কিরীটী বলতে বলতে একবার হাতের চুরুটের ছাইটা গাড়ির মধ্যস্থিত অ্যাসট্রেতে ঝেড়ে ফেলে তার অর্ধসমাপ্ত কথার মধ্যে ফিরে যায়।
বলে, অবিশ্যি গুলজার সিংয়ের প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যাবার আক্রোশ ও সেই সঙ্গে তার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসও তাকে মৃত্যু-ফঁদের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল সে-রাত্রে। এবং যার ফলে দুটো ব্যাপার হল।
দুটো ব্যাপার? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। প্রথমত, গুলজার সিং দিল প্রাণ, আর দ্বিতীয়ত, হত্যাকারী আবার ভুল করল আর একটা-এবং সেটাই হল তার সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ভুল।
আবার কি ভুল করল?
কতকটা যেন ছেলেমানুষের মতই সুদর্শন প্রশ্ন করে। সে যেন গল্প শুনছে আর কিরীটী যেন গল্প বলে চলেছে।
প্ৰথম ভুল করেছিল সে মাধবীকে হত্যা করে, দ্বিতীয় ভুল করল সে গুলজার সিংকে হত্যা করে।
কেন, ভুল করল কেন?
ভুল করল এই কারণে যে গুলজার সিং যে মাধবীর অন্যতম প্রেমিক বা প্রণয়প্রার্থী, এবং যে ব্যাপারটা কারও জানবার কথা নয়, সেটাই প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্ধ আক্রোশে হত্যাকারী আমার চোখে স্পষ্ট করে দিল—and I also got my clue! অর্থাৎ গুলজার সিং নিহত না হলে আমরা বোধ হয় এত তাড়াতাড়ি রহস্যের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারতাম না। আরও বেশ কিছুদিন অন্ধকারেই হাতড়ে বেড়াতে হত। কিন্তু আর নয়, আমরা বোধ হয় এসে গেলাম। মিশির?
জী সাব!
আউর থোড়া যাকে ডাইনা তরফ গাড়ি রোখো, সুদর্শন সাব উতার যায়গা। সুদর্শন, তোমাকে যা বলেছি মনে থাকে যেন। রাত এগারোটার আগে বেরোবে না, তাড়াহুড়ো করবে না।
সুদর্শন মৃদুকণ্ঠে বলে, না দাদা, যেমন বলেছেন তাই করব।
.
৩০.
সুদর্শনকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি আরও কিছুটা এগোতেই কিরীটী মিশিরকে বলল, এইখানেই গাড়ি রাখ মিশির।
মিশির গাড়ি থামায়।
কিরীটী ও সুব্রত গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। মিশির ওদের নামিয়ে দিয়ে তার প্রতি কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত থানার দিকেই গাড়ি চালায়। গাড়িটা ক্রমে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
কিরীটী হাতঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দশটা বাজতে আর মিনিট তিনেক আছে।
রাস্তায় মানুষের, বাস, মোটর, সাইকেল ও সাইকেল-রিকশার চলাচল তখনও বেশ আছে—যদিও শীতের রাত। তবে অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেকটা কম। ভিড় অনেকটা পাতলা হয়ে এসেছে। ক্রমশ পাতলা হচ্ছে আরও। তা প্রায় দোকানপাঠ বন্ধ, বললেই চলে।
কিছুটা এগিয়ে এসে বাজারের পরে যে রাস্তাটা পূর্বদিকে চলে গেছে, কিরীটী ও সুব্রত সেই রাস্তা ধরেই চলতে থাকে।
