এবং দ্বিতীয়ত, পর পর যে হত্যাগুলো এ তল্লাটে সংঘটিত হয়েছে, সে হত্যাব্যাপারগুলো পৃথক কিছু নয়—ওই ওয়াগন ভাঙার ব্যাপারেরই খণ্ডাংশ বা ওরই সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কাজেই সর্বাগ্রে তখন যে কথাটা আমার মনে হয়, সেটা হচ্ছে ওই দশ নম্বর পল্লী থেকেই আমায় অনুসন্ধান শুরু করতে হবে। করলামও তাই। এবং ভাগ্যক্রমে আগেই বলেছি, হীরু সাহাকে সাহায্যকারী পেয়ে গিয়েছিলাম!
কিন্তু সুবোধ মিত্রকে সন্দেহ করলেন কেন?
প্রথমে তার ওপর আমার সন্দেহ হয়নি। সন্দেহটা প্রথম জাগে মাধবীর মৃত্যুর পর।
কেন?
কারণ হীরু সাহার মুখে যে কথাটা শুনেছিলাম, তাছাড়াও আরও দুটো সংবাদ তার কাছ থেকে পেয়েছিলাম!
কি সংবাদ?
প্রথমত, বাইরে দশ নম্বর পল্লীর সবাই যদিও জানত, সুবোধ মিত্রের সঙ্গে মাধবীর কোন যোগাযোগ ছিল না—সেটা সত্য নয়, আসলে মাধবীই ছিল সুবোধ মিত্রের দক্ষিণ বাহুঁ। এবং শুনলে তুমি আশ্চর্য হবে ভায়া—
কি?
আসলে সুবোধ মিত্রের রক্ষিতা ছিল মাধবী!
সে কি! অর্ধস্ফুট কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে সুদর্শন।
জানতাম কথাটা শুনে তুমি বিস্ময়ের প্রচণ্ড এক ধাক্কা খাবে। কিন্তু কথাটা নির্মম সত্য। বাইরে সে দেখাত বটে সুবোধ মিত্রকে ঘৃণা করে, এবং সুবাধ মিত্রও তার সঙ্গে যে কোন যোগাযোগ আছে হাবেভাবে আদৌ তা প্রকাশ করত না। কিন্তু হলে কি হবে, সকলের চোখে তারা ধুলো দিলেও একজনের চোখে তারা ধুলো দিতে পারেনি—সে সবই জানত-বলতে পার জানতে পেরেছিল—
কে?
বল তো কে?
কে?
তোমার সাবিত্রী। বলেন কি দাদা! সাবিত্রী জানত?
হ্যাঁ, ভায়া, জানত। ভুলে যাচ্ছ কেন, একঘরে তারা শুতো—দুই বোন। আর সুবোধ মিত্র ছিল তাদের ঠিক নেক্সট-ডোর নেবার। মাধবীর হত্যার রাত্রে তাই সাবিত্রী জেগে ছটফট করছিল তার দিদির প্রতীক্ষ্ণয়। কারণ সে তো জানতই যে মধ্যে মধ্যে তার দিদির বাড়ি ফিরতে রাত হয় এবং তার কারণ থিয়েটার বা রিহার্সাল নয়—সুবোধ মিত্র–
আশ্চর্য!
এখনও তোমার বয়স অল্প, অভিজ্ঞতাও তোমার সামান্যই ভায়া। তাই তুমি জান না নারীচরিত্র কি দুজ্ঞেয়, কি বিচিত্র!
সুদর্শন আবার তার কথাটার পুনরাবৃত্তি করে, আশ্চর্য! সাবিত্রী জানত অথচ–
অথচ তোমাকে সে বলেনি! আরে গর্দভ, এটা বুঝতে পারছ না কেন, কিরীটী সুদর্শনকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলে, প্রথম প্রেমের মুহূর্তে কোন মেয়ে কখনও তাদের সংসারের লজ্জার কথা মুখ ফুটে প্রেমাস্পদের কাছে বলে না-বলতে পারে না।
কিন্তু দাদা—
ভয় নেই ভায়া, সাবিত্রী খাটি হীরে। অপাত্রে তুমি হৃদয় দান করোনি। কিরীটী হাসতে হাসতে বলে।
সুদর্শনের মুখটা সহসা লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। সে আর কিরীটীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না।
কিরীটী বলে, মনে আছে তোমার, মাধবীহত্যার রাত্রে সাবিত্রী তার দিদির অপেক্ষায় জেগে থাকতে থাকতে নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিল।
হ্যাঁ।
আসলে তা নয়। তবে?
