করছিলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে।
কিন্তু দুটি শ্রবণেন্দ্রিয়ই তাঁর সজাগ হয়ে ছিল একটি সাঙ্কেতিক শব্দের প্রত্যাশায়।
ঠিক আধঘণ্টা পরে তাঁর ঘর ও পাশের ঘরের মধ্যবর্তী দরজার গায়ে টুক টুক করে দুটি মৃদু টোকা পড়ল।
মুহূর্তে এগিয়ে গিয়ে দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা খুলে দিতেই অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মত একজন নিঃশব্দে এসে ঘরে প্রবেশ করল।
এসেছেন। মৃদু কণ্ঠে শুধালেন প্রশান্ত বসাক।
হ্যাঁ।
আপনার ঘর থেকে যখন বের হন কেউ আপনাকে দেখেনি তো? দেখেনি তো কেউ আপনাকে ল্যাবরেটারী ঘরে ঢুকতে?
না।
তাহলে এবারে আপনি নিশ্চিন্তে গিয়ে ঐ বিছানাটার ওপরে শুয়ে পড়ুন।
শুয়ে পড়ব?
হ্যাঁ। শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোন।
প্রশ্নোত্তর পাওয়া যায় না।
কি হল?
কিন্তু—
কিন্তু কি?
আপনি—
আমি! আজ রাত্রে আমার ঘুমের আশা আর কোথায়!
কেন?
একজন সম্ভবত আসবেন, তাঁকে রিসিভ করতে হবে।
এত রাত্রে আবার কে আসবেন।
কে আসবেন তা জানি না, তবে আশা করছি একজনকে। অবিশ্যি ভাবছি হয়তো নাও আসতে পারেন আজ।
তবে মিথ্যে মিথ্যে জেগে থাকবেন কেন? আসবার যখন তাঁর কোন স্থিরতা নেই।
তাই তো জেগে থাকতে হবে। মহৎ ব্যক্তিবিশেষ আসছেন, অভ্যর্থনার জন্য না জেগে বসে থাকলে চলবেই বা কেন!
তা রেবতী বা দারোয়ানকে বলে রাখলেই তো পারতেন, তিনি এলে তখন আপনাকে খবর দিত।
মৃদু হাসির সঙ্গে প্রশান্ত বসাক বলেন, সোজা রাস্তা দিয়ে জনান্তিকে তিনি আসবেন না বলেই তো এত হাঙ্গামা।
কি আপনি বলছেন!
ঠিক তাই সুজাতাদেবী। তাইতো আপনাকে পূর্বাহ্নেই এ ঘরে এসেশোবার জন্য বলেছিলাম।
কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর আসবার কি সম্পর্ক?
সেইজন্যই তো এত সাবধানতা, এত সব আয়োজন। বিশেষ করে আপনি জানেন না, কিন্তু তিনি আপনারই জন্য আসবেন আমার ধারণা।
এ সব কি আপনি বলছেন বলুন তো প্রশান্তবাবু?
ভাবছেন হয়তো এই মাঝরাতে আপনাকে এ ঘরে ডেকে এনে আরব্য উপন্যাস শোনাতে শুরু করলাম, তাই না সুজাতাদেবী? বলতে বলতে আচমকা যেন কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, কিন্তু আর না, এবারে আপনি শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করুন, আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে—
বাইরে এত রাত্রে।
হ্যাঁ, বেশী দূরে নয়, আপনার আজ রাত্রের পরিত্যক্ত শূন্য ঘরে। নিন, আপনি শুয়ে পড়ুন তো।
আমি আপনার সঙ্গে যাব।
কোথায়?
কেন, আমার ঘরে। এখন বুঝতে পারছি, আমার ঘরে আজ রাত্রে কিছু ঘটবে। আপনি জানেন, আর সেইজন্যই আমার বিছানার ওপরে পাশবালিশটা চাদর দিয়ে ঢেকে রেখে আমাকে এ ঘরে চলে আসতে বলেছিলেন।
হ্যাঁ, তাই সুজাতাদেবী। কিন্তু আপনি—আপনি জানেন না বা বুঝতে পারছেন না হয়তো সেখানে যাওয়া আপনার এখন খুব বিপজ্জনক, risky!
তা হোক, তবু আপনার সঙ্গে আমি যাব।
কিন্তু সুজাতাদেবী—
বললাম তো। যাব। সুজাতার কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা।
কিন্তু আপনি! আপনি আমার সঙ্গে না গেলেই হয়তো ভাল করতেন সুজাতাদেবী।
ভাল-মন্দ বুঝি না। আমি যাব।
কয়েক মুহূর্ত প্রশান্ত বসাক কি যেন ভাবলেন, তারপর মৃদু নিস্পৃহ কণ্ঠে বললেন, বেশ, তবে চলুন।
প্রথমে প্রশান্ত বসাক দরজা খুলে বাইরের অন্ধকার বারান্দায় একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিলেন বারান্দার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত, শূন্য খাঁ খাঁ করছে।
পা টিপে টিপে প্রথমে প্রশান্ত বসাক তারপর বের হলেন ঘর থেকে এবং তাঁর পশ্চাতে অনুসরণ করল তাঁকে সুজাতা। এদিকে ওদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে দুজনে সুজাতার ঘরের দিকে এগিয়ে চললেন।
ঘরের দরজাটা সুজাতা খুলেই রেখে এসেছিলেন। কেবলমাত্র দরজার কবাট দুটো ভেজানো ছিল প্রশান্ত বসাকের পূর্ব-নির্দেশ মত।
ভেজানো দরজার গায়ে কান পেতে কি যেন শোনবার চেষ্টা করলেন মিঃ বসাক; তারপর ধীরে ধীরে নিঃশব্দে ভেজানো কবাট দুটি ফাঁক করে প্রথমে ঘরের মধ্যে নিজে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর পশ্চাতে প্রবেশ করে সুজাতা। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
প্রথমটায় অন্ধকারে কিছুই বোঝা যায় না। ক্রমে একটু একটু করে ঘরের অন্ধকারটা যেন উভয়ের চোখেই সয়ে আসে।
বাগানের দিককার খোলা জানলা বরাবর খাটের উপরে বিস্তৃত শয্যায় অস্পষ্ট মনে হয় কে যেন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
গায়ে হাত দিয়ে স্পর্শের ইঙ্গিতে মিঃ বসাক সুজাতাকে নিয়ে গিয়ে ঘরের সংলগ্ন যে বাথরুম তার মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলেন।
চাপা সতর্ক কণ্ঠে সুজাতা প্রশ্ন করে, বাথরুমের মধ্যে এলেন কেন?
চুপ। এখানেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
বাথরুমের মধ্যে প্রবেশ করে বাথরুমের ঈষদুন্মুক্ত দরজাপথে তীক্ষ্ণ সতর্ক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন ঘরের ভিতরে প্রশান্ত বসাক।
সময় যেন আর কাটতে চায় না। ভারী পাথরের মত যেন সমস্ত অনুভূতির উপরে চেপে বসেছে সময়ের মুহূর্তগুলো। যেন অত্যন্ত শ্লথ ও প্রলম্বিত মুহূর্তগুলি মনে হয়।
তবু এক সময় মিনিটে মিনিটে প্রায় তিন কোয়াটার সময় অতিবাহিত হয়ে যায়।
সুজাতার পা দুটো যেন টনটন করছে।
রেডিয়াম ডায়েলযুক্ত দামী হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রশান্ত বসাক দেখলেন, রাত প্রায় পৌনে একটা। নাঃ! আজ রাতে বোধ হয় এল না।
কিন্তু মিঃ বসাকের চাপা কণ্ঠে উচ্চারিত কথাটা শেষ হল না। ইতিমধ্যে আকাশে বোধ হয় চাঁদ দেখা দিয়েছিল, সামান্য চাঁদের আলো বাগানের দিককার ভোলা জানলাপথে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছিল।
খুট করে একটা যেন অস্পষ্ট শব্দ শোনা গেল। এবং তারপরই প্রশান্ত বসাক দেখলেন কে একজন জানলাপথে মাথা তুলে ঘরের ভিতর উঁকি দিচ্ছে।
এসেছে। অনুমান তাহলে তাঁর মিথ্যা হয়নি।
অস্বাভাবিক একটা উত্তেজনার ঢেউ যেন মুহূর্তে মিঃ বসাকের সমস্ত ইন্দ্রিয় ও অনুভূতির উপর দিয়ে বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মতই প্রবাহিত হয়ে যায়।
জানলাপথে ওদিকে ততক্ষণে মাথার সঙ্গে সঙ্গে দেহের ঊর্ধ্বাংশও স্পষ্ট হয়ে ওঠে মিঃ বসাকের চোখের সামনে। জানলাপথেই ছায়ামূর্তি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে শয্যার দিকে। শয্যার একেবারে কাছটিতে দাঁড়াল।
হঠাৎ চমকে উঠলেন মিঃ বসাক।
খোলা জানলায় আর একখানি মুখ দেখা গেল। এবং বিড়ালের মতই নিঃশব্দে দ্বিতীয় ছায়ামূর্তিও ঘরে প্রবেশ করল প্রায় প্রথম ছায়ামূর্তির পিছনে পিছনেই।
কিন্তু যত নিঃশব্দেই দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি ঘরে প্রবেশ করুক না কেন, প্রথম ছায়ামূর্তি বোধ। হয় সেই ক্ষীণতম শব্দটুকুও শুনতে পেয়েছিল।
চকিতে প্রথম ছায়ামূর্তিও ঘুরে দাঁড়াল।
প্রথম ছায়ামূৰ্তি ঘুরে দাঁড়াবার আগেই দ্বিতীয় ছায়মূর্তি হাত বাড়িয়ে দেওয়ালের গায়ে আলোর সুইচটা টিপে দিয়েছিল। খুট করে একটা শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের বৈদ্যুতিক আলোটা জ্বলে ওঠে।
হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে সমস্ত কক্ষটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
ঠিক সেই মুহূর্তে বাথরুমের দরজাটা খুলে ঘরের মধ্যে পা দিয়েই বজ্রকঠিন কণ্ঠে মিঃ বসাক বলে উঠলেন, মিঃ চৌধুরী!
