সুদর্শন মল্লিক তাকিয়ে ছিল কল্যাণ বসুর দিকে।
কল্যাণ বসু হাসছিল।
.
সে যাই হোক, হীরু সাহা, খগেন পাঠক, কল্যাণ বসু, সুবোধ মিত্র ও মাধবী ব্যানার্জি দশ নম্বর পল্লীর বাসিন্দা হিসাবে তার মনের পাতায় বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল যেন। মাসচারেক তারপর নিরুপদ্রবেই কেটেছিল।
অবিশ্যি ইতিমধ্যে কানে যে আসেনি দু-চারটে ব্যাপার তা নয়। যেমন মদ চোলাই, চোরাই মাল পাচার, ওয়াগন ব্রেক। কিন্তু সুদর্শন মল্লিক কথাগুলো কানে এলেও যেন ব্যাপারগুলোতে তেমন কোন গুরুত্ব দেয়নি বাইরে থেকে, যদিও ভিতরে ভিতরে সে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছিল। সর্বক্ষণই সতর্ক সজাগ থাকত। এবং তারপরও দু-পাঁচ দিন দশ নম্বর পল্লীতে গিয়েছে, এর-ওর সঙ্গে আলাপ করে আবার চলে এসেছে।
তারপরই হঠাৎ এল দুঃসংবাদটা।
ফলে সুদর্শন মল্লিককে সরেজমিনে তদন্তে নামতেই হল।
নিষ্ঠুর এক হত্যাকাণ্ড।
.
০৩.
সময়টা শীতকাল।
পৌষ শেষ হয়ে মাঘের শুরু। শহরে বেশ শীত পড়েছে কদিন থেকে।
সকালবেলা থানার অফিসে বসে সুদর্শন মল্লিক দিন দুই আগে রাত্রে অল্পদূরে রেলওয়ে ইয়ার্ডে একটা লোডেড ওয়াগন থেকে দশ পেটি কাপড় ওয়াগন ভেঙে চুরি হয়েছে সেই সম্পর্কেই একটা রিপোর্ট খাড়া করছিল, এমন সময় দশ নম্বর পল্লীর হরগোবিন্দ ঘোষ নামে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে এসে থানায় ঢুকল।
দারোগাবাবু আছেন নাকি?
কে? ভিতরে আসুন।
হরগোবিন্দ এসে ঘরে ঢুকলো। হাঁপাচ্ছে সে তখন রীতিমত।
রোগা চেহারা। মাথার সামনের দিকটায় একগাছিও চুল নেই, চকচকে একটি টাক।
এই যে দারোগাবাবু, শিগগির চলুন!
কোথায়?
দশ নম্বর পল্লীর পিছনে যে মাঠটা আছে—সেখানে।
কেন, ব্যাপার কি?
খুন মশাই খুন!
খুন?
সুদর্শন ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
হ্যাঁ, খুন-নৃশংস খুন!
কে-কে খুন হল?
ওই পল্লীরই একটি যুবতী মেয়ে।
কি নাম বলুন তো?
ওই যে আমাদের পল্লীর অভিনেত্রী
অভিনেত্রী!
হ্যাঁ, যঁহ্যাঁ, পতিতপাবন ব্যানার্জি-ওই যে অন্ধ স্কুল-মাস্টার পতিতপাবন ব্যানার্জি–তারই বড় মেয়ে মাধবী!
সে কি?
সুদর্শন মল্লিক যেন দ্বিতীয়বার চমকে ওঠে কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে।
কখন খুন হল মাধবী ব্যানার্জি? জিজ্ঞাসা করে।
তা কি করে জানব মশাই বলুন! সকালবেলা উঠে একটু প্রাতঃভ্রমণ করা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আজও বের হয়েছিলাম। দশ নম্বর পল্লীর পিছনদিকে যে মাঠটা আছে—সেই মাঠেরই মধ্যে পড়ে আছে কি একটা দূর থেকে নজরে পড়ে আমার যাবার সময়ই, কিন্তু দৃষ্টি দিইনি তখন।
তারপর?
