মনে নেই তোমার, গাড়িতে আসতে আসতে আজ রাত্রেই তোমাকে বলেছিলাম, গুলজার সিংয়ের ফ্ল্যাট সার্চ করতে গিয়ে তার ঘরে মাধবীর একটা ফটো পাওয়া গিয়েছে!
হ্যাঁ।
হয়ত সেই ফটোই হয়েছিল তারপর কাল। মাধবী ছিল মিত্র মশাইয়ের রক্ষিতা কাজেই গুলজার সিংয়ের ঘরে যদি মাধবীর ফটো থাকে আর মিত্র মশাই কোনমতে সেটা জানতে পারেন, ব্যাপারটা তিনি ভাল চোখে অবশ্যই দেখবেন না—দেখতে পারেন না। হয়ত ওই রকম কিছু হয়েছিল, যদিও সেটা আমার অনুমান—আর তাতেই হতভাগ্য গুলজার সিংকে প্রাণ দিতে হল। এবং সেটাই হল মিত্র মশাইয়ের সর্বাপেক্ষা বড় ভুল, সবচেয়ে বেশি অবিবেচনার কাজ।
কেন?
কারণ গুলজার সিং নিহত না হলে এত তাড়াতাড়ি হয়ত সমস্ত রহস্যটা চোখের সামনে আমার পরিষ্কার হয়ে যেত না। মিত্র মশাইয়ের ঝাপসা চেহারাটাও এত সহজে স্পষ্ট হয়ে উঠত না। এমনিই হয় সুদর্শন, কোন গ্যাংয়ের মধ্যে কোন নারী থাকলে শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই নারীই সমস্ত গ্যাংটার মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে। মিত্র মশাইয়েরও হল তাই।
আচ্ছা চোরাই মালের বেচা-কেনাটা কোথায় হত বলে আপনার মনে হয় দাদা?
তা অবিশ্যি সঠিক জানি না, তবে এটা ঠিক, একটা লভ্যাংশ নিয়ে মাল সব পাচার করত তোমার ঐ রাধেশ্যাম অর্থাৎ নরহরি সরকার। এবং মালের দাম হিসেবে টাকাকড়ি নয়, তাকে দিতে হত সোনার বার বা গিনি-গুনে গুনে। আর গিনিগুলো আসত ঐ মাধবীর হাত দিয়ে।
ক্রমশ এখন সব বুঝতে পারছি দাদা–
অথচ নরহরি জানত না, মাধবী কার হাতে গিনি বা সোনার বার পৌঁছে দেয়। সব কিছুর মূলে যে আছেন আমাদের মিত্র মশাই,-সভ্যভব্য শিক্ষিত সুরকার শান্ত মানুষটি, নরহরির সেটা কল্পনাতেও কখনও আসেনি।
কিন্তু–
কেন আসেনি, তাই না?
হ্যাঁ।
সে-কথা ভাববার তার সময় কোথায় ছিল! সে তো সর্বক্ষণ মাধবীকে পাওয়ার স্বপ্নেই মশগুল ছিল।
মাধবীরও তাহলে লুঠের মালের ভাগ ছিল?
নিঃসন্দেহে। আর তার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
কি প্রমাণ?
কিরীটী বলে, তোমাকে সেকথা বলা হয়নি, তার অফিসের ডেক্সে সেভিংস ডিপজিটের পাসবই পাওয়া গিয়েছে।
পাসবই।
হ্যাঁ, আর সেই পাসবইয়ের মধ্যে কত জমা আছে জান?
কত?
তাতে জমা আছে ত্রিশ হাজার টাকা!
সত্যি? বলেন কি দাদা? কথাটা বলে সুদর্শন তাকায় বিস্ময়ে কিরীটর দিকে।
খুব বিস্ময় লাগছে, তাই না? হাসতে হাসতে কিরীটী বলে, পাখি হয়ত একদিন অকস্মাৎ ডানা মেলে তোমার ওই দশ নম্বর পল্লীর ছোট ঘর থেকে উড়ে যেত, তখন তুমি হয়ত কেবল ভাবতে মাধবী কারও সঙ্গে ভেগেছে! কিন্তু তুমি কল্পনা করতে পারতে না, তার পশ্চাতে ফেলে যাওয়া তার সত্যকারের ইতিহাসটা!