ঘরের মধ্যে যেন অকস্মাৎ বজ্রপাত হল।
বিদ্যুৎ-চমকের মতই যুগপৎ দুই ছায়ামূর্তিই ঘুরে দাঁড়ায়।
কৌতূহলী সুজাতাও ইতিমধ্যে প্রায় মিঃ বসাকের সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। সে দেখল মিঃ বসাকের উদ্যত পিস্তলের সামনে সামান্য দূরের ব্যবধানে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে পুরন্দর চৌধুরী ও সুন্দরলাল। উভয়ের চোখেই হতভম্ব বোবা দৃষ্টি।
উদ্যত পিস্তল হাতে ওঁদের প্রতি দৃষ্টি রেখেই সুজাতাকে সম্বোধন করে মিঃ বসাক বললেন, সুজাতাদেবী, নীচে রামানন্দবাবু অপেক্ষা করছেন, তাঁকে ডেকে আনুন।
৩৬-৪২. থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন
থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন ঘরে এসে প্রবেশ করতেই মিঃ বসাক তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, এঁদের গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করুন মিঃ সেন, এঁরাই বিনয়েন্দ্র রায় ও রামচরণের যুগ্ম হত্যাকারী।
রামানন্দ সেন বারেকের জন্য তাঁর সম্মুখে তখনো প্রস্তরমূর্তিবং দণ্ডায়মান পুরন্দর চৌধুরী ও সুন্দরলালের দিকে তাকিয়ে বললেন, এঁদের মধ্যে একজনকে তো চিনতে পারছি মিঃ বসাক কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তিটিকে তো ঠিক এখনও চিনতে পারছি না। দ্বিতীয় ঐ মহাশয় ব্যক্তিটি কে?
মৃদু হাসলেন মিঃ বসাক রামানন্দ সেনের কথায়। তারপর স্মিতকৌতুকভরা কণ্ঠে বললেন, ভদ্রমহাশয় ব্যক্তি অর্থাৎ পুরুষ উনি নন, উনি ভদ্রমহিলা,মিঃ সেন।
পুরুষ নন, মহিলা! বিস্মিত কণ্ঠ হতে উচ্চারিত হয় কথাটা রামানন্দ সেনের। এবং শুধু রামানন্দ সেনই নন। ঘরের মধ্যে ঐ সময় উপস্থিত সুজাতা মিঃ বসাকের কথায় কম বিস্মিত হয় না।
সে বলে ওঠে, কি বলছেন প্রশান্তবাবু!
ঠিকই বলেছি আমি মিস রয়। ওষ্ঠের উপরে চিকন ঐ গোঁফটি আসল নয়, মেকী, মাথার শিরস্ত্রাণ ঐ রেশমী পাগড়ি ওটিও আংশিক ছদ্মবেশ মাত্র। ওর নীচে রয়েছে বেণীবদ্ধ কেশ। চশমার কালো কাঁচের অন্তরালে রয়েছে নারীর দুটি চক্ষু।
কথাগুলো বলতে বলতেই ঘুরে দাঁড়ালেন মিঃ বসাক সুন্দরলালের দিকে এবং বললেন, উনি শ্রীমতী লতাদেবী।
আবার রামানন্দ সেন ও সুজাতা দুজনেই যুগপৎ চমকে মিঃ বসাকের দিকে তাকান।
কী বললেন? লতাদেবী!
কিন্তু যাকে সম্বোধন করে কথাগুলো মিঃ বসাক ক্ষণপূর্বে বললেন তিনি কিন্তু নির্বাক। পাষাণপুত্তলিকাবৎ নিশ্চল।
মিঃ বসাক পুনরায় বলে উঠলেন, এত তাড়াতাড়ি অবিশ্যি প্রথম দিনের দর্শনেই আপনার চেহারায়, কণ্ঠস্বরে ও হাতের আঙুলে আমার সন্দেহ হলেও আপনি যে সত্যি সত্যিই পুরুষ নন নারী এই স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারতাম না। যদি না আজই দ্বিপ্রহরের কিরীটীর সংকেত আপনার প্রতি আমাকে বিশেষভাবেই সজাগ করে দিত। তা সত্ত্বেও আমি বলব মিস সিং, আপনার ছদ্মবেশধারণ অপূর্ব নিখুঁত হয়েছিল।
একেবারে সামনাসামনি ও খোলাখুলিভাবে চ্যালেঞ্জড্ হলেও ছদ্মবেশী লতাদেবী পাষাণপুত্তলিকার মতই এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ যেন পরমুহূর্তেই পাথরের মত দণ্ডায়মান লতাদেবীকে তাঁর প্যান্টের পকেটে ডান হাতটা প্রবেশ করতে উদ্যত দেখেই চকিতে পিস্তল সমেত নিজের হাতটা উদ্যত করে মিঃ বসাক কঠিন কঠে বলে উঠলেন, No–No-সে চান্স আপনাকে আমি দেব না মিস সিং, প্যান্টের পকেট থেকে হাত সরান। সরান—Yes-হ্যাঁ, এতদিন ধরে এমন নৃশংস খেলা খেললেন, তারপরেও শেষটায় আপনারাই জিতে আমাদের মাত করে দিয়ে যাবেন, তাই কি হয়! বলতে বলতে মিঃ রামানন্দ সেনের দিকে তাকিয়ে মিঃ বসাক এবারে বললেন, মিঃ সেন, শ্রীমতী সিংয়ের বডিটা সার্চ করুন। চৌধুরী সাহেবকেও বাদ দেবেন না যেন।
দ্বিধামাত্র না করে রামানন্দ সেন ইন্সপেক্টারের নির্দেশমত এগিয়ে গেলেন, এবং লতা সিংয়ের বডি সার্চ করতেই তাঁর প্যান্টের পকেট থেকে বের হয়ে এল একটি মোটা কলমের মত বস্তু এবং শুধু তাই নয়, ছোট অটোমেটিক পিস্তলও একটি পাওয়া গেল।
আর পুরন্দর চৌধুরীর বডি সার্চ করে পাওয়া গেল একটি চমৎকারভাবে কাপড়ে মোড়া এক হাত পরিমাণ কালো প্লাস্টিকের তৈরী রড ও একটি অটোমেটিক পিস্তল।
প্লাস্টিকের রডটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখছিলেন রামানন্দ। হঠাৎ সেদিকে নজর পড়ায় মিঃ বসাক বলে উঠলেন, সাবধান মিঃ সেন, ওটা যা ভাবছেন বোধ হয় তা নয়, নিছক একটি প্লাস্টিকের তৈরী রড নয়। আর আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তো খুব সম্ভবত ওটা একটা প্ৰেয়িং অ্যাপারেটা। এবং ওর ভিতরে আছে তীব্র কালকূট,মেক ভেন।
কী বলছেন আপনি মিঃ বসাক!
