পথ চলতে চলতে একসময় হরগোবিন্দকে সুদর্শন মল্লিক শুধায়, ঘোষ মশাই!
আজ্ঞে, কিছু বলছেন?
কি করা হয় আপনার?
কাছেই আমার লেদ মেসিনের একটা দোকান আছে।
দশ নম্বর পল্লীরই বাসিন্দা যখন আপনি, নিশ্চয়ই মাধবীকে ভাল করেই চিনতেন?
চেনা মানে যাতায়াতের পথে সর্বদা দেখাশোনা হচ্ছে, একই পল্লীতে থাকি। কে চেনা নয়—সবাই তো চেনা!
তা বটে। তবে বলছিলাম, আলাপ-টালাপ ছিল না মেয়েটির সঙ্গে?
না মশাই, বড় দেমাক ছিল মেয়েটার। আমাদের বড় একটা মানুষের মধ্যেই গণ্য করত না।
বলেন কি!
হ্যাঁ! চাকরি করে, অভিনেত্রী-অ্যাকটো করে স্টেজে!
খুব ভাল অভিনয় করত বুঝি?
তা জানি না মশাই, তবে আমার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে সে যাতায়াত করত সর্বদা। দেখতাম প্রায়ই অনেক রাত করে ফিরত–
একা একা?
আগে আগে তো একা-একাই যাতায়াত করত, তবে ইদানীং দেখতাম—
কি?
সঙ্গে রয়েছে সুন্দরমত সুট-পরা এক বাবু!
কে সে? আপনাদেরই পল্লীরই নাকি?
না।
তবে?
জানি না। তারপরই বলে হরগোবিন্দ, বুঝলেন না, স্কুল-মাস্টারের মেয়ে হলে কি হবে-আর না বলাটা অন্যায়ই হবে, স্বভাবচরিত্র তেমন সুবিধের ছিল না!
কেন—কেন?
পল্লীর সব জোয়ান-মদ্দ ছোকরাগুলোই তো ওর চারপাশে ঘুরঘুর করত, হাসাহাসি ঠাট্টামস্করা চলত।
তাই বুঝি? তা কার সঙ্গে বেশি ভাব ছিল বলে আপনার মনে হয়?
কে জানে মশাই, ওসব গভীর জলের মাছ! হলও শেষ পর্যন্ত তেমনি, অপঘাতে মরতে হল। ওই সব চরিত্রের মেয়ের শেষ পর্যন্ত অমনটিই হয়, বুঝলেন না?
আচ্ছা ঘোষ মশাই।
বলুন।
আপনাদের পল্লীতে মাধবীর কোন লাভার—মানে প্রেমিক ছিল কিনা বলতে পারেন?
ওদের মত মেয়েছেলের কি একটা-আধটা প্রেমিক থাকে মশাই! কত প্রেমিক!
সুদর্শনের বুঝতে কষ্ট হয় না, যে কোন কারণেই হোক মাধবীর প্রতি হরগোবিন্দর একটা আক্রোশ ছিল মনের মধ্যে।
.
