কিরীটী ওই সময় পাশের ঘর থেকে সাড়া দেয়, না হে, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হয়—আমাদের দেশের একটা প্রবাদ আছে, জান না? তাছাড়া রক্তলোভী ব্যাঘ্র চতুর, চট করে ফাদে পা বাড়ায় না!
.
২৯.
কথাগুলা বলতে বলত কিরীটী এসে ঘরে প্রবেশ করল।
দেখা গেল কিরীটী খুব দ্রুত তার বেশ পরিবর্তন করেছে ইতিমধ্যেই। মুখে চাপদাড়ি, মাথায় পাগড়ি, পরিধানে কালো গরম সুট। হঠাৎ কোন পাঞ্জাবী বলে ভুল হয়।
এ কি দাদা, এই বেশে যাবেন নাকি? সুদর্শন শুধায়।
যস্মিন দেশে যদাচার ভায়া! বলতে বলতে হাতঘড়ির দিকে তাকাল কিরীটী, দশটা বাজতে বাজতে আমরা আমাদের গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যেতে পারব বোধ হয়—এখন নটা বাজতে দশ মিনিট বাকি!
কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকল। হাতে তার একটা প্যাকেট আর ফ্লাক্স ঝোলানো।
ওগুলো সুব্রতকে দাও কৃষ্ণা।
সুব্রত হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে পকেটে ভরে নিল আর ফ্লাস্কটা ঝুলিয়ে নিল কাধে।
সুব্রত, তোর গাড়ি এনেছিস তো?
হ্যাঁ।
চল, তাহলে আর দেরি নয়—বের হয়ে পড়া যাক। চল সুদর্শন।
সুদর্শন উঠে দাঁড়াল।
গাড়িতে যেতে যেতে কিরীটী বলে, মৌকা একটা হঠাৎ এসে গেল সুদর্শন। দুপুরেই ট্র্যাফিক সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছ থেকে ফোন পেয়ে ভাবলাম, এক ঢিলে যদি দুই পাখি মারা যায় তো মন্দ কি! ভাল কথা সুদর্শন
বসুন, দাদা?
তোমার সঙ্গে অস্ত্র আছে তো?
অস্ত্র!
হ্যাঁ, তোমার আগ্নেয়াস্ত্রটি?
না, আনিনি তো সঙ্গে।
তাহলে এক কাজ কর—
বলুন?
তোমাকে বড় রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিচ্ছি। তুমি থানায় গিয়ে অস্ত্রটি লোড করে নিয়ে ঠিক রাত এগারোটা নাগাদ বের হয়ে পড়বে।
তারপর?
সোজা চলে যাবে রেলওয়ে ইয়ার্ডে।
কিন্তু আপনারা?
আমরা তোমাকে খুঁজে নেব।
কেমন করে? যা অন্ধকার রাত আজ—
সঙ্গে তোমার সিগারটে-লাইটারটা থাকবে তো?
সব সময়ই তো পকেটে থাকে।
সেটা পর পর তিনবার জ্বেলো। তাহলেও তোমাকে আমরা স্পট করতে পারব।
বেশ, তাই হবে।
সুব্রত আর কিরীটী পাশাপাশি সীটে বসেছিল, সুদর্শন সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে বসেছিল।
মিশির!
ড্রাইভার কিরীটীর ডাকে সাড়া দেয়, জী সাব!
তুমি আমাদের নামিয়ে দিয়ে সোজা থানায় চলে যাবে।
থানায়?
হ্যাঁ। যেখানে আমরা নামব তারই বাঁ দিক দিয়ে যে পুবমুখো রাস্তাটা চলে গেছে, সেটা ধরে সোজা গেলেই থানায় পৌঁছে যাবে। থানা সেখান থেকে খুব বেশি দূর নয়।
বহুৎ আচ্ছা সাব।
হঠাৎ ওই সময় সুব্রত প্রশ্ন করে, গুলজার সিংয়ের ব্যাপারটা কিছু জানতে পারলি কিরীটী?
হ্যাঁ, তোর ধারণাটাই ঠিক। ফ্রি স্কুল স্ত্রীটে ওর একটা ইলেকট্রিক্যাল গুডস, রেডিও, রেডিওগ্রাম, ফ্রিজ প্রভৃতির ঝকঝকে সাজানো-গোছানো দোকান আছে-ইস্টার্ন ইলেকট্রিক কোম্পানি। আর খুব সম্ভবত ঐ দোকানটি ও ব্যবসাই ছিল গুলজার সিংয়ের কামোফ্লাজ।
দোকানে কর্মচারী নেই?