ঠিকই বলছি বোধ হয়। দিন তো বস্তুটি আমার হাতে।
এগিয়ে দিলেন রামানন্দ সেন বস্তুটি ইন্সপেক্টারের হাতে। বসাক প্লাস্টিকের রডটি একটু পরীক্ষা করতেই দেখতে পেলেন, তার একদিকে রয়েছে কলমের ক্যাপের মত একটি ক্যাপ। এবং সেই ক্যাপটি খুলতেই দেখা গেল তার মাথার দিকটা যেমন সরু হয়ে আসে তেমনি তারও মাথার দিকটা ক্রমশ সরু হয়ে এসেছে। এবং সেই সরু অগ্রভাগে বিন্দু পরিমাণ একটি ছিদ্র। আরও ভাল করে পরীক্ষা করতে দেখা গেল রডটির অন্যদিকে একটি ক্ষুদ্র স্প্রিংও আছে। সেই স্পিংটা টিপতেই পিচকারীর মত কি খানিকটা গাঢ় তরল পদার্থ ছিটকে বের হয়ে এল।
প্রশান্ত বসাক এবারে বললেন, হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। দেখলেন তে। এখন বোধ হয় বুঝতে পারছেন এই বিশেষ যন্ত্রটির সাহায্যেই হতভাগ্য বিনয়েন্দ্রবাবুকে সেই রাত্রে এবং পরশু রাত্রে হতভাগ্য রামচরণকে হত্যা করা হয়।
উঃ, কি সাংঘাতিক! রামানন্দ সেন বলেন আত্মগতভাবে।
হ্যাঁ, সাংঘাতিকই বটে। এবং অবিশ্বাস্য ব্যাপারও বটে। প্রশান্ত বসাক আবার বললেন। তারপর একটু থেমে আবার শুরু করলেন, যে বিজ্ঞান মানুষের সমাজজীবনে এনেছে প্রভূত কল্যাণ, যে বিজ্ঞানবুদ্ধি ও আবিষ্কার যুগে যুগে সমাজ-জীবনের পথকে নব নব সাফল্যের দিকে এগিয়ে দিয়েছে, সেই বিজ্ঞান-প্রতিভাই বিকৃত পথ ধরেই এনেছে অমঙ্গল—সর্বনাশা ধ্বংস। লতাদেবী ও মিঃ চৌধুরী দুজনেই অপূর্ব বৈজ্ঞানিক প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু বিকৃত বুদ্ধিতে আচ্ছন্ন হয়ে ওঁদের উভয়ের মিলিত প্রতিভা মঙ্গল ও সুন্দরের পথকে খুঁজে পেলেন না। ফলে ওঁরা নিজেরাও ব্যর্থ হলেন, ওঁদের প্রতিভাও ব্যর্থ হল।
.
ওদিকে রাত প্রায় ভোর হয়ে এসেছিল।
ঘরের জানলাপথে প্রথম আলোর আবছা আভাস এসে উঁকি দেয়।
লতা ও পুরন্দর চৌধুরীকে আপাততঃ আলাদা আলাদা করে দুজনকেই পুলিসের হেপাজতে রেখে সকলে নীচের ঘরে নেমে এলেন।
সংবাদ পেয়ে রজতও এসে ওঁদের সঙ্গে যোগ দিল।
প্রশান্ত বসাকের নির্দেশমত ড্রাইভার করালীকেও পূর্বাহ্নেই অ্যারেস্ট করা হয়েছিল।
সুজাতা, রজত ও রামানন্দ সেন সকলেই উদগ্রীব সমগ্র রহস্যটা জানবার জন্য। কী ভাবে বিনয়েন্দ্র ও রামচরণ নিহত হল, আর কেনই বা হল।
মিঃ বসাক বলতে লাগলেন তখন সেই কাহিনী।
.
৩৭.
কিরীটী আমাকে সব শুনে বলেছিল এই হত্যা-রহস্যের মধ্যে কোন একটি নারী আছে। কিরীটীর কথা শুনে সমগ্র ঘটনা পুনর্বার আমি আদ্যপান্ত মনে মনে বিশ্লেষণ করি। এবং তখনই আমার মনে পড়ে বিনয়েন্দ্র নিহত হবার কিছুদিন পুর্বেই এই নীলকুঠিতে এক রহস্যময়ী নারীর আবির্ভাব ঘটেছিল। এবং যে নারী অকস্মাৎ যেমন এখানে এসে একদিন উদয় হয়েছিল তেমনি অকস্মাৎ আবার একদিন দৃষ্টির অন্তরালে আত্মগোপন পরে। রামচরণের মুখেই আমি জানতে পারি যে, তার নাম লতা। বলাই বাহুল্য, আমার মন তখন সেই অন্তরালবর্তিনী লতার প্রতিই আকৃষ্ট হয়। এখন অবিশি স্পষ্টই বুঝতে পারছি, সুন্দরলালের ছদ্মবেশের অন্তরালেই ছিল সেই লতা এবং সেই সঙ্গে এও বুঝতে পারছি, ওই লতা বিনয়েন্দ্র ও পুরন্দর চৌধুরী উভয়েরই যথেষ্ট পরিচিত ছিল; যেহেতু প্রথমতঃ ল্যাবরেটারী অ্যাসিস্টেন্টরূপে সমস্ত প্রার্থীর মধ্যে লতাকেই যখন বিনয়েন্দ্র মনোনীত করেছিলেন তখন তার প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব প্রমাণ হয়েছে ও সেই সঙ্গে প্রমাণ হয়েছে লতা তাঁর মনের অনেকখানিই অধিকার করেছিল। তার আরো প্রমাণলতানামটি আমি বিনয়েন্দ্ররনোটবুকেরবহু পাতাতেই পেয়েছি। এখন কথা হচ্ছে লতা বিনয়েন্দ্র ও পুরন্দর চৌধুরী এই ট্রায়োর পরিচয় পরস্পরের সঙ্গে কতদিন ধরে। গোলমালটা অবিশ্যি গড়ে উঠেছে দুটি পুরুষ বন্ধুর মধ্যে এ মধ্যবর্তিনী নারীকেই কেন্দ্র করে। কিন্তু হত্যার কারণটা কি একমাত্র তাই, না আরো কিছু? এই তথ্যটি অবিশ্যি এখন আমাকে আবিষ্কার করতে হবে। তবে বিনয়েন্দ্র রামচরণকে হত্যা করা হয়েছিল কি ভাবে সেটা এখন আমি স্পষ্টই অনুমান করতে পারছি। এবং সে অনুমানের পরেই আমার মনে হচ্ছে সে রাত্রে যখন বিয়ে তাঁর গবেষণাগারে নিজের কাজে ব্যস্ত তখন হয়তো লতা এসে দরজায় টোকা দেয়। দরজা খুলে লতাকে দেখতে পেয়ে অত রাত্রে নিশ্চয়ই প্রথমটায় বিনয়েন্দ্র বিস্মিত হন। এবং খুব সম্ভব লতার সঙ্গে যখন বিনয়েন্দ্র কথা বলছেন সেই সময় তাঁর অলক্ষ্যে এক ফাঁকে ঘরে প্রবেশ করে পশ্চাৎ দিক হতে এসে অতর্কিতে কোন কিছু ভারী বস্তুর সাহায্যে পুরন্দর চৌধুরী বিনয়েন্দ্রকে তাঁর ঘাড়ে আঘাত করেন। যার ফলে বিনয়েন্দ্র পড়ে যান ও পড়ে যাবার সময় ধাক্কা লেগে বা কোন কারণে টেবিল থেকে আরও দু-একটা কাঁচের যন্ত্রপাতির সঙ্গে বোধ হয় ঘড়িটা মাটিতে ছিটকে পড়ে ভেঙে যায়। কিন্তু এর মধ্যেও কথা আছে, ঐ ভাবে মাথায় বা ঘাড়ে অতর্কিতে একটা আঘাত হেনেইতো হতঅগ্য বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করা যেত। তবে কেন আবার ভয়ঙ্কর মৃত্যুগরল সর্পবিষ প্রয়োগ করা হল তার শরীরে? আর একাকী পুরন্দর চৌধুরীই তো তার বন্ধুকে হত্যা করতে পারত; তবে লতার সহযোগিতার প্রয়োজন হল কেন? মনে হয় আমার, প্রথমতঃ তার কারণ ব্যাপারটাকে আত্মহত্যার রূপ দেবার জন্যই ঐ ভাবে পিছন থেকে অতর্কিতে বিনয়েন্দ্রকে আঘাত হেনে প্রথমে কাবু করা হয়েছিল এবং এমন ভাবে সেই ভারী বস্তুটি কাপড় মুড়ে নেওয়া হয়েছিল