কিরীটী বললে, এখানে আর নয়—চল থানায় যাওয়া যাক।
সকলে অতঃপর হাতকড়া-পরা সুবোধ মিত্রকে নিয়ে থানার দিকে অগ্রসর হল।
বহু লোক থানার আশেপাশে এসে ভিড় করে উকিঝুঁকি দিতে থাকে।
কিরীটী আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল।
সেই ব্যবস্থা মতই খগেন পাঠক, কল্যাণ বোস, অবিনাশ ও নরহরি সরকারকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছিল।
একটা বেঞ্চে সবাই পাশাপাশি বসে সশস্ত্র পুলিস প্রহারায়। সুবোধ মিত্রকে থানায় কয়েদঘরে হাতকড়া পরিয়ে আমড় প্রহরায় রাখার ব্যবস্থা হল।
ঘণ্টাখানেক বাদে সুদর্শন হাসপাতাল থেকে ফিরে এল।
ব্যবস্থা করে এলে? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ দাদা। সাবিত্রীকে ও. টি.-তে নিয়ে গিয়েছে, খুব ব্লিডিং হচ্ছে।
ভয় নেই। মনে হয় মারাত্মক কিছু নয়। দেখ তো ভায়া, একটু চায়ের ব্যবস্থা করা যায় কিনা!
এখুনি ব্যবস্থা করছি।
সুদর্শন ভিতরে চলে গেল।
.
আরও আধ ঘণ্টা পরে থানায় সুদর্শনের অফিসঘরের মধ্যে।
রাত তখন সোয়া বারোটা হবে।
কিরীটী, সুব্রত, কল্যাণ মিত্র ও সুদর্শন বসেছিল থানায় সুদর্শনের অফিস ঘরে।
কিরীটী একটা চুবরাটে অগ্নিসংযোগ করে গোটা দুই টান দিয়ে বলে, এখন তো বুঝতে পারছ সুদর্শন, তোমারও ঠিক সেই কথামালার একচক্ষু হরিণের দশা হয়েছিল! সব দিকেই তুমি নজর দিয়েছিলে—দাওনি কেবল মিত্র মশাইয়ের দিকে!
আমি সত্যি বলছি, কল্পনাও করতে পারিনি দাদা যে ওই সুবোধ মিত্রের মত একজন ভদ্রলোক, মিষ্টভাষী, শিক্ষিত শিষ্টাচারী—
সুদর্শনকে বাধা দিয়ে কিরীটী বলে, প্রজাপতির রঙটা দেখেই তুমি ভুলেছিলে ভায়া, কিন্তু সেই মন-মাতানো রূপের পেছনে যে কাটাওলা শুয়োপোকার একটা ইতিহাস থাকে, সেটা একবারও মনে পড়ল না কেন তা তুমিই জান!
মাথা নিচু করে সুদর্শন।
কিরীটী বলে, অবশ্যি এও সত্যি, আমি আশা করিনি, মিত্র মশাই আমার পাতা ফাঁদে অত সহজে অমন করে এসে আজ পা বাড়াবেন! ভাবছিলাম পর পর দুটো খুন হয়ে গেল, এখন কিছুদিন হয়ত মিত্র মশাই একটু সাবধানে পা ফেলার চেষ্টা করবেন। কিন্তু লোভ বড় সাংঘাতিক বস্তু। বুকের মধ্যে লোভের আগুন একবার জ্বললে সহজে নিভতে চায় না। আর লোভের ধর্মই হচ্ছে, হাত সে বাড়িয়েই চলে।
কিন্তু দাদা-সুদর্শন যেন কি বলবার চেষ্টা করে।
কিরীটী তাকে বাধা দিয়ে বলে, অবিশ্যি শুধু লোভই নয়, পরম আত্মম্ভরিতাও সুবোধ মিত্রকে আজ রাত্রে চরম সর্বনাশের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।
আপনি কি দাদা, সুদর্শন আবার বলে, প্রথম থেকেই সুবোধ মিত্রকে সন্দেহ করেছিলেন?
