তারপরই ওদের কানে এল সতর্ক একটা গলার স্বর, কটা হল রে?
দশটা। অন্য কে একজন জবাব দিল।
সবই মনে হচ্ছে কাপড়ের পেটি। প্রথম জনের গলার স্বর আবার শোনা গেল।
আরও একজনের—অর্থাৎ এবার তৃতীয় ব্যক্তির গলার স্বর শোনা গেল, আসল মালটা বোধ হয় এই কাপড়ের পেটির মধ্যেই আছে!
ঠিক গুনেছিস তো? এটাই ষোল নম্বর ওয়াগন তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। না গুনে ওয়াগন ভেঙেছি নাকি? দ্বিতীয় ব্যক্তি জবাব দেয়।
তৃতীয় ব্যক্তি বলে, এবারে শালা ওই বুড়ো শকুনিটা যদি মোটা মত লাভের অঙ্ক থেকে না দেয় তো আমারই একদিন কি ওরই একদিন।
অন্য একজন বলে, শালা একের নম্বরের কঞ্জুষ, স্বার্থপর। কেবল নিজের কোলের দিকেই ঝোল টানে।
ও শালার মরণের পাখনা গজিয়েছে। ওকেও দেখ না গুলজার সিংয়ের পথেই পা বাড়াতে হবে একদিন।…কটা মাল নামালি রে? দ্বিতীয়ের গলা।
দশটা পেটি। তৃতীয় বক্তা বলে।
দূরে ঐ সময় সুব্রতর নজরে পড়ে লাইটারের আলো-তিনবার জ্বলল, আবার নিভে গেল।
সুব্রত! চাপা গলায় ডাকে কিরীটী, চট করে যা—সুদর্শনকে এখানে ডেকে নিয়ে আয়।
সুব্রত শিকারী বিড়ালের মতই সতর্ক ও ক্ষিপ্র গতিতে যেন কিরীটীর নির্দেশমত সুদর্শনের দিকে চলে গেল।
সুব্রত চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় ব্যক্তির চাপা গলার স্বর কিরীটী আবার শুনতে পায়, ওহে, ভাল মনে হচ্ছে না।
তৃতীয় ব্যক্তি শুধোয়, কেন? কি হল আবার?
দ্বিতীয় ব্যক্তির গলার স্বর শোনা যায়, দূরে একটা কীসের আলো যেন তিনবার জ্বলে নিভে গেল!
প্রথম ব্যক্তির গলার স্বর আবার শোনা গেল, তখুনি বলেছিলাম, গুলজার সিংয়ের মরার পর এত তাড়াতাড়ি আবার এদিকে না আসতে। শুনলে না তো আমার কথা?
চতুর্থ ব্যক্তির গলার স্বর আবার শোনা গেল, থাম থাম, আর উপদেশ ছড়াসনি!
সে তুমি যাই বল—আমার কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ ভাল মনে হচ্ছে না। প্রথম ব্যক্তির গলার স্বর আবার শোনা গেল।
পঞ্চম ব্যক্তির গলার স্বর, আরে যানে দো ইয়ার—এই ঠাণ্ডিকো রাতমে কৌন তুমারা পিছে পড়েগী! চল, জলদি মাল উঠাও!
প্রথম ব্যক্তির গলার স্বর, আর দুটো বাকি আছে।
সুদর্শন ততক্ষণে ওইখানে পৌঁছে গেছে।
প্রথম ব্যক্তির গলার স্বর আবার শোনা যায়। কি ব্যাপার, ওরা যে গাড়িতে মাল তুলে দিতে গেল তো গেলই! ফেরার আর নাম নেই!
স্পষ্ট গলার স্বর।
মনে হয় যেন সুদর্শনও গলার স্বরটা শুনতে পেয়েছিল। পরিচিত গলার স্বরটা শুনে সে যেন হঠাৎ চমকে ওঠে।
হয়ত তার মুখ দিয়ে নামটা বের হয়েই আসত, কিন্তু তার আগেই কিরীটী ওর মুখে হাত চাপা দেয় এবং হিহি করে বলে, উঁহু, উত্তেজিত হয়ো না ভায়া।
এ সময় কিরীটীর নজরে পড়ল, বোধ হয় ওদের মধ্যে যে লোক দুটো মাল নিয়ে গিয়েছিল—তারা লাইন টপকে টপকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঐদিকেই ছুটে আসছে।
লোক দুটো ওয়াগনগুলোর ওদিকে চলে গেল। দ্রুত পায়ের শব্দ।
কি রে, কি ব্যাপার? প্রথম ব্যক্তি শুধোয়।
পুলিস!