যাতে করে সেই ভারী বস্তুটির আঘাতটা তার কাজ করবে, কিন্তু চিহ্ন রাখবে না দেহে। দ্বিতীয়তঃ, আঘাত হেনে অজ্ঞান করে দিতে পারলে পরে বিষ প্রয়োগকরবার সুবিধা হবে। এবং লতারসহযোগিতার প্রয়োজনও হয়েছিল; আমার মনে হয়, এই জন্যই অন্যথায় এত রাত্রে বিনয়েন্দ্রর গবেষণা-ঘরে পুরন্দর চৌধুরীর প্রবেশ সম্ভবপর ছিল না একা একা। এবং কোনমতে পুরন্দর চৌধুরী একা প্রবেশ করলেও হঠাৎ অমন করে পশ্চাৎ দিক থেকে আঘাত করবার সুযোগও পেত না, যেটা সহজ হয়ে গিয়েছিল উভয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় ও সহযোগিতায়। এবং লতাকে প্রথমে ঘরে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে বিনয়েন্দ্রকে কথাবার্তার মধ্যে অন্যমনস্ক রেখে সেই ফাঁকে একসময় পশ্চাৎ দিক হতে গিয়ে পরম নিশ্চিন্তে বিনয়েন্দ্রকে আঘাত করা পুরন্দর চৌধুরীর পক্ষে ঢের বেশী সহজসাধ্য ছিল। যা হোক, আমার অনুমান ঐ ভাবেই বিয়েকে অজ্ঞান করে পরে সাক্ষাৎ মারণ-অস্ত্র ঐ বিশেষ অ্যাপারেটাটির সাহায্যেই মুখের মধ্যে সর্প-বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়। ঐ বস্তুটি জোর করে মুখে প্রবেশ করাবার চিহ্নও ছিল ওষ্ঠে, যা থেকে মৃতদেহ পরীক্ষা করেই মনে আমার সন্দেহ জাগায়। এবং পরে সমগ্র ব্যাপারটাকে হত্যা নয়, আত্মহত্যা এই রূপ দিয়ে হত্যাকারী আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে। তারপর পরে মৃতদেহের পাশে একটা বিকারে কিছু সৰ্প-বিষ রেখে দেয় আত্মহত্যার প্রমাণস্বরূপ।
কিন্তু কথা হচ্ছে ঐ ভাবে বিশেষ অ্যাপারেটাসের সাহায্যে দেহের মধ্যে বিষ প্রয়োগ না করে সাধারণভাবেও তো গলায় বিষ ঢেলে কাজ শেষ করা যেতে পারত। তার জবাবে আমার মনে হয়, অজ্ঞান অবস্থায় বিষ গলায় ঢেলে দিলেও যদি তার খুব বেশি অংশ পেটের মধ্যে না যায় তো কাজ হবে না, অথচ অজ্ঞান অবস্থায় খুব বেশি বিষও ভিতরে প্রবেশ করানো কষ্টসাধ্য হবে। এবং সম্ভবতঃ সেইটাই ছিল কারণ। দ্বিতীয় কারণ, এমন অভিনব একটা পথ নেওয়া হয়েছিল যাতে করে কারো মনে কোনরূপ সন্দেহই না জাগে। এখন কথা হচ্ছে, বিশেষ করে সর্প-বিষই কেন হত্যাকারী বেছে নিয়েছিল বিয়েকে হত্যা করবার যন্ত্রস্বরূপ? তার উত্তরে বলব, বিনয়েন্দ্র সর্প-বিষের নেশায় অভ্যস্ত ছিল। যাতে তার দেহে বিষ পেলেও পুরন্দরের কাহিনী শুনে লোকে মনে করত, হয় বিনয়েন্দ্র আত্মহত্যা করেছে না হয় বেশি খেয়ে সর্প-বিষে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। আর যে বিষে সে অভ্যস্ত ছিল সে বিষ দিয়ে হত্যা করতে হয়েছিল বলেই বেশি পরিমাণ বিষের প্রয়োজন হয়েছিল।
কিন্তু যা বলছিলাম, পুরন্দর চৌধুরী ও লতা দুই বিজ্ঞানীর মিলিত হত্যা-প্রচেষ্টা অভিনব সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের সকলের দৃষ্টির বাইরে ত্রিকালদশী একজন, যিনি সর্বদা দুটি চক্ষু মেলে সদা জাগ্রত, সদা সচেতন, যাঁর বিচার ও দণ্ড বড় সূক্ষ, তাঁকে যে আজ পর্যন্ত কেউ এড়াতে পারেনিদগবী মানুষ তা ভুলে যায়। আজ পর্যন্ত কোন পাপ, কোন দুষ্কৃতিই যে চিরদিনের জন্য ঢাকা থাকে না আমরা তা বুঝতে চাই না বলেই না পদে পদে আমরা পর্যদুস্ত, লাঞ্ছিত, অপমানিত হই।
.
৩৮.
পুরন্দর চৌধুরী, লতা ও করালীকে রামানন্দ সেনই পুলিস-ভ্যানে করে নিয়ে গেলেন যাবার সময়।
অভিশপ্ত নীলকুঠি!
সন্ধ্যার দিকে ঐ নীলকুঠির ঘরে ঘরে ও সদর দরজায় তালা পড়ে গেল।
রজত কলকাতায় চলে গেল।
আর সুজাতা গেল তার দূর সম্পর্কীয় এক মাসীর বাড়িতে বরাহনগর। ছুটির এখনো দশটা দিন বাকি আছে, সুজাতা সে দশটা দিন মাসীর ওখানেই থাকবে স্থির করল।
দিন পাঁচেক বাদে বিকেলের দিকে প্রশান্ত বসাক কী একটা কাজে দক্ষিণেশ্বর গিয়েছিলেন, ফেরবার পথে কি মনে করে সুজাতার মাসীর বাড়ির দরজায় এসে গাড়িটা থামালেন।
সুজাতা বাসাতেই ছিল, সংবাদ পেয়ে বাইরে এল।
আপনি!
হ্যাঁ, হঠাৎ এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, তাই ভাবলাম যাবার পথে আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।
বসুন। দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? সুজাতা বলে।
খালি একটা চেয়ারে বসতে বসতে প্রশান্ত বসাক বললেন, লক্ষ্ণৌ ফিরে যাচ্ছেন কবে?
আরও দিন দশেকের ছুটি নিয়েছি।
তাহলে এখন এখানেই থাকবেন বলুন?
তাই তো ভাবছি।
এবং শুধু ঐ দিনই নয় তার পরের সপ্তাহে আরও চার-পাঁচবার দুজনে দেখা হল।
হঠাৎ তার পর থেকে ঘন ঘন কাজ পড়ে যায় যেন ঐ দিকে প্রশান্ত বসাকের এবং ফেরবার পথেই দেখাটা করেন তিনি সুজাতার সঙ্গে। কারণ সুজাতার কথা তাঁর মনে পড়ে প্রত্যেকবারেই।
অবশ্য সেটা খুবই স্বাভাবিক।
সেদিন দ্বিপ্রহরে রামানন্দ সেনের সঙ্গে হেডকোয়ার্টারের নিজস্ব অফিসরুমে বসে প্রশান্ত বসাক নীলকুঠির হত্যাব্যাপার নিয়েই আবার আলোচনা করছিলেন।
পুরন্দর চৌধুরী বা লতা এখনও তাদের কোন জবানবন্দি দেয়নি।
তদন্ত চলছে, পুরোপুরি সেটাও এখনও তৈরী করা যায়নি।
রামানন্দ সেন বলছিলেন, কিন্তু আপনি ওদের সন্দেহ করলেন কি করে ইন্সপেক্টার?
ব্যাপারটা যে আত্মহত্যা নয়, হত্যা-নিষ্ঠুর হত্যা, সে আমি অকুস্থানে অর্থাৎ ল্যাবরেটারী ঘরে প্রবেশ করে, মৃতদেহটা পরীক্ষা করে ও অন্যান্য সব কিছু দেখেই বুঝেছিলাম মিঃ সেন, আর তাতেই সন্দেহটা আমার ওদের উপরে ঘনীভূত হয়।
কি রকম?