আছে জনা-পাঁচেক। দুটি অল্পবয়সী ছোকরা পাঞ্জাবী, দুটি বাঙালী আর একটি অ্যাংলো মেয়ে-বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। সেই অ্যাংলো মেয়েটিকে আমি আগে থাকতেই চিনতাম, মিসেস শেয়েল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। একসময় ফ্রিজার কর্পোরেশনে ও সেলস-গার্ল ছিল। আমাকে দেখেই চিনতে পারল। ইশারায় তাকে বাইরে ডেকে সোজা গিয়ে উঠলাম একটা রেস্তোরাঁয়। তার কাছে সিংয়ের অনেক কিছু জানতে পারলাম।
কি রকম?
বম্বের ফিল্ম মার্কেটে ও একজন ফিনানসিয়ার। হুঁণ্ডিতে টাকা ধার দেয়। বুঝলাম সেটা দশ-পাঁচ হাজার টাকার ব্যাপার নিশ্চয়ই নয়—হিন্দিফ্লিম মানেই লাখ নিয়ে কারবার! কাজেই বুঝতে কষ্ট হল না ইস্টার্ন ইলেকট্রিক কোম্পানি থেকে ওই টাকা আসে না–আসতে পারে না। ওই টাকা অন্য খাতে আসে তার পকেটে।
তাহলে তো দেখতে পাচ্ছি, লোকটাকে হত্যা করবার কারণ ছিল! সুব্রত বললে।
তা ছিল বৈকি। বিনা কারণে কেউ কি কাউকে হত্যা করে? কিরীটী বললে।
সুদর্শন ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারে, ও যখন থানার মধ্যে বসে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিল, তখন কিরীটী অনেকটা এগিয়ে গেছে।
কিরীটী ওই সময় বলে, তবে এটাও ঠিক সুব্রত, গুলজার সিং নিহত না হলে হয়ত এত তাড়াতাড়ি ঐ গোলকধাঁধার সহজ রাস্তাটা আমি খুঁজে পেতাম না।
কিরীটী পকেট থেকে চুরুট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বলে আবার, কিন্তু এখনও একটা ব্যাপার আমার কাছে অস্পষ্ট রয়ে গেছে, গুলজার সিংয়ের মত ধূর্ত লোক অমন করে ফাদে পা দিয়েছিল কি করে? সে যে মাধবীর ব্যাপারটা, জানতে পারেনি তাও তো মনে হয় না!
সুদর্শনই ওই সময় প্রশ্ন করে, মাধবী? মাধবীর সঙ্গে গুলজার সিংয়ের কোন সম্পর্ক ছিল নাকি?
নিঃসন্দেহে। কিন্তু কতখানি ঘনিষ্ঠতা ছিল জানি না।
কি করে বুঝলেন?
পুলিশ গুলজারের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তার ফ্ল্যাট সার্চ করতে গিয়ে তার শোবার ঘরে ড্রয়ারের মধ্যে মাধবীর একটা ফটো পেয়েছে।
সে কি! সুদর্শন বলে ওঠে।
শুনে খুব শকড় হলে সুদর্শন, তাই না? জান না চলতি প্রবাদটা। নারী চরিত্র দেবতারই অগম্য-তা মানুষ কি কথা!
আমার কেমন যেন সব ঘুলিয়ে যাচ্ছে দাদা! সুদর্শন বলে।
যাবে ভায়া—আরও যাবে। যখন মাধবীর হত্যাকারীকে তুমি চিনতে পারবে।
মাধবীর হত্যাকারী কি ওই গুলজার সিংই নাকি?
না। মৃদু হেসে কিরীটী বলে।
তবে?
তবে যদি অনুমানটা আমার মিথ্যা না হয় তো গুলজার সিং পূর্বাহ্রেই মাধবীর মৃত্যুর ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছিল। অর্থাৎ সে জানতে পেরেছিল মাধবীর হত্যাকারী কে আর সেই কারণেই সে হত্যাকারীর সঙ্গে একটা মোকাবিলা করবার জন্য সে-রাত্রে ওইখানে এসেছিল এবং কথাটা সম্পূর্ণ না জেনেই সে হত্যাকারী যে আসতে পারে অনুমান করে তার জন্য পূর্বাহ্নেই ফাঁদ পেতে রেখেছিল।