সুদর্শন অতঃপর যেন কতকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেই কিরীটীর নির্দেশমত সাবিত্রীদের গৃহের দিকে অগ্রসর হয়।
সুব্রত তখন মিটিমিটি হাসছিল।
ওরা বুঝতে পারেনি যে ব্যাপারটা তখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
.
৩২.
সাবিত্রীদের গৃহের কাছাকাছি পৌঁছতেই একটা বেহালার সুর ওদের কানে এল।
কে যেন বেহালায় দরবারী কানাড়া আলাপ করছে।
বাঃ ভারি মিষ্টি হাত! কিরীটী বলে, কে বেহালায় দরবারী কানাড়া বাজাচ্ছে হে সুদর্শন?
জানি না তো!
তোমার সাবিত্রী দেবী নয় তো?
জানি না।
বল কি! সে বেহালা বাজাতে পারে কিনা সে খবরটি এখনও অজ্ঞাত তোমার! তবে কি ছাই ভালবাস!
আঃ, দাদা—
যাই বল ভায়া, চমৎকার দরবারী কানাড়া আলাপ জমিয়েছে। কিরীটী আবার বললে।
হঠাৎ ওই সময় ওদের নজরে পড়ল সামনেরই একটা বাড়ির সামনের ঘরেরই ঈষৎ খোলা জানালা-পথে মৃদু আলোর আভাস আসছে এবং মনে হল বেহালার সুর সেই আলোকিত কক্ষ হতেই ভেসে আসছে।
কিরীটী দাঁড়াল, সুদর্শন।
দাদা?
ওইটিই তোমার মিত্র মশাই—অর্থাৎ আমাদের সুবোধ মিত্র মশাইয়ের বাড়ি না?
সুদর্শন মৃদু গলায় বলে, হ্যাঁ।
মিত্র মশাই-ই মনে হচ্ছে আমাদের এই মধ্যরাত্রের সুরকার!
হ্যাঁ। ওঁর ঘরে বেহালা দেখেছিলাম মনে পড়েছে, প্রথম দিন আলাপের সময়।
অমন ভাল সুরকার একজন, অথচ তুমি তাকে অবহেলাই করেছ! প্রথম দিন সামান্য আলাপের পর আর তার সঙ্গে আলাপ জমাবারই চেষ্টা করনি-কে-কে ওখানে?
আজ্ঞে স্যার আমি!
অন্ধকারে কিরীটীর প্রশ্নে দুটো বাড়ির মধ্যবর্তী স্থান থেকে কে একজন আত্মগোপনকারী বের হয়ে এল আলো-আঁধারি থেকে নিঃশব্দে।
সুদর্শন চমকে ওঠে আগন্তুককে চিনতে পেরে যেন।
মানুষটি আর কেউ নয়, ব্যায়ামপুষ্ট তাগড়াই চেহারার অন্নপূর্ণা জুট মিলের লেবারার হীরু সাহা–যাকে ঘিরে প্রথম দর্শন থেকেই সুদর্শন একটু বেশি মাত্রায় সন্দিগ্ধ হয়েছিল।
কিন্তু অতঃপর সব যেন কেমন ঘুলিয়ে যাচ্ছে সুদর্শনের। সুদর্শন যেন বোবা।
.
হীরু সাহা তখন কিরীটীকে বলছে চাপা গলায়, দেখলেন স্যার, আমি আপনাকে বলিনি!
হ্যাঁ, এখন দেখছি তুমি ঠিকই বলেছিলে হীরুবাবু। তা কোন্ পথে ফিরল?
এই পথেই নাকি? কিরীটী শুধায়।
বলতে পারি না স্যার। ফিরতে আমি দেখিনি।
ওই বাড়িতে পিছন দিয়ে ঢোকাবার আর কোন রাস্তা আছে?
তা একটা আছে স্যার।
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি এখানে একটু অপেক্ষা কর হীরুবাবু। চল হে সুদর্শন।
কোথায়? সাবিত্রীদের বাড়িতে এই রাত্রে হানা দেবেন নাকি এখন?
