সাবিত্রী ডাকে, এখানে এসে বসুন না।
সুদর্শন এগিয়ে গিয়ে সাবিত্রীর পাশেই বসে পড়ে।
কোথায় যাচ্ছ? সুদর্শন প্রশ্ন করে।
দিদির এক বন্ধু অরুণাদি মীর্জাপুর স্ট্রীটে থাকে, তার কাছে যাচ্ছি। অরুণাদি একটা স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। দেখি তাকে বলে, একটা চাকরি যদি করে দিতে পারে তার স্কুলে।
কেন, সত্যিই কি তুমি পরীক্ষা দেবে না?
ফিস যোগাড় হলে দেব। কিন্তু সে কথা তো পরে ভাবলেও চলবে। আপনি তো সবই জানেন। আপাতত সংসারটা তো চালাতে হবে?
কেন, অবিনাশবাবু আর অমলেন্দুবাবু কি সত্যিই কোন সাহায্য করবেন না?
দাদা তো গতকালই চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে মিলের কোয়ার্টারে—
চলে গেছেন?
হ্যাঁ।
আর অমলেন্দুবাবু?
ছোড়দা অবিশ্যি বাড়ি ছেড়ে যায়নি, তবে—
কি, তবে?
তাকেও তো আর একটা সংসার টানতে হয়।
তার মানে?
প্রশ্নটা করে সুদর্শন সাবিত্রীর মুখের দিকে তাকাল।
সাবিত্রীও মনে হয় যেন হঠাৎ ঐ কথাটা বলে থমকে গিয়েছে, কেমন যেন একটু বিব্রত।
সুদর্শন আবার প্রশ্ন করল, আর একটা সংসার টানতে হয়—কি বলেছিলে সাবিত্রী! কথাটা তো ঠিক বুঝলাম না!
২৬-৩০. আমাদের পাড়ার হরগোবিন্দ
২৬.
আমাদের পাড়ার হরগোবিন্দকে চেনেন?
কে? যার ওই লেদ মেশিনের কারখানা আছে?
হ্যাঁ। তার মেয়ে সবিতা। তার সঙ্গে ছোড়দার খুব ভাব। বিয়ে করবে তাকে। মাতাল, হরগোবিন্দ সংসারে বিশেষ কিছুই দেয় না। ছোড়দাই তো সবিতাদের সংসারটা বলতে .. গেলে চালায়।
তাই নাকি? তা কই, অবিনাশবাবু-তোমার দাদা তো সেকথা বললেন না?
দাদা বা দিদি কেউই ব্যাপারটা জানত না। একমাত্র আমিই জানি।
তা এক কাজ করলেই তো পারেন অমলেন্দুবাবু, মেয়েটিকে বিয়ে করে নিয়ে এলেই তো হয়। দুটো সংসার আর টানতে হয় না।
বিয়ে ছোড়দা করবে না।
কেন?
ছোড়দাও ভীষণ মদ খায়।
জানি।
কিন্তু সবিতা সেকথা জানে না।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তাছাড়া সবিতা মাতালকে ভয়ানক ঘৃণা করে। মদ তো ছোড়দা ছাড়তে পারবে —অথচ বিয়ে করে সবিতাকে বাড়ি নিয়ে এলে হয়ত সব একদিন-না-একদিন জানাজানি হয়ে যাবে, তাই হয়তো–
বিচিত্র ব্যাপার দেখছি!
আরও একটা ব্যাপার আছে।
কি?
সবিতাকে ছোড়দা অনেকবার বলেছে, সে নাকি মদ স্পর্শও করে না!
জনবহুল রাস্তা ধরে বাস ছুটে চলেছিল। শীতের আলো ইতিমধ্যেই ম্লান হয়ে এসেছিল। রাস্তার আলো জ্বলতে শুরু করেছিল একটি দুটি করে।
সুদর্শন একসময় ডাকে, সাবিত্রী!
সাবিত্রী সুদর্শনের দিকে তাকাল।
বলছিলাম, আমি যদি তোমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিই?
