সাবিত্রী কোন সাড়া দেয় না। মুখটা ঘুরিয়েই থাকে।
কথা বলবে না সাবিত্রী! আমার দিকে তাকাও সাবিত্রী!
সাবিত্রী সাড়া দেয় না, মুখ ঘুরিয়েই থাকে।
সাবিত্রী, লক্ষ্মীটি, শোন!
তবু সাবিত্রী সাড়া দেয় না।
তাকাও সাবিত্রী আমার দিকে! আবার বলে।
সাবিত্রী তথাপি নীরব, নিশ্চল।
আবারও ডাকে সুদর্শন।
এতক্ষণে সাবিত্রী মুখ ফিরিয়ে তাকাল সুদর্শনের দিকে। তার দুচোখে জল।
সাবিত্রী!
কেন এসেছেন আপনি? ছি ছি, লোকে কি ভাববে—এখন স্মাগলারের বোন—
তার জন্যে তো তোমার কোন অপরাধ নেই সাবিত্রী–
না, না। সাবিত্রী দুহাতে মুখ ঢাকে।
সাবিত্রী, শোন–
না, না। আপনি যান—যান।
কিরীটী রায় বলেছেন, তুমি খাঁটি হীরে, নিষ্পাপ।
না, না, আমি হীরে নই, নিষ্পাপও নই—আমারও দোষ ছিল।
কি দোষ ছিল তোমার?
সব কথা আপনাকেও বলিনি—বলতে পারিনি—
বলনি ঠিকই, কিন্তু তাতে তোমার অপরাধটা কোথায়?
অপরাধ নেই?
ন।
আপনি বিশ্বাস করেন সে-কথা?
করি।
সত্যি বলছেন?
সত্যি বলছি।
কিন্তু কেউ তো সে-কথা বিশ্বাস করবে না। বলবে আমার বোন—আমার ভাই–
তোমার দিদি-তোমার দাদা যদি কোন অপরাধে অপরাধী হয়, তার জন্য তোমাকে কেন অপযশ কুড়াতে হবে?
হবে, আপনি জানেন না—
কিছু হবে না।
এ আপনি কি বলছেন?
ঠিকই বলছি।
সাবিত্রীর দুচোখে জল।
কান্নাঝরা গলায় বলে, কিন্তু এরপর কেমন করে আবার আমি ঐ পল্লীতে সবার সামনে ফিরে যাব!
ফিরবেই বা কেন সেখানে আবার তুমি?
তবে কোথায় যাব?
যদি তোমার আপত্তি না থাকে—
কি?
আমার কাছে তুমি যাবে।
আপনার কাছে?
হ্যাঁ, আমার ঘরে।
সাবিত্রীর দুচোখের কোল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
শোন সাবিত্রী, তুমি সুস্থ হয়ে ওঠার আগেই সব ব্যবস্থা আমি করে ফেলব। কালই ডি. সি.-কে আমায় নতুন থানায় পোস্টিং করবার জন্য বলব। সেখানে নতুন কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে তোমাকে আমি তুলব।
মা, বাবা—
অবশ্য তাদের মত নেব বৈকি! কি, রাজী তো?
সাবিত্রী কোন জবাব দেয় না, চোখ বুজিয়ে ফেলে।
সাবি!
ছোড়দা এসেছিল, কিন্তু তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি এরা—
দেয়নি?
না।
সুদর্শন বলে, যা ঘটে গিয়েছে তার জন্য তুমি নিজেকে বিব্রত বা অপরাধীই বোধ করছ কেন সাবিত্রী!
সাবিত্রী বললে, কেমন করে ভুলব বলুন তারা আমারই দিদি, আমারই দাদা
তা হলেই বা। ওসব চিন্তা তুমি মন থেকে তোমার মুছে ফেলে দাও। যা হয়ে গিয়েছে গিয়েছে, সামনে তোমার নতুন জীবন!
সাবিত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করে, একটা কথা বলল?
বল।
বাবা সব জানেন? জানতে পেরেছেন?
