আরে ভায়া, এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি নারী-হৃদয়ের রহস্য উদঘাটনে অগ্রসর হয়েছ।
আঃ দাদা, প্লীজ!
শোন সুদর্শন, আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো—যে প্রেম মানুষকে ক্ষেত্রবিশেষে নিঃস্ব বৈরাগী করে তোলে, সেই প্রেমই আবার ক্ষেত্রবিশেষে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যে কি নিষ্ঠুর, নৃশংস, প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে, মাধবীর মৃত্যুই তার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। তবে এও আমি বলব, সেটা হয়ত ঠিক প্রেম নয়—বলতে পার মানুষের আদিম রিপুর দহন অথবা একটা অত্যন্ত রূঢ় যৌন আকর্ষণ।
যৌন আকর্ষণ।
কিরীটী সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে আবার বললে, হ্যাঁ। যা তোমার মাধবী দেবীর সারাটা দেহ জুড়ে ছিল এবং পুরুষ মাত্রেরই বুকে যা মারাত্মক লোভের আগুন জ্বালিয়ে তুলত সর্বদা!
আপনি তাহলে বলতে চাইছেন–
সুদর্শনকে বাধা দিয়ে কিরীটী বলে, সেই মারাত্মক যৌন আকর্ষণের অতৃপ্তিরই শেষ পরিণতি এবং যা স্বাভাবিক ওই সব ক্ষেত্রে অর্থাৎ সেই রিভেঞ্জ নিতে গিয়েই মাধবীর হত্যাকারী নিজেই আমার চোখে কেবল যে এক্সপোজডই হয়ে গিয়েছে তাই নয়, সেই সঙ্গে ইতিপূর্বে যেসব হত্যা-ব্যাপার সংঘটিত হয়েছে, সেই রহস্যর অন্ধকারেও নিজের অজ্ঞাতে আলোকসম্পাত করেছে–যা তোমাকে একটু আগেই আমি বলছিলাম!
.
২৮.
কিরীটীর শেষের কথায় সুদর্শন যেন উত্তেজনায় ভেঙে পড়ে। বলে, সত্যি-সত্যিই আপনি জানতে পেরেছেন দাদা, মাধবীর হত্যাকারী কে?
কেবল মাধবীরই বা কেন? গুলজার সিংয়েরও! কিরীটী বলে।
জানতে পেরেছেন?
এটা তো স্বীকার করবে ভায়া, ঐ সবগুলো হত্যার সঙ্গেই ঐ তল্লাটের ওয়াগন ভেঙে মালচুরির ব্যাপারটার একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে আর তাতেই আমার মনে। হয়—
তাহলে কি দাদা আপনি–
কিরীটী মৃদু হেসে বাধা দিয়ে বলে, সঠিক একবারে জানতে না পারলেও অনুমান করতে কিছুটা পেরেছি বৈকি। এবং এও বুঝতে পেরেছি একই ব্যাক্তি উভয়ের হত্যাকারী–হ্যাঁ, অন্তত সেটা বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি।
কে-কে সে দাদা?
মনে হয় দু-একদিনের মধ্যেই তুমিও জানতে পারবে।
তাহলে আপনি কি বলতে চান, গত তিন বছর ধরে যেসব হত্যা ওই অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে, সব একজনেরই কীর্তি?
তা হয়ত হতেও পারে, নাও হতে পারে।
তবে?
তবে এটা ঠিক, হত্যাকারীও ওই ওয়াগন থেকে মাল চুরির ব্যাপারে কোন-না-কোন। ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল।
অর্থাৎ তাদেরই একজন ছিল?
নিঃশন্দেহে।
তবে কি মাধবীও–
জোর গলায় কিছু বলা যায় না সুদর্শন। কারণ একটা ব্যাপার তুমি সহজ ভাবে বিচার করে দেখলে বুঝতে পারবে, মাধবী ওই অঞ্চলেই বসবাস করত এবং থিয়েটারের ব্যাপারে তাকে প্রায়ই অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরত হত। সেক্ষেত্রে তার পক্ষে আকস্মিক ভাবে কিছু দেখে ফেলা বা জানতে পারাটা এমন কিছু আশ্চর্যের ব্যাপার যেমন ছিল না, তেমনি পরে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক তাদের দলে গিয়ে ভিড়ে পড়াটাও কিছু অস্বাভাবিক ছিল না।
আচ্ছা আপনার কি ধারণা দাদা, ওই ওয়াগন ভেঙে মাল সরাবার ব্যাপারটা এই অঞ্চলেরই কোন এক বিশেষ ব্যক্তির কীর্তি?