আগে একদিন কিরীটী ওই রাস্তাটা ধরে হেঁটে যতটা সম্ভব দেখে গিয়েছিল, কাজেই রাস্তাটা তার অপরিচিত নয়। সে স্বচ্ছন্দ গতিতেই এগিয়ে চলছিল।
প্রায় আধমাইলটাক হাঁটার পর বাঁয়ে মোড় নিল কিরীটী। একটা পুকুরের ধার দিয়ে সরু পায়ে-চলা আর একটা রাস্তা, এবারে সেই রাস্তাটাই ধরল কিরীটী। সুব্রত নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে।
এদিকটায় তেমন আলোর ব্যবস্থা না থাকায় বেশ অন্ধকার। কিরীটী পকেট থেকে টর্চটা বের করে সাবধানে সেই টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে অগ্রসর হয়।
সাবধানে আয় সুব্রত-বেকায়দায় এদিকে-ওদিকে পা পড়লে কিন্তু এই শীতের রাতে সোজা হয় পানাপুকুরের জলে, না হয় কাঁচা নর্দমার পঙ্করাশির মধ্যে প্রপাত হবি। কারণ একদিকে পানাপুকুর,অন্যদিকে কাচা ড্রেন। কিরীটী চাপা গলায় বলল।
ড্রেনের দুর্গন্ধ ও কচুরিপানার একটা আঁশটে গন্ধে সুব্রত আগেই বুঝতে পেরেছিল, আশেপাশে কোথাও কাচা ড্রেন আছে। সেটা যে একেবারে পাশেই জানতে পেরে সুব্রত আরও সাবধানে হাঁটতে লাগল আবছা অন্ধকারে।
পুকুরটা শেষ হল একসময়। তারপর কিছু বস্তি-বাড়ি। রাস্তা সেখানেও রীতিমত সঙ্কীর্ণ। আলোর কোন ব্যবস্থাই নেই। প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটবার পর একটা ভাঙা প্রাচীরের ভেতর দিয়ে ওরা পড়ল এসে রেলওয়ে ইয়ার্ডে।
অন্ধকার এখন আর অত মনে হয় না, কারণ ইয়ার্ডের আলোয় খুব স্পষ্ট না হলেও এরা দেখতে পাচ্ছে এখন চারদিক আবছা-আবছা।
এদিকে-ওদিকে সিগন্যালের লাল ও সবুজ আলো আকাশের অন্ধকারে পড়ে।
অসংখ্য ইস্পাতের লাইন এঁকেবেঁকে সাপের মত চলে গেছে।
ইঞ্জিনের শব্দ। একটা বোধ হয় মেল ট্রেন চলে গেল পশ্চিমগামী।
এখানে-ওখানে সারা ইয়ার্ডে ছড়িয়ে আবছা আলো-অন্ধকারে মালগাড়ি ও প্যাসেঞ্জার বগিগুলো দাঁড়িয়ে।
৩১-৩৫. সন্তর্পণে কিরীটী এগিয়ে চলে
৩১.
সন্তর্পণে কিরীটী এগিয়ে চলে।
ওরা স্টেশনের দিকেই এগিয়ে চলে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা মালগাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।
আর ঠিক সেই সময়ই হঠাৎ ওদের কানে এল একটা যান্ত্রিক শব্দ। লোহা জাতীয় কোন কিছুর মেটালিক শব্দ বলে যেন সেটা মনে হল।
কিরীটী হাতের টর্চটা আগেই নিভিয়ে দিয়েছিল। অন্ধকারে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে কিরীটী তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টিতে। কোথা থেকে ঐ শব্দটা আসছে জানবার বুঝবার চেষ্টা করে। শব্দটা এক-একবার হচ্ছিল। আবার একটুক্ষণের জন্যে থামছিল।
ক্রমশ বুঝতে পারে কিরীটী শব্দটা মালগাড়ির অন্য দিক থেকে আসছে।
শব্দটা অনুসরণ করে এবারে এগোয় কিরীটী। কয়েক পা সন্তর্পণে এগোতেই ঝাপসা ঝাপসা অন্ধকারে কিরীটীর নজরে পড়ে, দুজন লোক কি একটা ভারী মত বস্তু অন্ধকারে মাথায় করে বয়ে রেল-লাইন দিয়ে প্রাচীরের দিকে এগিয়ে চলেছে সতর্ক ভাবে।