প্রথমতঃ মৃতদেহের position, সে সম্পর্কে পূর্বেই আমি আলোচনা করেছি আপনাদের সঙ্গে। দ্বিতীয়তঃ, মৃতদেহ ও তার ময়নাতদন্তের রিপোের্টও তাই প্রমাণ করেছে। তৃতীয়তঃ, বিনয়েন্দ্রর নিত্যব্যবহার্য অপহৃত রবারের চপ্পলজোড়া। সেটা কোথায় গেল? আপনাদের বলিনি সেটা রক্তমাখা অবস্থায় পাওয়া যায় নীলকুঠির বাঁ পাশের পোড়ো বাড়ির মধ্যে। খুব সম্ভব অতর্কিতে ঘাড়ে আঘাত পেয়ে বিনয়েন্দ্র যখন মেঝেতে পড়ে যান তখন টেবিলের উপর থেকে ঘড়িটার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কাঁচের অ্যাপারেটাও মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়; যে ভাঙা কাঁচের টুকরোয় হত্যাকারী বা তার সঙ্গীর সম্ভবত পা কেটে যায়। রক্ত পড়তে থাকে। তখন তারা ঘরের সিঙ্কের ট্যাপে পা ঘোয় ও পরে ঐ চপ্পলজোড়া পায়ে দিয়েই হয়তো ঘর থেকে বের হয়ে যায় যাতে করে রক্তমাখা পায়ের ছাপ মেঝেতে না পড়ে। আপনি জানেন না মিঃ সেন, ওদের যেদিন অ্যারেস্ট করা হয় সেই দিনই হাজতে পুরন্দর চৌধুরী ও লতার পা পরীক্ষা করে দেখা যায় লতাদেবীর পায়েই ব্যাণ্ডেজ বাঁধা ছিল। এবং তারই পায়ের পাতায় ক্ষত ছিল। পা খোবার পর উত্তেজনার মধ্যে ওরা ঘরের সিঙ্কের ট্যাপটা বন্ধ করে রেখে যেতে ভুলে যায়—যেটা খুব স্বাভাবিক, আর তাইতেই সেই ট্যাপটা আমরা খোলা অবস্থায় দেখি। নীলকুঠিতে ওদের প্রবেশে অত রাত্রে সাহায্য করেছিল করালী, এবং ওরা দুজনে যখন করালীর সাহায্যে নীলকুঠিতে প্রবেশকরে বা বের হয়ে যায় তখন হয়তো রামচরণের নজরে ওরা পড়েছিল বলেই তাকে প্রাণ দিতে হল পরে হত্যাকারীর হাতে। দ্বিতীয় রাত্রে আমার সঙ্গে যখন ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে বসে এক কাল্পনিক কাহিনী বলে নিজেকে সন্দেহমুক্ত করবার জন্য ও নিজের alibi সৃষ্টির চেষ্টায় আমাকে বোকা বোঝাবার চেষ্টায় রত ছিল, সম্ভবতঃপূর্বেই পুরন্দর রামচরণকে হত্যা করে কাজ শেষ করে এসেছিল। এবং কেমন করে সে রাত্রে সেটা সম্ভব হয়েছিল নীলকুঠির উপরের ও নীচের তলাকার নকশা দেখলেই আপনি তা বুঝতে পারবেন। রাত্রে সকলের শয়নের কিছুক্ষণ পরেই পুরন্দর চৌধুরী ঘর থেকে বের হয়ে যান এবং বারান্দা পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে যান। করালীর সাহায্যে রামচরণকে হত্যা করে দোতলায় ওঠবার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে আবার। তারপর আমার দৃষ্টি তার প্রতি আকর্ষণ করবার জন্য শব্দ করে ল্যাবরেটারী ঘরের দিকে যায়। কারণ সে জানত আমি সম্ভবত জেগেই থাকব। এবং পূর্বেও ছায়াকুহেলীর দুঃস্বপ্ন গড়ে তোলবার জন্য। ঐ সিঁড়ি দিয়েই সে উপরে উঠে যেত; কারণ অন্য সিঁড়ির দরজাটা রাত্রে বন্ধ থাকত। শেষ, রাত্রে যেদিন করালীকে দেখে সুজাতাদেবী ভয় পেয়েছিলেন সে রাত্রেও ওই ঘোরানো সিঁড়ি দিয়েই উপরে উঠে পালাবার সময়ও সেই পথেই পালায়। এবারে আসা যাক ওদের আমি। সন্দেহ করলাম কি করে। পুরন্দর চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রমাণ, সেই চিঠি। যা বিনয়েন্দ্রর নামে রজতবাবু ও সুজাতাদেবীকে ও তার নামেও লেখা হয়েছিল। চিঠিটা যে পুরন্দরেরই নিজের হাতে লেখা সেটা তার কৌশলে জবানবন্দির কাগজে নাম দস্তখত করে নেওয়ার ছলে সংগ্রহ করে দুটো লেখা মিলিয়ে দেখতেই ধরা পড়ে যায় আমার কাছে। কিন্তু কথা। হচ্ছে, ওভাবে risk সে নিতে গেল কেন? বোধ হয় তার মধ্যেও ছিল তার আত্ম-অহমিকা বা সুনিশ্চিয়তা নিজরে উপরে। দ্বিতীয় প্রমাণ, পুরন্দর চৌধুরীর জবানবন্দি, যা আমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। খবর নিয়ে আমি জেনেছিলাম, গত পনেরদিন ধরেই পুরন্দর চৌধুরী কলকাতার এক হোটেলে ছিল। হোটেলটির নাম হোটেল স্যাভয়। সেখানকার এক বয়ের মুখেই সংবাদটা আমি পাই। তৃতীয় প্রমাণ, লতাকে আমার লোক অনুসরণ করে জানতে পারে সেও হোটেল স্যাভয়ে উঠেছিল পুরন্দরের সঙ্গে পুরুষের বেশে, কিন্তু সে যে পুরুষ নয় নারী, সেও এ হোটেলের বয়ই অতর্কিতে একদিন জানতে পারে। তারপরে বাকিটা আমি অনুমান করে নিয়েছিলাম ও কিরীটী আমার দৃষ্টিকে সজাগ করে দিয়েছিল।
হঠাৎ ঐ সময় টেবিলের উপরে টেলিফোনটা বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং শব্দে।
রিসিভারটা তুলে নিলেন বসাক, হ্যালো—
আপনাকে একবার আসতে হবে স্যার।
কেন, ব্যাপার কী?
লতাদেবী সুইসাইড করবার চেষ্টা করছিলেন।
বল কি হে!
হ্যাঁ, এখনও অবস্থা খারাপ। তিনি আপনাকে যেন কি বলতে চান।
.
৩৯.
আর দেরি করলেন না প্রশান্ত বসাক। পুলিস হাসপাতালে ছুটলেন। একটা কেবিনের মধ্যে লতাদেবী শুয়েছিলেন। জানা গেল, গোটা দুই সিঙ্গাপুরী মুক্তা তাঁর কাছে ছিল; সেই খেয়েই তিনি আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করেছেন। অবস্থা ভাল নয়।
মিঃ বসাককে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে মৃদু কণ্ঠে লতাদেবী বললেন মিঃ বসাক!
কাছে এসে বসলেন মিঃ বসাক।
আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। তবে জানবেন শেষ মুহূর্তে মিথ্যা কথা বলছি না।
বলুন।
মিঃ বসাকের চোখের ভঙ্গিতে রামানন্দ সেন আগেই কাগজ কলম নিয়ে বসেছিলেন।
লতাদেবীর শেষ জবানবন্দি রামানন্দ সেন লিখে নিতে লাগলেন।
.
এবং বলাই বাহুল্য বাঁচানো গেল না লতাকে।
পরের দিন ভোরের দিকেই তাঁর মৃত্যু হল বিষের ক্রিয়ায়। এবং মৃত্যুর পূর্বে যে কাহিনী তিনি বিবৃত করে গেলেন, সেটা জানতে না পারলে নীলকুঠির হত্যারহস্যের যবনিকা তুলতে আরও কতদিন যে লাগত কে জানে!
শুধু তাই নয়, কখনও যেত কিনা তাই বা কে বলতে পারে।
মৃত্যুপথযাত্রিণী লতা সংক্ষেপে এক মর্মান্তিক কাহিনী বলে গেল তার শেষ সময়ে। দুটি পুরুষের প্রবল প্রেমের আকর্ষণের মধ্যে পড়ে শেষ পর্যন্ত কাউকে সে পেলে না, কাউকেই সুখী করতে পারল তো নাই, উপরন্তু তাদের মধ্যে একজনকে হত্যা করল সে হত্যাকারীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এবং অন্যজনকেও বিদায় দিতে হল মর্মান্তিক এক পরিস্থিতির মধ্যে। এবং সবচাইতে করুণ হচ্ছে দুজনকেই সে ভালবেসেছিল; তবে একজনের ভালবাসা সম্পর্কে সে সর্বদা সচেতন থাকলেও অন্যজনকেও যে ভালবাসত এবং ঘটনাচক্রে তারই মৃত্যুর কারণ হয়েছিল—শেষ মুহূর্তে সেটা সে বুঝতে পারল ব্যথা ও অনুশোচনার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু তখন যা হবার হয়ে গিয়েছে।
.
আরও পাঁচদিন পর—
বিনয়েন্দ্র ও রামচরণের হত্যা-রহস্যের যে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রশান্ত বসাক পুলিসের কর্তৃপক্ষকে দাখিল করেছিলেন, সেটা একটি কল্পিত উপন্যাসের কাহিনীর চেয়ে কম বিস্ময়কর ও চমকপ্রদ নয়। একটি নারীকে ঘিরে দুটি পুরুষের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের আজন্মপোষিত হিংসা যে কি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে এবং হাসিমুখে বন্ধুত্বের ভান করে কী ভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বৎসরের পর বৎসর দুই বন্ধু একের প্রতি অন্যে সেই হিংসার গরল বিন্দু বিন্দু করে সঞ্চয় করে তুলতে পারে ও শুধুমাত্র সময় ও সুযোগে সেই প্রতিহিংসার গরল-মাখানো নখরে চরম আঘাত হানবার জন্য লতার স্বেচ্ছাকৃত জবানবন্দি পেলে হয়তো সম্যক বোঝাই যেত না কোনদিন। এবং বিনয়েন্দ্রও রামচরণের হত্যা-রহস্যের উপরেও কোনদিন আলোকসম্পাত হত কিনা তাই বা কে বলতে পারে।
.
৪০.
