দাদা জিজ্ঞাসা করে, কেন?
মাধবী—তোমার বোন—
কি—কি হয়েছে মাধবীর?
সে মরে গিয়েছে।
সুদর্শন প্রশ্ন করে, তারপর?
আমরা ছুটতে ছুটতে তখুনি এখানে চলে এসেছি, দাদা আর আমি।
আপনাদের মা-বাবা বোধ হয় এখনও শোনেননি কিছু?
সারাটা পল্লীই জেনে গিয়েছে। অবিনাশ বললে, তাদের কি আর এতক্ষণ কিছু জানতে বাকি আছে?
তা অবিশ্যি ঠিক। একটু থেমে সুদর্শন মল্লিক বলে, তাহলে এবার আপনারা বাড়ি যান।
অবিনাশ শুধায়, মৃতদেহ কখন পাব?
অনেক আইন-কানুনের ব্যাপার আছে, তাছাড়া পোস্টমর্টেম আছে। কাল বিকেলের আগে বডি পাবেন বলে তো মনে হয় না।
অবিনাশ সাবিত্রীর হাত ধরে চলে যাচ্ছিল, সুদর্শন আবার ডাকে, একটা কথা অবিনাশবাবু–
বলুন?
থানায় আপনাদের দুজনেরই একটা করে এজাহার দিতে হবে। সন্ধ্যার দিকে যদি একবার আসেন–
আসব।
অবিনাশ আর সাবিত্রী দাঁড়াল না। যাবার জন্য পা বাড়াল।
সুদর্শন আবার ওদের বললে, অমলেন্দুবাবুকেও আনবেন।
.
মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করতেই বেলা বারোটা বেজে গেল।
সুদর্শন মনে মনে যেন মাধবীর মৃত্যুর ব্যাপারটা ভেবে কিছুই কূল-কিনারা পাচ্ছিল না। মেয়েটাকে হত্যা করল কে আর কেনই বা হত্যা করল? হত্যা যে সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। এবং মৃতদেহ পরীক্ষা করে নিয়ে সুদর্শন যতটা বুঝতে পেরেছে, যে-ই হত্যা করে থাকুক-হয় হত্যার পর বা আগে হত্যাকারী মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে, তারপর হয়ত মৃতদেহটা ওইখানে নিয়ে গিয়ে ফেলা হয়েছে।
হত্যা সম্ভবত অন্যত্র হয়েছে–কিন্তু সে কোথায়?
আর একটা কথা মনে হয় সুদর্শনের। হত্যাকারী কি ওই দশ নম্বর পল্লীরই কেউ, না বাইরের কেউ?
হরগোবিন্দ বর্ণিত সেই সুট-পরা বাবুটি, তার কথাটাও মনে পড়ে। তার খবরটাও যোগাড় করা দরকার।
পল্লীতে মাধবীর প্রেমাকাঙ্ক্ষী অনেকেই ছিল। অনেকেই আকৃষ্ট হয়েছে মাধবীর প্রতি। আর একটু কৃপালাভের আশায় অনেকেই তার চারপাশে মক্ষিকার মত গুঞ্জন করে ফিরেছে। তাদের কেউ একজন নয় তো?
প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিহিংসা গ্রহণ? কিন্তু কে?
হীরা সাহা, খগেন পাঠক, কল্যাণ বসু কিংবা হরগোবিন্দ ঘোষ?
হরগোবিন্দর কথায়বার্তায় মনে হয় মাধবীর প্রতি ওর একটা চাপা আক্রোশ ছিল যেন!
এমনও হতে পারে, প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে গিয়েই হয়ত ওই আক্রোশ দেখা দিয়েছিল।
কাজেই ঐ হরগোবিন্দ লোকটারও সংবাদ নেওয়া দরকার।
আর একজন—আরও একজনের কথা মনে পড়ে সুদর্শনের।
সুবোধ মিত্র।
মাধবীদের একেবারে পাশের বাড়িতেই সে থাকে। তাকেও দেখা গিয়েছিল সকালে ভিড়ের মধ্যে। একমাত্র দেখা যায়নি হীরু সাহাকে।
সে কি খবরটা পায়নি, না পেয়েও যায়নি?
