ব্যস্ত কি! আমারও চায়ের পিপাসা পেয়েছে। বসুন, আসছি আমি।
কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
২৭.
কিরীটীর নতুন বাড়িতে আগে আর আসেনি সুদর্শন।
মেজোনিন ফ্লোরের ঘরটা নেহাত ছোট নয়, আকারে বেশ বড়ই হবে। একধারে সোপা সেট ও একধারে সোফা-কাম-বেড একটি।
এক কোণে পাশাপাশি দুটো আলমারি। একটাতে ঠাসা বই, অন্যটায় নানা ধরনের সব কিউরিও।
ছোট আলমারিটার মাথায় একটা মাটির বুদ্ধের ধ্যানস্থ মুখ। কৃষ্ণনগরের তৈরি। আলমারির মাথায় একটা দামী জার্মান ক্যাজেল ঘড়ি। সোফার একপাশে ফোন। বিদেশী ফোন-সাদা রঙের।
মাঝখানে ডিম্বাকৃতি সেন্টার টেবিল–ওপরে কাচ বসানো। টেবিলের ওপরে ফ্লাওয়ার ভাসে এক গাছা টাটকা রজনীগন্ধা। ঘরের মধ্যে ধূপ ও ফুলের মিশ্র একটা গন্ধ বাতাসে।
ফোনের পাশে কিছু স্পন, সোভিয়েত ল্যান্ড, নবকল্লোল ইত্যাদি মাসিক ও পাক্ষিক পত্র। একটা নবকল্লোল টেনে নিয়ে সুদর্শন পাতা ওলটাতে থাকে। মিনিট পনেরো বাদেই কৃষ্ণা ভৃত্যের হাতে চায়ের ট্রে ও প্লেটে কিছু মিষ্টি নিয়ে কাচের দরজা ঠেলে এসে ঘরে প্রবেশ করল।
ও কি বৌদি, প্লেটে এত কি খাবার এনেছেন? ও কথা তো ছিল না! বলেছিলেন তো কেবল চায়ের কথা!
আপনার দাদার হুকুম।
তার মানে?
হ্যাঁ। আমাকে বলে গিয়েছে, আজ যেন আপনাকে মিষ্টিমুখ করানো হয়।
হঠাৎ দাদার অমন নির্দেশ দেবার হেতু?
তা তো জানি না। বলে গিয়েছে মিষ্টিমুখ করাতে আপনাকে, তাই নিয়ে এলাম।
কথাগুলো বলে মৃদু হাসে কৃষ্ণা।
ঠিক আছে, তাহলে আগে দাদা আসুন, শুনি আগে কেন তিনি আমাকে মিষ্টিমুখ করাতে চান—তারপর না হয় দেখা যাবে। বলতে বলতে একটা চায়ের কাপ হাতে তুলে নিল সুদর্শন।
কৃষ্ণাও একটা কাপ তুলে নিয়েছিল। সে তখনও মৃদু মৃদু হাসছে।
হঠাৎই যেন একটা সম্ভাবনার কথা চকিতে সুদর্শনের মনের পাতায় উঁকি দিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখটা লাল হয়ে ওঠে।
কৃষ্ণা তখনও হাসছে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি।
সুদর্শন মুখটা নামিয়ে নেয়। নিজেকে সুদর্শন কেমন যেন বিব্রত বোধ করে—কেমন একটা অস্বস্তি।
কৃষ্ণার চোখের দিকে কয়েকটা মুহূর্ত যেন তাকাতে পারে না সুদর্শন।
তারপর আপনার খবর কি বলুন? কৃষ্ণা স্মিতকণ্ঠে শুধায় একসময়।
ওই একরকম চলে যাচ্ছ।
ওই একরকম কেন? ও যে বলছিল—
কি বলছিলেন দাদা?
নতুন যেখানে পোস্টিং হয়েছেন, আপনার থানা এলাকাটা বেশ ভালই!
ভাল না ছাই! চোরাকারবারির আচ্ছা একটা। তিন বছরে সাত-সাতটা খুন!