ইদানীং পতিতবাবুর স্ত্রী—ওদের মা, মাধবীর গতিবিধি সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন। তাই সাবিত্রী ঘুমোয়নি, জেগেই ছিল-এবং সম্ভবত সুবোধ ও মাধবীকে একত্রে দেখেছিল।
কিরীটী আবার বলতে শুরু করে, থাক যা বলছিলাম, সাবিত্রী ভয়েও খানিকটা মুখ খুলতে পারেনি। মিত্র মশাইটি তো আমাদের সহজ চীজ নন! একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে শুরু করে, মাধবীর সঙ্গে মিত্র মশাইয়ের যোগাযোগের ব্যাপারটা যেমন আমাকে চমকে দেয়, ঠিক তেমনি নরহরি সরকারের ওখানে মাধবীর যাতায়াতটাও দুইয়ে দুইয়ে চারের মত মিত্র মশাইয়ের প্রতি মনটা আমার আরও সন্দেহযুক্ত করে তোলে। আর ওই শেষোক্ত কারণেই মিত্র মশাইয়ের ওপর আমার সমস্ত সন্দেহটা গিয়ে পড়ে। তারপরই আমি মিত্র মশাইয়ের ওপর কড়া নজর রাখি।
৩৬-৪০. কিন্তু সুবোধ মিত্রই যে দোষী
৩৬.
কিন্তু সুবোধ মিত্রই যে দোষী, সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হলেন কখন? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
গুলজার সিংয়ের মৃত্যুর পর। কিরীটী রায় জবাব দেয়।
কেন? প্রশ্নটা করে সুদর্শন কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
তোমার হয়ত মনে আছে সুদর্শন, মৃত গুলজার সিংয়ের মুঠির মধ্যে এক টুকরো সাদা পশম পেয়েছিলে—পরে যেটা তুমি আমাকে দেখিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
সেই পশমটুকুই আমার দৃষ্টির সামনে সত্যকে উদ্ঘাটিত করে দিল।
কি রকম?
মিত্র মশাইকে তুমি যদি ভাল করে স্টাডি করতে বিশেষ তার বেশভূষা, তাহলেই নজরে পড়ত তোমার, সাদা রঙের ওপর তার একটা স্বাভাবিক প্রশ্রয় আছে। সাদা ভয়েল পাঞ্জাবি, সাদা শাল, উলের সোয়েটার। ব্যাপারটা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি।
ওই সাদা পশমটুকু গুলজার সিংয়ের হাতের বড় বড় নখে আটকে গিয়েছিল, হয়ত ধস্তাধস্তির সময় এই পশমটুকু মিত্র মশাইয়ের সে-রাত্রে যে গরম হাতে-বোনা সোয়েটারটা ছিল তা থেকেই ছিঁড়ে এসেছিল।
হয়ত গুলজার সিংয়ের সঙ্গে সে-রাত্রে মিত্র মশাইয়ের মারামারির মত কিছু একটা হয়েছিল প্রথমে, তারপরই হয়ত প্রথম সুযোগেই ক্লোজ রেঞ্জ থেকে মিত্র মশাই গুলজারকে গুলি করে হত্যা করে। অবিশ্যি তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি উন্ডের গায়ে কার্বনডিপজিট থেকে।
গুলজার সিংও তাহলে ওই দলের?
নিঃসন্দেহে। নচেৎ বোম্বাই ফিল্মে ফাইনান্স করবার মত অত টাকা সে কোথায় পেত?
গুলজার সিংকে মিত্র মশাই কেন মেরেছেন বলতে পারেন দাদা?