রাত প্রায় আটটা নাগাদ এল অবিনাশ একাই। সাবিত্রী আসেনি।
সুদর্শন থানার অফিসঘরেই বসেছিল ওদের অপেক্ষায়।
আসুন। একা যে! আপনার ছোট ভাই আর বোন এলেন না? বসুন।
অমল তো এখানে নেই। বসতে বসতে বললে অবিনাশ।
কোথায় গিয়েছেন তিনি?
একদল বরযাত্রী নিয়ে গতকাল বিকেলে কৃষ্ণনগর গিয়েছে, এখনও ফেরেনি। তারপরই একটু থেমে অবিনাশ বললে, মা অত্যন্ত আঘাত পেয়েছেন, ঘন ঘন ফিট হচ্ছে তাঁর সংবাদটা পাওয়ার পর থেকেই, তাই সাবিত্রী আসতে পারল না।
ঠিক আছে। কাল যখন তোক একবার যেন সময় করে থানায় আসেন। অবিশ্যি আমিই যেতে পারতাম, কিন্তু আপনার মা-বাবার কথা ভেবেই যাইনি। একটু থেমে বললে, আপনার বাবা পতিতপাবনবাবু শুনেছেন?
হ্যাঁ।
খুব ভেঙে পড়েছেন বোধহয়?
কান্নাকাটি তো করছেন না, একেবারে চুপচাপ।
খুবই স্বাভাবিক। সুদর্শন বলে।
০৬-১০. অতঃপর সুদর্শন কিছুক্ষণ চুপচাপ
অতঃপর সুদর্শন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। মনে মনে গুছিয়ে নেয় কি ভাবে শুরু করবে।
আচ্ছা অবিনাশবাবু!
বলুন।
ব্যাপারটা ডেলিকেট হলেও বুঝতেই তো পারছেন, আইনের খাতিরেই আমাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ আপনাদের করতে হচ্ছে।
আপনি অত কিন্তু-কিন্তু করছেন কেন? তাছাড়া এমন একটা কিছু যে ঘটবে এ তো আমি জানতামই।
জানতেন?
হ্যাঁ। আপনি হয়তো জানেন না, ইদানীং ওর চালচলন যা হয়ে উঠেছিল—
কি রকম?
নিজের মায়ের পেটের বোন, তবু যা সত্যি তা বলতেই হবে আমাকে। ক্লাবে ক্লাবে অভিনয় করাটাই যে একদিন হবে ওর কাল আমি জানতাম
কেন, আজকাল তো অনেক মেয়েই অভিনয় করে অ্যামেচার ক্লাবে দু-পয়সা উপার্জন করে!
শুধু তো অভিনয়ই নয়, অভিনয় করতে গিয়ে অফিসের বাবুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি, সিনেমায় যাওয়া, হোটেল-রেস্তোরাঁতে খাওয়া—কি বলব, নানা জনে নানা কথা বলতে শুরু করেছিল বেশ কিছুদিন ধরেই, আর তারা যে মিথ্যা বলত তাও নয়—
আচ্ছা, শুনেছি ওঁর আয়েই ইদানীং আপনাদের সংসারটা চলত, কথাটা কি সত্যি?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন? আপনারা তো দুই ভাই-ই শুনেছি ভাল রোজগার করেন?
দেখুন, উচ্ছলতাকে আর অনাবশ্যক ব্যয়বাহুল্যকে কোনদিনই আমি প্রশ্রয় দিইনি। তাই বছরখানেক আমার খাওয়া-খরচ ছাড়া আমি কিছুই দিতাম না সংসারে।
আর আপনার ছোট ভাই অমলেন্দুবাবু?
ওর নিজেরই বাবুয়ানী করে আর ড্রিঙ্ক করে, পয়সায় কুলোয় না তো সংসারে দেবে কি?
খুব ড্রিঙ্ক করেন বুঝি?
একটা বেহেড মাতাল। অর্ধেক দিন তো বাড়িতেই ফেরে না রাত্রে।
এবার তো আপনার ঘাড়েই সব পড়ল।
ক্ষেপেছেন? আমি চলে যাব মিলের কোয়ার্টারে। ঝামেলার মধ্যে আমি নেই।