আহা, সে-সব তো সব থানাতেই থাকে। নচেৎ আপনাদের প্রয়োজনটাই বা কি? তাছাড়া ওই সঙ্গে কোন আনন্দের উৎসও তো থাকতে পারে।
কৃষ্ণার কথা এবার আর অস্পষ্ট নয়—এবং কৃষ্ণার আলোচনার গতিটা যে কোন্ দিকে চলেছে সুদর্শনের বুঝতে কষ্ট হয় না।
তবু সুদর্শন বলে, থানা-অফিসারদের জীবনে, বিশেষ কর আজকালকার দিনে, কোন আনন্দই আর নেই বৌদি। হাজারটা ঝামেলা—প্রবলেম
আরে ভাই, প্রবলেম না হলে জীবন কি?
সুদর্শন হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরে দরজার দিকে ফিরে তাকায়।
ইতিমধ্যে কখন যে কিরীটী ঘরের কাচের দরজা ঠেলে জাপানী রবারের চপ্পল পায়ে নিঃশব্দে ভেতরে পা দিয়েছে, ও জানতেও পারেনি।
কিরীটী একটা সোফার ওপর বসতে বসতে বললে, তারপর সুদর্শনবাবু, তোমার সেই তিনির খবর বল?
সুদর্শনের মুখটা সহসা আবার লাল হয়ে ওঠে।
কিগো সুদর্শনবাবু?
কি যে যা-তা বলেন দাদা!
আহা যা-তা নয় হে, যা-তা নয়। আমি জিজ্ঞাসা করছি, সবচাইতে বেশি ইম্পর্টেন্ট নিউজ যেটা—অর্থাৎ তোমার সাবিত্রী দেবীর খবর কি?
দাদা, আপনি যদি ওই রকম করেন তো আমি উঠে যাব বলছি!
আরে বস বস। তুমি জান না কিন্তু তাকে আমি না দেখে তোমার মুখ থেকে শুনেই বুঝতে পেরেছি সাবিত্রী মেয়েটি সত্যিই ভাল। অপাত্রে তুমি মন দাওনি।
সবটাই আগাগোড়া আপনারা একটা কল্পনা। ক্ষীণকণ্ঠে যেন প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করে সুদর্শন আবার।
কল্পনা কেন হবে, চাক্ষুষ পরিচয় হয়েছে।
মানে? সাবিত্রীকে আপনি দেখলেনই বা কখন—পরিচয়ই বা হল কি করে তার সঙ্গে আপনার?
হয়েছে হে ভায়া হয়েছে। তারপই কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, জান কৃষ্ণা, সত্যিই সাবিত্রী মেয়েটি বড় ভাল। অবিশ্যি তারও লাক আছে বলব, নচেৎ সুদর্শনের নজরে সে পড়ে?
দাদা, থামবেন আপনি!
থামতে আমি রাজি আছি ভায়া, কিন্তু সেটা তো আর কিছু তোমার মনের সত্যিকারের কথা নয়।
আপনি কি ওই সব আজেবাজে কথা বলবার জন্যেই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন দাদা?
আজেবাজ কি হে! এর চাইতে প্রয়োজনীয় কথা—
সম্পূর্ণ আজেবাজে।
না হে না। সাবিত্রীর বোন মাধবী নিহত না হলে সাবিত্রী যেমন এত তাড়াতাড়ি তোমার অত কাছে আসত না, তেমনি মাধবী নিহত না হলেও বোধ করি এত তাড়াতাড়ি তোমার দশ নম্বর পল্লীর হত্যারহস্যগুলির মূল সূত্রটিও আমি খুঁজে পেতাম না।
কিরীটীর কথায় যেন হঠাৎ চমকে ওঠে সুদর্শন।
কি বলছেন দাদা!
ঠিকই বলছি ভায়া। হত্যাকারী মাধবীকে হত্যা করেই কেবল যে তার জীবনের সর্বাপেক্ষা বড় ব্লান্ডার করেছে তাই নয়, সেই সঙ্গে ইতিপূর্বে ওই অঞ্চলে যে সব হত্যাব্যাপার সংঘটিত হয়েছে, সেই রহস্যের অন্ধকারেও আলোকসম্পাত করেছে নিজের
অজ্ঞাতেই।
কিছু বুঝতে পারছি না দাদা! মাধবীকে হত্যা করে হত্যাকারী ভুল করছে কেন বলছেন?