পুলিস? কোথায়?
লরি ঘিরে ফেলেছে। ভোলা আর হোঁৎকা সটকেছে—
শালা কুত্তার বাচ্চা। প্রথম ব্যক্তি বলে।
দূর থেকে একটা মালগাড়ি আসছে মনে হয়—তারই শব্দ। শব্দ তুলে মালগাড়িটা ওদের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলে।
সুদর্শন, রেডি-চল ওদিকে! কিরীটী বললে এবারে।
কিন্তু দুটো ওয়াগনের মধ্যবর্তী ফাঁক দিয়ে অন্যাদিকে আসবার পর দেখা গেল কেউ সেখানে নেই। গোটা দুই পেটি কেবল পড়ে আছে। রেললাইনের ওপরে আর একটা ওয়াগনের দরজার লক ভাঙা, কপাট খোলা।
রেললাইন ধরে দুটো লোক ছুটছিল, হঠাৎ কানে এল পর পর কটা ফায়ারিংয়ের আওয়াজ। ফারারিংয়ের আওয়াজ ইয়ার্ডের মধ্যে ছড়িয়ে গেল।
কিরীটী হুইসেল বাজাল একটা।
দেখতে দেখতে কয়েকজন আর্মড পুলিস ঘটনাস্থলে খোলা ওয়াগনটার সামনে এসে পড়ে ছুটতে ছুটতে।
ইন্সপেক্টার কল্যাণ মিত্র বলেন, কি ব্যাপার? ওয়াগন ভেঙেছে দেখছি!
কিরীটী বললে, হ্যাঁ, মিস্টার মিত্র-ইউ আর লেট।
আমরা কাছেই ছিলাম—শেষ ওয়াগনটার ধারে!
দেখতে পেলেন না তবু? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না।
অন্তত ঘণ্টাখানেক হবে ওরা এসে ওয়াগন ভেঙেছে। কিরীটী বললে।
আমি ভেবেছিলাম, হয়ত রাত আরও বেশি হলে–
ঠিক আছে, এখানে দুজন আমর্ড পুলিশ পাহারা রেখে আপনারা থানায় যান, আমরা থানায় আসছি একটু পরে।
কিরীটী কথাগুলো কল্যাণ মিত্রকে বলে সুদর্শনের দিকে তাকাল, চল সুদর্শন, তোমার দশ নম্বর পল্লীতে যাওয়া যাক।
কিন্তু সেখানে কি আর এখন তাকে পাওয়া যাবে দাদা?
চলই না হে, একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতিটা কি!
ইয়ার্ড থেকে মাঠের ভেতর দিয়ে দশ নম্বর পল্লীতে পৌঁছতে মিনিট কুড়ি লাগে হেঁটে।
পল্লীর মধ্যে পৌঁছে সুদর্শন নিজের মনেই এগোচ্ছিল, কিন্তু কিরীটী তাকে হঠাৎ বাধা দিল, ওদিকে কোথায় চলেচ ভায়া?
ওকে অ্যারেস্ট করবেন না?
আরে ব্যস্ত কি—আগে অন্য একটা জায়গা একটিবার ঘুরে আসি চল!
কোথায় যাবেন?
তোমার সাবিত্রী দেবীর কুঞ্জে—
কোথায়?
বললাম তো। তোমার সাবিত্রী দেবীর কুঞ্জের কাছে। চল।
সুদর্শন যেন ব্যাপারটা সম্যক উপলব্ধি করতে পারেনি, তাই কতকটা যেন হতভম্ব হয়েই দাঁড়িয়ে থাকে অনড় অবস্থায়।
কি হল, দাঁড়িয়ে রইলে কেন—চল!
কিন্তু দাদা, সাবিত্রী
আহা, চলই না হে! তোমার সেই একচক্ষু হরিণের মত নিবুদ্ধিতা না করে ফিরে হয় একবার তাকালেই অন্য দিকে! চল চল, hurry up!