কিছুই জানেন না?
আজ্ঞে বিশ্বাস করুন স্যার—
আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কি আসে-যায়! আদালতে হাকিম সাহেবকে যদি বিশ্বাস করাতে পারেন, তাহলেই হবে।
খগেন পাঠক অনুচ্চ কণ্ঠে ওই সময় বলে, শালা।
সুদর্শন হেসে ফেলে।
কিরীটী আবার বলে, এখনও সবাই আপনারা যে যতটুকু জানেন স্বীকার করুন, আইনের হাত থেকে—গুরুদণ্ড থেকে যদি বাঁচতে চান!
অবিনাশ ওই সময় বলে ওঠে, ওই—ওই শালা পাঠকই যত নাটের গুরু। ওই-ই টাকার লোভ দেখিয়ে আমাকে ওদের দলে টেনেছিল।
আর আপনিও সুবোধ বালকের মত ভ্যান লুট করবার ব্যাপারে লেগে গেলেন, তাই না অবিনাশবাবু! এবং শুধু তাই নয়, নিজের মায়ের পেটের বোনটিও যে ওই দলে ভিড়েছে—জেনেও চুপ করে রইলেন! বলে ওঠে সুদর্শন।
হঠাৎ যেন খগেন, অবিনাশ ও নরহরির মুখটা চুপসে গেল সুদর্শনের শেষ কথায়।
কি, মুখ শুকিয়ে গেল যে একেবারে অবিনাশবাবু আপনাদের?
সুদর্শন! কিরীটী ডাকল।
দাদা!
যাও, ওদের দলপতিকে ওদের সামনে এনে একবার দাঁড় করাতে বল।
সুদর্শন বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
ওরা সকলই উপস্থিত পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।
একটু পরে হাতকড়া পরা অবস্থায় সুবোধ মিত্রকে দুজন আমর্ড কনস্টেবল ঘরে এনে ঢোকাতেই সকলের গলা থেকেই বিস্ময়ভরা স্বর নির্গত হয় একত্রে যেন।
নরহরি বলে, সুবোধ!
খগেন পাঠক বলে, সুবোধবাবু!
অবিনাশ বলে, সুবোধ!
কল্যাণ বসু বলে, সুবোধবাবু।
আর সুবোধ ওদের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
কিরীটী বলে, কি হল সরকারমশাই, আপনার তো আজ অত চমকাবার কথা নয় আপনি তো বোধ হয় দু-একদিন আগেই ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছিলেন।
রাধেশ্যাম! তাহলে সত্যিই ড়ুবলাম?
হ্যাঁ, একবারে অগাধ জলে!
.
বুঝতে কারোই আর কষ্ট হয় না, হাতকড়াবদ্ধ অবস্থায় ঐভাবে সুবোধ মিত্রকে। সামনে দেখে ও কিরীটীর কথা শুনে সকলেরই মনোবল যেন ভেঙে গিয়েছে তখন।
কি, এবারে নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন আপনারা যে যা জানেন! কিরীটী বলে সকলের ॥ মুখের দিকে তাকিয়ে।
সকলেই পর্যায়ক্রমে একে একে তখন নরহরির মুখের দিকে তাকাচ্ছ শ্যেনদৃষ্টিতে।
কিরীটী ব্যাপারটা বুঝতে পারে। বলে, মনে হচ্ছে আপনারা ঐ রাধেশ্যামকেই চিনতেন!
একে একে সকলেই স্বীকার করে, তারা নরহরিকেই চিনত। ওয়াগন ভেঙে মাল চুরি করে নরহরির নির্দেশমতই ট্রাকে মাল চালান করে দিত, তারপর নরহরিই সকলকে যা টাকা-পয়সা দেবার দিত।
নরহরি বলল, দোহাই ধর্মের, আমি বিশেষ কিছুই জানি না। মাল শুধু পাচার করে দিতাম মাধবীর নির্দেশমত এবং মাধবী যেমন যেমন বলে যেত তেমনিই করা হত। দোহাই হুজুরের। রাধেশ্যাম! আমি কখনও মাল চুরিও করিনি-মালে হাতও দিইনি!