মিনিট পঁচিশের মধ্যেই এরা পৌঁছে গেল অকুস্থানে।
মিথ্যা বলেনি হরগোবিন্দ। ইতিমধ্যে দশ নম্বর পল্লীর অনেকেই এসে সেখানে ভিড় করেছে। নানা বয়েসী পুরুষই বেশি, তবে কিছু মেয়েও আছে। তাদের মধ্যে মাধবীর ছোট বোন সাবিত্রী আর বড় ভাই অবিনাশও ছিল।
আরও ভিড়ের মধ্যে নজরে পড়ে সুদর্শনের—খগেন পাঠক মোটর মেকানিক, মিলের কর্মী কল্যাণ বসু, রোগা পাকাটির মত চেহারা—ওই একই মিলের কর্মী এবং সুবোধ মিত্র—সেই ভদ্র কেতাদুরস্ত মানুষটিকে বিশেষ করে।
সুদর্শন মল্লিক ও তার সঙ্গের সেপাইদের দেখে ভিড় সরে গিয়ে ওদের এগোবার পথ করে দেয় আপনা থেকেই।
পত্রশূন্য বটগাছটার নিচেই পড়ে আছে মাধবীর দেহটা। চিৎ হয়ে পড়ে আছে। পরনে একটা দামী শাড়ি। ডানহাতে একগাছি সোনার চুড়ি, বাঁহাতে দামী একটা লেডিস রিস্টওয়াচ।
মুখটা সামান্য হাঁ হয়ে আছে। ঝকঝকে দাঁতের পাশ দিয়ে জিভটা যেন সামান্য বের হয়ে এসেছে। চোখের পাতা খোলা—চোখের মণি দুটো যেন বের হয়ে আসতে চায়। স্পষ্ট একটা আতঙ্ক ও সেই সঙ্গে যন্ত্রণার চিহ্ন দু-চোখের তারায়।
মুখে ও ঠোটে প্রসাধনের চিহ্ন বেশ বোঝা যায়। ডান পায়ের হাঁটুর কাছাকাছি শাড়িটা উঠে এসেছে। মৃতদেহটা পরীক্ষা করতেই বুঝতে পারে সুদর্শন, পুরোপুরি রাইগার মর্টিস সেট ইন করেনি। পরনের শাড়িটা বেশ এলোমেলো। গায়ের ব্লাউজটা দু-এক জায়গায় ফেঁসে গিয়েছে দেখা যায়।
মৃতদেহটাকে উপুড় করে দিতেই নজরে পড়ল সুদর্শনের-পরনের শাড়ি ও ব্লাউজে ধূলোমাটি লেগে আছে, এখানে ওখানে ফেঁসে গিয়েছে।
মনে হয় কেউ যেন পৈশাচিক হিংস্রতায় মহিলার গায়ের ব্লাউজখানা টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে।
দেহের কোথাও কোন ক্ষতচিহ্ন নজরে পড়ল না সুদর্শনের।
একফোঁটা রক্তের চিহ্ন নেই কোথাও। সুদর্শন আরও একটু ঝুঁকে পড়ে মৃতদেহের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতেই তার নজরে পড়ল মৃতদেহের গলায় যেন একটা আবছা কালসিটার দাগ আছে।
সুদর্শনের পরীক্ষা হয়ে গেলে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশের ভিড়কে লক্ষ্য করে বললে, আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে ভিড় করছেন কেন? যান সব!
একে একে সবাই চলে গেল। কেবল সাবিত্রী আর অবিনাশ তখনও দাঁড়িয়ে। অবিনাশ স্তব্ধ, সাবিত্রীর চোখে জল। সে নিঃশব্দে কাঁদছিল।
চোখ দুটো কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে উঠেছে।
.
০৫.
সাবিত্রীর বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে সুদর্শনের মনটা যেন হঠাৎ কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। তবু প্রশ্ন তো করতেই হবে, যা জানবার তাকে জানতেই হবে।
সাবিত্রী দেবী! সুদর্শন ডাকে।
সাবিত্রী সুদর্শনের দিকে অশ্রুভেজা লাল চোখ তুলে তাকাল।
কাল কি আপনার দিদির কোথাও অভিনয় ছিল?
ক্ষণকাল সাবিত্রী যেন একটু ইতস্তত করলে, তারপর কান্নাঝরা গলায় বললে, হ্যাঁ, একটা অফিস-ক্লাবে অভিনয় ছিল। বলে গিয়েছিল ফিরতে রাত হবে। বাবা তো দিদির অভিনয়ের ব্যাপারটা জানে না, তাই আমি জেগে অপেক্ষা করছিলাম।
তারপর?
অপেক্ষা করতে করতে কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর ভোরবেলা হরগোবিন্দবাবুর চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায়।
সকাল হয়ে গিয়েছে তখন?
হ্যাঁ, বেলা প্রায় পৌনে ছটা হবে। তবে—
কি?
কুয়াশার জন্যে আলো তখনও তত ফোটেনি ভাল করে। চেঁচামেচি শুনে দাদাও বাইরে এসেছিল। আমি আর দাদা জিজ্ঞাসা করি, ব্যাপার কি? হরগোবিন্দবাবু আমাদের বাড়ির বাইরে ডেকে নিয়ে বললেন, শিগগির চল পল্লীর পিছনের মাঠে।