ঐ অঞ্চলেরই অবিশ্যি—তবে—
তবে?
ব্রেন নিঃসন্দেহে একজনের। বাকি সব ছিল হয়ত তার হাতে দড়ি-বাঁধা পুতুলনাচের পুতুল মাত্র। কিন্তু আর ভয় নেই ভায়া—আজ এই পর্যন্ত, কাল বাদে পরশু তুমি এস –আশা করছি তোমার দশ নম্বর পল্লীর রহস্যের যবনিকা উত্তোলন করত পারব।, তুমি বরং তোমার বৌদির সঙ্গে গল্প কর।
কিরীটী বের হয়ে যাবার পরও অনেকক্ষণ সুদর্শন বসে কৃষ্ণার সঙ্গে গল্প করল।
.
পরের দিনই সন্ধ্যার দিকে সুদর্শন কিরীটীর একটা জরুরী কল পেয়ে তার গড়িয়াহাটার বাড়িতে এসে হাজির হল।
কি ব্যাপার দাদা, হঠাৎ জরুরী তলব?
হ্যাঁ, চল।
কোথায়?
তোমারই তল্লাটে। তোমার সঙ্গে আজ রাত্রে একবার ঘুরে দেখব।
বেশ তো, চলুন। কিন্তু হঠাৎ সেখানে?
কিরীটী বলে, একটা ফাঁদ পাতা হয়েছে। বাঘ হয়ত সে ফাঁদে পড়লেও পড়তে পারে, যদি অবিশ্যি লাক আমাদের ফেভার করে!
কৃষ্ণা বলে, এখনি বেরুবে নাকি?
হ্যাঁ।
ফিরবে কখন?
সে কি এখন-এখনই বলা যায়।
তাহলে তো তার কোন ঠিক নেই?
তা নেই।
তবে কিছু খেয়ে যাও।
না। পেটে কিছু পড়লেই ঘুম পাবে। তুমি বরং এক কাজ কর কৃষ্ণা!
কি?
কিছু স্যান্ডউইচ তৈরি করে দাও, আর ফ্লাস্কে কফি তিনজনের মত।
কৃষ্ণা উঠে গেল।
সুদর্শন, তুমি বরং কিছু খেয়ে নাও না?
না দাদা, আমার ক্ষিধে নেই।
আহা, এখন না থাকলেও একটু পরে পেতেও তো পারে!
না , ক্ষিধে পাবে না।
বাইরে ওই সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।
কিরীটী মুহূর্তকাল কান পেতে সিঁড়িতে জুতোর শব্দটা শুনে বলে, সুব্রত এসে গেল বোধ হচ্ছে!
সত্যিই সুব্রত এসে পরক্ষণে ঘরে ঢুকল।
সুব্রতর পরিধানে গরম লংস ও গায়ে বাদামী একটা গলাবন্ধ গ্রেট কোট।
পায়ে ভারী রবার সোলের জুতো।
সুব্রতর দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, দ্যাটস গুড! তুই বস্ সুব্রত, আমি চট করে জামা-কাপড়টা পালটে আসি। কথাগুলো বলে কিরীটী উঠে পাশের ঘরে চলে গেল।
সুব্রত বসতে বসতে বলে, তারপর সুদর্শনবাবু, কতক্ষণ?
এই কিছুক্ষণ। আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন মনে হচ্ছে!
হ্যাঁ। কারণ ব্যাপারটার মধ্যে যথেষ্ট রিস্ক আছে। দলে আমরা যতটা ভারী থাকি, ততই শেফ।
তাই যদি হয় তো দাদা আমাকে আগে বললেই তো পারতেন, থানা থেকে কিছু পুলিশ-ফোর্সের ব্যবস্থা করা যেত।