বিনয়েন্দ্র ও পুরন্দর চৌধুরীর পরস্পরের আলাপ হয় কলেজের তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে! দুজনেই ছিল প্রখর তীক্ষ্ণধী ছাত্র। চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণীতে যখন তারা উঠল তারই মাসখানেক বাদে পাঞ্জাব থেকে লতা সিং পড়তে এল কলকাতায়।
সতার বাপ ছিল পাঞ্জাবী আর মা ছিল লুধিয়ানা-প্রবাসী এক বাঙালী মেয়ে। লতা তার জন্ম-স্বত্ব হিসাবে পাঞ্জাবী পিতার দেহসৌষ্ঠব ও বাঙালী মায়ের রূপমাধুর্য পেয়েছিল।
লুধিয়ানার কলেজেই পড়তে পড়তে হঠাৎ পিতার মৃত্যু হওয়ায় লতার মা তাকে নিয়ে তাঁর পিতার কাছে কলকাতায় চলে আসেন; কারণ লতার মাতামহ তখন দীর্ঘকাল পরে আবার তাঁর নিজের মাতামহর বাড়ি ও সম্পত্তি পেয়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেছেন।
লতা, পুরন্দর ও বিনয়েন্দ্র যে কলেজে পড়তেন সেই কলেজেই সেই শ্রেণীতে এসে ভর্তি হল।
বিনয়েন্দ্র ও পুরন্দর চৌধুরীর সহপাঠিনী লতা। এবং ক্রমে লতার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় বিনয়েন্দ্র ও পুরন্দর চৌধুরীর। দুর্ভাগ্যক্রমে উভয়েই ভালবাসলেন লতা সিংকে। আর সেই হল যত গোলযোগের সূত্রপাত। কিন্তু পরস্পরের ব্যবহার বা কথাবার্তায় কেউ করো কাছে সে-কথা স্বীকার করলে না বা প্রকাশ পেল না। ইতিমধ্যে নানা দুর্বিপাকে পড়ে পুরন্দর চৌধুরীকে পড়াশুনায় ইস্তাফা দিয়ে জীবিকা অর্জনের জন্য চেষ্ঠা শুরু করতে হল।
পুরন্দর চৌধুরী ও বিনয়েন্দ্র দুজনেই লতাকে ভালবাসলেও লতার কিন্তু মনে মনে দুর্বলতা ছিল পুরন্দর চৌধুরীর উপরেই একটু বেশী। সে কথাটা জানতে বা বুঝতে পেরেই হয়তো বিনয়েন্দ্র সরে দাঁড়িয়েছিলেন পুরন্দর চৌধুরীর রাস্তা থেকে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সরে দাঁড়ালেও প্রেমের ব্যাপারে এত বড় পরাজয়টা বিনয়েন্দ্র কোনদিনই ভুলতে তো পারেনইনি, এমন কি লতাকেও বোধ হয় ভুলতে পারেননি। এবং সেই কারণেই পুরন্দরকে ক্ষমা করতে পারেননি। চিরদিন মনে মনে পুরন্দর চৌধুরীর প্রতি একটা ঘৃণা পোষণ করে এসেছেন।
যা হোক, পুরন্দর পড়াশুনা ছেড়ে দিলেন এবং বিনয়েন্দ্র ও লতা যথাসময়ে পাস করে স্নাতকোত্তর বিজ্ঞান বিভাগে নাম লেখালেন। সেখানে থেকে পাস করে বিনয়েন্দ্র নিলেন অধ্যাপনার কাজ, আর লতা বাংলার বাইরে একটা কেমিক্যাল ফার্মে চাকরি নিয়ে চলে গেল।
পুরন্দর চলে গেলেন সিঙ্গাপুরে। সেখানে গিয়ে লিং সিংয়ের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লেন। পুরন্দর বর্ণিত সিঙ্গাপুর-কাহিনী প্রায় সবটাই সত্য কেবল সত্য নয় তাঁর স্ত্রী ও পুত্রের অকস্মিক সর্পদংশনে মৃত্যুর কথাটা। তাদের তিনি নিজ হাতে বিষ দিয়ে হত্যা করে সেই বাড়িতেই কবর দিয়েছিলেন। এবং পরে অবিশ্যি ওই সংবাদ তারযোগে সিঙ্গাপুর স্পেশাল পুলিসই মাত্র কয়েকদিন আগে আমাকে জানায়। সেই নৃশংস হত্যার পর থেকে পুরন্দর অন্য নামে আত্মগোপন করে বেড়াচ্ছিল এতকাল।
তাই বলছিলাম পুরন্দর চৌধুরী শুধু নৃশংসই নয়, মহাপাষণ্ড।
এদিকে বিনয়েন্দ্র অনাদি চক্রবর্তীর বিষয়-সম্পত্তি পেয়ে নতুন করে আবার জীবন শুরু করলেন। এবং ক্রমে পুরন্দর ও বিনয়েন্দ্রের পরস্পরের প্রতি পোষিত যে হিংসাটা দীর্ঘদিনের অদর্শনে বোধ হয় একটু ঝিমিয়ে এসেছিল, সেটা ঠিক সেই সময়েই অকস্মাৎ একদিন জ্বলে উঠল পুরন্দর কলকাতায় এসে বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে দেখা করায় এবং সেখানে তাকে দেখে নতুন করে আবার সেটা জেগে উঠল দীর্ঘকাল পরে। যার ফলে যাবার পূর্বে পুরন্দর বিনয়েন্দ্রকে সিঙ্গাপুরী মুক্তার নেশায় হাতেখড়ি দিয়ে গেলেন।
সিঙ্গাপুরী মুক্তার নেশা ধরানোর ব্যাপারটা পূর্বাহেই অবিশ্যি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য পুরন্দর চৌধুরী মিঃ বসাকের নিকট তাঁর বিবৃতিকালে স্বীকার করেছিলেন।
ঐ সময় তার সঙ্গেও নিশ্চয়ই পুরন্দরের কোন কথাবার্তা হয়েছিল, যাতে করে ঐ সিঙ্গাপুরী মুক্তার নেশায় কবলিত করে তাকে দীর্ঘ দিন ধরে দোহন করে করে বিয়েকে একেবারে ঝাঁঝরা করে ফেলা ও লতাকে পাওয়া যায়। এক ঢিলে দুই পাখি বধ করা।
বলাই বাহুল্য, ইতিপূর্বে একসময় তার চাকরি গিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। আর ঠিক সেই সময় দৈবক্রমেই যেন একজন ল্যাবটারী অ্যাসিস্টেস্টের প্রয়োজন হওয়ায় কাগজে বিজ্ঞাপন দেয় বিনয়েন্দ্র। সেই বিজ্ঞাপন দেখে লতা আবেদন পাঠায়। আবেদনকারীদের মধ্যে হঠাৎ লতার আবেদনপত্র দেখে প্রথমটায় বিনয়েন্দ্রর কি রকম সন্দেহ হয়। তিনি তাকে একটা চিঠি দেন দেখা করবার জন্য লতা পত্রের জবাব দেয়, এবারে আর লতাকে চিনতে বিনয়েন্দ্রর কষ্ট হয় না। আবার লতাকে তিনি চিঠি দেন সাক্ষাতের জন্য। লতা সাক্ষাৎ করতে এল এবং বলাই বাহুল্য দীর্ঘদিন পর লতার প্রতি যে সুপ্ত প্রেম এতকাল বিনয়েন্দ্রর অবচেতন মনে ধিকি ধিকি জ্বলছিল তা লেলিহ হয়ে উঠল দ্বিগুণ তেজে। লতা কাজে বহাল হল। লতা অবিশ্যি তখনও অবিবাহিতা।
লতাকে বিনয়েন্দ্ররনীলকুঠিতে অকস্মিকভাবে আবিষ্কার করবার পরই পুরন্দরেরমনেলতাকে ঘিরে আবার বাসনার আগুন দ্বিগুণভাবে জ্বলে ওঠে। তাছাড়া বেলাকে বিবাহ করলেও তার প্রতি কোনদিনই সত্যিকারের ভালবাসা জন্মায়নি তার। এবং লতাকে দ্বিতীয়বার আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গেই লতার প্রতি তার পুরাতন দিনের আকর্ষণ আবার নতুন করে জেগে উঠল। বেলাকে ও তার পুত্রকে হত্যা করে লতাকে বিবাহ করবার পথ পরিষ্কার করে নিয়েছিল পুরন্দর। বেলার মৃতদেহ কোনদিন দৈবক্রমে যদি আবিষ্কৃত হয় তখন যাতে সহজেই হত্যার দায় থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে, ঐ কাল্পনিক কাহিনী পূর্বাহেই বলবার অন্যতম আর একটি কারণ ছিল বোধ হয় তাই আমার কাছে।
পরে সিঙ্গাপুরে ফিরে গিয়ে বেলাকে হত্যা করে সেই যে পুরন্দর আবার কলকাতায় এল আর ফিরে গেল না সেখানে। নীলকুঠির পাশেই সেই ভাঙা বাড়িতে গোপন আশ্রয় নিল ও; প্রতি রাত্রে উভয়ের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হতে লাগল এবং সেই সঙ্গে চলতে লাগল বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করবার পরিকল্পনা। সেই ভাঙা বাড়িতে তাদের গতিবিধির উপর যাতে কারও নজর না পড়ে সেজন্য দ্বিতীয় আর একজনকে সেখানে নিয়ে আসা হল মিশিরজীর পরিচয়ে। অর্থাৎ এবারে পাকাপোক্তভাবেই শুরু হল ওদের অভিযান। শুধু যে পুরন্দর চৌধুরীই দুঃসাহসীই ছিল তাই নয়, লতাও ছিল। পাঞ্জাবী বাপের রক্ত ছিল তার শরীরে, তাই তার পক্ষে সে রাত্রে কার্ণিশ বেয়ে পুরন্দরের পিছু পিছু সুজাতার শয়নকক্ষে প্রবেশ করাটা এমন কষ্টসাধ্য হয়নি কিছু। সে যাক, যা বলছিলাম।
৪১.
