এত রাত্র হাতে আপনার তেল-কালি-ময়লা লাগল কি করে সুবোধবাবু?
ঐ মানে—ফিরে এসে একটা মেসিন সারাচ্ছিলাম।
মেসিন, কীসের মেসিন?
ঐ–-
কিরীটীর স্বর হঠাৎ গম্ভীর শোনাল এরপরে যখন সে বলল, তাড়াতাড়িতে হাত দুটোও সাফ করবার সময় পাননি মনে হচ্ছে!
না না, তা নয়—
তবে?
কিরীটীর দুটো শ্যেন চক্ষুর দৃষ্টি সুবোধ মিত্রের ওপরে স্থির নিবদ্ধ—মিত্র মশাই, একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন যে!
কি বলছেন?
আমি যে কি বলছি, শান্ত কঠিন গলায় কিরীটী বলে, আপনার না বোঝাবার কথা নয়। বুঝতে পারছেন না—হাতে ঝুল-কালি, কপালে ঘাম। বেহালার হাতটি আপনার সত্যিই মিষ্টি মিত্র মশাই, কিন্তু সুরসৃষ্টি করে নিজেকে আপনি আড়াল করতে পারেন। নি, কারণ সুরের মধ্যে তাল কেটে যাচ্ছিল মধ্যে মধ্যে!
কি বলছেন, তাল কেটে যাচ্ছিল?
হ্যাঁ, বুঝতে পারেননি। কিন্তু কেন বলুন তো? অবিশ্যি অশান্ত মনে, উদ্বেগে সুরসৃষ্টি হয় না, তালও কাটতে পারে!
আজ্ঞে—
তা হলেও আই মাস্ট প্রেজ ইয়োর নার্ভ সুবোধবাবু!
সুদর্শনবাবু, এসবের মানে কি—আমি জানতে পারি কি? রুক্ষ গলায় সুবোধ মিত্র প্রশ্ন করে, কেন এভাবে আপনারা মাঝরাতে আমার বাড়িতে ঢুকে–
জবাব দিল কিরীটী। তীক্ষ্ণ শাণিত কণ্ঠস্বরে বললে, শুনুন মিত্র মশাই, অকারণে উনি আসেননি এই মধ্যরাত্রে এখানে-আপনার নামে গুরুতর অভিযোগ আছে!!
অভিযোগ? হোয়াট ড়ু ইউ মীন? কীসের অভিযোগ?
গত তিন বছর ধরে এ তল্লাটে ওয়াগন ভেঙে যে সব মালপত্র চুরি যাচ্ছে ইয়ার্ড থেকে—সেই দলেরই রিং-লিডার হিসাবে আপনাকে উনি গ্রেপ্তার করতে এসেছেন।
কি পাগলের মত আবোল-তাবোল বকছেন মশাই? ওয়াগন ভেঙে মাল চুরি করেছি আমি?
সুবোধবাবু! কিরীটী আবার বলে, আপনি যদি জানতেন কার সামনে দাঁড়িয়ে আপনি প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করছেন গলা চড়িয়ে, তার সত্য পরিচয়টা?
থামুন মশাই, থামুন!
সুদর্শন ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল। ব্যাপারটা তখনও যেন তার স্বপ্নেরও অতীত।
কিরীটী বলতে থাকে, শুধু তাই নয় মিত্র মশাই, ওইটি ছাড়াও আর একটি গুরুতর অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে আছে, মাধবীকে হত্যা করেছেন আপনিই!