সেটা কি ভাল দেখাবে হে! তার চাইতে চল দেখি, মিত্র মশাইকে দিয়ে যদি সাবিত্রী দেবীকে তার ওখানেই ডেকে আনানো যায় একবার! এস।
সুদর্শন এগিয়ে গেল কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে যেন একটু অনিচ্ছার সঙ্গেই।
সুবোধ মিত্রের বাড়ির সামনে এসে ওরা তিনজনে দাঁড়াল।
সদর দরজা বন্ধ। কিরীটী এগিয়ে গিয়ে বন্ধ দরজার গায়ে ধাক্কা দিল। কিন্তু দু-দুবার ধাক্কা দেওয়া সত্ত্বেও দরজা খুলল না। বেহালার বাজনাও থামল না।
সুদর্শন এবারে কিরীটীর ইঙ্গিতে বেশ জেরেই দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকে, সুবোধবাবু-–ও মশাই সুবোধবাবু, দরজাটা খুলুন!
এবারে বাজনা থেমে গেল। একটু পরে দরজাও খুলে গেল।
আলোকিত কক্ষের খোলা-দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে সুবোধ মিত্র। পরনে একটা লুঙ্গি, গায়ে একটা শাল জড়ানো।
কে? আমি সুদর্শন মল্লিক, থানার ও. সি.-
আসুন, আসুন। কি ব্যাপার মল্লিক মশাই—এত রাত্রে?
একটু বিশেষ প্রয়োজন আছে। চলুন ভেতরে।
সুবোধ মিত্র দরজা ছেড়ে দাঁড়াল, সকলে ভেতরে প্রবেশ করল। প্রথমে সুদর্শন, তার পশ্চাতে কিরীটী ও সুব্রত।
সুদর্শনের সঙ্গে আরও দুজন অপরিচিত ব্যক্তিকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সুবোধ মিত্র হঠাৎ যেন কেমন একটু বিস্মিতই হয়েছে, তার মুখের চেহারা দেখে মনে হল।
সুদর্শনবাবু, এঁরা? সুবোধ মিত্র প্রশ্ন করে।
সুদর্শন বলে, এঁকে দেখেননি হয়ত, তবে নাম নিশ্চয়ই এঁর শুনেছেন সুবোধবাবু! কিরীটী রায়—আর উনি সুব্রত রায়!
নমস্কার। সুবোধ মিত্র হাত তুলে নমস্কার জানায়।
কিরীটীও প্রতিনমস্কার জানায়।
কিরীটী হঠাৎ প্রশ্ন করে সুবোধ মিত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে, বাইরে তো বেশ ঠাণ্ডা, আপনার কপালে দেখছি ঘাম! এত শীতেও ঘামছেন আপনি?
সুবোধ মিত্র তাড়াতাড়ি কম্পিত হাতে কপালের ঘামটা মুছে ফেলবার চেষ্টা করতে করতে বলে, ওই মানে-আমার বরাবরই একটু গরমটা বেশি!
তাই দেখছি। কিরীটী কথাটা বলে মৃদু হাসল।
.
৩৩.
কিরীটীর দুটি চোখের সন্ধানী দৃষ্টি কিন্তু কথার মধ্যেও ঘরের চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
আবার সুবোধ মিত্রের খালিপায়ের দিকে তাকিয়ে কিরীটী প্রশ্ন করে, আপনি বুঝি। বাড়িতে খালিপায়েই থাকেন সাধারণত। কোন চটি বা চপ্পল দেখছি না ঘরে?
চপ্পল-মানে, ওই বাইরের বারান্দাতে আছে।
সুব্রত আর সুদর্শন দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। কিরীটীই আবার প্রশ্ন করে, কিন্তু হাতে আপনার অত তেল-ময়লা লেগেছে কেন সুবোধবাবু?
কিরীটীর কথায় সকলেরই নজরে পড়ে, সুবোধ মিত্রের হাত দুটো—দুই হাতের পাতা ও আঙুলেই তেল-কালি ময়লা লেগে আছে।
সুবোধ মিত্র যেন হঠাৎ কেমন বোবা হয়ে গেছে।
ফ্যালফ্যাল করে প্রশ্নকারী কিরীটীর মুখের দিকে একবার তাকায়, তারপরই নিজের কালি-তেল-ময়লা-মাখা হাত দুটোর দিকে তাকায়।