হ্যাঁ, কেবল বেচা-কেনাটা করেছেন! কিরীটী হাসতে হাসতে বললে।
সুবোধ মিত্র কিন্তু একটি কথাও বললে না। মুখ বন্ধ করেই রইল আগাগোড়া।
বেলা দশটা নাগাদ পুলিশ ভ্যানে চাপিয়ে হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি—সকলকে কলকাতায় লালবাজারে চালান করে দিল সুদর্শন।
দশ নম্বর পল্লীর ঘরে ঘরে তখন গুঞ্জন। সমস্ত পল্লীতে যেন সাড়া পড়ে গেছে।
আর এক প্রস্থ চা-পানের পর কিরীটী ও সুব্রত অনেক আগেই বিদায় নিয়েছিল।
কল্যাণ মিত্র পুলিস-ভ্যানের ইনচার্জ হয়ে গেল।
.
৩৮.
দশ নম্বর পল্লীতে সুবোধ মিত্রের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে রীতিমত যেন একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা যেন সত্যিই কল্পনারও অতীত। সুবোধ মিত্রের মত একজন শিক্ষিত নির্বিরোধী ভদ্র যুবক—সে যে মালগাড়ির দরজা ভেঙে মালপাচার করতে পারে ও মাধবী ও গুলজার সিংকে হত্যা করতে পারে অমন নৃশংসভাবে, ব্যাপারটা যেন পল্লীর সকলকে একেবারে বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। সকলের মুখেই এক কথা, শেষে ঐ সুবোধ–সুবোধের কাজ! তাও তো ভিতরের আসল ব্যাপারটা-মাধবীর সঙ্গে সুবোধ মিত্রের সত্যিকারের কি সম্পর্ক ছিল, সেটা কেউ জানতে পারেনি!
অবিশ্যি আর কেউ না জানতে পারলেও মাধবীর মা-বাবা জানতে পেরেছিলেন। দুজনেই যেন একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। তার উপর বড় ছেলে অবিনাশ, সেও ঐ দলে ছিল—সে সংবাদটাও তাদের পক্ষে কম মর্মান্তিক ছিল না।
ঐ ঘটনার দিন-দুই পরে।
দুটো দিন সুদর্শন অত্যন্ত ব্যস্ত ছিল রিপোর্ট তৈরি করবার ব্যাপার নিয়ে।
তৃতীয় দিন সকালের দিকে সুদর্শন কিরীটীর ফোন পেল।
কিরীটী বলে গিয়েছিল সুদর্শনকে, সন্ধ্যার দিকে যেন সে একবার তার ওখানে যায় তার এদিককার কাজকর্ম সেরে।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ সুদর্শন বের হল।
প্রত্যেহই সাবিত্রীর খোঁজ নিয়েছে সে হাসপাতালে। সাবিত্রী ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠছে। কিরীটীর ওখানে যাবার জন্য বের হয়ে প্রথমেই সুদর্শন গেল হাসপাতালে।
হাসপাতালের কেবিনেই কিরীটীর নির্দেশমতই সাবিত্রীকে চব্বিশ ঘণ্টা পুলিস প্রহরার মধ্যে রাখা হয়েছিল।
বাইরের কাউকে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছিল না।
হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা, সাবিত্রী চোখ বুঝে শয্যার ওপর শুয়ে ছিল।
সুদর্শন কেবিনে এসে প্রবশ করল।
পদশব্দে সাবিত্রী চোখ খুলে সুদর্শনের দিকে তাকাল।
সাবিত্রী!
মৃদু গলায় ডাকল সুদর্শন শয্যার কাছে গিয়ে।
সাবিত্রী মুখটা ঘুরিয়ে নেয়।
কাছে গিয়ে পাশের টুলটায় বসে সুদর্শন সাবিত্রীর রুক্ষ চুলে একখানি হাত রেখে স্নেহ-কোমল কণ্ঠে বলে, কেমন আছ সাবিত্রী?