থামবেন মশাই? এটা আমার বাড়ি-পাগলা গারদ নয়।
কিন্তু সুবাধ মিত্রের কথাটা শেষ হল না, সহসা খোলা দরজার ওদিক থেকে এক নারী-কণ্ঠস্বর ভেসে এল, হা হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই ধরেছেন! ও-ই দিদিকে খুন করেছে।
কে? এ কি, সাবিত্রী।
বিস্মিত হতভম্ব সুদর্শনের কণ্ঠ থেকে একটা অস্ফুট শব্দের মত কথাগুলো স্বতোচ্চারিত হল যেন।
সাবিত্রী তখন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। উত্তেজনায় সে হাঁপাচ্ছে।
সাবিত্রী! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে সুবোধ মিত্র।
করুন—করুন সুদর্শনবাবু, ওকে গ্রেপ্তার করুন। সাবিত্রী বলে, ও-ই আমার দিদিকে হত্যা করেছে। একসঙ্গে দুজনে সে-রাত্রে দিদির শো ভাঙবার পর ফিরেছেন জানি, আমি সব জানি—শয়তান, খুনী! তোমার-তোমার ফাঁসি হোক, এই আমি চাই।
তবে রে হারামজাদী।
সহসা বাঘের মত সুবোধ মিত্র সাবিত্রীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে তার গলাটা দুহাতে। চেপে ধরে।-খুন করব তোকে আজ।
সুব্রত প্রথমটায় ঘটনার আকস্মিকতায় একটু হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সুবোধ মিত্রের পর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একটা জুজুৎসুর প্যাচ দিয়ে তাকে ফেলে দেয়।
সাবিত্রী পড়ে যায় ওই সঙ্গে।
কিন্তু সুবোধ মিত্র তখন যেন মরীয়া হয়ে উঠেছে এবং সুব্রত বুঝতে পারে সুবোধ মিত্র লোকটা গায়ে যথেষ্ট শক্তি ধরে। সুব্রত তাকে জাপটে ধরেছিল, কিন্তু সুবোধ মিত্র সুব্রতর কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয় এবং খোঁচা খাওয়া হিংস্র বাঘের মত উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গিয়ে ঘরের কোণে যে বড় ফ্লাওয়ার ভাসে একগোছা রজনীগন্ধা ছিল, সেটার মধ্যে চকিতে হাত ঢুকিয়ে ছোট একটা অটোমেটিক পিস্তল বের করে সাবিত্রীকে লক্ষ্য করে পর পর দুটো গুলি চালায়।
একটা গুলি মিস করে, কিন্তু অন্যটা সাবিত্রীর ডানহাতে বিদ্ধ হয়।
চিৎকার করে ওঠে সাবিত্রী।
ইতিমধ্যে সুদর্শনও তার পকেট থেকে পিস্তল বের করেছিল, কিন্তু মাঝখানে সাবিত্রী থাকায় সে গুলি চালাতে পারে না। সাবিত্রী টলে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুদর্শন সুবোধ মিত্রের হাত লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
সুবোধ মিত্রের হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে মাটিতে পড়ে যায়।
সেই অবসরে সুব্রত ঝাপিয়ে পড়ে সুবোধ মিত্রকে দুহাতে সবলে জাপটে ধরে।
.
৩৪.
এবারে আর সুবোধ মিত্র সুব্রতর কবল থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করেও সফল হয় না।
সুদর্শনও ইতিমধ্যে এগিয়ে আসে সুব্রতর সাহায্যে।
বাইরে দুজন প্রহরী পূর্ব হতেই কাছে মোতায়েন ছিল। কিরীটীর নির্দেশে তাকে ডেকে তাদের সাহায্যে সুবোধ মিত্রের হাতে হাতকরা পরিয়ে দিল সুব্রত।
সুবোধ মিত্র এতক্ষণে চুপচাপ হয়ে যায়।
সুদর্শন সাবিত্রীর ক্ষতস্থানটা পরীক্ষা করছিল।
কিরীটী বললে, তুমি ডাক্তার নও ভায়া, চটপট ওকে হাওড়া জেনারেল হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা কর।
আমার জীপটা নিয়ে আসি। সুদর্শন বলে।
তাই যাও।
আহত সাবিত্রীকে হাওড়া জেনারেল হাসপাতালে সুদর্শনের সঙ্গেই কিরীটী পাঠিয়ে দেয় পুলিশের জীপে।
রাত তখন প্রায় তিনটে বেজে গেছে। দশ নম্বর পল্লীতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। অনেকেরই ইতিমধ্যে গোলমালে ও গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সবাই ছুটে আসে সুবোধ মিত্রের বাড়ির আশেপাশে।