সে যাক, যা বলছিলাম, প্রশান্ত বসাক বলতে লাগলেন। পূর্ব পরিকল্পনা মতই সব ঠিক হয়ে গেলে ড্রাইভার করালীকে ওখানে প্রহরায় রেখে লতা অকস্মাৎ একদিন অন্তৰ্হিতা হল। এবং নীলকুঠি থেকে অন্তৰ্হিতা হয়ে সে প্রবেশ করল গিয়ে ভাঙা বাড়িতে।
হত্যার দিন রাত্রে করালীর সাহায্যে সদর খুলিয়ে লতা এল বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে দেখা করতে। সবে হয়তো তখন বিনয়েন্দ্র সিঙ্গাপুরী মুক্তার নেশায় রঙিন হয়ে উঠেছে। লতা এসেই দরজায় নক করে এবং বিনয়েন্দ্র অকস্মাৎ ঐ রাত্রে গবেষণা-ঘরের দরজা খুলে লতাকে সামনে দেখে বিহ্বল হয়ে যান। আনন্দিতও যে হয়েছিলেন সেটা বলাই বাহুল্য। এবং তারপর ঘরের দরজা খোলাই ছিল। পরে একসময় বিনয়েন্দ্রর অজ্ঞাতে পুরন্দর ল্যাবরেটারী ঘরে প্রবেশ করে। লতার সঙ্গে গল্পে মশগুল বিনয়েন্দ্র, এমন সময় পশ্চাৎদিক থেকে পুরন্দর এসে বিনয়েন্দ্রর ঘাড়ে আঘাত করে। বিনয়েন্দ্র অতর্কিত আঘাতে টুল থেকে পড়ে যান মাটিতে এবং পড়বার সময় তাঁর হাতে লেগে টেবিলের উপর থেকে ঘড়িটা ও দু-একটা কাঁচের যন্ত্রপাতিও সম্ভবত মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়। একটা কাঁচের পাত্রে খানিকটা অ্যাসিড ছিল, সেটা মেঝেতে পড়ে যায়। ঘাড়ে আঘাত করে বিয়েকে অজ্ঞান করে পুরন্দর বিচিত্র ওই স্পেয়িং অ্যাপারেটাসটার সাহায্যে বিনয়েন্দ্রর গলারমধ্যে আরো সর্পবিষ ঢেলে দেয়। তারপর ব্যাপারটাকে আত্মহত্যার রূপ দেবার জন্য মেঝের ভাঙা কাঁচের টুকরো ও অ্যাসিড সরিয়ে ও মুছে নিতে গিয়ে অতর্কিতে লতার পা কেটে যায়। তখন সে রক্ত ধুয়ে ফেলতে ও ঘরের মেঝের সব চিছু মুছে নিতে ঘরের ওয়াশিং সিঙ্কের ট্যাপ খুলে ন্যাকড়া বা রুমাল জলে ভিজিয়ে সব ধুয়ে মুছে ফেলে। কিন্তু মেঝে থেকে অ্যাসিডের দাগ একেবারে যায় না এবং চলে যাবার সময় পুরন্দর ট্যাপটা বন্ধ করে রেখে যেতে ভুলে যায়। কাঁচের ভাঙা টুকরোয় পা কেটে যাওয়ায় লতা বিনয়েন্দ্রর রবারের চপ্পল-জোড়া পায়ে দিয়ে নিয়েছিল, কারণ সে এসেছিল খালি পায়ে। যে চপ্পল আমি পাশের বাড়ির মধ্যে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। শুধুমাত্র বিনয়েন্দ্রর হত্যাব্যাপারটাকে আত্মহত্যার রূপই যে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছিল তা নয়, ঐ হত্যা প্রচেষ্টার পূর্বে সঙ্গে সঙ্গে একটা ভৌতিক ব্যাপারও গড়ে তোলা হয়েছিল। মধ্যে মধ্যে কিছুদিন হতেই করালীর প্রচেষ্টায়, বলাবাহুল্য আমার একটা কথা বলতে ভুল হয়ে গিয়েছে। বিনয়েন্দ্রর মৃতদেহের পাশে গ্লাস-বিকারের মধ্যে যে তরল পদার্থ পাওয়া গিয়েছিল তার মধ্যেও পরীক্ষা করে সর্প-বিষ পাওয়া যায়। তাতে করে অবিশ্যি বিনয়েন্দ্রের দেহে সর্প-বিষ পাওয়ার ব্যপারটা যে আদৌ আত্মহত্যা নয় এবং হত্যাই সেটা আমার আরও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস হয়। কারণ বিনয়েন্দ্র যে সর্প-বিষ নিয়ে গবেষণা করছিল তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই তার বিকারে সর্প-বিষ পাওয়া ও মৃত্যুর কারণ সর্প-বিষ হওয়ার সন্দেহটা বৃদ্ধি করেছিল। এই গেল বিনয়েন্দ্রর হত্যার ব্যাপার! দ্বিতীয়, রামচরণকেও হত্যা করে পুরন্দর চৌধুরীই পররাত্রে। এবং হত্যা করবার পর সে ল্যাবরেটারীতে যায় নিজের একটা alibi তৈরী করবার জন্য। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য। সে ভালভাবেই জানত যে রাত্রে আমি সজাগ থাকব ও সহজেই সে আমার দৃষ্টিতে পড়বে এবং তখন তার সেই কাহিনী বলে আমাকে সে তার ব্যাপারে সন্দেহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে রাখবে পূর্বেই বলেছি সে-কথা। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি যে কিরীটীর সঙ্গে আলোচনার পর তাঁর উপরেই আমার সন্দেহটা জাগতে পারে এবং আমি সেইভাবেই পরে তদন্ত চালাতে পারি। কিরীটীই পুরন্দরের উপরে আমার মনে প্রথমে সন্দেহ জাগ্রত করে ও চিঠিগুলোর উপরে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করায়। পরে অবিশ্যি আলাদা আলাদা কাগজে জবানবন্দি লিখে তার উপরে প্রত্যেকের নাম দস্তখত করতে আমি সকলকে বাধ্য করি। এবং প্রত্যেকের আলাদা হাতের লেখা ও তার সঙ্গে সুজাতা, রজত ও পুরন্দর চৌধুরীর কাছে প্রাপ্ত বিনয়েন্দ্রর নামে লেখা চিঠির লেখা মেলাতেই দেখা গেল, একমাত্র পুরন্দর চৌধুরীর হাতের লেখার সঙ্গেই বেশ যেন কিছুটা মিল আছে। পরে অবিশ্যি হাতের লেখার বিশেষজ্ঞও সেই মতই দিয়েছেন। যা হোক, তারপর পুরন্দর চৌধুরীর প্রতিই সন্দেহটা আরো যেন আমার ঘণীভূত হয়। এবং এখানে আর একটা কথা বলা প্রয়োজন, ঐ তিনখানা চিঠি যে আদৌ বিনয়েন্দ্রর লেখা নয় সেটার প্রমাণ পূর্বেই আমি পেয়েছিলাম বিনয়েন্দ্রর ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে ড্রয়ারে প্রাপ্ত তার নোট-বইয়ের মধ্যেকার বাংলা লেখা দেখে এবং সেই লেখার সঙ্গে চিঠির লেখা মেলাতেই। বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করা হয়েছিল। এবং তাঁর হত্যার সংবাদও তাঁর সম্পত্তির ওয়ারিশন হিসাবে রজত ও সুজাতা পেতই একদিন না একদিন। তবে তাদের ওভাবে অত তাড়াতাড়ি হত্যা-মঞ্চে টেনে আনা হল কেন বিনয়েন্দ্রর নামে চিঠি দিয়ে? তারও কারণ ছিল বৈকি। এবং সেটা বুঝতে হলে আমাদের আসতে হবে পুরন্দর চৌধুরীর সত্যিকারের পরিচয়ে। কে ওই পুরন্দর চৌধুরী।
আমরা জানি অনাদি চক্রবর্তী তাঁর পিতার একমাত্র সন্তানই ছিলেন। কিন্তু আসলে তা নয়। তাঁর একটি ভগ্নীও ছিল। নাম প্রেমলতা।
প্রেমলতার তেরো বছর বয়সের সময় বিবাহ হয় এবুং মোল বৎসর বয়সে সে যখন বিধবা হয়ে ফিরে এল পিতৃগৃহে তখন তার কোলে একমাত্র শিশুপুত্র, বয়স তার মাত্র দুই। প্রেমলতা অনাদি চক্রবর্তীর থেকে আঠারো বছরের ছোট ছিল। মধ্যে আরো দুটি সন্তান অনাদির মার হয়, কিন্তু তারা আঁতুড় ঘরেই মারা যায়। প্রেমলতা বিনয়েন্দ্রর মার থেকে বয়সে বছর চারেকের বড় ছিল। বিধবা হয়ে পিতৃগৃহে ফিরে আসবার বছর খানেকের মধ্যে সহসা এক রাত্রে প্রেমলতা তার শিশুপুত্রসহ গৃহত্যাগিনী হয়। এবং কুলত্যাগ করে যাওয়ার জন্যই অনাদি চক্রবর্তী তার নামটা পর্যন্ত চক্রবর্তী বংশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলেন। কিন্তু জোর করে মুছে ফেললেই আর সব-কিছু মুছে ফেলা যায় না।