তারপর ক্রমশ সমস্ত ব্যাপারটা হয়ত একদিন কেবলমাত্র একটি মেয়ের গৃহত্যাগের ব্যাপারেই পর্যবসিত হত। কিন্তু বিধি হল বাম। বেচারী জানতেও পারেনি ইতিমধ্যে কখন তার ভাগ্যাকাশে ঘন কালো মেঘ সঞ্চারিত হয়েছে।
যাক ভোর হয়ে এসেছে, আর এক প্রস্থ চায়ের যোগাড় কর, তারপর শুরু করা যাবে মিত্র মশাইকে জিজ্ঞাসাবাদ। দেখা যাক, ভদ্রমহোদয় মুখ তার খোলেন কিনা!
সত্যিই ইতিমধ্যে কখন রাত্রির অন্ধকার শেষ হয়ে ভোরের প্রথম আলো ফুটে উঠেছে একটু একটু করে চারধারে।
সুদর্শন উঠে গেল চায়ের ব্যবস্থা করতে।
.
৩৭.
চা-পানের পর আবার যখন সকলে একত্রিত হল, সকাল তখন ছটা প্রায়।
সকলে এসে পাশের ঘরে ঢুকল।
চারজন তখনও পাশাপাশি বেঞ্চের ওপরে বসে। কেবল তাদের মধ্যে একজন ছিল না ধৃত ব্যক্তিদের মধ্যে।
সুবোধ মিত্রের হাতে হাতকড়া লাগানো পুলিস-প্রহরায় তাকে ওদের চোখের আড়ালে থানার কয়েদঘরে রাখা হয়েছিল।
ওদের সকলকে ঘরে ঢুকতে দেখে নরহরি সরকারই প্রথমে বিরক্তিসূচক কণ্ঠে বলে ওঠে, রাধেশ্যাম! আমাদের এভাবে এনে থানায় আটক করে রাখার কারণটা কি মল্লিক সাহেব?
নরহরি সুদর্শনকে লক্ষ্য করেই কথাটা বলে।
এখনও বুঝতে পারেননি, সরকার মশাই! ব্যঙ্গভরা স্বরে সুদর্শন জবাব দেয়।
রাধেশ্যাম। আজ্ঞে না।
বোঝেননি?
না।
এখন বলুন তো সরকার মশাই, ওয়াগান ভেঙে যেসব মাল রেলওয়ে ইয়ার্ড থেকে চুরি যেত তার কি ব্যবস্থা আপনি করতেন?
রাধেশ্যাম! এসব কি বলছেন? ছি ছি, শোনাও পাপ। রাধেশ্যাম!
তাহলে তাই করবেন—সবাইকে তো চালান দিচ্ছি, গাওনা যা গাইবার আদালত কক্ষে জজ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে করবেন সকলে মিলে। জমবে ভাল, যাত্রার দল তো আপনার তৈরি আছেই। সুদর্শন আবার বলে।
রাধেশ্যাম! সম্রান্ত ভদ্র ব্যক্তিদের এইভাবে ধরে হেনস্তা করা–
অকস্মাৎ যেন সুদর্শন খিঁচিয়ে ওঠে নরহরির মুখের দিকে তাকিয়ে থামুন চোরচূড়ামণি! লজ্জা করছে না আপনার, এখনও মুখে রাধেশ্যাম বুলি কপচাচ্ছেন! আপনাকে গুলি করে মারা উচিত।
পিপীলিকা পাখা ধরে মরিবার আশাতেই। হঠাৎ খগেন পাঠক বলে ওঠে পাশ থেকে।
কিরীটীই এবারে কথা বলে, পাঠক মশাই, এখনও হয়ত জানেন না আপনি, আপনার সাঙ্গোপাঙ্গরাই শুধু নন—আপনাদের দলপতিও ধরা পড়েছেন!
কথাটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সুদর্শনের যেন মনে হল, নরহরি ও কল্যাণ বোস চমকে উঠল।
কি কল্যাণবাবু, একেবারে যে চুপচাপ! সুদর্শন আবার বলে, সেদিন চোখে আমার খুব ধুলো দিয়েছিলেন!
আজ্ঞে বিশ্বাস করুন স্যার, এসবের মধ্যে আমি আদৌ নেই, বিন্দুবিসর্গও এসবের আমি জানি না। কল্যাণ বলে ওঠে।