ভাল করে তখন আলোও ফোটেনি আকাশে। বেড়িয়ে ফেরার সময় তখন বেশ আলো ফুটেছে চারদিকে। কি খেয়াল হল এগিয়ে গেলাম, আর গিয়ে দেখি আমাদের পল্লীর মাধবী পড়ে আছে-হাত-পা ছড়িয়ে, চোখ দুটো ঠেলে বের হয়ে এসেছে, মুখটা হাঁ করা, মুখের ভেতরে জিভটা একটু বের হয়ে এসেছে–
পল্লীর সবাই শুনেছে?
আমিই সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে পল্লীতে খবরটা দিই। এতক্ষণে সেখানে হয়ত ভিড় হয়ে গিয়েছে। পরে মনে ভাবলাম, আমিই যখন ব্যাপারটা প্রথম দেখেছি, আমারই
পুলিসকে একটা খবর দেওয়া কর্তব্য, তাই চলে এসেছি।
খুব ভাল করেছেন। তা আপনিও বুঝি ওই পল্লীতেই থাকেন?
থাকি মানে! দশ বছর আছি!
কি নাম আপনার?
আজ্ঞে হরগোবিন্দ ঘোষ।
.
সুদর্শন মল্লিক আর দেরি করে না। চারজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে তখুনি হরগোবিন্দকেও সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে পড়ে।
সকাল খুব বেশি হলে তখন সাতটার বেশি নয়। শেষরাতের দিকে বিশ্রী ঘন কুয়াশা নেমেছিল, এখনও কুয়াশাটা ভাল করে পরিষ্কার হয়ে যায়নি। তবে দেখা যায় স্পষ্টই সব কিছু।
থানা থেকে দশ নম্বর পল্লীটা মিনিট কুড়ি হবে হাঁটাপথে। সেই পল্লীরই পিছনে
একটা খোলা মাঠের মত।
এদিক-ওদিক গোটা দুই খাটাল আর একটা পুরাতন গোরস্তান আছে। তার ওধারে প্রাচীর—প্রাচীরের অপর পার্শ্বেই রেলওয়ে ইয়ার্ড।
এই থানার চার্জ নেবার পর সুদর্শন ওই জায়গাটা, ওধারের রেলওয়ে ইয়ার্ডটা ঘুরে ঘুরে দেখে গিয়েছিল ইতিপূর্বে দিনতিনেক খুল ভাল করে, কারণ ওই ইয়ার্ড থেকেই ওয়াগন ভেঙে মাল সরাবার ব্যাপার প্রায়ই ঘটে থাকে।
এবং যেটা সুদর্শন মল্লিকের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, নিকটবর্তী দশ নম্বর পল্লীরই কারও-না-কারও সেটা কীর্তি আর তাই সে বন্ধুত্বের ভান করে পল্লীর মধ্যে গিয়ে সকলের সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছিল।
নানা জায়গা থেকে ওয়াগন ভর্তি হয়ে নানা ধরনের পণ্যদ্রব্য আসে কলকাতা শহরে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু সে-সব আর খালাস হয় না, কখনও পাঁচ-সাত-দশ দিন পর্যন্ত মাল ওয়াগনেই পড়ে থাকে।
মালগাড়িগুলো ইয়ার্ডের মধ্যে একধারে শান্টিং করা থাকে খালাসের অপেক্ষায়।
.
০৪.
সীমানা প্রাচীরের চার-পাঁচটা জায়গায় ভাঙা। বোঝা যায় দুষ্কৃতকারীরা ওই পথেই ইয়ার্ডে যাতায়াত করে ও ওয়াগন ভেঙে মাল সরায়।
তবে এও সুদর্শনের মনে হচ্ছে সুনিশ্চিত যে, ওয়াগন ভেঙে মাল পাচারের ব্যাপারে মালগাড়ির এঞ্জিন ড্রাইভার ও খালাসীদের হাতও আছে। তারাও ভাগীদার। তারাই সরবরাহ করে খবরটা। নচেৎ ওরা কেমন করেই বা জানতে পারে, কোন্ ওয়াগনে মাল আছে! একটা-আধটা মালগাড়ি তো নয়, অসংখ্য মালগাড়ি থাকে দাঁড়িয়ে ইয়ার্ডের এদিকওদিক ছড়িয়ে!