দেবেন? সত্যিই? সাবিত্রীর চোখের মণি দুটে-প্রত্যাশার আনন্দে যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
দেব। তবে আগে পরীক্ষাটা দিতে হবে তোমায়—তারপর।
কিন্তু–
সাবিত্রী কি বলবার চেষ্টা করে, কিন্তু একপ্রকার স্মিতহাস্যে থামিয়ে দিয়েই মুখের দিকে তাকিয়ে সুদর্শন বলে, কোন কিন্তু না, পরীক্ষা তোমাকে দিতেই হবে। তোমার পরীক্ষার ফিস আমিই দেব। তুমি অমত করতে পারবে না।
সাবিত্রী যেন কেমন মনে হল থমমত খেয়ে গিয়েছে সুদর্শনের কথায়।
একটু মৃদু কণ্ঠে বলে, আপনি দেবেন!
তাই যদি দিই?
না না, তা হয় না।
কেন হয় না সাবিত্রী?
না, আপনার টাকা আমি নিতে পারি না।
বেশ তো, মনে কর না, এমনি নিচ্ছ না—তুমি টাকাটা ধার নিচ্ছ আমার কাছ থেকে। তারপর চাকরি হলে শোধ করে দিয়ো না হয়।
না। কথাটা বলে সাবিত্রী মুখটা ঘুরিয়ে নিল রাস্তার দিকে।
সাবিত্রী, আমি ওই কথাটা বলায় কি তুমি রাগ করলে?
সাবিত্রী কোন জবাব দেয় না, বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিন্তু তুমি বিশ্বাস কর সাবিত্রী, আমি তোমাকে কোনরকম অপমান করতে চাইনি। বন্ধু হিসাবে
আমরা গরিব বলেই তো, সাবিত্রী ওর মুখের দিকে তাকাল। তার দু-চোখে জল, গলার স্বরটা যেন বুজে আসে কান্নায়।
ছি ছি সাবিত্রী, একবারও ওকথা আমার মনে হয়নি। তুমি এত করে পড়াশুনা করলে, পরীক্ষার জন্য বছর দুই ধরে নিজেকে তৈরি করলে, অথচ কয়েকটা টাকার অভাবে পরীক্ষাটা তোমার দেওয়া হবে না—তাই বলেছিলাম কথাটা।
ইতিমধ্যে বাস কলেজ স্ট্রীট হ্যারিসন রোডের জংশনে পৌঁছে গিয়েছিল।
সাবিত্রী উঠে দাঁড়াল।আমি এখানে নামব।
সাবিত্রী নেমে গেল।
বাস আবার গন্তব্যপথে ছুটে চলে।
.
সুদর্শন যখন কিরীটীর গড়িয়াহাটের বাড়িতে পৌঁছল, তখন প্রায় সাড়ে ছটা বাজে। শীতের সন্ধ্যা, অন্ধকার হয়ে গিয়েছে বেশ-শহরের সর্বত্র আলো জ্বলে উঠেছে।
গড়িয়াহাটার নম্বরগুলো কেমন যেন এলোমেলো ভাবে এদিক-এদিক ছড়ানো। নম্বরটা খুঁজে পেতে বেশ একটু সময়ই লাগে সুদর্শনের।
দরজার বেল টিপতেই জংলী এসে দরজা খুলে দিল।
বাবু আছেন?
জংলী বললে, বাবু একটু বের হয়েছেন, এলে আপনাকে বসতে বলে গিয়েছেন। সিঁড়ির ঘরে যান।
দোতলার ও একতলার মাঝামাঝি মেজোনিন ফ্লোর। ঘরে আলো জ্বলছিল।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই কৃষ্ণাকে দেখতে পেল সুদর্শন। কৃষ্ণা ঘরের মেঝেতে কার্পেটের ওপর বসে সেতার বাজাচ্ছিল। সুদর্শন কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই বাজনা থামিয়ে সেতারটা নামিয়ে রাখল কৃষ্ণা।
আসুন সুদর্শনবাবু!
আপনি বাজনা থামালেন কেন বৌদি?
কৃষ্ণা মৃদু হাসে। আপনার দাদা একটু বেরিয়েছে, আপনাকে বসতে বলে গেছে। বসুন, চা করে আনি।
আপনি ব্যস্ত হবেন না বৌদি, বসুন।