হ্যাঁ, কতকটা বলতে পার। তবে অবিশ্যি আমার মনের সিক্সথ সেন্স কাজ করেছিল। একটু থেমে কিরীটী আবার বলে, তুমি জান না, তোমাকে বলিওনি-এ অঞ্চলের ওয়াগন থেকে মাল চুরি যাবার রহস্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারটা তোমাদের উপরওয়ালার একান্ত অনুরোধে হাতে নেওয়ার পরই এখানে এসে আমি ছদ্মবেশে দশ-বারো দিন ঘুরে ঘুরে বেড়াই।
আশ্চর্য! সুদর্শন বলে।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ, কেন জানাইনি—জানতে তোমাকে দিইনি কেন জান? কারণ তুমি জানা মানেই সুবোধ মিত্র ও তার দলবলেরও জানতে পারা!
কিন্তু–
বুঝতে পারছ না, কেন? আমার এ তল্লাটে আনাগোনা শুরু হয়েছে আর কেউ না জানুক সুবোধ মিত্র জানতে পারতই। তার ফলে যা হবার তাই হত–অর্থাৎ দশজোড়া চোখ সর্বক্ষণ তোমাকে পাহারা দিত এবং তার দলবল সতর্ক হয়ে যেত, যেটা আমি আদৌ চাইনি-আর তাতে করে অনুসন্ধানের ব্যাপারটাও চালানো এত সহজে যেত না। কিন্তু যা বলছিলাম, একা তো আমার পক্ষে সব সংবাদ সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। এবং এ তল্লাটে অনুসন্ধানের কাজ গোপনে চালাতে হলে এমন একজনকে চাই যে এ তল্লাটেরই একজন। অথচ বিশ্বাসী কে এমন আছে- কাকে পাই? খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম গোপনে গোপনে। এখানকার রেস্টুরেন্টের গোলাব সিং আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত, তাকেই ধরলাম ঐ ব্যাপারে। সেই-ই আলাপ করিয়ে দিল আমায় হীরু সাহার সঙ্গে। বললে, সাচ্চা আদমী, বিশ্বাসী। হীরু সাহাকেই দলে নিলাম।
আশ্চর্য! অথচ হীরুর প্রতি আমার
বরাবরই একটা সন্দেহ ছিল, তাই না ভায়া? না হে, গোলাব সিং মিথ্যা বলেনি–লোকটা শুধু সৎ-ই নয়, সরল। তবে হ্যাঁ, একটু রাগী গোয়ারগোবিন্দ টাইপের-অবশ্যি সেইখানেই হীরুর চরিত্র সম্পর্কে তোমার ভুল হয়েছিল।
তারপর?
তারপর থেকে হীরুই সব সংবাদ আমাকে সরবরাহ করত। এতে একটু সুবিধা হয়েছিল আমার–
কি?
হীরু দশ পল্লীরই একজন ও গুণ্ডাপ্রকৃতির বলে তার উপরে কারও সন্দেহ পড়েনি।
তারপর?
হীরু সাহাকে দলে পাওয়ায় আমার আরও একটা সুবিধা হয়েছিল।
কি?
হীরুকে পল্লীর কেউ চট করে ঘাঁটাবার সাহস পেত না। সে-ই আমাকে একটা বিশেষ সংবাদ দেয়।
বিশেষ সংবাদ!
হ্যাঁ, মাধবী-হত্যার রাত্রে সে মাধবী ও একজনকে মাঠের দিকে যেতে দেখেছিল গোটা বারোর সময়। মাধবীকে সে চিনতে পেরেছিল, কিন্তু অন্যজনকে পারেনি।
থামলেন কেন, বলুন দাদা! সুদর্শন বলে।
ইতিমধ্যে সব ব্যাপারটা আগাগোড়া পর্যালোচনা করে একটা কথা আমার মনে হয়েছিল–
কি? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
.
৩৫.
কিরীটী বলতে থাকে সুদর্শনের প্রশ্নের জবাবে।
প্রথমত, ইয়ার্ড থেকে ওয়াগন ভেঙে মাল সরানোর ব্যাপারে যারা জড়িত, তাদের সঙ্গে হয় ওই দশ নম্বর পল্লীর কারও-না-কারোর সঙ্গে যোগাযোগ নিশ্চয়ই আছে, নয়ত দশ নম্বর পল্লীরই লোক তারা।