যতটা শুনেছি বোধ হয় সব না হলেও কিছু কিছু জানতে পেরেছেন। সংসারে দুঃসংবাদ দেবারও লোকের অভাব হয় না সাবিত্রী। তাছাড়া দুঃসংবাদ হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। আর এখনও যদি না জানতে পেরে থাকেন সব কথা—কিন্তু আর চাপাও থাকতে পারে না, কানে যাবেই তাঁর।
জানি। আমি যদি হাসপাতাল না আসতাম হয়ত একটা ব্যবস্থা হত। আর বাড়িতে এখন কেউ নেই–
কেন, তোমার ছোড়দা তো আছেন?
তা আছেন।
তবে?
ছোড়দা অত বুঝেসুঝে চলতে পারে না কোনদিনই, তাই ভাবছি—
কি?
বাবা হয়ত সব শুনে আর বাঁচবেন না। দিদিকে যে তিনি কি ভালবাসতেন আর কেউ না জানলেও আমি তো জানি। আর বাবা জানতে পারবেন বলেই এতদিন দিদির সব কিছু ব্যাপার জেনেও মুখ বুজে থেকেছি।
তোমার দিদি জানত যে তুমি সব জান?
বোধ হয় না।
আচ্ছা একটা কথার জবাব দেবে সাবিত্রী?
কি?
কেমন করে প্রথম তুমি জানতে পেরেছিলে সব?
হঠাৎ একদিন রাত্রে—
বল, থামল কেন?
মধ্যে মধ্যে ফিরতে দিদির রাত হত, এমন কি কখনও কখনও রাত সাড়ে বারোটা একটা। কেউ জানত না। আমিই সদর দরজা খুলে দিতাম দিদি ডাকলে। আমি যে তার পথ চেয়ে জেগে বসে থাকি তা দিদি জানত না। সে জানত ঘুম আমার পাতলা, এক ডাকেই উঠে পড়ি। তাই যে রাত্রে ফিরতে দেরি হত, আমাকে বলে যেত। আর আমি এদিকে দিদি কখন ফিরবে সে আশায়—পাছে তার অত রাত্রে আসার কথা কেউ জানতে পারে, পাছে দিদির ডাকাডাকিতে মা-বাবার ঘুম ভেঙে যায় সেই ভয়ে-জেগে বসে থাকতাম।
.
৩৯.
সুদর্শন একটু থেমে প্রশ্ন করে, তোমার দিদির সঙ্গে যে সুবোধবাবুর ঘনিষ্ঠতা ছিল জানলে কি করে প্রথম?
আমার ওদের হাবভাব দেখে সন্দেহ যে হয়নি তা নয়, তবে এতটা যে ভাবতে পারিনি কখনও।
তারপর?
এক রাত্রে, আমি জেগেই ছিলাম দিদির অপেক্ষায়, হঠাৎ দিদি ও সুবোধদার গলার স্বর আমার কানে এল। আমাদের দরজার বাইরে ওরা দাঁড়িয়ে কথা বলছে–
তোমার দিদি আর সুবোধবাবু?
হ্যাঁ।
কি কথা বলছিল তারা?
দিদি বলছিল, এবার যাও, সাবি জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হবে!
সুবোধা হেসে জবাব দিল, কি আর কেলেঙ্কারি হবে! দুচারটে সোনার গয়না দিলেই চুপ করে যাবে। তোমাদের মেয়েদের চরিত্র তো আমার কিছু জানতে বাকি নেই!
সবাই মাধবী ভাবো, তাই না সুবোধ? দিদি জবাব দিল।
ভাবি বৈকি। সুবোধদা বললে।
তারপর সুবোধদা চলে গেল, দিদিও এসে দরজায় টোকা দিল। আমি উঠে দরজা খুলে দিলাম। তা সত্ত্বেও ওদের মধ্যে যে অতটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছে বুঝতে পারিনি। সাবিত্রী চুপ করল।
বল, থামলে কেন?
সাবিত্রী বলতে লাগল, দিন কয়েক বাদে অমনি এক রাত্রে দিদির অপেক্ষায় জেগে আছি, হঠাৎ ওদের দুজনের গলার স্বর কানে এল। কি খেয়াল হল, জানলা দিয়ে উঁকি দিলাম জ্যোৎস্না ছিল অল্প অল্প সে-রাত্রে, রাত বারোটা বেজে গিয়েছে, দেখলাম