যা হোক, গৃহত্যাগিনী প্রেমলতার পরবর্তী ইতিহাস খুঁজে না পাওয়া গেলেও তাঁর শিশু পুত্রটির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এক অনাথ আশ্রমে সেই শিশু মানুষ হল বটে, তবে কুলত্যাগিনী মায়ের পাপ য়ে তার রক্তে ছিল! সেই পাপের টানেই সেই শিশু যতই বড় হতে লাগল তার মাথার মধ্যে শয়তানী বুদ্ধিটাও তত পরিপক্ক হতে লাগল।
সেই শিশুঁকেই পরবর্তীকালে আমরা দেখছি পুরন্দর চৌধুরী রূপে। পুরন্দর চৌধুরী তাঁর যে জীবনের ইতিবৃত্ত দিয়েছিল তা সর্বৈব মিথ্যা, কাল্পনিক। নিজের সত্যিকারের পরিচয়টা পুরন্দর চৌধুরী জানত, কিন্তু তা সত্বেও কোনদিন সাহস করে গিয়ে তার মামা অনাদি চক্রবর্তীর সামনে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ, সে জানত অনাদি চক্রবর্তী কোনদিনই তাকে ক্ষমার চোখে দেখবেনই না, এমন কি সামনে গেলে দূর করেই হয়ত তাড়িয়ে দেবেন।
তাই কলেজ অধ্যয়নকালে সহপাঠী বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে যখন তার পরিচয় হয় তখন থেকেই। বিনয়েন্দ্রর প্রতি একটা হিংসা পোষণ করতে শুরু করে পুরন্দর এবং সে হিংসায় নতুন করে ইন্ধন পড়ে লতা সিংয়ের প্রেমের প্রতিদ্বন্দিতায়।
পুরন্দর চৌধুরী অনাদি চক্রবর্তীর সঙ্গে বিনয়েন্দ্রর কোন সম্পর্ক নেই জেনে প্রথমে যেটুকু নিশ্চিন্ত হয়েছিল, পরে অনাদি চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর যখন সে জানতে পারল বিনয়েন্দ্রকেই অনাদি তার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছেন তখন থেকেই সে নিশ্চিন্ত ভাবটা তো গেলই, ঐসঙ্গে বিনয়েন্দ্রর প্রতি আক্রোশটা আবার নতুন করে দ্বিগুণ হয়েজেগে ওঠে। এবং প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই মনে মনে বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করবার পরিকল্পনা করতে থাকে পুরন্দর। কিন্তু এ সময় কিছু দিনের জন্য ভাগ্যচক্রে তাকে সিঙ্গাপুরে ভাগ্যান্বেষণে যেতে হওয়ায় ব্যাপারটা চাপা পড়ে থাকে মাত্র। তবে ভোলেনি সে কথাটা। বিনয়েন্দ্রকে কোন মতে পৃথিবী থেকে সরাতে পারলে সে-ই হবে অনাদি চক্রবর্তীর সম্পত্তির অন্যতম ওয়ারিশন তাও সে ভুলতে পারেনি কোনদিন। আর তাই সে কিছুতেই নীলকুঠির মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। নীলকুঠিতে পুরন্দর ছায়াকুহেলীর সৃষ্টি করে। তার ইচ্ছা ছিল, ঐ ভাবে একটা ভৌতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে পরে কোন এক সময় সুযোগ মত বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করবে। সেই মতলবই ধীরে ধীরে পুরন্দর তার পরিকল্পনা মত এগুচ্ছিল।
এদিকে একদা যৌবনের বাঞ্ছিতা লতাকে পৌঢ়ত্বের সীমানায় এসে হঠাৎ আবার নতুন করে কাছে পেয়ে বিনয়েন্দ্র পাগল হয়ে উঠল। এবং অন্যদিকে আকস্মিকভাবে আবার একদিন। রাত্রে বহুকাল পরে পুরন্দরকে দেখে লতা বুঝতে পারল যৌবনের সে-ভালবাসাকে আজও সে ভুলতে পারেনি। এবং সেই ভালবাসার টানেই পুরন্দরের পরামর্শে তার দুষ্কৃতির সঙ্গে হাতে হাত মেলাল লতা। পরে অবিশ্যি ধরা পড়ে, মুক্তির আর কোন উপায়ই নেই দেখে অনন্যোপায় লতা আত্মহত্যা করে তার ভুলের ও সেই সঙ্গে প্রেমের প্রায়শ্চিত্ত করল।
কিন্তু বলছিলাম পুরন্দর চৌধুরীর কথা। কেন সে সুজাতা ও রজতকে বিনয়েন্দ্রর নামে চিঠি দিয়ে অত তাড়াতাড়ি নীলকুঠিতে ডেকে এনেছিল?
কারণ, বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করলেই সে সমস্ত সম্পত্তি পাবে না। রজত ও সুজাতা হবে। তার অংশীদার। কিন্তু তাদের সরাতে পারলে তার পথ হবে সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টক। তাই সে ওদের হাতের সামনে ডেকে এনেছিল সুযোগ ও সুবিধা মত হত্যা করবার জন্যই।
বিনয়েন্দ্রকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে সে তার সম্পত্তি লাভের প্রথম সোপান তৈরী করেছিল; এখন রজত ও সুজাতাকে হত্যা করতে পারলেই সব ঝামেলাই মিটে যায়। নিরঙ্কুশভাবেই সে ও লতা বিনয়েন্দ্রর সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু ইতিমধ্যেই নিরপরাধিনী স্ত্রী ও তার শিশু পুত্রকে ও বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করে যে পাপের বোঝা পূর্ণ হয়ে উঠেছিল তারই অমোঘ দণ্ড যে মাথার উপরে নেমে আসতে পারে, পুরন্দর চৌধুরী বোধ হয় স্বপ্নেও তা ভাবেনি।
সাজানো খুঁটি যে কেঁচে যেতে পারে শেষ মুহূর্তেও তা বোধহয় ধারণাও করেনি পুরন্দর। এমনিই হয়। এবং একেই বলে ভগবানের মার। যাঁর সুক্ষ্ম বিচারে কোন ত্রুটি, কোন ভুল থাকে না। যাঁর নির্মম দণ্ড বজ্রের মতই অকস্মাৎ অপরাধী পাপীর মাথার উপরে নেমে আসে।
নইলে তারই দেওয়া সিঙ্গাপুরী মুক্তা-বিষ খেয়ে লতাকেই বা শেষ মুহূর্তে আত্মহত্যা করে তার মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে কেন? আর হতভাগ্য পুরন্দর চৌধুরীকেই বা অন্ধকার কারাকক্ষের মধ্যে ফাঁসির প্রতীক্ষ্ণয় দণ্ড পল প্রহর দিন গণনা করতে হবে কেন?
.
৪২.
এ গল্পের শেষ এখানেই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হল না। রজতকে নিজের সম্পত্তির দাবী লিখে দিয়ে পরের দিন যখন সুজাতা আবার লক্ষ্ণৌ ফিরে যাবার জন্য ট্রেনে উঠে বসেছে এবং কামরার খোলা জানলা পথে তাকিয়ে ছিল, এমন সময় পরিচিত একটি কণ্ঠস্বরে চমকে সুজাতা ফিরে তাকাল।
সুজাতা!
তুমি এসেছ!
হ্যাঁ, একটা কথা বলতে এলাম।
কী?
এখন যাচ্ছ যাও, এক মাসের মধ্যেই আমিও ছুটি নিয়ে লক্ষ্ণৌ যাচ্ছি।
সত্যি?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন?
তোমাকে নিয়ে আসতে।
ঢং ঢং করে ট্রেন ছাড়বার শেষ ঘণ্টা পড়ল। গার্ডের হুঁইসেল শোনা গেল।
কি, তুমি যে কিছু বলছ না? প্রশান্ত প্রশ্ন করে।
কী বলব?
কেন, বলবার কিছু নেই?
ট্রেনটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে তখন। সুজাতার চোখের কোল দুটো অকারণেই ছল ছল করে আসে। সে কেবল মৃদু কণ্ঠে বলে, না।
–: সমাপ্ত :–